আমার স্ত্রী প্রায়ই মিথ্যা কথা বলে।বিয়ের পর থেকে বেশ কয়েকবার সামনাসামনি প্রমাণ ও পেয়েছি। খুব সুন্দর করে গুছিয়ে মিথ্যা বলে। ওর মিথ্যাগুলো সত্যির মত শোনায়! কেউ শুনলে কোনদিন ভাবতেও পারবে না এটা মিথ্যা কথা। একটা মেয়ে যে মিথ্যা কথা দিয়ে তার স্বামীকে মুগ্ধ করতে পারে তা মেলিশার মিথ্যেগুলো না শুনলে বিশ্বাস হবে না।
একদিন আমার মেজো মামার বাসায় দাওয়াত। অনেক লোকজন এসেছে। আমি আর মেলিশা ও গিয়েছি! আমার মামাতো ভাই শাফকাতের বিয়ের পর সবাইকে দাওয়াত দিয়েছেন মেজোমামা। শাফকাত যেহেতু আমার ছোট তাই ওর বউ আমাকে এসে সালাম করে বসলে সালামী দিতেই হবে। কিন্তু আমি যা টাকা নিয়ে বের হয়েছি সেটা এখানে আসার সময় ফল আর মিষ্টি কিনেই শেষ। পকেটে আছে মাত্র ৪৫৫ টাকা। একদম মাথায় ছিল না। তাহলে বেশি করে টাকা রাখতাম। দুপুরে খাওয়া-দাওয়া পর্ব শেষে মেজোমামার বাসার ড্রয়িং রুমে সবার আড্ডা। বিকেল গড়াতেই চায়ের কাপের টুং টাং বাজতে লাগলো ড্রয়িং রুমে।
এমন সময় শাফকাতের বউ নিলি এসে শুরু করলো পায়ে ধরে সালাম।শাফকাত বললো- নিলি, সব ভাইয়া-ভাবীরা,বোন জামাইরা আজকে আসছে! সবার পা ধরে বসে থাকো! দেখবা আমাদের হানিমুনের খরচ উঠে গেছে! হা হা হা। বড় ভাইয়াকে সালাম করার সাথে ভাইয়া নিলিকে ১০০০ টাকা দিল!এক ঘর লোকের হৈ হুল্লোড় আমার কেমন অস্বস্তি লাগা ধরিয়ে দিল! কেমন একটা মান-সম্মানের ব্যাপার! নিলি আমাকে সালাম করতে আসলে আমি কেবল মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করে দিলাম। নিলি কিছু বললো না। আমার মনটাই খারাপ হয়ে গেলো। কেমন লজ্জা লাগছিল। রাত ৯ টায় সবাই যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমি মেলিশাকে ডাকতে ভেতরের ঘরে গেলাম। দরজা দিয়ে রুমে ঢোকার আগে দূর থেকে দেখি মেলিশা নিলির হাতে টাকা গুঁজে দিচ্ছে আর হাসতে হাসতে বলছে- “ তোমার ভাইয়া তো টাকা আমার কাছে দিয়ে রাখছে! ভাবছে আমি ভাবী মানুষ!আমার কাছে এসেই সালামী চাইবা তোমরা। আর ওর তো হারানোর স্বভাব। তাই মানিব্যাগ আমার কাছে দিয়ে রাখছিল।
আমি তো তখন মামিমার সাথে গল্প করছিলাম।নাহলে গিয়ে হাতে মানিব্যাগটা দিয়ে আসতাম। এখন যাও। দুইজন মিলে সব সালামীর টাকা দিয়ে হানিমুনের টিকিট বুক করে ফেলো” আমি এই কথা শুনে আর ভেতরে গেলাম না। মেলিশার বানানো মিথ্যে কথায় আমি মুগ্ধ হয়ে ফিরে আসলাম। একটা মেয়ে তার স্বামীর সম্মান বাঁচানোর জন্য তারই আত্মীয়-স্বজনের কাছে তাকে কতটা বড় করে রাখলো। আমি আবার মেলিশাকে ভালোবেসে ফেললাম। নতুন করে। গতবছর যশোর থেকে আম্মা ঢাকায় আমার বাসায় আসে চেকাপ করাতে। এসে আমাদের বাসায়ই ওঠেন সবসময়। বড় ভাইয়ার বাসায় আম্মা থাকতে পছন্দ করেন না। আম্মা একদিন বলেছিলেন- “বাবা আমার জন্য এক কেজি ভালো দেখে আপেল নিয়ে আসিস তো” আমি সেই কথা বেমালুম ভুলে গেলাম। অফিসে এম্নিতেই ঝামেলা চলছিল তখন।আমি খুবই ডিস্টার্বড ছিলাম। বাসায় এসে নিজের ঘরে ল্যাপটপে টুকটাক অফিসের কাজ সাড়ছিলাম আর তখনি পাশের রুম থেকে স্পষ্ট শুনতে পেলাম, আম্মা মেলিশাকে বলছে,
– “শিশির আপেল আনছে না বউমা? দাও তো একটা কেটে।“
মেলিশা কট করে জবাব দিল! “আম্মা আপনার ছেলে তো আমাকে বলছিল আপেল আনায় রাখতে! ওর আজকে কাজের প্রেসার যাবে।কিন্তু আমার মনে ছিল না আম্মা। কাল আমি অবশ্যই আনায় রাখবো।“ মেলিশা নিজের কাঁধে দোষ নিয়ে আমাকে আরো একবার আমারই পরিবারের কাছে বড় করে রাখলো।আম্মা নিশ্চয়ই মেলিশাকে ভুল বুঝলো। তার ছেলেকে ভালো ভাবলো। তাও ও আমার কথা বললো না যে আমিই আসলে ভুলে গেছি। একটা মন্ত্রমুগ্ধের মত মিথ্যা কথা সত্যির মত সাজালো।ওর কথা শুনলে কেউ বুঝবেই না ও মিথ্যা বলে বা একটু আগেই বলেছে। একটা মেয়ে মিথ্যা বলে তার স্বামীকে এভাবে মুগ্ধ করতে পারে তা মেলিশার মিথ্যে কথার ঝুলি না জানলে জানা যাবে না। আমি মেলিশার প্রেমে পড়ি। তার যথেষ্ঠ বুদ্ধিমত্তা আর আমার সম্মানের প্রতি তার যে খেয়াল তা দেখে মেলিশার প্রতি আমার শ্রদ্ধা, সম্মানের জায়গা আরো ভারী করি।
ও আজ পর্যন্ত যত জায়গায় আমার সব ভুলের জন্য আমাকে ছোট হওয়া থেকে বাঁচিয়েছে তার কোনটাই ও পরে
এসে আমাকে বলে না।ও নিজের স্বামীকে সবার কাছে বড় করে রাখলেও নিজে কখনো তার জন্য অহমিকা করে না।এমন ভাব করে যেন ও কিছুই করেনি। ও কিছুই জানে না। ও যা করে তার কোনটা আমি জানি কোনটা জানি না। কিন্তু, আমি বুঝে যাই, নিশ্চয়ই ও কোনভাবে আমাকে ওর মত করে আড়াল করে গেছে। সম্পর্কে একজন আরেকজনের প্রতি সম্মানটাই আসল। যেটায় আমার স্ত্রী কোন কমতি রাখেনি। আমিও রাখিনি। আমি রোজ তাকে নতুন করে আবিষ্কার করি। তার মিথ্যাগুলোর প্রেমে পড়ি।
গল্পের বিষয়:
গল্প