মেয়েটার বয়স তখন ১২ । আশেপাশে তখন মেয়েদের একটাই সরকারি হাইস্কুল । সেই স্কুলেই ক্লাস সেভেনে পড়ে মেয়েটা । পড়াশোনায় আগাগোড়াই মন নেই । চোখে একরাশ স্বপ্ন একদিন মস্ত বড়ো গাইয়ে হবো । কিন্তু তার মত গ্রামের এক সাধারন কৃষকের ঘরের মেয়ে কে গান শেখাবেই বা কে ? কতবার গ্রামে যাত্রা পালায় গান শুনতে গিয়ে বাড়ির লোকের কাছে কত বোকাঝকা শুনেছে । তাই মনে সুপ্ত একরাশ ইচ্ছা নিয়েই অভাবের মধ্যে দিয়ে বড় হচ্ছিল সে । নামটাই তো বলা হলো না ! মেয়েটির নাম দীপা ।
দিনটা ছিল দূর্গাপুজোর অষ্টমী । প্রত্যেকবারের মতো এ বছরেও গ্রামের পুজোর প্যান্ডেলে অঞ্জলী দিতে গেছে দীপা । সেখানে ওর পরিচয় হলো গ্রামেরই একটা ছেলে অপুর সাথে ।
এবার বলি অপুর কথা । গ্রামের ছেলেদের হাইস্কুলের ক্লাস নাইনের ছাত্র অপু । অত্যন্ত মেধাবী একটি ছাত্র সে । বাড়ির আর্থিক অবস্থাও যথেষ্ট সচ্ছল । বলতে গেলে দীপার জীবনের থেকে অনেকটা আলাদা ছিল তার জীবন । আর তাদের দুই বাড়ির মধ্যেও সম্পর্ক খুব একটা ভালো ছিলোনা ।
এরপর থেকে শুরু হলো দুজনের বন্ধুত্ব । যেহেতু দুজনের বাড়ির মধ্যে খুব দূরত্ব ছিল না তাই তাদের অনেকটা সময়ই এক সাথে কাটতো । স্কুল যাওয়া আসা হত একসাথেই । দুজনের স্কুলও ছিল প্রায় পাশাপাশিই । বিকেলে ক্ষেতের আল দিয়ে ঘুরে বেড়াত উচ্ছসিত দুটি প্রাণ । গ্রামের পরিবেশ যেন তাদের বন্ধুত্বকে এক আলাদাই রূপ দিয়েছিল । দিনের পর দিন গভীর হচ্ছিল তাদের সম্পর্ক । একে অপরকে সব কিছু না বলে থাকতে পারতোনা ।
তাদের এই বন্ধুত্ব অজান্তেই প্রেমে পরিণত হতে খুব বেশী দেরি হলো না । কিন্তু কেউই সেটা প্রকাশ করতে পারলোনা । যদি এই প্রেম তাদের দূরত্ব বাড়িয়ে দেয় কখনো? ঐ একটাই ভয় । তাছাড়া বাড়িতে কখনই মানবে না তাদের । যদি শেষে গিয়ে পরিস্থিতি তাদের হাত দুটো আলাদা করে দেয়? তাই দুজনেই একে অপরকে প্রেমের কথা বলতে সাহস পায়নি কখনো । এভাবেই চলতে থাকল তাদের জীবন । এদিকে অপু উচ্চমাধ্যমিক দিলো আর দীপা মাধ্যমিক । দীপার খুব ভালো ফল এলো না । আগেই বলেছি ওর পড়াশোনায় বিশেষ মন নেই । যাই হোক এবার অপুর রেজাল্ট । কদিন পরেই ফলপ্রকাশ হল । গ্রামের মধ্যে প্রথম হলো অপু । সবাই খুব খুশি । দীপাও আজ খুব খুশি হয়েছে তার অপুর এই সাফল্যের খবর পেয়ে ।
কিন্তু সেই আনন্দ মুহুর্তে ম্লান হয়ে গেলো যখন অপু এসে বললো এবার তাকে যেতে হবে শহরে ডাক্তারি পড়তে । বাড়ির সবার এবং তার নিজের সেই ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন ডাক্তার হওয়ার । দীপা তার দুঃখ প্রকাশ না করে অপু কে উৎসাহ দিল । মনখারাপ হলেও সব সময় হাসিখুশি থাকত সে । অপু কে কখনো বুঝতেই দেয়নি কিছু । বরং অপুর মনখারাপ হলে সান্তনা দিয়েছে সে । এভাবে চলে গেল কিছুদিন ।শহরে চলে গেলো অপু । কথা দিয়ে গেলো ফিরে আসবে একদিন আবার দীপার কাছে ।
দিন গুনতে গুনতে দুটো বছর কেটে গেলো। দীপা উচ্চমাধ্যমিক পাস করল কোনো রকমে । এবার শুরু হলো তার জন্য পাত্র দেখা । কারন একটা গ্রামের কৃষিজীবী পরিবারের মেয়ের এর চেয়ে বেশী অবিবাহিত থাকা যে দৃষ্টিকটু । সেই গ্রামে এতদূরই বা পরে কোন মেয়েটা ! দীপা কিছু বলতেও পারেনি কাউকে । কারন সে জানেনা তার অপু এখনো তার আছে কি না । তবে বিশ্বাসটা তখনো অক্ষুণ্ণ ছিল তার । যাই হোক শুভদিনে তার বিয়ের কথা পাকা হলো । কিন্তু সে যে চায়না কাউকে অপু কে ছাড়া । মনে মনে ঠিক করল পালিয়ে যাবে । কিন্তু যাবে কোথায়? খাবে কি ? সে যে পড়াশোনা তেও ভালোনা ! এত সব চিন্তা উপেক্ষা করে একদিন গভীর রাতে বেরিয়েই পরল । স্টেশন থেকে ধরল কলকাতার ট্রেন । তারপর সোজা কলকাতা ।
