আমার প্রতিবেশিনী বালবিধবা। যেন শরতের শিশিরাপ্লুত শেফালির মতো বন্তচ্যুত ; কোনো বাসরগৃহের ফুলশয্যার জন্য সে নহে, সে কেবল দেবপুজার জন্যই উৎসর্গ-করা ।
তাহাকে আমি মনে মনে পূজা করিতাম। তাহার প্রতি আমার মনের ভাবটা যে কী ছিল পুজা ছাড়া তাহা অন্য কোনো সহজ ভাষায় প্রকাশ করিতে ইচ্ছা করি না— পরের কাছে তো নয়ই, নিজের কাছেও না ।
আমার অন্তরঙ্গ প্ৰিয়বন্ধ নবীনমাধব, সেও কিছু জানিত না। এইরূপে এই-যে আমার গভীরতম আবেগটিকে গোপন করিয়া নিমাল করিয়া রাখিয়াছিলাম, ইহাতে আমি কিছু গর্ব অনুভব করিতাম।
কিন্তু মনের বেগ পার্বতী নদীর মতো নিজের জন্মশিখরে আবদ্ধ হইয়া থাকিতে চাহে না। কোনো-একটা উপায়ে বাহির হইবার চেষ্টা করে । অকৃতকার্য হইলে বক্ষের মধ্যে বেদনার সৃষ্টি করিতে থাকে। তাই ভাবিতেছিলাম, কবিতায় ভাব প্রকাশ করিব। কিন্তু কুণ্ঠিতা লেখনী কিছুতেই অগ্রসর হইতে চাহিল না।
পরমাশচর্য্যের বিষয় এই যে, ঠিক এই সময়েই আমার বন্ধু নবীনমাধবের অকস্মাৎ বিপুল বেগে কবিতা লিখিবার ঝোঁক আসিল, যেন হঠাৎ ভূমিকম্পের মতো।
সে বেচারার এরূপে দৈববিপত্তি পাবে কখনও হয় নাই, সুতরাং সে এই অভিনব আন্দোলনের জন্য লেশমাত্র প্রস্তুত ছিল না। তাহার হাতের কাছে ছন্দ মিল কিছুরই জোগাড় ছিল না, তবু সে দমিল না দেখিয়া আশ্চর্য হইয়া গেলাম। কবিতা যেন বদ্ধ বয়সের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর মতো তাহাকে পাইয়া বসিল। নবীনমাধব ছন্দ মিল সম্বন্ধে সহায়তা ও সংশোধনের জন্য আমার শরণাপন্ন হইল।
কবিতার বিষয়গুলি নূতন নহে ; অথচ পুরাতনও নহে। অর্থাৎ তাহাকে চিরনূতনও বলা যায়, চিরপুরাতন বলিলেও চলে। প্রেমের কবিতা, প্রিয়তমার প্রতি । আমি তাহাকে একটা ঠেলা দিয়া হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “কে হে, ইনি কে।”
নবীন হাসিয়া কহিল, “এখনও সন্ধান পাই নাই।”
নবীন রচয়িতার সহায়তাকাযে আমি অত্যন্ত আরাম পাইলাম। নবীনের কাল্পনিক প্রিয়তমার প্রতি আমার রুদ্ধ আবেগ প্রয়োগ করিলাম। শাবকহীন মুরগি যেমন হাঁসের ডিম পাইলেও বুক পাতিয়া তা দিতে বসে, হতভাগ্য আমি তেমনি নবীনমাধবের ভাবের উপরে হৃদয়ের সমস্ত উত্তাপ দিয়া চাপিয়া বসিলাম। আনাড়ির লেখা এমনি প্রবল বেগে সংশোধন করিতে লাগিলাম যে, প্রায় পনেরো-আনা আমারই লেখা দাঁড়াইল।
নবীন বিস্মিত হইয়া বলে, “ঠিক এই কথাই আমি বলিতে চাই, কিন্তু বলিতে পারি না। অথচ তোমার এ-সব ভাব জোগায় কোথা হইতে।” ।
