সকালবেলায় শীত-শাঁত ছিল। দুপারবেলায় বাতাসটি অল্প একট তাতিয়া উঠিয়া দক্ষিণ দিক হইতে বহিতে আরম্ভ করিয়াছে। যতীন যে বারামদায় বসিয়া ছিল সেখান হইতে বাগানের এক কোণে এক দিকে একটি কাঁঠাল ও আর-এক দিকে একটি শিরীষগাছের মাঝখানের ফাঁক দিয়া বাহিরের মাঠ চোখে পড়ে। সেই শান্য মাঠ ফালগমনের রৌদ্রে ধধে করিতেছিল। তাহারই এক প্রান্ত দিয়া কাঁচা পথ চলিয়া গেছে—সেই পথ বাহিয়া বোঝাই-খালাস গোরুর গাড়ি মন্দগমনে গ্রামের দিকে ফিরিয়া চলিয়াছে, গাড়োয়ান মাথায় গামছা ফেলিয়া অত্যন্ত বেকারভাবে গান গাহিতেছে। – এমন সময় পশ্চাতে একটি সহাস্য নারীকণ্ঠ বলিয়া উঠিল, “কাঁ যতীন, পাবজন্মের কারও কথা ভাবিতেছ বকি ?” – যতীন কহিল, “কেন পটল, আমি এমনিই কি হতভাগ্য যে, ভাবিতে হইলেই পবজন্ম লইয়া টান পাড়িতে হয়।” আত্মীয়সমাজে পটল মামে খ্যাত এই মেয়েটি বলিয়া উঠিল, “আর মিথ্যা বড়াই করিতে হইবে না। তোমার ইহজন্মের সব খবরই তো রাখি, মশায়। ছি ছি, এত বয়স হইল তব একটা সামান্য বউও ঘরে আনিতে পারিলে না! আমাদের ঐ-ষে ধনা মালাঁটা, ওরও একটা বউ আছে—তার সঙ্গে দই বেলা ঝগড়া করিয়া সে পাড়াসদ্ধ লোককে জানাইয়া দেয় যে, বউ আছে বটে। আর তুমি যে মাঠের দিকে তাকাইয়া ভাণ করিতেছ, যেন কার চাদমুখ ধ্যান করিতে বসিয়াছ, এ-সমস্ত চালাকি আমি কি বুঝি না—ও কেবল লোক দেখাইবার ভড়ং মাত্র। দেখো যতীন, চেনা বামনের পৈতের দরকার হয় না। আমাদের ঐ ধনাটা তো কোনোদিন বিরহের ছতা করিয়া মাঠের দিকে অমন তাকাইয়া থাকে না; অতিবড়ো বিচ্ছেদের দিনেও গাছের তলায় নিড়ানি হাতে উহাকে দিন কাটাইতে দেখিয়াছি, কিন্তু উহার চোখে তো অমন ঘোর-ঘোর ভাব দেখি নাই। আর তুমি, মশায়, সাত জন্ম বউয়ের মুখ দেখিলে না—কেবল হাসপাতালে মড়া কাটিয়া ও পড়া মুখস্থ করিয়া বয়স পার করিয়া দিলে, তুমি অমনতরো দপারবেলা আকাশের দিকে গদগদ হইয়া তাকাইয়া থাক কেন। না, এ-সমস্ত বাজে চালাকি আমার ভালো লাগে না। আমার গা জমালা করে।” যতীন হাতজোড় করিয়া কহিল, “থাক, থাক, আর নয়। আমাকে আর লন্জা দিয়ো না। তোমাদের ধনাই ধন্য। উহারই আদশে আমি চলিতে চেষ্টা করিব। আর কথা নয়, কাল সকালে উঠিয়াই যে কাঠকুড়ানি মেয়ের মখে দেখিব তাহারই গলায় মালা দিব—ধিককার আমার আর সহ্য হইতেছে না।” পটল। তবে এই কথা রহিল ? थउौन । शाँ, ब्रांश्ल । পটল। তবে এসো। যতীন। কোথায় যাইব । পটল। এসোই-না।
যতীন। না না, একটা-কণী দন্টেমি তোমার মাথায় আসিয়াছে। আমি এখন নড়িতেছি না। পটল। আচ্ছা, তবে এইখানেই বোসো।—বলিয়া সে প্রতপদে প্রস্থান করিল। পরিচয় দেওয়া যাক। যতীন এবং পটলের বয়সের একদিন মাত্র তারতম্য। পটল যতীনের চেয়ে একদিনের বড়ো বলিয়া যতীন তাহার প্রতি কোনোপ্রকার সামাজিক সম্মান দেখাইতে নারাজ। উভয়ে খড়তুত-জাঠতুত ভাইবোন। বরাবর একত্রে খেলা করিয়া আসিয়াছে। দিদি বলে না বলিয়া পটল যতীনের নামে বাল্যকালে বাপখড়ার কাছে অনেক নালিশ করিয়াছে, কিন্তু কোনো শাসনবিধির বারা কোনো ফল পায় নাই— একটিমাত্র ছোটো ভাইয়ের কাছেও তাহার পটল-নাম ঘুচিল না। পটল দিব্য মোটাসোটা গোলগাল, প্রফুল্লতার রসে পরিপণ। তাহার কৌতুকহাস্য দমন করিয়া রাখে, সমাজে এমন কোনো শক্তি ছিল না। শাশুড়ির কাছেও সে কোনোদিন গাম্ভীয* অবলম্বন করিতে পারে নাই। প্রথম প্রথম তা লইয়া অনেক কথা উঠিয়াছিল। কিন্তু, শেষকালে সকলকেই হার মানিয়া বলিতে হইল— ওর ঐরকম। তার পরে এমন হইল যে, পটলের দনিবার প্রফুল্লতার আঘাতে গরজনদের গাম্ভীৰ্য ধালিসাৎ হইয়া