দর্পহরণ

কী করিয়া গল্প লিখিতে হয় তাহা সম্প্রতি শিখিয়াছি। বঙ্কিমবাব এবং সার ওয়ালটার স্কট পড়িয়া আমার বিশেষ ফল হয় নাই। ফল কোথা হইতে কেমন করিয়া হইল, আমার এই প্রথম গল্পেই সেই কথাটা লিখিতে বসিলাম । আমার পিতার মতামত অনেকরকম ছিল ; কিন্তু বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে কোনো মত তিনি কেতাব বা বাধীনবাধি হইতে গড়িয়া তোলেন নাই। আমার বিবাহ যখন হয় তখন সতেরো উত্তীণ হইয়া আঠারোয় পা দিয়াছি ; তখন আমি কলেজে থাড” ইয়ারে পড়ি— এবং তখন আমার চিত্তক্ষেত্রে যৌবনের প্রথম দক্ষিণবাতাস বহিতে আরম্ভ করিয়া কত অলক্ষ্য দিক হইতে কত অনিবাচনীয় গীতে এবং গন্ধে, কমপনে এবং মমরে আমার তরণ জীবনকে উৎসকে করিয়া তুলিতেছিল, তাহা এখনও মনে হইলে বকের ভিতরে দীঘনিশ্বাস ভরিয়া উঠে। তখন আমার মা ছিলেন না— আমাদের শান্য সংসারের মধ্যে লক্ষীপথাপন করিবার জন্য আমার পড়াশনা শেষ হইবার অপেক্ষা না করিয়াই, বাবা বারো বৎসরের বালিকা নিঝরিণীকে আমাদের ঘরে আনিলেন। নিঝরিণী নামটি হঠাৎ পাঠকদের কাছে প্রচার করিতে সংকোচবোধ করিতেছি। কারণ, তাঁহাদের অনেকেরই বয়স হইয়াছে— অনেকে ইস্কুলমাস্টারি মনসেফি এবং কেহ কেহ বা সম্পাদকিও করেন—তাঁহারা আমার বশরেমহাশয়ের নামনিবাচনরচির অতিমাত্র লালিত্য এবং নতনত্বে হাসিবেন, এমন আশঙ্কা আছে। কিন্তু আমি তখন অবাচীন ছিলাম, বিচারশক্তির কোনো উপদ্রব ছিল না, তাই নামটি বিবাহের সম্প্রবন্ধ হইবার সময়েই যেমনি শুনিলাম অমনি— কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো, আকুল করিল মোর প্রাণ। এখন বয়স হইয়াছে এবং ওকালতি ছাড়িয়া মনসেফি-লাভের জন্য ব্যগ্র হইয়া উঠিয়াছি, তব হাদয়ের মধ্যে ঐ নামটি পরাতন বেহালার আওয়াজের মতো আরও বেশি মোলায়েম হইয়া বাজিতেছে। প্রথম বয়সের প্রথম প্রেম অনেকগুলি ছোটোখাটো বাধার স্বারা মধরে। লজার বাধা, ঘরের লোকের বাধা, অনভিজ্ঞতার বাধা, এইগুলির অন্তরাল হইতে প্রথম পরিচয়ের যে আভাস দিতে থাকে তাহা ভোরের আলোর মতো রঙিন ; তাহা মধ্যাহ্নের মতো স্পষ্ট, অনাবত এবং বর্ণচ্ছটাবিহীন নহে। আমাদের সেই নবীন পরিচয়ের মাঝখানে বাবা কিধ্যগিরির মতো দাঁড়াইলেন। তিনি আমাকে হস্টেলে নিবাসিত করিয়া দিয়া তাঁহার বউমাকে বাংলা লেখাপড়া শিখাইতে প্রবত্ত হইলেন। আমার এই গল্পের শরে হইল সেইখানে। খবশরমশায় কেবল তাঁহার কন্যার নামকরণ করিয়াই নিশ্চেন্ট ছিলেন না, তিনি তাহাকে শিক্ষাদানেরও প্রভূত আয়োজন করিয়াছিলেন। এমন-কি, উপক্ৰমণিকা তাহার মখস্থ শেষ হইয়াছিল। মেঘনাদবধ কাব্য পড়িতে হেমবাবর টীকা তাহার প্রয়োজন इक्वेऊ ना ।

