প্রচণ্ড চিন্তা হচ্ছে তুবাকে নিয়ে। সরকারী চাকুরিজীবী ছেলে থেকে মেয়ের জন্য বিয়ের প্রস্তাব আসার পর থেকে তুবার বাবা-মায়ের মাথায় এত চিন্তা। বিকেলে ঘটকের মাধ্যমে বিয়ের প্রস্তাবটা আসে। কিন্তু বিয়ের প্রস্তাব আসা কোনো চিন্তার বিষয় নয়। চিন্তার বিষয় হলো ডিমান্ড বা যৌতুকের জন্য। মেয়েটা সুন্দরী হলে কথা ছিল না, কিন্তু শ্যামলা বলেই তুবার বাবা-মায়ের চিন্তা হচ্ছে খুব। দেশে সুন্দরী মেয়েদের চেয়ে,শ্যামলা আর কালো মেয়েদের যৌতুক দিতে হয় বেশী। সুন্দরী মেয়েদের যে দিতে হয় না তা কিন্তু নয়। তবুও তুলনামূলক কম দিতে হয় আজকাল। তাই তো দেশে হাজার হাজার বিউটি পার্লার আছে। সুন্দর বানানোর হাজার পন্থা। আবার সে ডুপলিকেট সুন্দরি ধরারও আছে, বিভিন্ন টিপস বা কৌশল। অনেকে তাই মেয়ের পায়ের গোড়ালির দিকে তাকিয়ে সত্যিকারের সুন্দর কিনা অবলোকন করেন। কারণ পায়ের গোড়ালি তো আর সাজানো হয় না।।
তুবা মেয়েটা শ্যামলা আর বেটে। তুবার বাবা-মায়ের তাই চিন্তা ছিল কোনো রকম মেয়েকে হালকা-পাতলা যৌতুক দিয়ে যেকোনো ছেলের সাথে বিদায় দিতে পারলেই হয়। কিন্তু সেখানে যখন তার জন্য সরকারী চাকুরিজীবী ছেলের সন্ধান পায় সেটা বড়ই উদ্বিগ্নের বিষয়, না জানি কত কিছুই না ছেলের বাবা ডিমান্ড করে বসে। তুবার জন্য ঘর-বাড়ি সব যদি বন্ধক রাখতে হয় তখন? তারা যাবেটা কোথায়? সকল বাবা-মা চায় ভালো ঘরে মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার জন্য কিন্তু নিজের মন মতো বিয়ে কয়জন মা-বাবাই দিতে পারেন। ইচ্ছা থাকলেও আজকের যুগে সাধ্যে হয় না কারো কারো। সমাজে যে এখনো যৌতুকের অভিশাপ রয়েছে। এই অভিশাপ যে অনেক ভয়ানক। যৌতুক শব্দটা হয়ত একদিন বাংলা অভিধান থেকে হারাবে কিন্তু থেকে যাবে নতুন নাম নিয়ে। যেমন সম্মানি,খাওয়া-দাওয়া, উপহার এসব নামে।
এদিকে ঠিকমত খাওয়া-দাওয়া হয় না তুবার বাবার। তুবার বাবা যে একদম গরীব তা কিন্তু নয়; মধ্যবিত্ত। যেখানে ভিক্ষাও করা যায় না আবার সহ্য করাও যায় না। একটা দোকানের উপর নির্ভর করে তার জীবন জীবিকা চলে। তাই বড় সপ্ন দেখতেও উনার ভয় করে। এসব কথা চিন্তা করেই গভীর রাতে তাহাজ্জুদের নামাজে বসে যান তিনি। হয়ত যৌতুক কম চায় সে দুয়া করতেই আল্লাহর দরবারে বারবার হাত তুলেন। পরেরদিন সন্ধ্যায় যে তুবাকে দেখতে আসবে ছেলেপক্ষ। সেটা যেন ভালো মতেই শেষ হয় সে দুয়াই করছেন বারবার। কোনোমতে রাত্রিটা কাটে রহমান সাহেবের। ছেলে পক্ষকে সন্তুষ্ট রাখতে বাহারি রঙ্গের পিঠা আর নাস্তা তৈরী করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তুবার মা। তুবাও সাজগোজ কেমন করে করবে তার পরিকল্পনা করতে থাকে।।