গেল। পটল তাহার আশেপাশে কোনোখানে মন-ভার মাখ-ভার দশিচন্তা সহিতে পারিত না-অজস্র গল্প-হাসি-ঠাট্টায় তাহার চারি দিকের হাওয়া যেন বিদ্যুৎশক্তিতে বোঝাই হইয়া থাকিত। পটলের স্বামী হরকুমারবাব ডেপটি ম্যাজিস্ট্রেট– বেহার-অঞ্চল হইতে বদলি হইয়া কলিকাতায় আবকারি-বিভাগে পথান পাইয়াছেন। প্লেগের ভয়ে বালিতে একটি বাগানবাড়ি ভাড়া লইয়া থাকেন, সেখান হইতে কলিকাতায় যাতায়াত করেন। অবকারিপরিদর্শনে প্রায়ই তাঁহাকে মফস্বলে ফিরিতে হইবে বলিয়া দেশ হইতে মা এবং অন্য দই-একজন আত্মীয়কে আনিবার উপক্ৰম করিতেছেন, এমন সময় ডাক্তারিতে নতনউত্তীণ পসারপ্রতিপত্তিহীন যতীন বোনের নিমন্ত্রণে হপতাখানেকের জন্য এখানে আসিয়াছে। কলিকাতার গলি হইতে প্রথম দিন গাছপালার মধ্যে আসিয়া যতীন ছায়াময় নিজন বারান্দায় ফাগনমধ্যাহের রসালস্যে আবিষ্ট হইয়া বসিয়া ছিল, এমন সময়ে পর্বকথিত সেই উপদ্রব আরম্ভ হইল। পটল চলিয়া গেলে আবার খানিকক্ষণের জন্য সে নিশিচন্ত হইয়া একটখানি নড়িয়া-চড়িয়া বেশ আরাম করিয়া বসিল-কাঠকুড়ানি মেয়ের প্রসঙ্গে ছেলেবেলাকার রপেকথার অলিগলির মধ্যে তাহার মন ঘরিয়া বেড়াইতে লাগিল। এমন সময় আবার পটলের হাসিমাখা কণ্ঠের কাকলিতে সে চমকিয়া উঠিল । পটল আর-একটি মেয়ের হাত ধরিয়া সবেগে টানিয়া আনিয়া যতীনের সমখে পথাপন করিল; কহিল, “ও কুড়ান!” भार्याप्ले कश्लि, “कौ, मिनि।” পটল। আমার এই ভাইটি কেমন দেখ দেখি। মেয়েটি অসংকোচে যতীনকে দেখিতে লাগিল। পটল কহিল, “কেমন, ভালো দেখিতে না ?” মেয়েটি গম্ভীরভাবে বিচার করিয়া ঘাড় নাড়িয়া কহিল, “হা, ভালো।” মাল্যদান করিতেছ।” পটল। আমি ছেলেমানষি করি, না তুমি বড়োমানষি কর । তোমার বঝি বয়সের গাছপাথর নাই ! : যতীন পলায়ন করিল। পটল তাহার পিছনে পিছনে ছটিতে ছটিতে কহিল, “ও যতীন, তোমার ভয় নাই, তোমার ভর নাই। এখনই তোমার মালা দিতে হইবে না— ফাগুন-চৈত্রে লগ্ন নাই— এখনও হাতে সময় আছে।” পটল যাহাকে কুড়ানি বলিয়া ডাকে সেই মেয়েটি অবাক হইয়া রহিল। তাহার বয়স ষোলো হইবে, শরীর ছিপছিপে-মুখশ্ৰী সম্বন্ধে অধিক কিছু বলিবার নাই, কেবল মুখে এই একটি অসামান্যতা আছে যে দেখিলে যেন বনের হরিণের ভাব মনে আসে। কঠিন ভাষায় তাহাকে নিবন্ধি বলা যাইতেও পারে, কিন্তু তাহা বোকামি নহে; তাহা বৃদ্ধিবৃত্তির অপরিস্ফারণমাত্র, তাহাতে কুড়ানির মাখের সৌন্দৰ্য নষ্ট না করিয়া বরঞ্চ একটি বিশিষ্টতা দিয়াছে। সন্ধ্যাবেলায় হরকুমারবাব কলিকাতা হইতে ফিরিয়া আসিয়া যতীনকে দেখিয়া কহিলেন, “এই-যে, যতীন আসিয়াছ, ভালোই হইয়াছে। তোমাকে একটা ডাক্তারি করিতে হইবে। পশ্চিমে থাকিতে দভিক্ষের সময় আমরা একটি মেয়েকে লইয়া মানুষ করিতেছি । —পটল তাহাকে কুড়ানি বলিয়া ডাকে। উহার বাপ-মা এবং ঐ মেয়েটি আমাদের বাংলার কাছে একটি গাছতলায় পড়িয়া ছিল। যখন খবর পাইয়া গেলাম গিয়া দেখি, উহার বাপ-মা মরিয়াছে, মেয়েটির প্রাণটুকু আছে মাত্র। পটল তাহাকে অনেক যত্নে বচিাইয়াছে। উহার জাতের কথা কেহ জানে না— তাহা লইয়া কেহ আপত্তি করিলেই পটল বলে, ‘ও তো দ্বিজ ; একবার মরিয়া এবার আমাদের ঘরে জমিয়াছে, উহার সাবেক জাত কোথায় ঘুচিয়া গেছে। প্রথমে মেয়েটি পটলকে মা বলিয়া ডাকিতে শর করিয়াছিল ; পটল তাহাকে ধমক দিয়া বলিল, “খবরদার, আমাকে মা বলিস নে— আমাকে দিদি বলিস। পটল বলে, “অতবড়ো মেয়ে মা বলিলে নিজেকে বড়ি বলিয়া মনে হইবে যে ’ বোধ করি, সেই দভিক্ষের উপবাসে বা আর-কোনো কারণে উহার থাকিয়া থাকিয়া শলবেদনার মতো হয়। ব্যাপারখানা