এবারেই শুরু হলো জীবনযুদ্ধ । তার অপুও আছে এই শহরেই । কিন্তু এত বড়ো শহরে কোথায় খুঁজবে তাকে ? ঠিক করল সামনে যে হোটেলে(বার) অনেক মেয়েরা গান গাইতে আসে সেখানেই সে গান গেয়ে টাকা রোজগার করবে । যেমন ভাবনা তেমন কাজ । সামনের হোটেলের ম্যানেজার এর কাছে গিয়ে কাকুতি মিনতি করে একটা কাজ পেলো দীপা । এই পরিবেশে কখনই সে মানিয়ে নিতে পারলো না । কিন্তু এছাড়া যে তার কাছে কোনো উপায়ও ছিলো না । এর মধ্যেই সে নজর কারে হোটেলে আসা এক মিউজিসিয়ান এর । দীপাকে তিনি বলেন দীপার অসাধারণ কন্ঠস্বরকে তিনি কাজে লাগাতে চান । দীপাও রাজি হয়ে যায় । আর তাকে এই পরিবেশে থাকতে হবেনা ।
এবার সে খুঁজে পায় বাঁচার রসদ । ধীরে ধীরে স্টেজ প্রোগ্রাম , রেকর্ডিং , ধীরে ধীরে সিনেমাতে গান গাওয়ার সুযোগ । খুব কম সময়েই সে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে নিল সুরের জাদুতে । সেই ছোট্ট দীপার এত দিনের একরাশ স্বপ্ন এবার বাস্তবে পরিণত হলো । তার এখন চারদিকে অনেক নাম যশ । এভাবেই কেটে গেলো বেশ কয়েক বছর । অপু ও আজ শহরের নামকরা ডাক্তার । দুজনের স্বপ্নই আজ পূরণ হয়েছে । কিন্তু আজ তারা অনেকটা কাছে থেকেও অনেক দূরত্ব । এত কিছুর মাঝে তারা অপেক্ষা ছাড়েনি দুজন দুজনের । অপু গ্রামে গিয়েও পেলোনা দীপা কে । কারন দীপা তখন মুম্বাই । সে জানেনা তার দীপা কোথায় । এখন সময়ের উপর নির্ভর করা ছাড়া আর কোনো পথই নেই । এরপর একদিন এক অনুষ্ঠানে দীপাকে দেখতে পেলো অপু । কিন্তু অত মানুষের ভীড়ে কোথায় যেন মিলিয়ে গেলো দীপা । একমুহূর্তের জন্যও তারা মুখোমুখি হতে পারেনি ।
কিন্তু আর কতদিন দূরে দূরে থাকবে? একদিন তো কাছে আসতেই হবে । মিলন টা হলো আবার সেই গ্রামেই সেই পুজোতেই । অনেক দিন পর অনেক নাম যশ হওয়ার পর এবছর দুর্গাপুজোয় সব কাজ থেকে ছুটি নিয়ে গ্রামে গেলো দীপা । পুজো তে গ্রামে গেল অপুও । পুজোর প্যাণ্ডেলেই দেখা হলো আবার দুজনের । সেই ছোটবেলার দিন টা যেন তারা আবার ফিরে পেলো । আজ সমস্ত বাধা নিষেধ সমস্ত কিছুর উর্ধ্বে তারা । কিন্তু এবারেও তারা ভয়ে সেই ছোটবেলাকার অনুভূতির কথা একে অপরকে বলতে পারলনা । কিন্তু এবার ভয় টা ছিল অন্য । তারা কি এখনো একে অপরের জন্য আছে ? নাকি জীবনে এসেছে নতুন কেউ ? হয়তো একদিন সাহস করে বলতেও পারতো কেউ । সে সময়টুকুও আর হলো না ।
দশমীর দিন সবাই যখন হৈহৈ করে মাতৃপ্রতিমা বিসর্জন করতে যাচ্ছে ঘটল এক ভয়াবহ দুর্ঘটনা । যা সমস্ত আনন্দ কে মুহুর্তে হাহাকারে পরিণত করল । সামনের গাড়িটা ধাক্কা খেল আর একটা গাড়ির সাথে । যে গাড়িতে ছিল অপু । সেখানেই চিরবিদায় নিতে হলো তাকে । এরপর যখন অপুর বাড়িতে সবার সঙ্গে দীপা গেলো তখন সে দেখল ছোটবেলাকার স্মৃতি গুলো যত্ন করে সাজানো আছে অপুর পড়ার টেবিলে । যার থেকে তার বুঝতে দেরি হল না যে অপু জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত দীপারই ছিল । চারদিক টা নিস্তব্ধ হয়ে গেলো । শুধু তখনো পড়ার টেবিলে শোভা পাচ্ছে সেই মিষ্টি সম্পর্কের স্মৃতিচিহ্ন গুলো আর দীপার চোখে ভাসছে তাদের ছোটবেলার দৃশ্যগুলো ।।