দুরাশা
দার্জিলিঙে গিয়া দেখিলাম, মেঘে বৃষ্টিতে দশ দিক আচ্ছন্ন। ঘরের বাহির হইতে ইচ্ছা হয় না, ঘরের মধ্যে থাকিতে আরও অনিচ্ছা জন্মে।
হোটেলে প্রাতঃকালের আহার সমাধা করিয়া পায়ে মোটা বুট এবং আপাদমস্তক ম্যাকিস্টশ পরিয়া বেড়াইতে বাহির হইয়াছি। ক্ষণে ক্ষণে টিপ টপ করিয়া বৃষ্টি পড়িতেছে এবং সবার ঘন মেঘের কুজ্ঝটিকায় মনে হইতেছে যেন বিধাতা হিমালয় পর্বত-সুদ্ধ সমস্ত বিশ্বচিত্র রবার দিয়া ঘষিয়া ঘষিয়া মুছিয়া ফেলিবার উপক্রম করিয়াছেন।
জনশূন্য ক্যালকাটা রোডে একাকী পদচারণ করিতে করিতে ভাবিতেছিলাম— অবলম্বনহীন মেঘরাজ্যে আর তো ভালো লাগে না, শব্দস্পর্শরূপময়ী বিচিত্রা ধরণীমাতাকে পুনরায় পাঁচ ইন্দ্রিয় দ্বারা পাঁচ রকমে আঁঁকড়িয়া ধরিবার জন্য প্রাণ আকুল হইয়া উঠিয়াছে।
এমন সময়ে অনতিদরে রমণীকণ্ঠের সকরণ রোদনগুঞ্জনধ্বনি শুনিতে পাইলাম। রোগশোকসংকুল সংসারে রোদনধ্বনিটা কিছুই বিচিত্র নহে, অন্যত্র অন্য সময় হইলে ফিরিয়া চাহিতাম কি না সন্দেহ, কিন্তু এই অসীম মেঘরাজ্যের মধ্যে সে রােদন সমস্ত লুপ্ত জগতের একমাত্র রোদনের মতাে আমার কানে আসিয়া প্রবেশ করিল, তাহাকে তুচ্ছ বলিয়া মনে হইল না।
শব্দ লক্ষ্য করিয়া নিকটে গিয়া দেখিলাম গৈরিকবসনাবৃতা নারী, তাহার মস্তকে স্বর্ণকপিশ জটাভার চড়া-আকারে আবদ্ধ, পথপ্রান্তে শিলাখণ্ডের উপর বসিয়া মৃদুস্বরে ক্রন্দন করিতেছে। তাহা সদ্যশােকের বিলাপ নহে, বহুদিনসঞ্চিত নিঃশব্দ শ্রান্তি ও অবসাদ আজ মেঘান্ধকার নির্জনতার ভারে ভাঙিয়া উচ্ছ্বসিত হইয়া পড়িতেছে।
মনে মনে ভাবিলাম, এ বেশ হইল, ঠিক যেন ঘর-গড়া গল্পের মতাে আরম্ভ হইল; পর্বতশঙ্গে সন্ন্যাসিনী বসিয়া কাঁদিতেছে ইহা যে কখনও চর্মচক্ষে দেখিব এমন আশা কস্মিনকালে ছিল না।
মেয়েটি কোন জাত ঠাহর হইল না। সদয় হিন্দী ভাষায় জিজ্ঞাসা করিলাম, “কে তুমি, তােমার কী হইয়াছে।”
প্রথমে উত্তর দিল না, মেঘের মধ্য হইতে সজলদীপ্তনেত্রে আমাকে একবার দেখিয়া লইল।
আমি আবার কহিলাম, “আমাকে ভয় করিয়াে না। আমি ভদ্রলােক।”
শুনিয়া সে হাসিয়া খাস হিন্দুস্থানীতে বলিয়া উঠিল, “বহুদিন হইতে ভয়ডরের মাথা খাইয়া বসিয়া আছি, লজ্জাশরমও নাই। বাবুজি, একসময় আমি যে জেনানায় ছিলাম সেখানে আমার সহােদর ভাইকে প্রবেশ করিতে হইলেও অনুমতি লইতে হইত, আজ বিশবসংসারে আমার পর্দা নাই।”
প্রথমটা একটু রাগ হইল; আমার চালচলন সমস্তই সাহেবি। কিন্তু এই হতভাগিনী বিনা দ্বিধায় আমাকে বাবজি সম্বােধন করে কেন। ভাবিলাম, এইখানেই আমার উপন্যাস শেষ করিয়া সিগারেটের ধোঁয়া উড়াইয়া উদ্যতনাসা সাহেবিয়ানার রেলগাড়ির মতো সশব্দে সবেগে সদর্পে প্রস্থান করি। অবশেষে কৌতূহল জয়লাভ করিল। আমি কিছু উচ্চভাব ধারণ করিয়া বক্রগ্রীবায় জিজ্ঞাসা করিলাম, “তোমাকে কিছু সাহায্য করিতে পারি? তোমার কোনো প্রার্থনা আছে?”