কী, তোমাকে ভালো করিয়া পরীক্ষা করিয়া দেখিতে হইবে। ওরে তুলসি, কুড়ানিকে ডাকিয়া আন তো।” কুড়ানি চুল বাঁধতে বধিতে অসম্পণে বেণী পিঠের উপরে দলাইয়া হরকুমারবাবার ঘরে আসিয়া উপস্থিত হইল। তাহার হরিণের মতো চোখদুটি দুজনের উপর রাখিয়া সে চাহিয়া রহিল। – যতীন ইতস্তত করিতেছে দেখিয়া হরকুমার তাহাকে কহিলেন, “বথা সংকোচ করিতেছ, যতীন। উহাকে দেখিতে মস্ত ডাগর, কিন্তু কচি ডাবের মতো উহার ভিতরে কেবল জল ছলছল করিতেছে-এখনও শাঁসের রেখামাত্র দেখা দেয় নাই। ও কিছুই বোঝে না—উহাকে তুমি নারী বলিয়া ভ্ৰম করিয়ো না, ও বনের হরিণী।” । যতীন তাহার ডাক্তারি কতব্য সাধন করিতে লাগিল— কুড়ানি কিছুমাত্র কুষ্ঠা প্রকাশ করিল না। যতীন কহিল, “শরীরষয়ের কোনো বিকার তো বোঙ্কা গেল না।” পটল ফস করিয়া ঘরে ঢাকিয়া বলিল, “হৃদয়যন্ত্রেরও কোনো বিকার ঘটে নাই। তার পরীক্ষা দেখিতে চাও?” আমার এই ভাইটিকে তোর পছন্দ হইয়াছে ?” কুড়ানি মাথা হেলাইয়া কহিল, “হাঁ।” সে আবার মাথা হেলাইয়া কহিল, “হাঁ।” পটল এবং হরকুমারবাব হাসিয়া উঠিলেন। কুড়ানি কৌতুকের মম না বঝিয়া তাঁহাদের অনুকরণে মুখখানি হাসিতে ভরিয়া চাহিয়া রহিল। যতীন লাল হইয়া উঠিয়া ব্যস্ত হইয়া কহিল, “আঃ, পটল, তুমি বাড়াবাড়ি করিতেছ— ভারি অন্যায়। হরকুমারবাব, আপনি পটলকে বড়ো বেশি প্রশ্রয় দিয়া থাকেন।” হরকুমার কহিলেন, “নহিলে আমিও যে উহার কাছে প্রশ্রয় প্রত্যাশা করিতে পারি না। কিন্তু, যতীন, কুড়ানিকে তুমি জান না বলিয়াই অত ব্যস্ত হইতেছ। তুমি লজ্জা করিয়া কুড়ানিকে সমৃদ্ধ লজ্জা করিতে শিখাইবে দেখিতেছি। উহাকে জ্ঞানবক্ষের ফল তুমি খাওয়াইয়ো না। সকলে উহাকে লইয়া কৌতুক করিয়াছে—তুমি যদি মাঝের থেকে গাভীয দেখাও তবে সেটা উহার পক্ষে একটা অসংগত ব্যাপার হইবে।” পটল ( ঐজন্যই তো যতীনের সঙ্গে আমার কোনোকালেই বনিল না, ছেলেবেলা থেকে কেবলই ঝগড়া চলিতেছে- ও বড়ো গম্ভীর। হরকুমার। ঝগড়া করাটা বুঝি এমনি করিয়া একেবারে অভ্যাস হইয়া গেছে— ভাই সরিয়া পড়িয়াছেন, এখন— পটল। ফের মিথ্যা কথা! তোমার সঙ্গে ঝগড়া করিয়া সাখ নাই— আমি চেণ্টাও कर्गद्र ना । হরকুমার। আমি গোড়াতেই হার মানিয়া যাই। পটল। বড়ো কমাই কর। গোড়ায় হার না মানিয়া শেষে হার মানিলে কত খুশি হইতাম । রাত্রে শোবার ঘরের জানলা-দরজা খলিয়া দিয়া যতীন অনেক কথা ভাবিল। ষে মেয়ে আপনার বাপ-মাকে না খাইতে পাইয়া মরিতে দেখিয়াছে তাহার জীবনের উপর কী ভীষণ ছায়া পড়িয়াছে। এই নিদারণে ব্যাপারে সে কতবড়ো হইয়া উঠিয়াছে— তাহাকে লইয়া কি কৌতুক করা যায়। বিধাতা দয়া করিয়া তাহার বন্ধিবৃত্তির উপরে একটা আবরণ ফেলিয়া দিয়াছেন—এই আবরণ যদি উঠিয়া যায় তবে অদস্টের রন্দ্রলীলার কী ভীষণ চিহ্ন প্রকাশ হইয়া পড়ে। আজ মধ্যাহে গাছের ফাঁক দিয়া যতীন যখন ফালানের আকাশ দেখিতেছিল, দর হইতে কাঁঠালমকৃলের গন্ধ মাদতর হইয়া তাহার প্রাণকে আবিষ্ট করিয়া ধরিতেছিল, তখন তাহার মনটা মাধয্যের কুহেলিকায় সমস্ত জগৎটাকে আচ্ছন্ন করিয়া দেখিয়াছিল ; ঐ বধিহীন বালিকা তাহার হরিণের মতো চোখদুটি লইয়া সেই সোনালি কুহেলিকা অপসারিত করিয়া দিয়াছে ; ফাগানের এই কজন-গঞ্জেন-মমরের পশ্চাতে যে সংসার ক্ষুধাতৃষ্ণাতুর দুঃখকঠিন দেহ লইয়া বিরাট মতিতে দাঁড়াইয়া আছে, উদঘাটিত যবনিকার শিল্পমাধায্যের অন্তরালে সে দেখা দিল। পরদিন সন্ধ্যার সময় কুড়ানির সেই বেদনা ধরিল। পটল তাড়াতাড়ি যতীনকে ডাকিয়া পাঠাইল। যতীন আসিয়া দেখিল, কন্টে কুড়ানির হাতে পায়ে খিল ধরিতেছে, শরীর আড়স্ট। যতীন ঔষধ আনিতে পাঠাইয়া বোতলে করিয়া গরম জল আনিতে হকুম করিল। পটল কহিল, “ভারি মস্ত ডাক্তার হইয়াছ, পায়ে একট, গরম তেল মালিশ করিয়া দাও-না। দেখিতেছ না, পায়ের তেলো হিম হইয়া গেছে।” যতীন রোগিণীর পায়ের তলায় গরম তেল সবেগে ঘষিয়া দিতে লাগিল। চিকিৎসাব্যাপারে রাত্রি অনেক হইল। হরকুমার কলিকাতা হইতে ফিরিয়া আসিয়া বারবার কুড়ানির খবর লইতে লাগিলেন। যতীন বুঝিল, সন্ধ্যাবেলায় কম হইতে ফিরিয়া আসিয়া পটল-অভাবে হরকুমারের অবস্থা আচল হইয়া উঠিয়াছে-ঘন ঘন কুড়ানির খবর লইবার তাৎপৰ্য তাই। যতীন কহিল, “হরকুমারবাব ছটফট করিতেছেন ; তুমি যাও, পটল।” পটল কহিল, “পরের দোহাই দিবে বই-কি। ছটফট কে করিতেছে তা বঝিয়াছি। আমি গেলেই এখন তুমি বাঁচ। এ দিকে কথায় কথায় লজায় মুখচোখ লাল হইয়া উঠে— তোমার পেটে যে এত ছিল তা কে বুঝিবে।” যতীন । আচ্ছা, দোহাই তোমার, তুমি এইখানেই থাকো। রক্ষা করো–তোমার মুখ বন্ধ হইলে বাঁচি। আমি ভুল বুঝিয়াছিলাম—হরকুমারবাব বোধ হয় শান্তিতে আছেন, এরকম সযোগ তাঁর সবাদা ঘটে না। কুড়ানি আরাম পাইয়া যখন চোখ খলিল পটল কহিল, “তোর চোখ খোলাইবার জন্য তোর বর যে আজ অনেকক্ষণ ধরিয়া তোকে পায়ে ধরিয়া সাধিয়াছে— আজ তাই বঝি এত দেরি করিলি। ছি ছি, ওঁর পায়ের ধলা নে ৷” কুড়ানি কতব্যবোধে তৎক্ষণাৎ গভীরভাবে যতীনের পায়ের ধলা লইল। যতীন দ্রতপদে ঘর হইতে চলিয়া গেল। তাহার পরদিন হইতে যতীনের উপরে রীতিমত উপদ্রব আরম্ভ হইল। যতীন খাইতে বসিয়াছে, এমন সময় কুড়ানি আসিয়া অম্বলানবদনে পাখা দিয়া তাহার মাছি তাড়াইতে প্রবত্ত হইল। যতীন ব্যস্ত হইয়া বলিয়া উঠিল, “থাক থাক, কাজ নাই।” কুড়ানি এই নিষেধে বিস্মিত হইয়া মুখ ফিরাইয়া পশ্চাদবতা ঘরের দিকে একবার চাহিয়া দেখিল— তাহার পরে আবার পনশ্চ পাখা দোলাইতে লাগিল। যতীন অন্তরালবতিনীর উদ্দেশে বলিয়া উঠিল, “পটল, তুমি যদি এমন করিয়া আমাকে জবালাও তবে আমি খাইব না— আমি এই উঠিলাম।” বলিয়া উঠিবার উপক্ৰম করিতেই কুড়ানি পাখা ফেলিয়া দিল। যতীন বালিকার বন্ধিহীন মখে তাঁর বেদনার রেখা দেখিতে পাইল ; তৎক্ষণাৎ অনন্তপত হইয়া সে পনবার বসিয়া পড়িল। কুড়ানি যে কিছু বোঝে না, সে যে লজা পায় না, বেদনা বোধ করে না, এ কথা যতীনও বিশ্বাস করিতে আরম্ভ করিয়াছিল। আজ চকিতের মধ্যে দেখিল, সকল নিয়মেরই ব্যতিক্ৰম আছে, এবং ব্যতিক্রম কখন হঠাৎ ঘটে আগে হইতে তাহা কেহই বলিতে পারে না। কুড়ানি পাখা ফেলিয়া দিয়া চলিয়া গেল। পরদিন সকালে যতীন বারান্দায় বসিয়া আছে, গাছপালার মধ্যে কোকিল অত্যন্ত ডাকাডাকি আরম্ভ করিয়াছে, আমের বোলের গন্ধে বাতাস ভারাকাস্ত-এমন সময় সে দেখিল, কুড়ানি চায়ের পেয়ালা হাতে লইয়া যেন একটা ইতস্তত করিতেছে। তাহার হরিণের মতো চক্ষে একটা সকরণ ভয় ছিল—সে চা লইয়া গেলে যতীন বিরক্ত হইবে कि मा, ऐश वन ट्ञ यदादाङ्गा छैठिटऊ शाब्रिटठाइल ना । অগ্রসর হইয়া তাহার হাত হইতে পেয়ালা লইল। এই মানবজন্মের হরিণশিশুটিকে তুচ্ছ কারণে কি বেদনা দেওয়া যায়। যতীন যেমনি পেয়ালা লইল অমনি দেখিল, বারান্দার অপর প্রান্তে পটল সহসা আবিভূত হইয়া নিঃশব্দহাস্যে যতীনকে কিল দেখাইল ; ভাবটা এই যে, “কেমন ধরা পড়িয়াছ।” সেইদিন সন্ধ্যার সময় যতীন একখানি ডাক্তার কাগজ পড়িতেছিল, এমন সময় ফলের গন্ধে চকিত হইয়া উঠিয়া দেখিল, কুড়ানি বকুলের মালা হাতে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল। যতীন মনে মনে কহিল, বড়োই বাড়াবাড়ি হইতেছে— পটলের এই নিষ্ঠর আমোদে আর প্রশ্রয় দেওয়া উচিত হয় না।’ কুড়ানিকে বলিল, “ছি ছি কুড়ানি, তোমাকে লইয়া তোমার দিদি আমোদ করিতেছেন, তুমি বঝিতে পার না।” কথা শেষ করিতে না করিতেই কুড়ানি কত সংকুচিত ভাবে প্রস্থানের উপক্ৰম করিল। যতীন তখন তাড়াতাড়ি তাহাকে ডাকিয়া কহিল, “কুড়ানি, দেখি, তোমার মালা দেখি।” বলিয়া মালাটি তাহার হাত হইতে লইল। কুড়ানির মখে একটি আনন্দের উজ্জলতা ফটিয়া উঠিল, অন্তরাল হইতে সেই মহতে একটি উচ্চহাস্যের উচ্ছৰাসধ্বনি শনা গেল। , পরদিন সকালে উপদ্রব করিবার জন্য পটল যতীনের ঘরে গিয়া দেখিল, ঘর শান্য। একখানি কাগজে কেবল লেখা আছে– “পালাইলাম। শ্রীযতীন।” “ও কুড়ানি, তোর বর যে পালাইল। তাহাকে রাখিতে পারিলি নে!” বলিয়া কুড়ানির বেণী ধরিয়া নাড়া দিয়া পটল ঘরকন্নার কাজে চলিয়া গেল। কথাটা বুঝিতে কুড়ানির একটা সময় গেল। সে ছবির মতো দাঁড়াইয়া পিথরদটিতে সম্মখে চাহিয়া রহিল। তার পর ধীরে ধীরে যতীনের ঘরে আসিয়া দেখিল, তাহার ঘর খালি। তার পবসন্ধ্যার উপহারের মালাটা টেবিলের উপর পড়িয়া আছে। বসন্তের প্রাতঃকালটি স্নিগ্ধসন্দর ; রৌদ্রটি কম্পিত কৃষ্ণচড়ার শাখার ভিতর দিয়া ছায়ার সহিত মিশিয়া বারান্দার উপর আসিয়া পড়িয়াছে। কাঠবিড়ালি লেজ পিঠে তুলিয়া ছাটাছটি করিতেছে এবং সকল পাখি মিলিয়া নানা সরে গান গাহিয়া তাহাদের বক্তব্য বিষয় কিছতেই শেষ করিতে পারিতেছে না। পথিবীর এই কোণটুকুতে, এই খানিকটা ঘনপল্লব ছায়া এবং রৌদ্ররচিত জগৎখণ্ডের মধ্যে প্রাণের আনন্দ ফটিয়া উঠিতেছিল ; তাহারই মাঝখানে ঐ বন্ধিহীন বালিকা তাহার জীবনের, তাহার চারি দিকের সংগত কোনো অর্থ ববিয়া উঠিতে পারিতেছিল না। সমস্তই কঠিন প্রহেলিকা। কী হইল, কেন এমন হইল, তার পরে এই প্রভাত, এই গহ, এই যাহা-কিছু সমস্তই এমন একেবারে শান্য হইয়া গেল কেন। যাহার বঝিবার সামথ অলপ তাহাকে হঠাৎ একদিন নিজ হাদয়ের এই অতল বেদনার রহস্যগভে কোনো প্রদীপ হাতে না দিয়া কে নামাইয়া দিল। জগতের এই সহজ-উচ্ছসিত প্রাণের রাজ্যে, এই গাছপালা-মগপক্ষীর আত্মবিস্মত কলরবের মধ্যে কে তাহাকে আবার টানিয়া তুলিতে পারবে। পটল ঘরকন্নার কাজ সারিয়া কুড়ানির সন্ধান চাইতে আসিয়া দেখিল, সে যতীনের পরিত্যন্ত ঘরে তাহার খাটের খরা ধরিয়া মাটিতে পড়িয়া আছে—শন্য শয্যাটাকে যেন পায়ে ধরিয়া সাধিতেছে। তাহার বকের ভিতরে যে-একটি সাধার পার লকোনো ছিল সেইটে যেন শন্যতার চরণে বখা আশ্বাসে উপড়ে করিরা ঢালিয়া দিতেছে भाछाछमान ভূমিতলে পঞ্জীভূত সেই শলিতকেশা লাণ্ঠিতবসনা নারী যেন নীরব একাগ্রতার ভাষায় বলিতেছে, “লও, লও, আমাকে লও। ওগো, আমাকে লও।” পটল বিস্মিত হইয়া কহিল, “ও কী হইতেছে, কুড়ানি।” * কুড়ানি উঠিল না ; সে যেমন পড়িয়া ছিল তেমনি পড়িয়া রহিল। পটল আসিয়া তাহাকে পশ করিতেই সে উচ্ছসিত হইয়া ফলিয়া ফলিয়া কাঁদতে ठूला िशक्ष । পটল তখন চকিত হইয়া বলিয়া উঠিল, “ও পোড়ারমখি, সবনাশ করিয়াছিস ! अग्निम्नाक्किम !” হরকুমারকে পটল কুড়ানির অবস্থা জানাইয়া কহিল, “এ কী বিপদ ঘটিল। তুমি কী করিতেছিলে, তুমি আমাকে কেন বারণ করিলে না।” হরকুমার কহিল, “তোমাকে বারণ করা যে আমার কোনোকালে অভ্যাস নাই। বারণ করিলেই কি ফল পাওয়া যাইত ” পটল। তুমি কেমন স্বামী। আমি যদি ভুল করি, তুমি আমাকে জোর করিয়া থামাইতে পার না ? আমাকে তুমি এ খেলা খেলিতে দিলে কেন। এই বলিয়া সে ছটিয়া গিয়া ভূপতিতা বালিকার গলা জড়াইয়া ধরিয়া কহিল, “লক্ষী বোন আমার, তোর কী বলিবার আছে আমাকে