রহমান সাহেবের বাজার-সাজারেও অনেকগুলো টাকা তার খরচ হয়ে যায়। তবুও রাগ হচ্ছে না তার। মেয়ে জন্ম দেয়ার পর থেকেই সে কথা জানেন তিনি। তিনি জানেন যে মেয়েকে বিয়ে দিতে হলে খরচ তো করতেই হবে। তাই তার প্রাপ্ত আয় থেকে মেয়ের বিয়ের জন্য টাকা জমিয়ে ছিলেন এতদিন। কিন্তু তবুও তো কথা থেকে যায়। যদি মেয়েকে বিয়ে দিতে গিয়ে তার জমানো অর্থ এর চেয়ে বেশী খরচ হয়? তখন? যদি উনাকে অনেকগুলো টাকা ঋণ নিতে হয় তবে? সে চিন্তা করেই উনার কপালে আবার ভাঁজ পড়ে। কি যে হবে সন্ধ্যায়! তা ভেবেই ঘেমে পড়েন তিনি।
উনার ভাইয়ের মেয়েকে বিয়ে দিতে খরচ পড়েছিল পনের লাখের মতো। ছেলেকে বাইক, ফ্রিজ সহ, কুরবানীর গরু অবধি দিতে হয়েছিল। তার ভাইয়ের মেয়েরও সরকারী চাকুরিজীবীর সাথেই বিয়ে হয়েছিল।। এমন খরচ যদি তার মেয়ের বেলায়ও হয় তাহলে তিনি শেষ হয়ে যাবেন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এগুলো বর্তমানে কালচার হয়ে পড়েছে। বিয়ে হলেই করতে হবেই।। যত ভালো ছেলে তত খরচ।।
ডাইনিং টেবিলে দুপুরবেলা খেতে বসেন তুবার পরিবার। রহমান সাহেব হতাশ হয়ে বলে উঠেন,” মেয়ে জন্ম হওয়াও বড় কষ্টের বিষয়। বিয়ে দেয়ার সময় কত রকম খরচ। বিয়ের পরও আছে অনেক খরচ। টাকা হবে কিনা কে জানে?” তুবার মা সুর মিলিয়ে বলেন,” যদি তারা অনেক কিছু দাবি করে তখন? তার চেয়ে ভালো নরমাল পরিবারে তুবাকে বিয়ে দেয়া।। রহমান সাহেবও তুবার মায়ের কথা শুনে তুবার মন খারাপ হয়ে ওঠে। সে না খেয়ে যখন উঠবে-উঠবে ভাবছিল তখন তার ভাই ঘরে প্রবেশ করে। হাতে সাদা কাগজ। মুখে একরাশ আনন্দ। সে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে,” বাবা! আমার পুলিশের এসআই এর চাকরীটা হয়ে গেছে। কিন্তু রহমান সাহেব প্রথমত আনন্দিত হলেও মুখভার করে নেন। কারণ তিনি জানেন আজকের যুগের চাকরীতে কিন্তুর মানে। অনেকগুলো টাকা ঘুষ।
আগেই কথা হয়েছে ১৫ লক্ষ টাকা দিতে হবে চাকরী হলে। এখন প্রবলেম হলো তার মতো মধ্যবিত্ত কি করবে! কালো মেয়েকে বিয়ে দিবে নাকি সরকারী চাকরীজীবি ছেলেকে বানাবে। সেটা ভেবেই ভাতের প্লেটে ঘাম পড়তে থাকে অবিরত। রহমান সাহেবের স্ত্রী তা দেখে বলেন,” যেহেতু চাকরীর বিষয়, হাতছাড়া না করা ভালো হবে। ঘর বন্ধক বা সুদের উপর টাকা নিয়ে হলেও চাকরীটা হলে বেকার ছেলেটার একটা গতি হবে। আর জীবনে অমন সুযোগ আসবে না।” তুবার মায়ের কথাটা পছন্দ হয় রহমান সাহেবের। চাকরীতে হাজার-হাজার প্রতিযোগী। হাজার-হাজার ঘুষ দাতা। তাই রহমান সাহেব দেরী না করে দলিলের মাধ্যমে ঋণ নিয়ে নেতার মাধ্যমে টাকা জমা দিয়ে আসেন। অন্তত ছেলের একটা পরিচয় হবে।।।