সে স্থিরভাবে আমার মুখের দিকে চাহিল এবং ক্ষণকাল পরে সংক্ষেপে উত্তর করিল, “আমি বদ্রাওনের নবাব গোলামকাদের খাঁর পুত্রী।”
বদ্রাওন কোন মল্লকে এবং নবাব গোলামকাদের খাঁ কোন নবাব এবং তাঁহার কন্যা যে কী দুঃখে সন্ন্যাসিনীবেশে দার্জিলিঙে ক্যালকাটা রোডের ধারে বসিয়া কাঁদিতে পারে আমি তাহার বিন্দুবিসর্গ জানি না এবং বিশ্বাসও করি না, কিন্তু ভাবিলাম রসভঙ্গ করিব না, গল্পটি দিব্য জমিয়া আসিতেছে। তৎক্ষণাৎ সুগম্ভীর মুখে সুদীর্ঘ সেলাম করিয়া কহিলাম, “বিবিসাহেব, মাপ করো, তোমাকে চিনিতে পারি নাই।”
চিনিতে না পারিবার অনেকগুলি যুক্তিসংগত কারণ ছিল, তাহার মধ্যে সব প্রধান কারণ, তাঁহাকে পূর্বে কস্মিনকালে দেখি নাই, তাহার উপর এমনি কুয়াশা যে নিজের হাত পা কয়খানিই চিনিয়া লওয়া দুঃসাধ্য।
বিবিসাহেবও আমার অপরাধ লইলেন না এবং সন্তুষ্টকণ্ঠে দক্ষিণহস্তের ইঙ্গিতে স্বতন্ত্র শিলাখণ্ড নির্দেশ করিয়া আমাকে অনুমতি করিলেন, “বৈঠিয়ে।”
দেখিলাম, রমণীটির আদেশ করিবার ক্ষমতা আছে। আমি তাঁহার নিকট হইতে সেই সিক্ত শৈবালাচ্ছন্ন কঠিনবন্ধুর শিলাখণ্ডতলে আসন গ্রহণের সম্মতি প্রাপ্ত হইয়া এক অভাবনীয় সম্মান লাভ করিলাম। বদ্রাওনের গোলামকাদের খাঁর পত্রী নুরুন্নীসা বা মেহেরউন্নীসা বা নুর-উলমুলক আমাকে দার্জিলিঙে ক্যালকাটা রোডের ধারে তাঁহার অনতিদূরবর্তী অনতি-উচ্চ পঙ্কিল আসনে বসিবার অধিকার দিয়াছেন। হোটেল হইতে ম্যাকিস্টশ পরিয়া বাহির হইবার সময় এমন সুমহৎ সম্ভাবনা আমার স্বপ্নেরও আগোচর ছিল।
হিমালয়বক্ষে শিলাতলে একান্তে দুইটি পান্থ নরনারীর রহস্যালাপকাহিনী সহসা সদ্যসপণ কবোষ্ণ কাব্যকথার মতো শুনিতে হয়, পাঠকের হাদয়ের মধ্যে দূরাগত নির্জন গিরিকন্দরের নিঝরপ্রপাতধননি এবং কালিদাস-রচিত মেঘদত-কুমারসম্ভবের বিচিত্র সংগীতমমর জাগ্রত হইয়া উঠিতে থাকে, তথাপি এ কথা সকলকেই স্বীকার করিতে হইবে যে, বট এবং ম্যাকিন্টশ পরিয়া ক্যালকাটা রোডের ধারে কদমাসনে এক দীনবেশিনী হিন্দুস্থানী রমণীর সহিত একত্র উপবেশন-পূর্বক সম্পূর্ণ আত্মগৌরব অক্ষমভাবে অনুভব করিতে পারে এমন নব্যবঙ্গ অতি অল্পই আছে। কিন্তু সেদিন ঘনঘোর বাপে দশ দিক আবৃত ছিল, সংসারের নিকট চক্ষুলজ্জা রাখিবার কোনো বিষয় কোথাও ছিল না, কেবল অনন্ত মেঘরাজ্যের মধ্যে বদ্রাওনের নবাব গোলামকাদের খাঁর পত্রী এবং আমি– এক নববিকশিত বাঙালি সাহেব— দুইজনে দুইখানি প্রস্তরের উপর বিশ্বজগতের দইখণ্ড প্রলয়াবশেষের ন্যায় অবশিষ্ট ছিলাম, এই বিসদৃশ সম্মিলনের পরম পরিহাস কেবল আমাদের অদৃষ্টের গোচর ছিল, কাহারও দৃষ্টিগোচর ছিল না।
আমি কহিলাম, “বিবিসাহেব, তোমার এ হাল কে করিল।” বদ্রাওনকুমারী কপালে করাঘাত করিলেন। কহিলেন, “কে এ-সমস্ত করায় তা আমি কি জানি! এতবড়ো প্রস্তরময় কঠিন হিমালয়কে কে সামান্য বাষ্পের মেঘে অন্তরাল করিয়াছে।”
আমি কোনােরূপ দার্শনিক তর্ক না তুলিয়া সমস্ত স্বীকার করিয়া লইলাম; কহিলাম, “তা বটে, অদৃষ্টের রহস্য কে জানে! আমরা তাে কীটমাত্র।”
তর্ক তুলিতাম, বিবিসাহেবকে আমি এত সহজে নিষ্কৃতি দিতাম না কিন্তু আমার ভাষায় কুলাইত না। দরােয়ান এবং বেহারাদের সংসর্গে যেটুকু হিন্দি অভ্যস্ত হইয়াছে তাহাতে ক্যাল্কাটা রােডের ধারে বসিয়া বদ্রাওনের অথবা অন্য কোনাে স্থানের কোন নবাবপূত্রীর সহিত অদৃষ্টবাদ ও স্বাধীন-ইচ্ছা-বাদ সম্বন্ধে সুস্পষ্টভাবে আলােচনা করা আমার পক্ষে অসম্ভব হইত।
বিবিসাহেব কহিলেন, “আমার জীবনের আশ্চর্য কাহিনী অদ্যই পরিসমাপ্ত হইয়াছে, যদি ফরমায়েস করেন তাে বলি।”
আমি শশব্যস্ত হইয়া কহিলাম, “বিলক্ষণ! ফরমায়েস কিসের। যদি অনুগ্রহ করেন তাে শুনিয়া শ্রবণ সার্থক হইবে।”