খালিয়া বল।” হায়, কুড়ানির এমন কী ভাষা আছে যে, আপনার হাদয়ের অব্যন্ত রহস্য সে কথা দিয়া বলিতে পারে। সে একটি অনিবাচনীয় বেদনার উপর তাহার সমস্ত বকে দিয়া চাপিয়া পড়িয়া আছে—সে বেদনাটা কী, জগতে এমন আর কাহারও হয় কি না, তাহাকে লোকে কী বলিয়া থাকে, কুড়ানি তাহার কিছুই জানে না। সে কেবল কান্না দিয়া বলিতে পারে ; মনের কথা জানাইবার তাহার আর কোনো উপায় নাই। পটল কহিল, “কুড়ানি, তোর দিদি বড়ো দুষ্ট ; কিন্তু তার কথা যে তুই এমন করিয়া বিশ্বাস করিবি, তা সে কখনও মনেও করে নি। তার কথা কেহ কখনও বিশ্ববাস করে না ; তুই এমন ভুল কেন করিলি। কুড়ানি, একবার মাখ তুলিয়া তোর দিদির মখের দিকে চা ; তাকে মাপ কর।” কিন্তু কুড়ানির মন তখন বিমুখ হইয়া গিয়াছিল, সে কোনোমতেই পটলের মাখের দিকে চাহিতে পারিল না ; সে আরও জোর করিয়া হাতের মধ্যে মাথা গজিয়া রহিল। সে ভালো করিয়া সমস্ত কথা না বুঝিয়াও একপ্রকার মঢ়েভাবে পটলের প্রতি রাগ করিয়াছিল। পটল তখন ধীরে ধীরে বাহপাশ খালিয়া লইয়া উঠিয়া গেল—এবং জানালার ধারে পাথরের মতির মতো তথভাবে দাঁড়াইয়া ফালানের রৌদ্রীচরণ সপোরিগাছের পল্লবশ্রেণীর দিকে চাহিয়া পটলের দুই চক্ষ দিয়া জল পড়িতে লাগিল। পরদিন কুড়ানির. আর দেখা পাওয়া গেল না। পটল তাহাকে আদর করিয়া ভালো ভালো গহনা এবং কাপড় দিয়া সাজাইত। নিজে সে এলোমেলো ছিল, নিজের সাজ সম্বন্ধে তাহার কোনো যত্ন ছিল না, কিন্তু সাজগোজের সমস্ত শখ কুড়ানির উপর দিয়াই সে মিটাইয়া লইত বহনকালসঞ্চিত সেই-সমস্ত বসনভূষণ স্কুড়ানির ঘরের মেজের উপর পড়িয়া আছে। তাহার হাতের বালাদুড়ি, নাসাগের লবঙ্গাফলটি পর্যন্ত সে খালিয়া ফেলিয়া গিয়াছে। তাহার পটলদিদির এতদিনের সমস্ত আদর সে যেন গা হইতে মাছিয়া ফেলিবার চেষ্টা করিয়াছে। হরকুমারবাবা কুড়ানির সন্ধানে পলিসে খবর দিলেন। সেবারে প্লেগ-দমনের বিভীষিকায় এত লোক এত দিকে পলায়ন করিতেছিল যে, সেই-সকল পলাতকদলের মধ্য হইতে একটি বিশেষ লোককে বাছিয়া লওয়া পলিসের পক্ষে শস্ত হইল। হরকুমারবাব দুই-চারিবার ভুল লোকের সন্ধানে অনেক দুঃখ এবং লজা পাইয়া কুড়ানির আশা পরিত্যাগ করিলেন। অজ্ঞাতের কোল হইতে তাঁহারা যাহাকে পাইয়াছিলেন অজ্ঞাতের কোলের মধ্যেই সে আবার লুকাইয়া পড়িল। যতীন বিশেষ চেষ্টা করিয়া সেবার পেলগ-হাসপাতালে ডাক্তারি-পদ গ্রহণ করিয়াছিল। একদিন দপারবেলায় বাসায় আহার সারিয়া হাসপাতালে আসিয়া সে শনিল, হাসপাতালের সী-বিভাগে একটি নতন রোগিণী আসিয়াছে। পলিস তাহাকে পথ হইতে কুড়াইয়া আনিয়াছে। যতীন তাহাকে দেখিতে গেল। মেয়েটির মাখের অধিকাংশ চাদরে ঢাকা ছিল। যতীন প্রথমেই তাহার হাত তুলিয়া লইয়া নাড়ী দেখিল। নাড়ীতে জর অধিক নাই, কিন্তু দাবলতা অত্যন্ত। তখন পরীক্ষার জন্য মুখের চাদর সরাইয়া দেখিল, সেই কুড়ানি । ইতিমধ্যে পটলের কাছ হইতে যতীন কুড়ানির সমস্ত বিবরণ জানিয়াছিল। অব্যন্ত ধ্যানদটির উপরে কেবলই আশ্রহেীন কাতরতা বিকীর্ণ করিয়াছে। আজ সেই রোগনিমলিত চক্ষর সন্দীঘ পল্লব কুড়ানির শীর্ণ কপোলের উপরে কালিমার রেখা টানিয়াছে; দেখিবামার যতীনের বকের ভিতরটা হঠাৎ কে যেন চাপিয়া ধরিল। এই একটি মেয়েকে বিধাতা এত যত্নে ফলের মতো সংকুমার করিয়া গড়িয়া দভিক্ষ হইতে মারীর মধ্যে ভাসাইয়া দিলেন কেন। আজ এই-যে পেলব প্রাণটি ক্লিটে হইয়া বিছানার উপরে পড়িয়া আছে, ইহার এই অলপ কয়দিনের আয়র মধ্যে এত বিপদের আঘাত, এত বেদনার ভার সহিল কী করিয়া, ধরিল কোথায়। যতীনই-বা ইহার জীবনের