আপু, আমার মনে হয় ওই বাসার ভাইয়াটা সময় সময় জানালায় উঁকি দিয়ে তোকে দেখে।” পড়ার টেবিলে পড়তে বসেছে মৌ । হঠাৎ তার ছোট ভাই তার কাছে কাছে এসে কথাটা বলল। কথাটা শুনে মৌ অবাক হয় কিন্তু বেশি না। কারণ সেও কয়েকবার লক্ষ্য করেছে পাশের বাড়ির ছেলেটা তাকে উঁকি ঝুঁকি করে দেখে। কিন্তু ছোট ভাইয়ের সামনে সেসব বলে না।
” আরে নয়ন তোর দেখায় ভূল হয়েছে হয়ত।”
” না আপু আমি কয়েকবার দেখেছি তোকে উঁকি দিয়ে দেখতে। “
” আরে বাবা ঠিকাছে মানলাম। কিন্তু ওরা তো হিন্দু তাই না। আর ওরাও জানে আমরা মুসলিম । তাহলে ভেবে দেখ ওই ভাইয়াটা কি এই ভূল করবে? “
” তাও আপু.. “
” এই বেশি পাকনা হয়েছিস না । যা এখান থেকে পাকনি কোথাকার।” বড় বোনের ঝারি খেয়ে বোনের রুম থেকে বেরিয়ে যায় নয়ন । তবে নয়নের চলে যাওয়ার পর মৌ ভেতর ভেতর দুর্শ্চিন্তায় পড়ে যায়। জানালা দিয়ে ভালো করে তাকাতেই দেখে পাশের বাসার ছেলেটা ওপাশ থেকে চেয়ে বসে আছে। দ্রুত জানালার পর্দা দিয়ে ঘরের লাইট জ্বালিয়ে দেয় মৌ।
মৌ একটি ছোট পরিবারের সদস্য। বাবা মা আর ছোট ভাইকে সাথে নিয়ে দীর্ঘদিন ফরিদপুরে বসবাস করছে। এখানেই সারদা সুন্দরী সরকারি মহিলা কলেজে ইন্টার দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছে। মৌ এর বাবা রেজাউল করিম, সোনালি ব্যাংকের কর্মকর্তা, মা, আয়েশা জাহান, গৃহিণী। ছোট ভাই নয়ন সবে ফোরে পড়ে । তার মেধা যথেষ্ট প্রশংসার দাবিদার, কারণ এরার ফরিদপুর জেলা স্কুলের ভর্তি পরিক্ষায় নয়ন ৫ ম হয়েছে। মৌ’ও কম যায় না। অষ্টম শ্রেণিতে গোল্ডেন মিস করে সে অতিরিক্ত সিরিয়াস হয়ে যায় ফলে এসএসসিতে এসে তার রেজাল্ট এত ভালো হয় যে, পুরো জেলার মধ্যে ১০ অবস্থানে চলে আসে সব বিষয়ে এ+ সহ। মৌ আবার পড়ায় মন দেয়। সামনে জীবনের সবচেয়ে বড় ধাপ ।এইচএসসি। কোনো বাজে চিন্তা মাথায় আসতে দেয়া যাবে না।
” কিরে দিক সকালে জানালায় পর্দা দিয়ে লাইট জ্বালিয়েছিস কেন? ” কিছুটা রাগান্বিত ভাব নিয়ে ঘরে প্রবেশ করেন আয়েশা জাহান।
” আ আম্মু, তাতে কি হয়েছে? বাইরের আলোতে আমার চোখ ব্যাথা করছিলো তাই।”
” এত সারাদিন চোখ বইতে গেরে রাখলে চোখ ব্যাথা করবে নাতো কি করবে? “
” হুম.. ঠিক বলেছো। যাও আজ থেকে পড়াশোনা সব বন্ধ।”
” ও বাবা, সে আবার কেমন কথা!? “
” তোমার কথা।”
” আমার কথা? “
” হুম.. । যুক্তি দিবো? “
” নারে মা তোর যুক্তি তোর কাছেই রাখ। শোন তোর বাবা এসে পড়বে এখনই তুই গিয়ে ছাদ থেকে কাপড়গুলো তুলে নিয়ে আয়। আমি তোর বাবার জন্য পানি গরম করে আনি।”