কেহ না মনে করেন, আমি ঠিক এই কথাগুলি এমনিভাবে হিন্দুস্থানী ভাষায় বলিয়াছিলাম, বলিবার ইচ্ছা ছিল কিন্তু সামর্থ্য ছিল না। বিবিসাহেব যখন কথা কহিতেছিলেন আমার মনে হইতেছিল যেন শিশিরস্নাত স্বর্ণশীর্ষ স্নিদ্ধশ্যামল শস্যক্ষেত্রের উপর দিয়া প্রভাতের মন্দমধুর বায়ু হিল্লোলিত হইয়া যাইতেছে, তাহার পদে পদে এমন সহজ নম্রতা, এমন সৌন্দর্য, এমন বাক্যের অবারিত প্রবাহ। আর আমি অতি সংক্ষেপে খণ্ড খণ্ড ভাবে বর্বরের মতাে সােজা সােজা উত্তর দিতেছিলাম। ভাষায় সেরূপ সুসম্পূর্ণ অবিচ্ছিন্ন সহজ শিষ্টতা আমার কোনােকালে জানা ছিল না; বিবিসাহেবের সহিত কথা কহিবার সময় এই প্রথম নিজের আচরণের দীনতা পদে পদে অনুভব করিতে লাগিলাম।
তিনি কহিলেন, “আমার পিতৃকুলে দিল্লির সম্রাটবংশের রক্ত প্রবাহিত ছিল, সেই কুলগর্ব রক্ষা করিতে গিয়া আমার উপযুক্ত পাত্রের সন্ধান পাওয়া দুঃসাধ্য হইয়াছিল। লক্ষ্নৌয়ের নবাবের সহিত আমার সম্বন্ধের প্রস্তাব আসিয়াছিল, পিতা ইতস্তত করিতেছিলেন, এমন সময় দাঁতে টোটা কাটা লইয়া সিপাহিলােকের সহিত সরকারবাহাদুরের লড়াই বাধিল, কামানের ধোঁয়ায় হিন্দুস্থান অন্ধকার হইয়া গেল।”
স্ত্রীকণ্ঠে, বিশেষ সভ্রান্ত মহিলার মুখে হিন্দুস্থানী কখনও শুনি নাই, শুনিয়া স্পষ্ট বুঝিতে পারিলাম, এ ভাষা আমিরের ভাষা—এ যে দিনের ভাষা সে দিন আর নাই, আজ রেলোয়ে-টেলিগ্রাফে, কাজের ভিড়ে, আভিজাত্যের বিলােপে সমস্তই যেন হ্রস্ব খর্ব নিরলংকার হইয়া গেছে। নবাবজাদীর ভাষামাত্র শুনিয়া সেই ইংরাজরচিত আধুনিক শৈলনগরী দার্জিলিঙের ঘনকুঞ্জটিকাজালের মধ্যে আমার মনশ্চক্ষের সম্মুখে মােগলসম্রাটের মানসপুরী মায়াবলে জাগিয়া উঠিতে লাগিল—শ্বেতপ্রস্তররচিত বড়াে বড়াে অভ্রভেদী সৌধশ্রেণী, পথে লম্বপুচ্ছ অশ্বপৃষ্ঠে মছলন্দের সাজ, হস্তী পৃষ্ঠে স্বর্ণঝালরখচিত হাওদা, পুরবাসিগণের মস্তকে বিচিত্রবর্ণের উষ্ণীষ, শালের রেশমের মসলিনের প্রচুরপ্রসর জামা পায়জামা, কোমরবন্ধে বক্র তরবারি, জরীর জুতার অগ্রভাগে বক্র শীষ — সুদীর্ঘ অবসর, সুলম্ব পরিচ্ছদ, প্রচুর শিষ্টাচার।
নবাবপুত্রী কহিলেন, “আমাদের কেল্লা যমুনার তীরে। আমাদের ফৌজের অধিনায়ক ছিল একজন হিন্দু ব্রাহ্মণ। তাহার নাম ছিল কেশরলাল।”
রমণী এই কেশরলাল শব্দটির উপর তাহার নারীকন্ঠের সমস্ত সংগীত যেন একেবারে এক মুহূর্তে উপুড় করিয়া ঢালিয়া দিল। আমি ছড়িটা ভূমিতে রাখিয়া নড়িয়া-চড়িয়া খাড়া হইয়া বসিলাম ।
“কেশরলাল পরম হিন্দু ছিল। আমি প্রত্যহ প্রত্যুষে উঠিয়া অন্তঃপূরের গবাক্ষ হইতে দেখিতাম, কেশরলাল আবক্ষ যমুনার জলে নিমগ্ন হইয়া প্রদক্ষিণ করিতে করিতে জোড়করে ঊর্ধ্বমুখে নবোদিত সূর্যের উদ্দেশে অঞ্জলি প্রদান করিত। পরে সিক্তবস্ত্রে ঘাটে বসিয়া একাগ্রমনে জপ সমাপন করিয়া পরিষ্কার সুকণ্ঠে ভৈরোঁরাগে ভজনগান করিতে করিতে গৃহে ফিরিয়া আসিত।
আমি মুসলমানবালিকা ছিলাম কিন্তু কখনও স্বধর্মের কথা শুনি নাই এবং স্বধর্মসংগত উপাসনাবিধিও জানিতাম না; তখনকার দিনে বিলাসে মদ্যপানে স্বেচ্ছাচারে আমাদের পুরুষের মধ্যে ধর্মবন্ধন শিথিল হইয়া গিয়াছিল এবং অন্তঃপুরের প্রমোদভবনেও ধর্ম সজীব ছিল না।
বিধাতা আমার মনে বোধকরি স্বাভাবিক ধর্মপিপাসা দিয়াছিলেন। অথবা আরকোনো নিগূঢ় কারণ ছিল কি না বলিতে পারি না। কিন্তু প্রত্যহ প্রশান্ত প্রভাতে নবোন্মেষিত অরুণালোকে নিস্তরঙ্গ নীল যমুনার নির্জন শ্বেত সোপানতটে কেশরলালের পূজার্চনাদৃশ্যে আমার সদ্যসুপ্তোত্থিত অন্তঃকরণ একটি অব্যক্ত ভক্তিমাধূর্যে পরিপ্লুত হইয়া যাইত।
নিয়ত সংযত শুদ্ধাচারে ব্রাহ্মাণ কেশরলালের গৌরবর্ণ প্রাণসার সুন্দর তনু দেহখানি ধূমর্লেশহীন জ্যোতিঃশিখার মতো বোধ হইত; ব্রাহ্মাণের পূণ্যমাহাত্ম্য অপূর্ব শ্রদ্ধাভরে এই মুসলমানদুহিতার মূঢ় হৃদয়কে বিনম্র কৰিয়া দিত।
আমার একটি হিন্দু বাঁদি ছিল, সে প্রতিদিন নত হইয়া প্রণাম করিয়া কেশরলালের পদধূলি লইয়া আসিত, দেখিয়া আমার আনন্দও হইত ঈর্ষাও জন্মিত। ক্রিয়াকর্মপাবণ উপলক্ষে এই বন্দিনী মধ্যে মধ্যে ব্রাহ্মাণ ভোজন করাইয়া দক্ষিণা দিত। আমি নিজে হইতে তাহাকে অর্থসাহায্য করিয়া বলিতাম, “তুই কেশরলালকে নিমন্ত্ৰণ করিবি না ? সে জিভ কাটিয়া বলিত, ‘কেশরলালঠাকুর কাহারও অন্নগ্রহণ বা দানপ্রতিগ্রহ করেন না।’