রাত্রিবেলা সাজগোজ করে তুবা ছেলে পক্ষের সামনে আসে। তুবার গুন, কথাবার্তা শুনে ছেলের মা-বাবারও খুব পছন্দ হয় তাকে। তুবার হাতে রিং পরিয়ে দেন ছেলের মা। যখন বিয়ের ডেট ফিক্সড করতে যাবেন ঘটক, ঠিক তখন
তুবার বাবা, ছেলের বাবাকে প্রশ্ন করেন,” ইয়ে মানে… যদি আপনাদের কোনো দাবি-দাওয়া যদি থাকে তাহলে যদি জানাতেন?” ছেলের বাবা অবাক হয়ে বলেন,”মানে?” রহমান সাহেব বলেন,” আমার মেয়েটা সুন্দর নয়। আপনার ছেলে দেখতে ভালো। চাকরী আছে। আপনাদের বংশ ভালো। যদি কোনো কিছু চাওয়ার থাকে প্লিজ বলে দেন, আমি চেষ্টা করব দেয়ার।” ছেলের বাবা হেসে জবাব দেন,” আরে না। আমার একটা মেয়ে দরকার। তাই আপনার কাছে এলাম। আগের যুগের মতো দাসী কিনতে নয়। আপনাদের কথামতই বিয়ে হবে। আমার শুধু আপনার মেয়েকে আমার মেয়ে করে ঘরে তুলতে চায়।।” মেয়ের বাবার বুক থেকে যেন একটা পাথর নেমে যায়। তিনি বলেন,” আলহামদুলিল্লাহ!” তখন তুবা বাবার দিকে তাকিয়ে বলে,” কিন্তু বাবা! আমার তো যৌতুক চাই।”
তুবার বাবা তুবার কাছ থেকে কথাটা শুনে আকাশ থেকে পড়েন। তিনি চমকিয়ে বলেন,” এসব কি বলছ! মশকারি করার জায়গা পাওনা?।” ঘটক হেসে ছেলের বাবাকে বলেন,” তুবা মা অনেক মশকারী করে। আমারো মাঝে ভেংচি মারে। আপনারা মাইন্ড কইরেন না। বিয়ে মানে শাদীতে মশকারী জায়েজ আছে।” তুবা দাঁড়িয়ে যায়। বলে, ” আমার যৌতুকই চাই। আমাকে একটা এয়ারকুলার, একটা বাইক আর একটা ফ্ল্যাট, তিন রুম বিশিষ্ট দরকার। এই ছাড়া আমি আর বিয়ে করব না। কোনো রকম কেউ জবরদস্তি করলে আমি আত্মহত্যা করতে বাধ্য হবো! এটা আমার ফাইনাল কথা।” তুবা কথাটা বলে, ভিতরের দিকে চলে যায়। ছেলে পক্ষ, তুবার বাবাকে বাড়ির প্রবলেম নিরসন করতে বলে চলে আসেন। ভাই রুমে গিয়ে তুবাকে চেচামেচি করে বলে উঠে,
_” কি মাথায় সমস্যা আছে! নিজের বাবার কাছে কেউ যৌতুক চায়? মান-ইজ্জত তো কিছু রাখলিনা আর। এমনি কালো। কেউ তোকে বিয়ে করছে যে এটাও তো লাখ শুকরিয়া। আর সেখানে কিনা তুই?”
-“দেখ ভাইয়া! তোর চাকরীর টাকার সময় আমি কিছু বলিনি তাই আমার বেলায়ও কিছু বলবি না। না হলে?
-” না হলে আমি আমার সম্পত্তির অধিকারের জন্য আইনের আশ্রয় চাইব। তারপর, সবাই জেলের ভাত খাবি!”
রহমান সাহেব তুবার পিছনে অগোচরে কথাগুলো শুনেন। অশ্রুসিক্ত হয়ে রুমে গিয়ে বসে পড়েন। নিজের মেয়ে, না কার মেয়ে তা নিয়ে সন্দেহ করতে থাকেন। তুবার মা তুবাকে গিয়ে বলে,” যেখানে ওরা কিছু চাইছে না তুই কেন চাইবি!”
-” নিজের পরিবারের কাছে নিজে চাইব, অন্যরা কেন চাইবে?”