হস্টেলে গিয়া তাহার পরিচয় পাইয়াছিলাম। আমি সেখানে থাকিতে নানা উপায়ে বাবাকে লুকাইয়া নববিরহতাপে অত্যন্ত উত্তপ্ত একখানা চিঠি তাহাকে পাঠাইতে আরম্ভ করিয়াছিলাম। তাহাতে কোটেশন-মাকৰ্ণ না দিয়া আমাদের নব্য কবিদের কাব্য ছকিয়া অনেক কবিতা ঢালিয়াছিলাম ; ভাবিয়ছিলাম— প্রণয়িনীর কেবল প্রেম আকষণ করাই যথেষ্ট নহে, শ্রদ্ধাও চাই। শ্রদ্ধা পাইতে হইলে বাংলা ভাষায় ষেরপ রচনাপ্রণালীর আশ্রয় লওয়া উচিত সেটা আমার স্বভাবত আসিত না, সেইজন্য মণেী বজ্রসমতকাঁণে সত্রস্যেবাতি মে গতিঃ । অথাৎ, অন্য জহরিরা যে-সকল মণি ছিদ্র করিয়া রাখিয়াছিলেন, আমার চিঠি তাহা সত্রের মতো গাঁথিয়া পাঠাইত। কিন্তু, ইহার মধ্যে মণিগুলি অন্যের, কেবলমাত্র সন্ত্রট-কুই আমার, এ বিনয়টুকু স্পষ্ট করিয়া প্রচার করা আমি ঠিক সংগত মনে করি নাই-কালিদাসও করিতেন না, যদি সত্যই তাঁহার মণিগুলি চোরাই মাল হইত। চিঠির উত্তর যখন পাইলাম তাহার পর হইতে যথাসথানে কোটেশন-মাকৰ্ণ দিতে আর কাপণ্য করি নাই। এটুকু বেশ বোঝা গেল, নববধ বাংলা ভাষাটি বেশ জানেন। তাঁহার চিঠিতে বানান-ভুল ছিল কি না তাহার উপযুক্ত বিচারক আমি নই, কিন্তু সাহিত্যবোধ ও ভাষাবোধ না থাকিলে এমন চিঠি লেখা যায় না, সেটুকু আন্দাজে বঝিতে পারি। সল্লীর বিদ্যা দেখিয়া সৎস্বামীর যতটুকু গব ও আনন্দ হওয়া উচিত তাহা আমার হয় নাই এমন কথা বলিলে আমাকে অন্যায় অপবাদ দেওয়া হইবে, কিন্তু তারই সঙ্গে একটা অন্য ভাবও ছিল। সে ভাবটুকু উচ্চদরের না হইতে পারে; কিন্তু স্বাভাবিক। মশকিল এই যে, যে উপায়ে আমার বিদ্যার পরিচয় দিতে পারিতাম সেটা বালিকার পক্ষে দগম। সে যেটুকু ইংরাজি জানে তাহাতে বাক-মেকলের ছাঁদের চিঠি তাহার উপরে চালাইতে হইলে মশা মারিতে কামান দাগা হইত—মশার কিছুই হইত না, কেবল ধোওয়া এবং আওয়াজই সার হইত। আমার যে তিনটি প্রাণের বন্ধ ছিল তাহাদিগকে আমার স্মীর চিঠি না দেখাইয়া থাকিতে পারিলাম না। তাহারা আশ্চর্য হইয়া কহিল, “এমন সত্নী পাইয়াছ, ইহা তোমার ভাগ্য।” অর্থাৎ, ভাষান্তরে বলিতে গেলে এমন সীর উপযন্ত স্বামী আমি নই। নিঝরিণীর নিকট হইতে পরোত্তর পাইবার পবেই যে ক’খানি চিঠি লিখিয়া ফেলিয়াছিলাম তাহাতে হাদয়োচ্ছনাস যথেষ্ট ছিল, কিন্তু বানান-ভুলও নিতান্ত অলপ ছিল না । সতক হইয়া লেখা যে দরকার তাহা তখন মনেও করি নাই। সতক হইয়া লিখিলে বানান-ভুল হয়তো কিছু কম পড়িত, কিন্তু হৃদয়োচ্ছাসটাও মারা যাইত। এমন অবস্থায় চিঠির মধ্যস্যতা ছাড়িয়া মোকাবিলায় প্রেমালাপই নিরাপদ । সতরাং, বাবা আপিসে গেলেই আমাকে কালেজ পালাইতে হইত। ইহাতে আমাদের উভয় পক্ষেরই পাঠচচায় যে ক্ষতি হইত আলাপচর্চায় তাহা সদস্যন্ধ পোষণ করিয়া লইতাম। বিশ্বজগতে যে কিছুই একেবারে নস্ট হয় না, এক আকারে যাহা ক্ষতি অন্য আকারে তাহা লাভ– বিজ্ঞানের এই তথ্য প্রেমের পরীক্ষাশালায় বারবার যাচাই করিয়া লইয়া একেবারে নিঃসংশয় হইয়াছি । – এমন সময়ে আমার শীর জাঠতুত বোনের বিবাহকাল উপস্থিত—আমরা তো যথানিয়মে আইবড়োভাত দিয়া খালাস, কিন্তু আমার মন্ত্রী নেহের আবেগে এক नृत्रहङ्गण 8పిపి कर्गवठा ब्रध्ना कब्रिव्रा नाण कागज नाण कर्माण मिग्ना निषिब्रा ठाशत्र छजिनौक ना পাঠাইয়া থাকিতে পারিল না। সেই রচনাটি কেমন করিয়া বাবার হস্তগত হইল। বাবা তাহার বধমাতার কবিতায় রচনানৈপুণ্য সম্ভাবসৌন্দৰ্য প্রসাদগণ প্রাঞ্জলতা ইত্যাদি শাসসন্মত নানা গণের সমাবেশ দেখিয়া অভিভূত হইয়া গেলেন। তাঁহার বন্ধ বন্ধদিগকে দেখাইলেন, তাহারাও তামাক টানিতে টানিতে বলিলেন, “খাসা হইয়াছে!” নববধর যে রচনাশক্তি আছে, এ কথা কাহারও অগোচর রহিল না। হঠাৎ এইরূপ খ্যাতিবিকাশে রচয়িত্রীর কণমাল এবং কপোলম্বয় অরণবণ হইয়া উঠিয়াছিল ; অভ্যাসরুমে তাহা বিলুপ্ত হইল। পবেই বলিয়াছি, কোনো জিনিস একেবারে বিলুপ্ত হয় না— কী জানি, লজার আভাটাকু তাহার কোমল কপোল ছাড়িয়া আমার কঠিন হদয়ের প্রচ্ছন্ন কোণে হয়তো আশ্রয় লইয়া থাকিবে। কিন্তু তাই বলিয়া স্বামীর কতব্যে শৈথিল করি নাই। অপক্ষপাত সমালোচনার স্বারা সন্ত্রীর রচনার দোষ সংশোধনে আমি কখনোই আলস্য করি নাই। বাবা তাহাকে নিবিচারে যতই উৎসাহ দিয়াছেন, আমি ততই সতকাতার সহিত কটি নির্দেশ করিয়া তাহাকে যথোচিত সংযত করিয়াছি। আমি ইংরাজি বড়ো বড়ো লেখকের লেখা দেখাইয়া তাহাকে অভিভূত করিতে ছাড়ি নাই। সে কোকিলের উপর একটা-কী লিখিয়াছিল, আমি শেলির সকাইলাক ও কাঁটসের নাইটিগেল শনাইয়া তাহাকে একপ্রকার নীরব করিয়া দিয়াছিলাম। তখন বিদ্যার জোরে আমিও যেন শেলি ও কাঁটসের গৌরবের কতকটা ভাগী হইয়া পড়িতাম। আমার সাঁও ইংরাজি সাহিত্য ভালো ভালো জিনিস তাহাকে তজমা করিয়া শনাইবার জন্য আমাকে করিত, আমি গবের সহিত তাহার অনুরোধ রক্ষা করিতাম। তখন ইংরাজি नाश्टिछाब्र प्रशिधाग्न छैच्छदल झऐल्ला छेठेिग्ना आभाग्न न्छौद्ध धर्माऊछारक कि प्लान काव्र माई। পীলোকের কমনীয়তার পক্ষে এই একটা ছায়ার আচ্ছাদন দরকার, বাবা এবং বন্ধ:বাধবেরা তাহা বকিতেন না-কাজেই আমাকে এই কঠোর কতব্যের ভার লইতে হইয়াছিল। নিশীথের চন্দ্র মধ্যাহের সর্যের মতো হইয়া উঠিলে দুই দণ্ড বাহবা দেওয়া চলে, কিন্তু তাহার পরে ভাবিতে হয়, ওটাকে ঢাকা দেওয়া যায় কী উপায়ে। আমার পল্লীর লেখা বাবা এবং অন্যান্য অনেকে কাগজে ছাপাইতে উদ্যত হইয়াছিলেন। নিঝরিণী তাহাতে লজাপ্রকাশ করিত-আমি তাহার