এইরপে প্রত্যক্ষে বা পরোক্ষে কেশরলালকে কোনোরুপ ভক্তিচিহ্ন দেখাইতে না পারিয়া আমার চিত্ত যেন ক্ষুব্ধ ক্ষুধাতুর হইয়া থাকিত।
আমাদের পূর্বপুরুষের কেহ-একজন একটি ব্রাহ্মাণকন্যাকে বলপূর্বক বিবাহ করিয়া আনিয়াছিলেন, আমি অন্তঃপুরের প্রান্তে বসিয়া তাঁহারই পূণ্যরক্তপ্রবাহ আপন শিরার মধ্যে অনুভব করিতাম, এবং সেই রক্তসূত্রে কেশরলালের সহিত একটি ঐক্যসম্বন্ধ কল্পনা করিয়া কিয়ৎপরিমাণে তৃপ্তি বোধ হইত।
আমার হিন্দু দাসীর নিকট হিন্দুধর্মের সমস্ত আচার ব্যবহার, দেবদেবীর সমস্ত আশ্চৰ্য কাহিনী, রামায়ণ-মহাভারতের সমস্ত অপূর্ব ইতিহাস তন্ন তন্ন করিয়া শুনিতাম, শুনিয়া সেই অন্তঃপুরের প্রান্তে বসিয়া হিন্দুজগতের এক অপরূপ দশ্য আমার মনের সম্মুখে উদ্ঘাটিত হইত। মূর্তিপ্রতিমূর্তি, শঙ্খঘন্টাধানি, স্বর্ণচূড়াখচিত দয়াশা দেবালয়, ধপধনার ধাম, অগ্রচন্দনমিশ্রিত পপরাশির স্যগন্ধ, যোগীসন্ন্যাসীর অলৌকিক ক্ষমতা, ব্রাহরণের অমানষিক মাহাত্ম্য, মানুষ-ছদ্মবেশধারী দেবতাদের বিচিত্রলীলা, সমস্ত জড়িত হইয়া আমার নিকটে এক অতি পরাতন, অতি বিস্তীর্ণ, অতি সদরে অপ্রাকৃত মায়ালোক সজন করিত, আমার চিত্ত যেন নীড়হারা ক্ষুদ্র পক্ষীর ন্যায় প্রদোষকালের একটি প্রকাণ্ড প্রাচীন প্রাসাদের কক্ষে কক্ষে উড়িয়া উড়িয়া বেড়াইত। হিন্দসংসার আমার বালিকাহদয়ের নিকট একটি পরমরমণীয় রপেকথার রাজ্য ছিল। এমন সময় কোম্পানিবাহাদরের সহিত সিপাহিলোকের লড়াই বাধিল । আমাদের বন্দ্রাওনের ক্ষুদ্র কেল্লাটির মধ্যেও বিপ্লবের তরঙ্গ জাগিয়া উঠিল। কেশরলাল বলিল, “এইবার গো-খাদক গোরালোককে আযাবত হইতে দীর করিয়া দিয়া আর-একবার হিন্দুস্থানে হিন্দমসেলমানে রাজপদ লইয়া দ্যতক্ৰীড়া বসাইতে হইবে।” আমার পিতা গোলামকাদের খাঁ সাবধানী লোক ছিলেন; তিনি ইংরাজ জাতিকে কোনো-একটি বিশেষ কুটশৈব-সম্ভাষণে অভিহিত করিয়া বলিলেন, “উহারা অসাধ্য সাধন করিতে পারে, হিন্দপথানের লোক উহাদের সহিত পারিয়া উঠিবে না। আমি অনিশ্চিত প্রত্যাশে আমার এই ক্ষুদ্র কেল্লাটুকু খোয়াইতে পারিব না, আমি কোম্পানিবাহাদরের সহিত লড়িব না।’ যখন হিন্দুস্থানের সমস্ত হিন্দমসেলমানের রন্ড উত্তপ্ত হইয়া উঠিয়াছে, তখন আমার পিতার এই বণিকের মতো সাবধানতায় আমাদের সকলের মনেই ধিক্কার উপস্থিত হইল। আমার বেগম মাতৃগণ পর্যন্ত চঞ্চল হইয়া উঠিলেন। এমন সময়ে ফোঁজ লইয়া সশস্ত্র কেশরলাল আসিয়া আমার পিতাকে বলিলেন, ‘নবাবসাহেব, আপনি যদি আমাদের পক্ষে যোগ না দেন, তবে যতদিন লড়াই চলে আপনাকে বন্দী রাখিয়া আপনার কেল্লার আধিপত্যভার আমি গ্রহণ করিব।” পিতা বলিলেন, সে-সমস্ত হাঙ্গামা কিছই করিতে হইবে না, তোমাদের পক্ষে আমি রহিব।’ কেশরলাল কহিলেন, ধনকোষ হইতে কিছু অর্থ বাহির করিতে হইবে।” পিতা বিশেষ কিছ দিলেন না; কহিলেন, যখন যেমন আবশ্যক হইবে আমি দিব।’ আমার সীমন্ত হইতে পদাঙ্গুলি পৰ্যন্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গের যতকিছু ভূষণ ছিল সমস্ত কাপড়ে বধিয়া আমার হিন্দ দাসী দিয়া গোপনে কেশরলালের নিকট পাঠাইয়া দিলাম। তিনি গ্রহণ করিলেন। আনন্দে আমার ভূষণবিহীন প্রত্যেক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পলকে রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিল। কেশরলাল মরিচাপড়া বন্দকের চোঙ এবং পরাতন তলোয়ারগুলি মাজিয়া ঘষিয়া সাফ করিতে প্রস্তুত হইলেন, এমন সময় হঠাৎ একদিন অপরাহে জিলার কমিশনারসাহেব লালকুতি গোরা লইয়া আকাশে ধলা উড়াইয়া আমাদের কেল্লার মধ্যে আসিয়া প্রবেশ করিল। আমার পিতা গোলামকাদের খাঁ গোপনে তাঁহাকে বিদ্রোহ-সংবাদ দিয়াছিলেন। বদ্রাওনের ফৌজের উপর কেশরলালের এমন একটি অলৌকিক আধিপত্য ছিল যে, তাঁহার কথায় তাহারা ভাঙা বন্দকে ও ভোঁতা তরবারি হতে লড়াই করিয়া মরিতে ෆ6 දී গল্পগুচ্ছ প্রস্তুত হইল। বিশ্বাসঘাতক পিতার গহ আমার নিকট নরকের মতো বোধ হইল। ক্ষোভে দুঃখে