তুবার কথাশুনে মাথায় হাত দিয়ে বিছানায় বসে যান তিনি। তিনি বিলাপ করে বলে উঠেন,” হায় আল্লাহ এ-ই কোন বেহায়া মাইয়া আমারে দিলা?” একসপ্তাহ পরও একই সিদ্ধান্তে অটল থাকে তুবা। তার যৌতুক চায়। মানসিক ডাক্তারও দেখিয়েছেন তুবাকে, তবুও সে জায়গায় অটল থাকল সে। ডাক্তার এমন লোভী রোগী দেখেন নি তাও জানান। শেষমেশ রহমান সাহেব তুবার খালাকে বাসায় নিয়ে আসেন। কারণ একমাত্র ছোটো খালার কাছে সব কিছু খুলে বলে সে। তুবা ছাদে ছিল। তার ছোটোখালামনি সব শুনে তুবার সাথে দেখা করতে ছাদে চলে যায়। ছাদে গিয়ে তুবার কাঁধে হাত রাখলে পিছনে ফিরে সে দেখে তার ছোটোখালা। তিনি শান্তভাবে তুবাকে জিজ্ঞাসা করেন পন কেন চায় সে? আড়ালে তুবার বাবা-মা ও ভাই, সব শুনতে থাকে। তুবা হাউমাউ করে কান্না করে বলে; আমার মা-বাবায় আমাকে যৌতুক নেয়ার কথা শিখিয়েছে।
খালা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলে, তুবা বলতে থাকে,” ছোটবেলা থেকে যখনি আমি দামি কিছু চাইতাম তখনই বাবা-মা আমাকে বলত তোকে বিয়ে দিতে হবে না? টাকা জমাচ্ছি। আর আমার ভাই কিছু চাইলেই নিয়ে দিত। আমাকে পড়িয়েছেন সাধারণ স্কুলে আর ভাইয়াকে পড়িয়েছেন প্রাইভেট স্কুলে। আমাকে টিউশনি অবধি দেয়নি কারণ আমি মেয়ে। আমি পরের ঘরে চলে যাবো একদিন। অনেক কষ্টে আমি এইচএসসি পাশ করেছি। তারপর আমাকে পড়ানো হয়নি। চুরি করে অনার্সে ভর্তি হলাম। ভার্সিটি ছিল অনেক দূরে। তাই একটা মেয়েদের বাইক চেয়েছিলাম ভার্সিটির জন্য। কিন্তু বিয়ে দিতে হবে, সে খোটা দিয়ে আমাকে দেওয়া হলো না। কিন্তু ভাইয়াকে দিলো। ছোটবেলা থেকে যৌতুকের টাকার জমানোর কথাশুনে, বিয়ের খরচের কথাশুনে আমি সেক্রিপ্রাইসস করে এসেছি। এখন যখন আমার যৌতুক লাগবে না, তা কি করে হয়! আমার স্যাক্রিপ্রাইসেইসের কি হবে!
তাই আমি নিবো না কেন? আজ আমার জীবনও সুন্দর হতে পারত আমিও নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারতাম কিন্তু মা-বাবার জন্য হয় নি। যারা ছেলে আর মেয়েকে আলাদাভাবে দেখে, ছেলেদের পাইরোটি দেয়, তারা কারো মা-বাবা হতে পারে না। আমার মা-বাবায় আমাকে জন্ম নেয়ার পর জানিয়ে দিয়েছে আমি কালো। জানিয়ে দিয়েছে আমাকে বিয়ে দিতে অনেক টাকা লাগবে। তাহলে আজ তারা কেন সে কথার বরখেলাফ করবে।।” এটা বলে তুবা ছোটবাচ্চার মতো কেঁদে উঠে। তার কথাশুনে মা-বাবা সহ সবাই আড়ালে কাঁদতে থাকে।। কয়েকসপ্তাহ পর, আগের জায়গায় তুবার বিয়ে ঠিক হয়। বিয়ের দিন কন্যাদানের সময় হাতে ফ্ল্যাটের চাবি, অন্য ডিমান্ড সব রহমান সাহেব তুবাকে তুলে দেন । তুবা তা পেয়ে তার বাবাকে বলে, এগুলো আমার জন্য নয়, এগুলো তোমাদের জন্য। আমি শুধু চেয়েছি তোমরা তোমাদের ভুল বুঝতে পারো। আর আমার আর রোহানের এরেঞ্জ ম্যারেজ নয় লাভ ম্যারেজ। সে স্কুল থেকে আমাকে ভালবাসত। পরে সে জব পেয়ে ঘটকের মাধ্যমে বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়। এসব আমরা একসাথে করেছি।
এখনো বাংলার অধিকাংশ হিন্দু-মুসলিম পরিবারে মেয়ের বিয়ের টাকা খরচের জন্য মেয়েদেরকে ছোটোবেলা থেকে তাদেরকে চাওয়া-পাওয়া সব বিলিয়ে দিতে হয়। যৌতুক যেমন অপরাধ, তেমনি অপরাধ নিজ সন্তানের মাঝে তফাত সৃষ্টি করা। মেয়েদের কমজোর একটি পরিবারই ক্রিয়েট করে। পরিবারেই আসল আসামী। চলি বাবা! দুয়া করো অন্তত। আসা করি, তোমরা বুঝতে পেরেছ?” রহমান সাহেব ও তার স্ত্রী তাদের ভুল বুঝতে পেরে অঝোরে কাঁদতে থাকেন। মেয়ে বিদায় দেয়ার জন্য নয়, মেয়েকে সুন্দর মতো জীবন উপহার দিতে পারেনি সেজন্য এই কান্না।।
গল্পের বিষয়:
গল্প