” যাও।”
” ভুলে যাস না এখনই যা নিয়ে আয় এগুলো রাত হলে আবার কেউ চুরি করে নিয়ে যাবে।”
” হুম.. যাচ্ছি, তুমি যাও ।”
মা চলে যাওয়ার পর মৌ দুই হাত দুদিকে ছড়িয়ে স্ট্রেস একটু কমায়। তারপর চেয়ার থেকে উঠে ছাদের দিক যাক। তিনতলা বাড়ির দোতলায় থাকে মৌ’য়েরা । মৌ ছাদে পৌছালো। প্রকৃতিতে এখন পৌষের শেষ । বেলার দৈঘ্য অনেকটা বেড়েছে । তবে সূর্যের প্রখরতা খুবই কম। বাতাসের মাঝে বয়ে চলছে শীতলতা যা নাকে ঢুকলে যেন চিরে মস্তিষ্কে পৌছায়। কিন্তু মৌ মানে না নাক চেরার ভয়। জোরে নিশ্বাস নিয়ে বুক ফোলায়। শীতের এই শীতলতা তার খুব প্রিয় । চারিদিকের শীতল নিরবতা তার খুব আপন।
নিজেদের জামাকাপড়গুলো বেছে বেছে দড়ি থেকে নামায়। তারপর গুছিয়ে বা’হাতে ফেলে যখন নামতে যাবে তখন নজর পড়ল পাশের বাসার ছাদের উপর । ঐ হিন্দু ছেলেটা তাকিয়ে আছে মৌয়ের দিকে । মুখটা বোধহয় হালকা হা করা । দূর থেকে তাই মনে হয় মৌ’য়ের। ভেতরে ভেতরে প্রচন্ড রাগ হতে থাকে মৌ’য়েরা । একটু হন হন করেই নেমে আসে ছাদ থেকে। এত জোরে নামার অভ্যাস না থাকায় পড়তে পড়তে বেঁচে যায় মৌ। রূপমের মোহ যেন কাটে না। মেয়েটাকে যত দেখছে ততই যেন অবাক হচ্ছে । গড়নে যেন ঈশ্বরের অপরূপ সৃষ্টি । গোলগাল মুখ, ফর্সা গায়ের রং আর কোমরদীর্ঘ চুল সত্যি অবাক করার মতো । ছাদে উঠেছিলো নিজের হাতে লাগানো গোলাপ আর গান্দা ফুল গাছে পানি দিতে। পানি দিয়ে যখন ছাদ থেকে নেমে যাবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তখন দেখে মেয়েটা ছাদে উঠছে। মেয়েটাকে একবার দেখার কোনো সুযোগই যেন মিস করতে চায় না রূপম।
” দাদা… দাদা” রূপমের খোজ করতে করতে ছাদে আসে ছোট বোন আরোধা।
” কিরে বুড়ি কি হয়েছে? ” রূপম বোনের প্রতি নজর দেয়।
” সব এনেছো বেলুনগুলো কই? “
জ্বীভ কাটে রূপম । তার একেবারেই মনে নেই। বোনের জন্মদিন উপলক্ষে অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ছুটি নিয়ে বাসায় এসেছে রূপম । আসা পথে “অভাল” থেকে অর্ডার দিয়ে রাখা কেক, মোমবাতি, হ্যাপি বার্থ-ডে ডিজাইন বেলুন কিনে আনলেও এমনি বেলুনের কথা তার মনে নেই।
” আরে আমার বুড়ি রে দাদা তো ভূলে গেছে ।”
” কেন ভুললে? এখন যাও নিয়ে আসো। নাহলে কিন্তু কান্না করে সবাইকে বলে দেব।”
” ও বাবা এদেখি ব্লাকমেইল করছে। আচ্ছা বুড়ি আমি এখনই যাচ্ছি। তুই চাবিটা নিয়ে আয় বাইকের।”
” ইয়েএএএ… “