লক্ষজায় ঘণায় বক ফাটিয়া যাইতে লাগিল, তব চোখ দিয়া এক ফোঁটা জল বাহির হইল না। আমার ভাঁর ভ্রাতার পরিচ্ছদ পরিয়া ছদ্মবেশে অতঃপর হইতে বাহির হইয়া গেলাম, কাহারও দেখিবার অবকাশ ছিল না। তখন ধলো এবং বারদের ধোঁয়া, সৈনিকের চিৎকার এবং বন্দকের শব্দ থামিয়া গিয়া মৃত্যুর ভীষণ শান্তি জলস্থল-আকাশ আচ্ছন্ন করিয়াছে। যমনার জল রক্তরাগে রঞ্জিত করিয়া সন্য অস্ত গিয়াছে, সন্ধ্যাকাশে শুক্লপক্ষের পরিপর্ণপ্রায় চন্দ্রমা। রণক্ষেত্র মৃত্যুর বিকট দশ্যে আকীর্ণ। অন্য সময় হইলে কর্ণায় আমার বক্ষ ব্যথিত হইয়া উঠিত, কিন্তু সেদিন সব নাবিস্টের মতো আমি ঘরিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছিলাম, খুজিতেছিলাম কোথায় আছে কেশরলাল, সেই একমাত্র লক্ষ্য ছাড়া আর সমস্ত আমার নিকট অলীক বোধ হইতেছিল। খুজিতে খুজিতে রাত্রি দ্বিপ্রহরের উক্তজবল চন্দ্রালোকে দেখিতে পাইলাম, রণক্ষেত্রের অদরে যমনার তীরে আম্রকাননচ্ছায়ায় কেশরলাল এবং তাঁহার ভক্তভূত্য দেওকিনন্দনের মতদেহ পড়িয়া আছে। বঝিতে পারিলাম, সাংঘাতিক আহত অবস্থায়, হয় প্রভু ভৃত্যকে অথবা ভৃত্য প্রভুকে, রণক্ষেত্র হইতে এই নিরাপদ পথানে বহন করিয়া আনিয়া শান্তিতে মৃত্যুহতে আত্মসমপণ করিয়াছে। প্রথমেই আমি আমার বহুদিনের বর্ভূক্ষিত ভক্তিব্যত্তির চরিতার্থতা সাধন করিলাম। কেশরলালের পদতলে লাঠিত হইয়া পড়িয়া আমার আজানবিলম্বিত কেশজাল উন্মুক্ত করিয়া দিয়া বারবার তাঁহার পদধলি মাছিয়া লইলাম, আমার উত্তপ্ত ললাটে তাঁহার হিমশীতল পাদপদ্ম তুলিয়া লইলাম, তাঁহার চরণ চুম্বন করিবামার বহুদিবসের নিরন্ধ আশ্ররোশি উদ্বেল হইয়া উঠিল। এমন সময়ে কেশরলালের দেহ বিচলিত হইল, এবং সহসা তাঁহার মুখ হইতে বেদনার অসফট আতসবর শনিয়া আমি তাঁহার চরণতল ছাড়িয়া চমকিয়া উঠিলাম; শুনিলাম, নিমলিত নেত্রে শকে কণ্ঠে একবার বলিলেন, ‘জল । আমি তৎক্ষণাৎ আমার গাত্রবস্ত্র যমনার জলে ভিজাইয়া ছটিয়া চলিয়া আসিলাম। বসন নিংড়াইয়া কেশরলালের আমীলিত ওঠাধরের মধ্যে জল দিতে লাগিলাম, এবং বামচক্ষ নষ্ট করিয়া তাঁহার কপালে যে নিদারণে আঘাত লাগিয়াছিল সেই আহত সথানে আমার সিক্ত বসনপ্রান্ত ছিড়িয়া বধিয়া দিলাম। এমনি বারকতক যমনার জল আনিয়া তাঁহার মথে চক্ষে সিঞ্চন করার পর অপে আলেপ চেতনার সঞ্চার হইল। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, আর জল দিব ? কেশরলাল কহিলেন, কে তুমি। আমি আর থাকিতে পারলাম না, বলিলাম, অধীনা আপনার ভক্ত সেবিকা। আমি নবাব গোলামকাদের খাঁর কন্যা।’ মনে করিয়াছিলাম, কেশরলাল আসন্ন মত্যুকালে তাঁহার ভক্তের শেষ পরিচয় সঙ্গে করিয়া লইয়া যাইবেন, এ সখ হইতে আমাকে কেহ বঞ্চিত করিতে পরিবে না। আমার পরিচয় পাইবামায় কেশরলাল সিংহের ন্যায় গজম করিয়া উঠিয়া বলিলেন, বেইমানের কন্যা, বিধমী! মৃত্যুকালে যবনের জল দিয়া তুই আমার ধর্ম নষ্ট করিলি! এই বলিয়া প্রবল বলে আমার কপোলদেশে দক্ষিণ করতলের আঘাত করিলেন, আমি দরাশা ●●● মছিতপ্রায় হইয়া চক্ষে অন্ধকার দেখিতে লাগিলাম। তখন আমি ষোড়শী, প্রথম দিন অন্তঃপর হইতে বাহিরে আসিয়াছি, তখনও বহিরাকাশের লব্ধ তপ্ত সযকর আমার স্কুমার কপোলের রক্তিম লাবণ্যবিভা অপহরণ করিয়া লয় নাই, সেই বহিঃসংসারে পদক্ষেপ করিবামাত্র সংসারের নিকট হইতে, আমার সংসারের দেবতার নিকট হইতে এই প্রথম সম্প্রভাষণ প্রাপ্ত হইলাম।” আমি নিবাপিত-সিগারেটে এতক্ষণ মোহমান্ধ চিত্রাপিতের ন্যায় বসিয়া ছিলাম। গল্প শুনিতেছিলাম কি ভাষা শুনিতেছিলাম কি সংগীত শনিতেছিলাম জানি না, আমার মুখে একটি কথা ছিল না। এতক্ষণ পরে আমি আর থাকিতে পারিলাম না, হঠাৎ বলিয়া উঠিলাম, “জানোয়ার।” নবাবজাদী কহিলেন, “কে জানোয়ার জানোয়ার কি মৃত্যুযন্ত্রণার সময় মাখের নিকট সমাহত জলবিন্দ পরিত্যাগ করে।” আমি অপ্রতিভ হইয়া কহিলাম, “তা বটে। সে দেবতা।” নবাবজাদী কহিলেন, “কিসের দেবতা ! দেবতা কি ভক্তের একাগ্রচিত্তের সেবা