সে লজা রক্ষা করিয়াছি। কাগজে ছাপিতে দিই নাই, কিন্তু বন্ধবোন্ধবদের মধ্যে প্রচার বন্ধ করিতে পারা গেল না। ইহার কুফল যে কতদর হইতে পারে, কিছুকাল পরে তাহার পরিচয় পাইয়াছিলাম। তখন উকিল হইয়া আলিপরে বাহির হই। একটা উইল-কেস লইয়া বিরদ্ধে পক্ষের সঙ্গে খাব জোরের সহিত লড়িতেছিলাম। উইলটি বাংলায় লেখা। স্বপক্ষের অনকেলে তাহার অর্থ যে কিরাপ স্পষ্ট তাহা বিধিমতে প্রমাণ করিতেছিলাম, এমন সময় বিরোধী পক্ষের উকিল উঠিয়া বলিলেন, “আমার বিবান ফখ যদি তাঁহার বিদষী শাঁর কাছে এই উইলটি ববিয়া লইয়া আসিতেন তবে এমন অভূত ব্যাখ্যা স্বারা মাতৃভাষাকে ব্যথিত করিয়া তুলিতেন না।” চুলায় আগন ধরাইবার বেলা ফ দিতে দিতে মাকের জলে চোখের জলে হইতে চুয়, কিন্তু গহদাহের আগন নেবানোই দায়। লোকের ভালো কথা চাপা থাকে, আর 6:00 গল্পগুচ্ছ অনিষ্টকর কথাগুলো মুখে মুখে হরহয় শব্দে ব্যাপ্ত হইয়া যায়। এ গল্পটিও সবত্র প্রচারিত হইল। ভয় হইয়াছিল, পাছে আমার পল্লীর কানে ওঠে। সৌভাগ্যক্রমে ওঠে নাই– অন্তত এ সম্বন্ধে তাহার কাছ হইতে কোনো আলোচনা কখনও শনি নাই। একদিন একটি অপরিচিত ভদ্রলোকের সহিত আমার পরিচয় হইতেই তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনিই কি শ্রীমতী নিঝরিণী দেবীর স্বামী।” আমি কহিলাম, “আমি তাঁহার স্বামী কি না, সে কথার জবাব দিতে চাহি না, তবে তিনিই আমার সী বটেন।” বাহিরের লোকের কাছে সন্ত্রীর স্বামী বলিয়া খ্যাতিলাভ করা আমি গৌরবের বিষয় বলিয়া জ্ঞান করি নাই । সেটা যে গৌরবের বিষয় নহে, সে কথা আমাকে আর-এক ব্যক্তি অনাবশ্যক পষ্ট ভাষায় স্মরণ করাইয়া দিয়াছিল। পবেই পাঠকগণ সংবাদ পাইয়াছেন, আমার স্মীর জাঠতুত বোনের বিবাহ হইয়াছে। তাহার স্বামীটা অত্যন্ত ববীর দুবৰ্ত্তি। সন্ত্রীর প্রতি তাহার অত্যাচার অসহ্য। আমি এই পাষণ্ডের নিদয়াচরণ লইয়া আত্মীয়সমাজে আলোচনা করিয়াছিলাম, সে কথা অনেক বড়ো হইয়া তাহার কানে উঠিয়াছিল। সে তাহার পর হইতে আমার প্রতি লক্ষ করিয়া সকলের কাছে বলিয়া বেড়াইতেছে যে, নিজের নামে হইতে আরম্ভ করিয়া শবশরের নামে পর্যন্ত উত্তম-মধ্যম-অধম অনেকরকম খ্যাতির বিবরণ শাস্ত্রে লিখিয়াছে, কিন্তু নিজের সীর খ্যাতিতে যশস্বী হওয়ার কলপনা কবির মাথাতেও আসে নাই । এমন-সব কথা লোকের মুখে মুখে চলিতে আরম্ভ করিলে স্মীর মনে তো দম্ভ জমিতেই পারে। বিশেষত বাবার একটা বদ অভ্যাস ছিল, নিঝরিণীর সামনেই তিনি আমাদের পরস্পরের বাংলাভাষাজ্ঞান লইয়া কৌতুক করিতেন। একদিন তিনি বলিলেন, “হরিশ যে বাংলা চিঠিগুলো লেখে তাহার বানানটা তুমি দেখিয়া দাও-না কেন, বউমা। আমাকে এক চিঠি লিখিয়াছে, তাহাতে সে