মাঝখানে তৃতীয় আর-একটি সংকটের মতো কোথা হইতে আসিয়া জড়াইয়া পড়িল । রন্ধ দীঘনিশ্বাস যতীনের বক্ষোবারে আঘাত করিতে লাগিল—কিন্তু সেই আঘাতের তাড়নায় তাহার হৃদয়ের তারে একটা সখের মীড়ও বাজিয়া উঠিল। যে ভালোবাসা জগতে দলভি, যতীন তাহা না চাহিতেই, ফাগানের একটি মধ্যাহ্নে একটি পণবিকশিত মাধবীমঞ্জরির মতো অকস্মাৎ তার পায়ের কাছে আপনি আসিয়া খসিয়া পড়িয়াছে। ষে ভালোবাসা এমন করিয়া মৃত্যুর দুবার পর্যন্ত আসিয়া মছিত হইয়া পড়ে, পথিবীতে কোন লোক সেই দেবভোগ্য নৈবেদ্যলাভের অধিকারী। যতীন কুড়ানির পাশে বসিয়া তাহাকে অলপ অলপ গরম দুধ খাওয়াইয়া দিতে । লাগিল। খাইতে খাইতে অনেকক্ষণ পরে সে দীঘনিশ্বাস ফেলিয়া চোখ মেলিল। যতীনের মথের দিকে চাহিয়া তাহাকে সদরে সবনের মতো যেন মনে করিয়া লইতে চেষ্টা করিল। যতীন যখন তাহার কপালে হাত রাখিয়া একটখানি নাড়া দিয়া কহিল “কুড়ানি” তখন তাহার অজ্ঞানের শেষ ঘোরটুকু হঠাৎ ভাঙিয়া গেল— যতীনকে সে চিনিল এবং তখনই তাহার চোখের উপরে বাপকোমল আর-একটি মোহের আবরণ মাল্যদান পড়িল। প্রথম-মেঘ-সমাগমে সংগম্ভীর আষাঢ়ের আকাশের মতো কুড়ানির কালো চোখদটির উপর একটি যেন সদরব্যাপী সজলনিখতা ঘনাইয়া আসিল। যতীন সকরণ যত্নের সহিত কহিল, “কুড়ানি, এই দধেটকু শেষ করিয়া ফেলো।” কুড়ানি একটা উঠিয়া বসিয়া পেয়ালার উপর হইতে যতীনের মখে স্থিরদটিতে চাহিয়া সেই দধটকু ধীরে ধীরে খাইয়া ফেলিল। হাসপাতালের ডাক্তার একটিমাত্র রোগীর পাশে সমস্ত ক্ষণ বসিয়া থাকিলে কাজও চলে না, দেখিতেও ভালো হয় না। অন্যত্র কতব্য সারিবার জন্য যতীন যখন উঠিল তখন ভয়ে ও নৈরাশ্যে কুড়ানির চোখদটি ব্যাকুল হইয়া পড়িল। যতীন তাহার হাত ধরিয়া তাহাকে আশ্বাস দিয়া কহিল, “আমি আবার এখনই আসিব, কুড়ানি, তোমার কোনো ভয় নাই।” যতীন কতৃপক্ষদিগকে জানাইল যে, এই নতন-আনীত রোগিণীর পেলগ হয় নাই, সে না খাইয়া দলবল হইয়া পড়িয়াছে। এখানে অন্য প্লেগরোগীর সঙ্গে থাকিলে তাহার পক্ষে বিপদ ঘটিতে পারে। – বিশেষ চেষ্টা করিয়া যতীন কুড়ানিকে অন্যত্র লইয়া যাইবার অনুমতি লাভ করিল এবং নিজের বাসায় লইয়া গেল। পটলকে সমস্ত খবর দিয়া একখানি চিঠিও লিখিয়া झिठा । সেইদিন সন্ধ্যার সময় রোগী এবং চিকিৎসক ছাড়া ঘরে আর কেহ ছিল না। শিয়রের কাছে রঙিন কাগজের আবরণে ঘেরা একটি কেরোসিন-ল্যাম্প ছায়াচ্ছন্ন মদ আলোক বিকীর্ণ করিতেছিল, ব্র্যাকেটের উপরে একটা ঘড়ি নিস্তব্ধ ঘরে টিকটিক শব্দে দোলক দোলাইতেছিল। যতীন কুড়ানির কপালে হাত দিয়া কহিল, “তুমি কেমন বোধ করিতেছ, কুড়ানি।” কুড়ানি তাহার কোনো উত্তর না করিয়া যতীনের হাতটি আপনার কপালেই চাপিয়া ब्राथिझा मिळ । – যতীন আবার জিজ্ঞাসা করিল, “ভালো বোধ হইতেছে ?” কুড়ানি একটুখানি চোখ বজিয়া কহিল, “হাঁ।” যতীন জিজ্ঞাসা করিল, “তোমার গলায় এটা কী কুড়ানি।” কুড়ানি তাড়াতাড়ি কাপড়টা টানিয়া তাহা ঢাকিবার চেষ্টা করিল। যতীন দেখিল, সে একগাছি শুকনো বকুলের মালা। তখন তাহার মনে পড়িল, সে মালাটা কী। ঘড়ির টিকটিক শব্দের মধ্যে যতীন চুপ করিয়া বসিয়া ভাবিতে লাগিল। কুড়ানির এই প্রথম লুকাইবার চেষ্টা, নিজের হৃদয়ের ভাব গোপন করিবার এই তাহার প্রথম প্রয়াস। কুড়ানি মগশিশ ছিল, সে কখন হাদয়ভারাতুর যাবতী নারী হইয়া উঠিল। কোন রৌদ্রের আলোকে, কোন রৌদ্রের উত্তাপে তাহার বন্ধির উপরকার সমস্ত কুয়াশা কাটিয়া গিয়া তাহার লজ্জা, তাহার শঙ্কা, তাহার বেদনা এমন হঠাৎ প্রকাশিত হইয়া পড়িল । রাত্রি দটো-আড়াইটার