প্রত্যাখ্যান করিতে পারে।” আমি বলিলাম, “তাও বটে।” বলিয়া চুপ করিয়া গেলাম। নবাবপত্রী কহিতে লাগিলেন, “প্রথমটা আমার বড়ো বিষম বাজিল। মনে হইল, বিশ্বজগৎ হঠাৎ আমার মাথার উপর চুরমার হইয়া ভাঙিয়া পড়িয়া গেল। মহেতের মধ্যে সংজ্ঞা লাভ করিয়া সেই কঠোর কঠিন নিষ্ঠর নিবিকার পবিত্র ব্রাহরণের পদতলে দর হইতে প্রণাম করিলাম— মনে মনে কহিলাম, হে ব্ৰাহরণ, তুমি হীনের সেবা, পরের অন্ন, ধনীর দান, যাবতীর যৌবন, রমণীর প্রেম কিছই গ্রহণ কর না; তুমি স্বতন্ত্র, তুমি একাকী, তুমি নিলিপিত, তুমি সদর, তোমার নিকট আত্মসমপণ করিবার অধিকারও আমার নাই ! – নবাবদহিতাকে ভুলাঠিতমস্তকে প্রণাম করিতে দেখিয়া কেশরলাল কী মনে করিল বলিতে পারি না, কিন্তু তাহার মুখে বিস্ময় অথবা কোনো ভাবান্তর প্রকাশ পাইল না। শান্তভাবে একবার আমার মাখের দিকে চাহিল; তাহার পর ধীরে ধীরে উঠিল। আমি সচকিত হইয়া আশ্রয় দিবার জন্য আমার হস্ত প্রসারণ করিলাম, সে তাহা নীরবে প্রত্যাখ্যান করিল এবং বহন কষ্টে যমনার ঘাটে গিয়া অবতীণ হইল। সেখানে একটি খেয়ানৌকা বাঁধা ছিল। পার হইবার লোকও ছিল না, পার করিবার লোকও ছিল না। সেই নৌকার উপর উঠিয়া কেশরলাল বাঁধন খলিয়া দিল, নৌকা দেখিতে দেখিতে মধ্যস্রোতে গিয়া ক্রমশ অদশ্য হইয়া গেল— আমার ইচ্ছা হইতে লাগিল, সমস্ত অভিমখে জোড়কর করিয়া সেই নিস্তব্ধ নিশীথে সেই চন্দ্রালোকপালকিত নিস্তরঙ্গ যমনার মধ্যে অকালবন্তচু্যত পাপমঞ্জরীর ন্যায় এই ব্যথা জীবন বিসর্জন করি। কিন্তু পারিলাম না। আকাশের চন্দ্র, যমনাপারের ঘনকৃষ্ণ বনরেখা, কালিন্দীর নিবিড় নীল নিকম্প জলরাশি, দরে আমবনের উধ্যে আমাদের জ্যোৎস্নাচিঙ্কণ কেল্লার চড়াগ্রভাগ, সকলেই নিঃশব্দগম্ভীর ঐকতানে মৃত্যুর গান গাহিল; সেই নিশীথে গ্রহচন্দ্রতারাখচিত নিস্তথ তিন ভুবন আমাকে একবাক্যে মরিতে কহিল। কেবল ●গল্পগুচ্ছ বচিভাগবিহীন প্রশান্ত যমনাবক্ষোবাহিত একখানি অদশ্য জীণ নৌকা সেই জ্যোৎস্নারজনীর সৌম্যসন্দর শান্তশীতল অনন্ত ভুবনমোহন মতুর প্রসারিত আলিঙ্গনপাশ হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া আমাকে জীবনের পথে টানিয়া লইয়া চলিল । আমি মোহস্বপ্নাভিহতার ন্যায় যমনার তীরে তীরে কোথাও-বা কাশবন, কোথাও-বা মরবালকো কোথাও-বা বন্ধর বিদীশ তট, কোথাও-বা ঘনগলমদগম বনখণ্ডের ভিতর झिझा झाठाहउ ठलाक्रिाञ्जान्न ।” এইখানে বস্তা চুপ করিল। আমিও কোনো কথা কহিলাম না। অনেক ক্ষণ পরে নবাবদহিতা কহিল, “ইহার পরে ঘটনাবলী বড়ো জটিল। সে কেমন করিয়া বিশে্লষ করিয়া পরিস্কার করিয়া বলিব জানি না। একটা গহন অরণ্যের মাঝখান দিয়া যাত্রা করিয়াছিলাম, ঠিক কোন পথ দিয়া কখন চলিয়াছিলাম সে কি আর খাজিয়া বাহির করিতে পারি। কোথায় আরম্ভ করিব, কোথায় শেষ করিব, কোনটা ত্যাগ করিব, কোনটা রাখিব, সমস্ত কাহিনীকে কী উপায়ে এমন স্পষ্ট প্রত্যক্ষ করিয়া তুলিব যাহাতে কিছই অসাধ্য অসম্ভব অপ্রকৃত বোধ না হয়। কিন্তু জীবনের এই কয়টা দিনে বঝিয়াছি যে, অসাধ্য-অসম্ভব কিছুই নাই। নবাব-অন্তঃপরের বালিকার পক্ষে বাহিরের সংসার একান্ত দগম বলিয়া মনে হইতে পারে, কিন্তু তাহা কাল্পনিক; একবার বাহির হইয়া পড়িলেই একটা চলিবার পথ থাকেই। সে পথ নবাবি পথ নহে, কিন্তু পথ; সে পথে মানুষ চিরকাল চলিয়া আসিয়াছে—তাহা বন্ধর বিচিত্র সীমাহীন, তাহা শাখাপ্রশাখায় বিভক্ত, তাহা সখেদঃখে বাধাবিঘো জটিল, কিন্তু তাহা পথ। এই সাধারণ মানবের পথে একাকিনী নবাবদহিতার সদেীঘ প্রমণবৃত্তান্ত সুখশ্রাব্য হইবে না, হইলেও সে-সব কথা বলিবার উৎসাহ আমার নাই। এক কথায়, দুঃখকষ্টে বিপদ অবমাননা অনেক ভোগ করিতে হইয়াছে, তব জীবন অসহ্য হয় নাই। আতসবাজির মতো যত দাহন ততই উন্দাম গতি লাভ করিয়াছি। যতক্ষণ বেগে চলিয়াছিলাম ততক্ষণ পড়িতেছি বলিয়া বোধ ছিল না, আজ হঠাৎ সেই পরম দুঃখের, সেই চরম সখের আলোকশিখাটি নিবিয়া গিয়া এই পথপ্রান্তের ধালির উপর জড়পদার্থের ন্যায় পড়িয়া গিয়াছি—আজ আমার যাত্রা শেষ হইয়া গেছে, এইখানেই আমার কাহিনী সমাপত।” এই বলিয়া নবাবপত্রী থামিল। আমি মনে মনে ঘাড় নাড়িলাম; এখানে তো কোনোমতেই শেষ হয় না। কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া ভাঙা হিন্দিতে বলিলাম, “বেয়াদবি মাপ করিবেন, শেষ দিককার কথাটা আর-একটা খোলসা করিয়া বলিলে অধীনের মনের ব্যাকুলতা অনেকটা হ্রাস হয়।” নবাবপত্রী হাসিলেন। বঝিলাম, আমার ভাঙা হিন্দিতে ফল হইয়াছে। যদি আমি খাস হিন্দিতে বাং চালাইতে পারিতাম তাহা হইলে আমার কাছে তাঁহার লজ্জা ভাণ্ডিত ना, किन्छू श्राधि प्य उाँशग्न भाङ्छाषा अछि वाहे छानि द्वनईय़ाई श्राघाटमग्न छेछरग्नद्र মধ্যে বহৎ ব্যবধান, সেইটেই একটা আর । তিনি পনরায় আরম্ভ করিলেন, “কেশরলালের সংবাদ আমি প্রায়ই পাইতাম দরাশা ● কিন্তু কোনোমতেই তাঁহার সাক্ষাৎ লাভ করিতে পারি নাই। তিনি তাঁতিয়াটোপির দলে মিশিয়া সেই বিপ্লবাচ্ছন্ন আকাশতলে অকস্মাৎ কখনও পাবে, কখনও পশ্চিমে, কখনও ঈশানে, কখনও নৈঋতে, বজ্রপাতের মতো মহাতের মধ্যে ভাঙিয়া পড়িয়া, মহাতের মধ্যে অদশ্য হইতেছিলেন। আমি তখন যোগিনী সাজিয়া কাশীর শিবানন্দস্বামীকে পিতৃসম্বোধন করিয়া তাহার নিকট সংস্কৃত শাস্ত্র অধ্যয়ন করিতেছিলাম। ভারতবর্ষের সমস্ত সংবাদ তাঁহার পদতলে আসিয়া সমাগত হইত, আমি ভক্তিভরে শাস্ত্র শিক্ষা করিতাম এবং মমাতিক উদ্বেগের সহিত যন্ধের সংবাদ সংগ্ৰহ করিতাম। ক্লমে ব্রিটিশরাজ হিন্দুস্থানের বিদ্রোহবহি পদতলে দলন করিয়া নিবাইয়া দিল । তথন সহসা কেশরলালের সংবাদ আর পাওয়া গেল না। ভীষণ প্রলয়ালোকের রক্তরশিমতে ভারতবষের দরদ রান্তর হইতে যে-সকল বীরমাতি ক্ষণে ক্ষণে দেখা যাইতেছিল, হঠাৎ তাহারা অন্ধকারে পড়িয়া গেল। তখন আমি আর থাকিতে পারিলাম না। গরের আশ্রয় ছাড়িয়া ভৈরবীবেশে আবার বাহির হইয়া পড়িলাম। পথে পথে, তীথে তীথে”, মঠে মন্দিরে ভ্রমণ করিয়াছি, কোথাও কেশরলালের কোনো সন্ধান পাই নাই। দই-একজন যাহারা তাহার নাম জানিত, কহিল, সে হয় যুদ্ধে নয় রাজদণ্ডে মাতৃ লাভ করিয়াছে। আমার অন্তরাত্মা কহিল, কখনও নহে, কেশরলালের মৃত্যু নাই। সেই ব্রাহ্মণ, সেই দুঃসহ জলদনি কখনও নিবাণ পায় নাই, আমার আত্মাহুতি গ্রহণ করিবার জন্য সে এখনও কোনো দগম নিজান যজ্ঞবেদীতে উধনশিখা হইয়া জলিতেছে।’ হিন্দুশাস্ত্রে আছে, জ্ঞানের বারা তপস্যার বারা শদ্রে ব্রাহ্মণ হইয়াছে, মসলমান ব্রাহ্মণ হইতে পারে কি না সে কথার কোনো উল্লেখ নাই, তাহার একমাত্র কারণ, তখন মসলমান ছিল না। আমি জানিতাম, কেশরলালের সহিত আমার মিলনের বহু বিলম্ব আছে, কারণ তৎপশ্চাবে আমাকে ব্রাহ্মণ হইতে হইবে। একে একে ত্রিশ বৎসর উত্তীর্ণ হইল। আমি অন্তরে বাহিরে আচারে ব্যবহারে কায়মনোবাক্যে ব্রাহ্মণ হইলাম, আমার সেই ব্রাহ্মণ পিতামহীর রক্ত নিকলষতেজে আমার সবাঙ্গে প্রবাহিত হইল, আমি মনে মনে আমার সেই যৌবনারভের প্রথম ব্রাহ্মণ, আমার যৌবনশেষের শেষ ব্রাহ্মণ, আমার ত্রিভুবনের এক ব্রাহ্মণের পদতলে সম্পণে নিঃসংকোচে আপনাকে প্রতিষ্ঠিত করিয়া একটি অপরাপ দীপিত লাভ করিলাম। যন্ধবিপ্লবের মধ্যে কেশরলালের বীরত্বের কথা আমি অনেক শনিয়াছি, কিন্তু সে কথা আমার হাদয়ে মুদ্রিত হয় নাই। আমি সেই-যে দেখিয়াছিলাম নিঃশব্দে জ্যোৎস্নানিশীথে নিস্তব্ধ যমনার মধ্যস্লোতে একখানি ক্ষুদ্র নৌকার মধ্যে একাকী কেশরলাল ভাসিয়া চলিয়াছে, সেই চিত্রই আমার মনে অস্তিকত হইয়া আছে। আমি কেবল অহরহ দেখিতেছিলাম, ব্রাহ্মণ নিজন স্রোত বাহিয়া নিশিদিন কোন অনিদেশ রহস্যাভিমুখে ধাবিত হইতেছে—তাহার কোনো সঙ্গী নাই, কোনো সেবক নাই, কাহাকেও তাহার কোনো আবশ্যক নাই, সেই নিম’ল আত্মনিমগ্ন পরিষে আপনাতে আপনি সপণ: আকাশের গ্রহচন্দ্ৰতারা তাহাকে নিঃশব্দে নিরীক্ষণ করিতেছে। এমন সময় সংবাদ পাইলাম কেশরলাল রাজদণ্ড হইতে পলায়ন করিয়া নেপালে আশ্রয় লইয়াছে। আমি নেপালে গেলাম। সেখানে দীঘকাল বাস করিয়া সংবাদ পাইলাম, গল্পগুচ্ছ কেশরলাল বহুকাল