গৌরী প্রাচীন ধনীবংশের পরমাদরে পালিতা সন্দেরী কন্যা। স্বামী পরেশ হীনাবস্থা হইতে সম্প্রতি নিজের উপাজনে কিঞ্চিং অবসথার উন্নতি করিয়াছে। যতদিন তাহার দৈন্য ছিল ততদিন কন্যার কষ্ট হইবে ভয়ে অবশর শাশুড়ি স্মীকে তাঁহার বাড়িতে পাঠান নাই। গৌরী বেশ-একটা বয়স্থা হইয়াই পতিগহে আসিয়াছিল। বোধ করি এই সকল কারণেই পরেশ সন্দেরী যাবতী স্মীকে সম্পণে নিজের আয়ত্তগম্য বলিয়া বোধ করিতেন না। এবং বোধ করি সন্দিগধ স্বভাব তাঁহার একটা ব্যাধির মধ্যে। পরেশ পশ্চিমে একটি ক্ষুদ্র শহরে ওকালতি করিতেন ; ঘরে আত্মীয়স্বজন বড়ো কেহ ছিল না, একাকিনী সন্ত্রীর জন্য তাঁহার চিত্ত উদবিগ্ন হইয়া থাকিত। মাঝে মাঝে এক-একদিন হঠাৎ অসময়ে তিনি আদালত হইতে বাড়িতে আসিয়া উপস্থিত হইতেন । প্রথম প্রথম স্বামীর এইরুপ আকস্মিক অভু্যদয়ের কারণ গৌরী ঠিক বকিতে পারিত না। মাঝে মাঝে অকারণ পরেশ এক-একটা করিয়া চাকর ছাড়াইয়া দিতে লাগিলেন। কোনো চাকর তাঁহার আর দীর্ঘকাল পছন্দ হয় না। বিশেষত অসুবিধার আশঙ্কা করিয়া যে চাকরকে গৌরী রাখিবার জন্য অধিক আগ্রহ প্রকাশ করিত তাহাকে পরেশ এক মহত স্থান দিতেন না। তেজস্বিনী গৌরী ইহাতে যতই আঘাত বোধ করিত স্বামী ততই অস্থির হইয়া এক-এক সময়ে অদ্ভুত ব্যবহার করিতে থাকিতেন। অবশেষে আত্মসম্বরণ করিতে না পারিয়া যখন দাসীকে গোপনে ডাকিয়া পরেশ নানাপ্রকার সন্দিগ্ধ জিজ্ঞাসাবাদ আরম্ভ করিলেন তখন সে-সকল কথা গৌরীর কর্ণগোচর হইতে লাগিল। অভিমানিনী বল্পভাষিণী নারী অপমানে আহত সিংহিনীর ন্যায় অন্তরে অন্তরে উদদীপ্ত হইতে লাগিলেন এবং এই উন্মত্ত সন্দেহ দম্পতির মাঝখানে প্রলয়খণের মতো পড়িয়া উভয়কে একেবারে বিচ্ছিন্ন করিয়া দিল । গৌরীর কাছে তাঁহার তীব্র সন্দেহ প্রকাশ পাইয়া যখন একবার লজ্জা ভাঙিয়া গেল তখন পরেশ স্পষ্টতই প্রতিদিন পদে পদে আশঙ্কা ব্যক্ত করিয়া সত্রীর সহিত কলহ করিতে আরম্ভ করিল এবং গৌরী যতই নিরক্তের অবজ্ঞা এবং কষাঘাতের ন্যায় তীক্ষ কটাক্ষ বারা তাঁহাকে আপাদমস্তক যেন ক্ষতবিক্ষত করিতে লাগিল ততই তাহার সংশয়মত্ততা আরও যেন বাড়িবার দিকে চলিল। . এইরুপ স্বামীসখ হইতে প্রতিহত হইয়া পত্রহীনা তরণী ধমে মন দিল। হরিসভার নবীন প্রচারক ব্রহমচারী পরমানন্দস্বামীকে ডাকিয়া