সময় যতীন চেকিতে বসিয়াই ঘামাইয়া পড়িয়াছে। হঠাৎ বার খোলার শব্দে চমকিয়া উঠিয়া দেখিল, পটল এবং হরকুমারবাব এক বড়ো ব্যাগ হাতে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিলেন। গলপথচ্ছে শইলাম। অধোঁক রাত্রে পটল কহিল, ওগো, কাল সকালে গেলে কুড়ানিকে দেখিতে পাইব না— আমাকে এখনই যাইতে হইবে। পটলকে কিছতেই বুঝাইয়া রাখা গেল না— তখনই একটা গাড়ি করিয়া বাহির হইয়া পড়িয়াছি।” পটল হরকুমারকে কহিল, “চলো, তুমি যতীনের বিছানায় শোবে চলো।” হরকুমার ঈষৎ আপত্তির আড়ম্বর করিয়া যতীনের ঘরে গিয়া শুইয়া পড়িলেন, তাঁহার নিদ্রা যাইতেও দেরি হইল না। পটল ফিরিয়া আসিয়া যতীনকে ঘরের এক কোণে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “আশা আছে ?” যতীন কুড়ানির কাছে আসিয়া তাহার নাড়ী দেখিয়া মাথা নাড়িয়া ইঙ্গিতে জানাইল যে, আশা নাই। পটল কুড়ানির কাছে আপনাকে প্রকাশ না করিয়া যতীনকে আড়ালে লইয়া কহিল, “যতীন, সত্যু বলে, তুমি কি কুড়ানিকে ভালোবাস না।” যতীন পটলকে কোনো উত্তর না দিয়া কুড়ানির বিছানার পাশে আসিয়া বসিল। তাহার হাত চাপিয়া ধরিয়া নাড়া দিয়া কহিল, “কুড়ানি, কুড়ানি।” কুড়ানি চোখ মেলিয়া মুখে একটি শান্ত মধর হাসির আভাসমাত্র আনিয়া কহিল, “কী, দাদাবাব।” ষতীন কহিল, “কুড়ানি, তোমার এই মালাটি আমার গলায় পরাইয়া দাও।” কুড়ানি অনিমেষ অবাক চোখে যতীনের মুখের দিকে তাকাইয়া রহিল। যতীন কহিল, “তোমার মালা আমাকে দিবে না ?” যতীনের এই আদরের প্রশ্রয়ট কু পাইয়া কুড়ানির মনে পবেীকৃত অনাদরের একটনখানি অভিমান জাগিয়া উঠিল। সে কহিল, “কী হবে, দাদাবাব।” যতীন দই হাতে তাহার হাত লইয়া কহিল, “আমি তোমাকে ভালোবাসি, কুড়ানি।” শনিয়া ক্ষণকালের জন্য কুড়ানি সন্তব্ধ রহিল; তাহার পরে তাহার দুই চক্ষ দিয়া অজস্র জল পড়িতে লাগিল। যতীন বিছানার পাশে নামিয়া হাঁট গাড়িয়া বসিল, কুড়ানির হাতের কাছে মাথা নত করিয়া রাখিল। কুড়ানি গলা হইতে মালা খলিয়া যতীনের গলায় পরাইয়া দিল। তখন পটল তাহার কাছে আসিয়া ডাকিল, “কুড়ানি।” কুড়ানি তাহার শীর্ণ মখ উজ্জল করিয়া কহিল, “কণী, দিদি।” পটল তাহার কাছে আসিয়া তাহার হাত ধরিয়া কহিল, “আমার উপর তোর আর কোনো রাগ নাই, বোন ?” কুড়ানি স্নিগ্ধকোমল দটিতে কহিল, “না দিদি।” পটল কহিল, “যতীন, একবার তুমি ও ঘরে যাও।” যতীন পাশের ঘরে গেলে পটল ব্যাগ খলিয়া কুড়ানির সমস্ত কাপড়-গহনা তাহার মধ্য হইতে বাহির করিল। রোগিণীকে অধিক নাড়াচাড়া না করিয়া একখানি লাল বেনারসি শাড়ি সন্তপণে তাহার মলিন বম্মের উপর জড়াইয়া দিল। পরে একে একে এক-একগাছি চুড়ি তাহার হাতে দিয়া দই হাতে দই বালা পরাইয়া দিল। তার পরে ডাকিল, “যতীন।” যতীন আসিতেই তাহাকে বিছানায় বসাইয়া পটল তাহার হাতে কুড়ানির একছড়া মাল্যদান 4ఏ& সোনার হার দিল। যতীন সেই হারছড়াটি লইয়া আস্তে আস্তে কুড়ানির মাথা তুলিয়া ধরিয়া তাহাকে পরাইয়া দিল। ভোরের আলো যখন কুড়ানির মাখের উপর আসিয়া পড়িল তখন সে আলো সে আর দেখিল না। তাহার অম্লান মাখকাতি দেখিয়া মনে হইল, সে মরে নাই—কিন্তু সে ষেন একটি অতলপশ সখীবনের মধ্যে নিমগ্ন হইয়া গেছে। যখন মতদেহ লইয়া যাইবার সময় হইল তখন পটল কুড়ানির বকের উপরে পড়িয়া কাঁদিতে কাঁদিতে কহিল, “বোন, তোর ভাগ্য ভালো। জীবনের চেয়ে তোর মরণ সখের।” যতীন কুড়ানির সেই শান্তনিধি মৃত্যুচ্ছবির দিকে চাহিয়া ভাবিতে লাগিল, যাঁহার ধন তিনিই নিলেন, আমাকেও বঞ্চিত করিলেন না।’
চৈত্র ১৩০৯