জগদিন্দু লিখিতে দীঘ ঈ বসাইয়াছে।” শনিয়া বাবার বউমা নীরবে একটুখানি স্মিতহাস্য করিলেন। আমিও কথাটাকে ঠাট্টা বলিয়া হাসিলাম, কিন্তু এরকম ঠাট্রা ভালো নয়। সল্লীর দম্ভের পরিচয় পাইতে আমার দেরি হইল না। পাড়ার ছেলেদের এক ক্লাব আছে; সেখানে একদিন তাহারা এক বিখ্যাত বাংলা-লেখককে বস্তৃতা দিতে রাজি করিয়াছিল। অপর একটি বিখ্যাত লোককে সভাপতিও ঠিক করা হয়; তিনি বস্তৃতার পরবরাত্রে অস্বাস্থ্য জানাইয়া ছটি লইলেন। ছেলেরা উপায়ান্তর না দেখিয়া আমাকে আসিয়া ধরিল। আমার প্রতি ছেলেদের এই অহৈতুকী শ্রদ্ধা দেখিয়া আমি কিছর প্রফুল্ল হইয়া উঠিলাম। বলিলাম, “তা বেশ তো, বিষয়টা কী বলো তো।” তাহারা কহিল, “প্রাচীন ও আধুনিক বঙ্গসাহিত্য।” পরদিন সভায় যাইবার পাবে জলখাবার এবং কাপড়চোপড়ের জন্য স্মীকে কিছ তাড়া দিতে লাগিলাম। নিঝরিণী কহিল, “কেন গো, এত ব্যস্ত কেন— আবার কি পাত্রী দেখিতে যাইতেছ।” – আমি কহিলাম, “একবার দেখিয়াই নাকে-কানে খত দিয়াছি; আর নয়।” “তবে এত সাজসজ্জার তাড়া যে ?” স্মীকে সগবে সমস্ত ব্যাপারটা বলিলাম। শনিয়া সে কিছমায় উল্লাস প্রকাশ मश्रृं’झक्लन्। না করিয়া ব্যাকুলভাবে আমার হাত চাপিয়া ধরিল। কহিল, “তুমি পাগল হইয়াছ ? না না, সেখানে তুমি যাইতে পারিবে না।” আমি কহিলাম, “রাজপত-নারী যন্ধসাজ পরাইয়া স্বামীকে রণক্ষেত্রে পাঠাইরা দ্বিত—আর বাঙালির মেয়ে কি বস্তৃতাসভাতেও পাঠাইতে পারে না।” নিঝরিণী কহিল, “ইংরাজি বস্তৃতা হইলে আমি ভয় করিতাম না, কিন্তু— থাক-না, অনেক লোক আসিবে, তোমার অভ্যাস নাই—শেষকালে—” শেষকালের কথাটা আমিও কি মাঝে মাঝে ভাবি নাই। রামমোহন রায়ের গানটা মনে পড়িতেছিল— মনে করো শেষের সে দিন ভয়ংকর অন্যে বাক্য কবে কিন্তু তুমি রবে নিরক্তের। বক্তার বস্তৃতা-অন্তে উঠিয়া দড়িাইবার সময় সভাপতি যদি হঠাৎ দুটিহীন নাড়ীক্ষীণ হিমকলেবর অবস্থায় একেব্লারে নিরক্তর হইয়া পড়েন তবে কী গতি হইবে। এই-সকল কথা চিন্তা করিয়া পাবোন্ত পলাতক সভাপতিমহাশয়ের চেয়ে আমার বাস্থ্য যে কোনো অংশে ভালো ছিল, এমন কথা আমি বলিতে পারি না। বকে ফলাইয়া স্মীকে কহিলাম, “নিঝর, তুমি কি মনে কর—” সল্লী কহিল, “আমি কিছই মনে করি না, কিন্তু আমার আজ ভারি মাথা ধরিয়া আসিয়াছে, বোধ হয় জবর আসিবে, তুমি আজ আমাকে ফেলিয়া যাইতে পারিবে না।” আমি কহিলাম, “সে আলাদা কথা। তোমার মুখটা একট লাল দেখাইতেছে বটে।” সেই লালট সভাস্থলে আমার দরবস্থা কল্পনা করিয়া লজ্জায়, অথবা আসন্ন জনরের আবেশে, সে কথা নিঃসংশয়ে পৰ্যালোচনা না করিয়াই আমি ক্লাবের সেক্রেটারিকে দীর পীড়ার কথা জানাইয়া নিম্প্রকৃতিলাভ করিলাম। বলা বাহুল্য, স্মীর জরভাব অতি সত্বর ছাড়িয়া গেল। আমার অন্তরাত্মা কহিতে লাগিল, আর সব ভালো হইল, কিন্তু তোমার বাংলা বিদ্যা সম্বন্ধে তোমার সন্ত্রীর মনে এই-ষে সংস্কার, এটা ভালো নয়। তিনি নিজেকে মস্ত বিদুষী বলিয়া ঠাওরাইয়াছেন— কোনদিন-বা মশারির মধ্যে নাইট-স্কুল খালিয়া তিনি তোমাকে বাংলা পড়াইবার চেষ্টা করিবেন।’ – আমি কহিলাম, ঠিক কথা। এই বেলা দপ চণ না করিলে ক্ৰমে আর তাহার নাগাল পাওয়া যাইবে না।’ * সেই রাত্রেই তাহার সঙ্গে একটা খিটিমিটি বাধাইলাম। অল্পশিক্ষা যে কিরাপ ভয়ংকর জিনিস, পোপের কাব্য হইতে তাহার উদাহরণ উদ্ধার করিয়া তাহাকে শনাইলাম। ইহাও বুঝাইলাম, কোনোমতে বানান এবং ব্যাকরণ বাঁচাইয়া লিখিলেই যে লেখা হইল তাহা নহে— আসল জিনিসটা হইতেছে আইডিয়া। কাশিয়া বলিলাম, সেটা উপক্ৰমণিকায় পাওয়া যায় না, সেটার জন্য মাথা চাই।” মাথা যে কোথায় আছে সে কথা তাহাকে স্পষ্ট করিয়া বলি নাই, কিন্তু তব বোধ হয়, কথাটা অপটি ছিল না। আমি কহিলাম, “লিখিবার যোগ্য কোনো লেখা কোনো দেশে কোনোদিন কোনো ম্মীলোক লেখে নাই।” – শনিয়া নিঝরিণীর মেয়েলি তাকিকতা চড়িয়া উঠিল। সে বলিল, “কেন মেয়েরা লিখিতে পারবে না। মেয়েরা এতই কি হীন।” चाभ कर्णाश्णाभ, “ब्राण कौब्रम्ला कौ कीब्रत्य। मोन्ठ हनथाe-ना।” আমি ঢের দশটাত দেখাইতে পারিতাম।” এ কথাটা শনিয়া আমার মন একটা নরম হইয়াছিল, কিন্তু তক এইখানেই শেষ হয় নাই। ইহার শেষ যেখানে সেটা পরে বণনা করা যাইতেছে। উদ্দীপনা বলিয়া মাসিক পত্রে ভালো গল্প লিখিবার জন্য পঞ্চাশ টাকা পরস্পকার ঘোষণা করিয়াছিল। কথা এই স্থির হইল, আমরা দুইজনেই সেই কাগজে দুটা গল্প লিখিয়া পাঠাইব, দেখি কাহার ভাগ্যে পুরস্কার জোটে। রাত্রের ঘটনা তো এই। পরদিন প্রভাতের আলোকে বন্ধি যখন নিম’ল হইয়া আসিল তখন বিধা জমিতে লাগিল। কিন্তু প্রতিজ্ঞা করিলাম, এ অবসর ছাড়িয়া দেওয়া হইবে না; যেমন করিয়া হউক, জিতিতেই হইবে। হাতে তখনও দই মাস मञझ झिल्न । o প্রকৃতিবাদ অভিধান কিনিলাম; বকিমের বইগলোও সংগ্রহ করিলাম। কিন্তু বঙ্কিমের লেখা আমার চেয়ে আমার অন্তঃপরে অধিক পরিচিত, তাই সে মহদাশ্রয় পরিত্যাগ করিতে হইল। ইংরাজি গল্পের বই দেদার পড়িতে লাগিলাম। অনেকগলো গল্প ভাঙিয়া-চুরিয়া একটা প্লট দাঁড় করাইলাম। প্লটটা খুবই চমৎকার হইয়াছিল, কিন্তু মশকিল এই হইল, বাংলা-সমাজে সে-সকল ঘটনা কোনো অবস্থাতেই ঘটিতে পারে না। অতিপ্রাচীনকালের পাঞ্জাবের সীমান্তদেশে গলে্পর ভিত্তি ফাঁদলাম; সেখানে সম্ভব-অসম্ভবের সমস্ত বিচার একেবারে নিরাকৃত হওয়াতে কলমের মাখে কোনো বাধা রহিল না। উন্দাম প্রণয়, অসম্ভব বীরত্ব, নিদারণে