মনের আনন্দে ছুটে যায় আধোরা। আধোরা রূপমদের পরিবারের সবচেয়ে ছোট্ট এবং সবচেয়ে আদরের সদস্য। রূপম মেজো, বড় বোন পূজা। নিচে নেমে ফ্লাটের দরজার সামনে আসতেই, রূপমের মা পারমিতা সেন পথ আটকে দাঁড়ান ।
” এই মণি শোন, আলুবোখারা কম পড়েছে। বেলুন আনার সময় হরিদার দোকান থেকে আলুবোখারা আর পারলে ৫০ কিসমিস নিয়ে আসিস।” মুখের ঘাম মুছতে মুছতে বলেন পারমিতাজী।
” আচ্ছা মা নিয়ে আসব। কই বুড়ি তো বাইকের চাবি নিয়ে এলো না এখনো।”
” এই নাও দাদা ।” বলতে না বলতে চাবি নিয়ে হাজির আরোধা।
” বুড়ি একটা ।” রূপম ছোট বোনের নাকটা একটু টিপে দিয়ে বেরিয়ে যায়।
বাইক বের করে তাকায় মৌ’দের ফ্লাটের দিকে। ভেতরে একটা অজানা হতাশাপূর্ণ বাতাস ছেড়ে বাইক চালিয়ে চলে যায় প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে। মৌ জামাকাপড়গুলো নিয়ে মাত্র রুমে ঢুকেছে। কিন্তু মৌ’য়ের প্রচন্ড রাগ হচ্ছে । ছেলেটা সব জেনেও এভাবে তাকিয়ে থাকে। আর লোক জানাজানি হলে খুব ঝামেলা হবে।
” উফ.. আর ভাবতে পারছি না।”
” কি ভাবতে পারছিস না, মা? “
পিছন থেকে হঠাৎ বাবার কন্ঠের শব্দ শুনতে পায় মৌ। পিছনে ফিরে দেখে বাবা এসেছে । ভেতর ভেতর লজ্জা লাগে মৌ’য়ের।
” কিছু না আব্বু। একটা ইকুয়েশন মাথায় ঘুরছিল । সমাধান পাচ্ছি না।”
” মাথায় এত চাপ দিস না, বুঝলি? “
” তুমি এসে গেছো? “
মৌ’য়ের মা এসে উপস্থিত ।
” হ্যা.. এলাম আরকি।”
” বাথরুমে গরম পানি দিচ্ছি গোসল করে নাও।”
” হুম যাচ্ছি । মা তুই এগুলো নিয়ে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? এতো দেখি পড়ে পড়ে মাথা খারাপ করে দিবে।” বাবার কন্ঠে মৌ চিন্তাজগত থেকে বেরিয়ে আসে।
” আরে ধুর চিন্তা করতে দাও তো।”
” সে নাহয় কর হাতের জিনিসপত্রগুলো নামিয়ে কর। মানা করলো কে? “
“হুম” মৌ স্থান ত্যাগ করবে করবে ভাব এমন সময় মৌয়ের মা বলল,
” শোনো রাতের রান্না করিনি , জন্মদিনের দাওয়াত আছে।”
দাওয়াতের কথা শুনে মৌয়ের মনে আনন্দ জাগে। কতদিন দাওয়াত খায়না। তারপর যদি জন্মদিনের দাওয়াত হয় কেক খাওয়া যাবে। মৌয়ের কেক ভীষণ প্রিয়।
” তাই আম্মু? “
” হুম.. তোকে বলতে মনে নেই। পড়া চাপিয়ে রাখ। যাতে যেতে পারিস কাল তো প্রাইভেটও আছে।”
” আচ্ছা যাচ্ছি ।”
মৌ আবাব টেবিলে বসে । কিন্তু জানালার পর্দা দেয়ার তার নিজেরই দম আটকা আটকা লাগছে। সব চিন্তা বাদ দিয়ে জানালার পর্দা সরিয়ে দেয়। কিন্তু পর্দা সরাতেই সে খুব বিস্মিত হয়ে যায়।
“আম্মু…. “
গল্পের বিষয়:
গল্প