মন্ত্র লইল এবং তাঁহার নিকট ভাগবতের ব্যাখ্যা শুনিতে আরম্ভ করিল। নারীহাদয়ের সমস্ত ব্যথা স্নেহ প্রেম কেবল ভক্তি-আকারে পঞ্জীভূত হইয়া গরে দেবের পদতলে সমপিত হইল। পরমানন্দের সাধ্য চরিত্র সম্বন্ধে দেশে বিদেশে কাহারও মনে সংশয়মাত্র ছিল না। সকলে তাঁহাকে পজা করিত। পরেশ ইহার সবধে মাখ ফটিয়া সংশয় প্রকাশ করিতে পারিতেন না বলিয়াই তাহা গুপ্ত ক্ষতের মতো ক্রমশ তাঁহার মমের নিকট *शि“ब्ठ थनन् कर्माद्भग्ना कलिग्नाझिल ।
একদিন সামান্য কারণে বিষ উদ্গীরিত হইয়া পড়িল। সীর কাছে পরমানন্দকে উল্লেখ করিয়া দশচরিত্র ভণ্ড বলিয়া গালি দিলেন এবং কহিলেন, “তোমার শালগ্রাম পশ করিয়া শপথপবেক বলো দেখি, সেই বকধামিককে তুমি মনে মনে ভালোবাস না।” দলিত ফণিনীর ন্যায় মহাতের মধ্যেই উদগ্র হইয়া মিথ্যা পধা বারা স্বামীকে বিদ্ধ করিয়া গৌরী রাধকণ্ঠে কহিল, “ভালোবাসি, তুমি কী করিতে চাও করো” পরেশ তৎক্ষণাৎ ঘরে তালাচাবি লাগাইয়া তাহাকে রন্ধ করিয়া আদালতে চলিয়া গেল। অসহ্য রোষে গৌরী কোনোমতে বার উন্মোচন করাইয়া তৎক্ষণাৎ বাড়ি হইতে বাহির হইয়া গেল। পরমানন্দ নিভৃত ঘরে জনহীন মধ্যাহ্নে শাস্ত্রপাঠ করিতেছিলেন। হঠাৎ অমেঘবাহিনী বিদ্যল্লেতার মতো গৌরী ব্রহমচারীর শাস্ত্ৰাধ্যয়নের মাঝখানে আসিয়া ভাঙিয়া পড়িল । গর কহিলেন, “এ কাঁ।” শিষ্য কহিল, “গরদেব, অপমানিত সংসার হইতে আমাকে উদ্ধার করিয়া লইয়া চলো, তোমার সেবারতে আমি জীবন উৎসগা করিব।” পরমানন্দ কঠোর ভৎসনা করিয়া গৌরীকে গহে ফিরিয়া পাঠাইলেন। কিন্তু, হয়। গরদেব, সেদিনকার সেই অকস্মাং ছিন্নবিচ্ছিন্ন অধ্যয়নসত্র আর কি তেমন করিয়া জোড়া লাগিতে পারিল। পরেশ গহে আসিয়া মন্তবার দেখিয়া সন্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এখানে কে আসিয়াছিল।” মন্ত্ৰী কহিল, “কেহ আসে নাই, আমি গরে দেবের গহে গিয়াছিলাম।” পরেশ মহন্তকাল পাংশ এবং পরক্ষণেই রক্তবর্ণ হইয়া কহিলেন, “কেন গিয়াছিলে।” গৌরী কহিল, “আমার খশি।” সেদিন হইতে পাহারা বসাইয়া সীকে ঘরে রাধ করিয়া পরেশ এমনি উপদ্রব আরম্ভ করিলেন যে, শহরময় কুৎসা রটিয়া গেল। এই-সকল কুৎসিত অপমান ও অত্যাচারের সংবাদে পরমানন্দের হরিচিন্তা দর হইয়া গেল। এই নগর অবিলম্বে পরিত্যাগ করা তিনি কতব্য বোধ করিলেন অথচ উৎপীড়িতকে ফেলিয়া কোনোমতেই দরে যাইতে পারিলেন না। সন্ন্যাসীর এই কয়দিনকার দিনরাত্রের ইতিহাস কেবল অন্তযর্ণমাই জানেন। অবশেষে অবরোধের মধ্যে থাকিয়া গৌরী একদিন পত্র পাইল, “বংসে, আলোচনা করিয়া দেখিলাম, ইতিপবে অনেক সাধনী সাধকরমণী কৃষ্ণপ্রেমে সংসার ত্যাগ করিয়াছেন। যদি সংসারের অত্যাচারে হরিপাদপদ্ম হইতে তোমার চিত্ত বিক্ষিপ্ত প্রভূব অভয় পদারবিন্দে উৎসগা করিতে প্রয়াসী হইব।
২৬শে ফাল্গন বুধবারে অপরাহ্ল ২ ঘটিকার সময় ইচ্ছা করিলে তোমাদের পকেরিণীতীরে আমার সহিত সাক্ষাৎ হইতে পারবে ।” গৌরী পত্ৰখানি কেশে বধিয়া খোঁপার মধ্যে ঢাকিয়া রাখিল। মধ্যাহ্নে নানের পাবে চুল খলিবার সময় দেখিল, চিঠিখানি নাই। হঠাৎ সন্দেহ হইল, হয়তো চিঠিখানি কখন বিছানায় খলিত হইয়া পড়িয়াছে এবং তাহা তাহার স্বামীর হস্তগত হইয়াছে। স্বামী সে পত্র-পাঠে ঈষায় দগধ হইতেছে মনে করিয়া গৌরী মনে মনে একপ্রকার জবালাময় আনন্দ অনুভব করিল ; কিন্তু তাহার শিরোভূষণ পত্ৰখানি পাষণ্ডহস্তপশে লাঞ্ছিত হইতেছে, এ কাপনাও আহার সহ্য হইল না । দ্রতপদে স্বামীগহে গেল। . দেখিল, স্বামী ভূতলে পড়িয়া গোঁ গো করিতেছে, মখ দিয়া ফেনা পড়িতেছে, চক্ষতারকা কপালে উঠিয়াছে। দক্ষিণ বন্ধমটি হইতে পত্ৰখানি ছাড়াইয়া লইয়া তাড়াতাড়ি ডাক্তার ডাকিয়া পাঠাইল । ডাক্তার আসিয়া কহিল, আপোপেলক্সি—তখন রোগীর মৃত্যু হইয়াছে। – সেইদিন মফস্বলে পরেশের একটি জরুরি মকদ্দমা ছিল। সন্ন্যাসীর এতদরে পতন হইয়াছিল যে, তিনি সেই সংবাদ লইয়া গৌরীর সহিত সাক্ষাতের জন্য প্রস্তুত হইয়াছিলেন।সদ্যবিধবা গৌরী যেমন বাতায়ন হইতে গরদেবকে চোরের মতো পঙ্করিণীর তটে দেখিল, তৎক্ষণাৎ বজ্রচকিতের ন্যায় দটি অবনত করিল। গরে যে কোথা হইতে কোথায় নামিয়াছেন, তাহা যেন বিদাতালোকে সহসা এই মাহ-তে তাহার হাদরে উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল। – গর ডাকিলেন, “গৌরী।” গৌরী কহিল, “আসিতেছি, গরদেব।” মৃত্যুসংবাদ পাইয়া পরেশের বন্ধগণ যখন সৎকারের জন্য উপস্থিত হইল, দেখিল, গৌরীর মতদেহ স্বামীর পাবে শয়ান। সে বিষ খাইয়া মরিয়াছে। আধুনিক কালে এই আশ্চৰ্য সহমরণের দন্টাতে সতীমাহাজ্যে সকলে স্তম্ভিত হইয়া গেল।
শ্রাবণ ১৩০৭