পরিণাম, সাকাসের ঘোড়ার মতো আমার গল্প ঘিরিয়া অভূত গতিতে ঘুরিতে লাগিল। রাত্রে আমার ঘমে হইত না; দিনে আহারকালে ভাতের থালা ছাড়িয়া মাছের কোলের বাটিতে ডাল ঢালিয়া দিতাম। আমার অবস্থা দেখিয়া নিঝরিণী আমাকে অননের করিয়া বলিল, “আমার মাথা খাও, তোমাকে আর গল্প লিখিতে হইবে না— আমি হার মানিতেছি।” আমি উত্তেজিত হইয়া বলিলাম, “তুমি কি মনে করিতেছ, আমি দিনরারি কেবল গলপ ভাবিয়াই মরিতেছি। কিছুই না। আমাকে মক্কেলের কথা ভাবিতে হয়—তোমার মতো গলপ এবং কবিতা চিন্তা করিবার অবসর পড়িয়া থাকিলে আমার ভাবনা কণী । झिल ।” যাহা হউক, ইংরাজি পলট এবং সংস্কৃত অভিধানে মিলাইয়া একটা গল্প খাড়া করিলাম। মনের কোণে ধমাবধিতে একট পীড়াবোধ করিতে লাগিলাম— ভাবিলাম, বেচারা নিঝর ইংরাজি সাহিত্য পড়ে নাই, তাহার ভাব সংগ্ৰহ করিবার ক্ষেত্র সংকীর্ণ; আমার সঙ্গে তাহার এই লড়াই নিতান্ত অসমকক্ষের লড়াই। উপসংহার লেখা পাঠানো হইয়াছে। বৈশাখের সংখ্যায় পরস্পকারযোগ্য গল্পটি বাহির হইবে। যদিও আমার মনে কোনো আশঙ্কা ছিল না, তব সময় যত নিকটবতী হইল মনটা তত मृत्र’एभ्रूण  शहैझा छैर्मठेल । বৈশাখ মাসও আসিল । একদিন আদালত হইতে সকাল-সকাল ফিরিয়া আসিয়া খবর পাইলাম, বৈশাখের উদ্দীপনা আসিয়াছে, আমার স্মী তাঁহা পাইয়াছে। ধীরে ধীরে নিঃশব্দপদে অন্তঃপারে গেলাম। শয়নঘরে উকি মারিয়া দেখিলাম, আমার সন্ত্রী কড়ায় আগমন করিয়া একটা বই পড়াইতেছে। দেয়ালের আয়নায় নিঝরিণীর মুখের যে প্রতিবিম্ব দেখা যাইতেছে তাহাতে পাট বাঝা গেল, কিছ পবে সে অশ্রবষণ করিয়া লইয়াছে। • মনে আনন্দ হইল, কিন্তু সেইসঙ্গে একট দয়াও হইল। আহা, বেচারার গল্পটি উদ্দীপনায় বাহির হয় নাই। কিন্তু এই সামান্য ব্যাপারে এত দুঃখ! সীলোকের অহংকারে এত অপেই ঘা পড়ে। আবার আমি নিঃশব্দপদে ফিরিয়া গেলাম। উদ্দীপনা-আপিস হইতে নগদ দাম দিয়া একটা কাগজ কিনিয়া আনাইলাম। আমার লেখা বাহির হইয়াছে কি না দেখিবার জন্য কাগজ খলিলাম। সচিপত্রে দেখিলাম, পরস্কারযোগ্য গল্পটির নাম বিক্রমনারায়ণ নহে, তাহার নাম “ননদিনী’, এবং তাহার রচয়িতার নাম—এ কী ! এ যে নিঝরিণী रझदौ ! বাংলাদেশে আমার সন্ত্রী ছাড়া আর কাহারও নাম নিঝরিণী আছে কি। গল্পটি খলিয়া পড়িলাম। দেখিলাম, নিঝরের সেই হতভাগিনী জাঠতুত বোনের বক্তাতটিই ডালপালা দিয়া বর্ণিত। একেবারে ঘরের কথা-সাদা ভাষা, কিন্তু সমস্ত ছবির মতো চোখে পড়ে এবং চক্ষ জলে ভরিয়া যায়। এ নিঝরিণী যে আমারই নিবার তাহাতে भएअश्। नाइँ । – তখন আমার শয়নঘরের সেই দাহদশ্য এবং ব্যথিত রমণীর সেই লান মাখ অনেকক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া