আমি কবির মতো উত্তর করি, “কল্পনা হইতে। কারণ, সত্য নীরব, কল্পনাই মুখরা। সত্য ঘটনা ভাবস্রোতকে পাথরের মতো চাপিয়া থাকে, কল্পনাই তাহার পথ মুক্ত করিয়া দেয়।”
নবীন গভীর মখে একটখানি ভাবিয়া কহিল, “তাই তো দেখিতেছি। ঠিক বটে।” আবার খানিকক্ষণ ভাবিয়া বলিল, “ঠিক, ঠিক।” পবেই বলিয়াছি আমার ভালোবাসার মধ্যে একটি কাতর সংকোচ ছিল, তাই নিজের জবানিতে কোনোমতে লিখিতে পারিলাম না। নবীনকে পদার মতো মাঝখানে রাখিয়া তবেই আমার লেখনী মুখ খলিতে পারিল। লেখাগুলো যেন রসে ভরিয়া উত্তাপে ফাটিয়া উঠিতে লাগিল । নবীন বলিল, “এ তো তোমারই লেখা। তোমারই নামে বাহির করি।” আমি কহিলাম, “বিলক্ষণ। এ তোমারই লেখা, আমি সামান্য একটা বদল করিয়াছি মাত্র।” ক্ৰমে নবীনেরও সেইরূপ ধারণা জন্মিল। জ্যোতিবিদ যেমন নক্ষত্রোদয়ের অপেক্ষায় আকাশের দিকে তাকাইয়া থাকে আমিও যে তেমনি মাঝে মাঝে আমাদের পাশের বাড়ির বাতায়নের দিকে চাহিয়া দেখিতাম, সে কথা অস্বীকার করিতে পারি না। মাঝে মাঝে ভক্তের সেই ব্যাকুল দটিক্ষেপ সাথকও হইত। সেই কমযোগনিরতা ব্ৰহাচারিণীর সৌম্য মুখশ্ৰী হইতে শান্তনিখ জ্যোতি প্রতিবিম্বিত হইয়া মহেতের মধ্যে আমার সমস্ত চিত্তক্ষোভ দমন করিয়া দিত। কিন্তু সেদিন সহসা এ কী দেখিলাম। আমার চন্দ্রলোকেও কি এখনও অগ্ন্যুৎপাত আছে। সেখানকার জনশন্য সমাধিমণ্ডন গিরিগুহার সমস্ত বহ্নিদাহ এখনও সম্পর্ণে নিবাণ হইযা যায় নাই কি । সেদিন বৈশাখ মাসের অপরাহ্লে ঈশান কোণে মেঘ ঘনাইয়া আসিতেছিল। সেই আসন্ন ঝঞ্জার মেঘবিচ্ছুরিত রদ্রদীপ্তিতে আমার প্রতিবেশিনী জানালায় একাকিনী দড়িাইয়া ছিল। সেদিন তাহার শনানিবিষ্ট ঘনকৃষ্ণ দটির মধ্যে কী সদরপ্রসারিত নিবিড় বেদনা দেখিতে পাইলাম। আছে, আমার ঐ চন্দ্রলোকে এখনও উত্তাপ আছে! এখনও সেখানে উষ্ণ নিশ্বাস সমীরিত। দেবতার জন্য মানুষ নহে, মানুষের জন্যই সে। তাহার সেই দলটি চক্ষর বিশাল ব্যাকুলতা সেদিনকার সেই ঝড়ের আলোকে ব্যগ্র পাখির মতো উড়িয়া চলিয়াছিল। বগের দিকে নহে, মানবহন্দয়নীড়ের দিকে। সেই উৎসক আকাঙ্ক্ষা-উদ্দীপত দটিপাতটি দেখার পর হইতে অশান্ত চিত্তকে সস্থির করিয়া রাখা আমার পক্ষে দুঃসাধ্য হইল। তখন কেবল পরের কাঁচা কবিতা সংশোধন করিয়া তৃপিত হয় না—একটা যে-কোনোপ্রকার কাজ করিবার জন্য চঞ্চলতা জন্মিল। তখন সংকল্প করিলাম, বাংলাদেশে বিধবাবিবাহ প্রচলিত করিবার জন্য আমার সমস্ত চেটা প্রয়োগ করিব। কেবল বস্তৃতা ও লেখা নহে, অথসাহায্য করিতেও অগ্রসর হইলাম। নবীন আমার সঙ্গে তক করিতে লাগিল ; সে বলিল, “চিরবৈধব্যের মধ্যে একটি পবিত্র শান্তি আছে, একাদশীর ক্ষীণ জ্যোৎস্নালোকিত সমবিভূমির মতো একটি বিরাট রমণীয়তা আছে ; বিবাহের সম্ভাবনামায়েই কি সেটা ভাঙিয়া যায় না।” এ-সব কবিত্বের কথা শুনিলেই আমার রাগ হইত। দভিক্ষে যে লোক জীৰ্ণ হইয়া মরিতেছে তাহার কাছে আহারপটে লোক যদি খাদ্যের স্থলেত্বের প্রতি ঘণা প্রতিবেশিনী Bés প্রকাশ করিয়া ফলের গন্ধ এবং পাখির গান দিয়া মমবার পেট ভরাইতে চাহে তাহা হইলে সে কেমন হয় । আমি রাগিয়া কহিলাম, “দেখো নবীন, আর্টিস্ট লোকে বলে, দশ্য হিসাবে পোড়ো বাড়ির একটা সৌন্দৰ্য আছে। কিন্তু বাড়িটাকে কেবল ছবির হিসাবে দেখিলে চলে না, তাহাতে বাস করিতে হয়, অতএব আর্টিস্ট যাহাই বলন, মেরামত আবশ্যক। বৈধব্য লইয়া তুমি তো দরে হইতে দিব্য কবিত্ব করিতে চাও, কিন্তু তাহার মধ্যে একটি আকাঙ্ক্ষাপণে মানবহৃদয় আপনার বিচিত্র বেদনা লইয়া বাস করিতেছে, সেটা সমরণ রাখা কতব্য ।” মনে করিয়াছিলাম, নবীনমাধবকে কোনোমতেই দলে টানিতে পারিব না, সেদিন সেইজন্যই কিছু অতিরিক্ত উস্মার সহিত কথা কহিয়াছিলাম। কিন্তু হঠাৎ দেখিলাম, আমার বস্তৃতা-অবসানে নবীনমাধব একটিমাত্র গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া আমার সমস্ত কথা মালিয়া লইল ; বাকি আরও অনেক ভালো ভালো কথা বলিবার অবকাশই मिळ ना । সপ্তাহখানেক পরে নবীন আসিয়া কহিল, “তুমি যদি সাহায্য কর আমি একটি বিধবাবিবাহ করিতে প্রস্তুত আছি।” এমনি খুশি হইলাম-নবীনকে বকে টানিয়া কোলাকুলি করিলাম ; কহিলাম ; “যত টাকা লাগে আমি দিব।” তখন নবীন তাহার ইতিহাস বলিল । বুঝিলাম, তাহার প্রিয়তমা কাল্পনিক নহে। কিছুকাল ধরিয়া একটি বিধবা নারীকে সে দরে হইতে ভালোবাসিত, কাহারও কাছে তাহা প্রকাশ করে নাই। যে মাসিক পত্রে নবীনের, ওরফে আমার, কবিতা বাহির হইত সেই পত্রগুলি যথাস্থানে গিয়া পেশছিত। কবিতাগুলি ব্যথ হয় নাই। বিনা সাক্ষাৎকারে চিত্ত-আকর্ষণের এই এক উপায় আমার বন্ধ বাহির করিয়াছিলেন। * কিন্তু নবীন বলেন, তিনি চক্রান্ত করিয়া এই-সকল কৌশল অবলম্বন করেন নাই। এমন-কি, তাঁহার বিশ্বাস ছিল, বিধবা পড়িতে জানেন না। বিধবার ভাইয়ের নামে কাগজগুলি বিনা বাক্ষরে বিনা মল্যে পাঠাইয়া দিতেন। এ কেবল মনকে সাত্বনা দিবার একটা পাগলামিমাত্র। মনে হইত, দেবতার উদ্দেশে পপাঞ্জলি দান করা গেল, তিনি জানন বা না জানন, গ্রহণ করন বা নাই করন। নানা ছতায় বিধবার ভাইয়ের সহিত নবীন ষে বন্ধত্ব করিয়া লইয়াছিলেন, নবীন বলেন, তাহারও মধ্যে কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। যাহাকে ভালোবাসা বায় তাহার নিকটবতী আত্মীয়ের সঙ্গ মধর বোধ হয়। অবশেষে ভাইয়ের কঠিন পীড়া উপলক্ষে ভগিনীর সহিত কেমন করিয়া সাক্ষাৎ হয় সে সদেীঘ কথা। কবির সহিত কবিতার অবলম্বিত বিষয়টির প্রত্যক্ষ পরিচয় হইয়া কবিতা সম্বন্ধে অনেক আলোচনা হইয়া গেছে। আলোচনা ষে কেবল ছাপানো কবিতা-কয়টির মধ্যেই বন্ধ ছিল তাহাও নহে। সম্প্রতি আমার সহিত তকে পরাস্ত হইয়া নবীন সেই বিধবার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া বিবাহের প্রস্তাব করিয়া বসিয়াছে। প্রথমে কিছুতেই সম্মতি পায় নাই। নবীন তখন আমার মুখের সমস্ত যুক্তিগুলি প্রয়োগ করিয়া এবং তাহার সহিত নিজের 8á象 গল্পগুচ্ছ চোখের দই-চার ফোঁটা জল মিশাইয়া তাহাকে সম্পণে হার মানাইয়াছে। এখন বিধবার অভিভাবক পিসে কিছু টাকা চায়। আমি বলিলাম, “এখনই লও।” নবীন বলিল, “তাহা ছাড়া বিবাহের পর প্রথম মাস পাঁচ-ছয় বাবা নিশ্চয় আমার মাসহারা বন্ধ করিয়া দিবেন, তখনকার মতো উভয়ের খরচ চালাইবার জোগাড় করিয়া দিতে হইবে।” आभि कथाम्नेि ना कश्झिा टळक लिथिग्ना मिलाभ । यळिालाभ, “७शन उाँशञ्च नार्भाम्ने বলো। আমার সঙ্গে যখন কোনো প্রতিযোগিতা নাই তখন পরিচয় দিতে ভয় করিয়ো না। তোমার গা ছ:ইয়া শপথ করিতেছি, আমি তাঁহার নামে কবিতা লিখিব না, এবং যদি লিখি তাঁহার ভাইকে না পাঠাইয়া তোমার কাছে পাঠাইয়া দিব।” নবীন কহিল, “আরে, সেজন্য আমি ভয় করি না। বিধবাবিবাহের লঙ্গায় তিনি অত্যন্ত কাতর, তাই তোমাদের কাছে তাঁহার সম্বন্ধে আলোচনা করিতে তিনি অনেক করিয়া নিষেধ করিয়া দিয়াছিলেন। কিন্তু এখন আর ঢাকিয়া রাখা মিথ্যা। তিনি তোমারই প্রতিবেশিনী, ১৯ নম্বরে থাকেন।” হৎপিণ্ডটা যদি লোহার বয়লার হইত তো এক চমকে ধক করিয়া ফাটিয়া যাইত। জিজ্ঞাসা করিলাম, “বিধবাবিবাহে তাঁহার অমত নাই ?” নবীন হাসিয়া কহিল, “সম্প্রতি তো নাই।” আমি কহিলাম, “কেবল কবিতা পড়িয়াই তিনি মগধ ?” নবীন কহিল, “কেন, আমার সেই কবিতাগলি তো মন্দ হয় নাই।” আমি মনে মনে কহিলাম, ধিক। ধিক কাহাকে। তাঁহাকে, না আমাকে, না বিধাতাকে ? কিন্তু ধিক।