হইল নেপাল ত্যাগ করিয়া কোথায় চলিয়া গিয়াছে কেহ জানে না। তাহার পর পাহাড়ে পাহাড়ে ভ্রমণ করিতেছি। এ হিন্দরে দেশ নহে— ভুটিয়ালেপচাগণ লেছ, ইহাদের আহার-ব্যবহারে আচার-বিচার নাই, ইহাদের দেবতা, ইহাদের পজাচনাবিধি সকলই স্বতন্ম ; বহুদিনের সাধনায় আমি যে বিশুদ্ধ শাচিতা লাভ করিয়াছি, ভয় হইতে লাগিল, পাছে তাহাতে রেখামাত্র চিহ্ন পড়ে। আমি বহন চেষ্টায় আপনাকে সব প্রকার মলিন সংপশ হইতে রক্ষা করিয়া চলিতে লাগিলাম। আমি জানিতাম, আমার তরী তীরে আসিয়া পোছিয়াছে, আমার জীবনের চরমতাঁথা অনতিদারে। তাহার পরে আর কী বলিব। শেষ কথা অতি স্বল্প। প্রদীপ যখন নেবে তখন একটি ফৎকারেই নিবিয়া যায়, সে কথা আর সদীঘ করিয়া কী ব্যাখ্যা করিব। আটত্রিশ বৎসর পরে এই দাজিলিঙে আসিয়া আজ প্রাতঃকালে কেশরলালের দেখা বক্তাকে এইখানে ক্ষান্ত হইতে দেখিয়া আমি ঔৎসক্যের সহিত জিজ্ঞাসা করিলাম, “কণী দেখিলেন।” নবাবপত্রী কহিলেন, “দেখিলাম, বন্ধ কেশরলাল ভুটিয়াপল্লীতে ভুটিয়া সী এবং তাহার গভজাত পৌত্রপৌত্রী লইয়া লানবসে মলিন অঙ্গনে ভুট্রা হইতে শস্য সংগ্ৰহ করিতেছে।” গল্প শেষ হইল; আমি ভাবিলাম, একটা সাস্ত্ৰনার কথা বলা আবশ্যক। কহিলাম, “আটত্রিশ বৎসর একাদিক্ৰমে যাহাকে প্রাণভয়ে বিজাতীয়ের সংস্নবে অহরহ থাকিতে হইয়াছে সে কেমন করিয়া আপন আচার রক্ষা করিবে।” নবাবকন্যা কহিলেন, “আমি কি তাহা বুঝি না। কিন্তু এতদিন আমি কী মোহ লইয়া ফিরিতেছিলাম! যে ব্রহ্মণা আমার কিশোর হদয় হরণ করিয়া লইয়াছিল আমি কি জানিতাম তাহা অভ্যাস তাহা সংস্কার মাত্র। আমি জানিতাম তাহা ধম, তাহা অনাদি অনন্ত। তাহাই যদি না হইবে তবে ষোলো বৎসর বয়সে প্রথম পিতৃগহ হইতে বাহির হইয়া সেই জ্যোৎস্নানিশীথে আমার বিকশিত পাপিত ভক্তিবেগকম্পিত দেহমনপ্রাণের প্রতিদানে ব্রাহ্মণের দক্ষিণ হস্ত হইতে যে দুঃসহ অপমান প্রাপ্ত হইয়াছিলাম, কেন তাহা গ্রহস্তের দীক্ষার ন্যায় নিঃশব্দে অবনত মস্তকে বিগণিত ভক্তিভরে শিরোধাব করিয়া লইয়াছিলাম। হায় ব্রাহ্মণ, তুমি তো তোমার এক অভ্যাসের পরিবতে’ আর-এক অভ্যাস লাভ করিয়াছ, আমি আমার এক যৌবন এক জীবনের পরিবতে’ আর-এক জীবন যৌবন কোথায় ফিরিয়া পাইৰ ।” এই বলিয়া রমণী উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, “নমস্কার বাবাজি ।” মহতপরেই যেন সংশোধন করিয়া কহিল, “সেলাম বাবসোহেব!” এই মুসলিম উরিয়াখামান্বর নবগনা এন আশান জৌলিছখ শ্রীজভগনাউ উন্না ব্লেমান্না নিকো রথব বিশ্বাস গ্রহণ করলেন।
আমি কোনো কথা না বলিতেই সে সেই হিমাদ্রিশিখরের ধসের কুজৰাটিকারাশির মধ্যে মেঘের মতো মিলাইয়া গেল। আমি ক্ষশকাল চক্ষ মল্লিত করিয়া সমস্ত ঘটনাবলী মানসপটে চিত্রিত দেখিতে লাগিলাম। মছলদের আসনে যমুনাতীরের গবাক্ষে সাখাসীনা ষোড়শী নবাববালিকাকে দরাশা ● দেখিলাম, তাঁথমন্দিরে সন্ধ্যারতিকালে তপস্বিনীর ভক্তিগদগদ একাগ্র মতি দেখিলাম, তাহার পরে এই দাজিলিঙে ক্যালকাটা রোডের প্রান্তে প্রবীণার কুহেলিকাচ্ছন্ন ভন্নহৃদয়ভারকাতর নৈরাশ্যমতিও দেখিলাম—একটি স্কুমার রমণীদেহে ব্ৰাহ্মণমসলমানের রক্ততরঙ্গের বিপরীত সংঘর্ষজনিত বিচিত্র ব্যাকুল সংগীতধ্বনি সন্দের সসম্পণে উদভাষায় বিগলিত হইয়া আমার মস্তিকের মধ্যে পদিত হইতে লাগিল। চক্ষ খালিয়া দেখিলাম, হঠাৎ মেঘ কাটিয়া গিয়া নিখ রৌদ্রে নিমল আকাশ ঝলমল করিতেছে, ঠেলাগাড়িতে ইংরাজ রমণী ও অলপঠে ইংরাজ পর্যগণ বায়সেবনে বাহির হইয়াছে, মধ্যে মধ্যে দই-একটি বাঙালির গলাবন্ধবিজড়িত মুখমণ্ডল হইতে আমার প্রতি সকৌতুক কটাক্ষ বৰ্ষিত হইতেছে। দ্রুত উঠিয়া পড়িলাম, এই সযোলোকি অনাবত জগৎদশ্যের মধ্যে সেই মেঘাচ্ছন্ন কাহিনীকে আর সত্য বলিয়া মনে হইল না। আমার বিশ্বাস আমি পবতের কুয়ালার সহিত আমার সিগারেটের ধর্ম ভূরিপরিমাণে মিশ্রিত করিয়া একটি কল্পনাখণ্ড রচনা করিয়াছিলাম— সেই মসলমানব্রাহ্মণী, সেই বিপ্লবীর, সেই যমুনাতীরের কেল্লা কিছুই হয়তো সত্য নহে ।
বৈশাখ ১৩o৫