বসিয়া ভাবিতে লাগিলাম। – রাত্রে শইতে আসিয়া সন্ত্রীকে বলিলাম, “নিঝর, ষে খাতায় তোমার লেখাগুলি আছে সেটা কোথায় ।” নিঝরিণী কহিল, “কেন, সে লইয়া তুমি কী করবে।” আমি কহিলাম, “আমি ছাপিতে দিব।” নিঝরিণী। আহা, আর ঠাট্টা করিতে হইবে না। আমি। না, ঠাট্টা করিতেছি না। সত্যই ছাপিতে দিব। নিঝরিণী। সে কোথায় গেছে, আমি জানি না। আমি কিছ: জেদের সঙ্গেই বলিলাম, “না নিবার, সে কিছতেই হইবে না। বলো, সেটা কোথায় আছে।” – নিঝরিণী কহিল, “সত্যই সেটা নাই।” अभि । रकन, कौं श्ञ । নিঝরিণী। সে আমি পাড়াইয়া ফেলিয়াছি। আমি চমকিয়া উঠিয়া কহিলাম, “অ্যাঁ, সে কী! কবে পড়াইলে।” নিঝরিণী। আজই পড়াইয়াছি। আমি কি জানি না যে, আমার লেখা ছাই লেখা। স্মীলোকের রচনা বলিয়া লোকে মিথ্যা করিয়া প্রশংসা করে। . &08 গল্পগুচ্ছ ইহার পর হইতে এ পর্যন্ত নিঝরকে সাধ্যসাধনা করিয়াও একছত্ৰ লিখাইতে পারি নাই। ইতি শ্ৰীহরিশ্চন্দ্র হালদার। উপরে যে গল্পটি লেখা হইয়াছে উহার পনেরো-আনাই গল্প। আমার পরামী যে বাংলা কত অলপ জানেন, তাহা তাঁহার রচনীত উপন্যাশটি পড়িলেই কাহারো বুঝিতে বাকি থাকিবে না। ছিছি নিজের দিকে লইয়া এমনি করিয়া কি গল্প বানাইতে হয় ? ইতি শ্ৰীনিঝরিনি দেবী। সন্ত্রীলোকের চাতুরী সম্বন্ধে দেশী-বিদেশী শাস্ত্ৰে-অশাস্ত্রে অনেক কথা আছে– তাহাই স্মরণ করিয়া পাঠকেরা ঠকিবেন না। আমার রচনাটুকুর ভাষা ও বানান কে সংশোধন করিয়া দিয়াছেন, সে কথা আমি বলিব না-না বলিলেও বিজ্ঞ পাঠক অনুমান করিতে পরিবেন। আমার স্ত্রী যে কয়-লাইন লিখিয়াছেন তাহার বানান-ভুলগুলি দেখিলেই পাঠক বুঝিবেন, সেগুলি ইচ্ছাকৃত; তাঁহার স্বামী যে বাংলায় পরমপণ্ডিত এবং গলপটা যে আষাঢ়ে, ইহাই প্রমাণ করিবার এই অতি সহজ উপায় তিনি বাহির করিয়াছেন– এইজন্যই কালিদাস লিখিয়াছেন, সাণামশিক্ষিতপটত্বম । তিনি সীচরিত্র বঝিতেন। আমিও সম্প্রতি চোখ-ফোটার পর হইতে বঝিতে শরে করিয়াছি। কালে হয়তো কালিদাস হইয়া উঠিতেও পারিব। কালিদাসের সঙ্গে আরও একটা সাদৃশ্য দেখিতেছি। শনিয়াছি, কবিবর নববিবাহের পর তাঁহার বিদুষী সীকে যে শেলাক রচনা করিয়া শোনান তাহাতে উল্ট্রশব্দ হইতে র-ফলাটা লোপ করিয়াছিলেন— শব্দপ্রয়োগ সম্বন্ধে এরপ দীঘটনা বর্তমান লেখকের বারাও অনেক ঘটিয়াছে— অতএব, সমস্ত গভীরভাবে পর্যালোচনা করিয়া আশা হইতেছে, কালিদাসের যেরপে পরিণাম হইয়াছিল আমার পক্ষেও তাহা অসম্ভব নহে। ইতি শ্রীহঃ এ গল্প যদি ছাপানো হয়, আমি বাপের বাড়ি চলিয়া যাইব । শ্ৰীমতী নিঃ আমিও তৎক্ষণাৎ শ্বশুরবাড়ি যাত্রা করিব।

শ্রীহঃ ফালগন ১৩০৯

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত