না জীবনে কোনোদিন আশা ছাড়তে নেই। হেরে গেলেও জীবন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে নেই। ভেঙে যাক স্বপ্ন তবুও স্বপ্ন দেখা ছেড়ে দিতে নেই। গভীর রাতে একা কেঁদে মনটা হালকা করে নাও, কিন্তু সকালে সূর্যাদয়ের সাথে সাথে রাতের সব ক্লান্তি গ্লানি মুছে দিয়ে নতুন করে শুরু করতে হয়। তোমার লক্ষ্যে পৌঁছাতে গেলে তোমাকেই লড়াই করতে হবে। সবাই চাইবে তোমাকে পিছনে ফেলে দিয়ে এগিয়ে যেতে, কিন্তু কিছু মানুষের খারাপ ব্যবহারের জন্য নিজেকে থামিয়ে নিলে হবে না,বরং ঐ খারাপ ব্যবহারগুলোকে অস্ত্র করে এগিয়ে যেতে হবে। কারোর জন্য থেমে যেতে নেই, তুমি নিজের জন্য বাঁচবে। সাফল্য যেদিন তোমার দরজায় কড়া নাড়বে সেদিন ঐ সমস্ত মানুষ তোমার শরণাপন্ন হতে বাধ্য হবে। একদিন যারা তোমার ব্যার্থতায় তোমাকে ছিঃ ছিঃ করেছিল, তোমার সাফল্যে সেই মানুষগুলোই আবার হাত তালি দেবে।
এই সব কথাগুলো আজও দিনের আলোর মত স্পষ্ট মনে পড়ে মেঘার। সেদিন যদি রাজ এই সব বলে ওকে মটিভেট না করতো তাহলে হয়তো এই দিনটাই আসত না মেঘার জীবনে। হ্যাঁ আজ মেঘা বিখ্যাত ক্যনসার স্পেশালিস্ট। ভারতবর্ষের বিখ্যাত ডক্টরদের মধ্যে একজন। এবার আসি মেঘার লড়াই এর গল্পে। খুবই সাধারণ পরিবারের মেয়ে মেঘা। তবে স্পপ্নগুলো আকাশ ছোঁয়া। ডক্টর হওয়ার স্বপ্ন ছোটো থেকেই। তবে তার এই স্বপ্নটার পাশাপাশি আরও একটা স্বপ্ন দেখতো মেঘা। সেটা হল সংসার করার স্বপ্ন, প্রিয় মানুষটার সাথে সংসার করার স্বপ্ন। হ্যা আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মতোই সংসার করার ইচ্ছা ছিল খুব। টুটাই এর সাথে। ওহ তোমাদের তো টুটাই এর সাথে পরিচয় করিয়ে দি নি। টুটাই হল মেঘার ভালোবাসার মানুষ। হ্যান্ডসাম,স্মার্ট, বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। বেশ ধনী।
তবে বলাবাহুল্য বাবা মায়ের বিগরে যাওয়া ছেলে। পড়াশুনা করে নি বেশি, সারা দিন ব্ন্ধু বান্ধব, মদ , সিগারেট আড্ডা নিয়ে দিন কাটত তার। মেঘার সাথে পরিচয় হওয়ার পর মেঘা বদলে দিয়েছিল টুটাই কে। যখন মেঘার সাথে প্রথম ওর দেখা হয় তখন কিন্তু টুটাই আজকের মতো এত স্মার্ট ছিল না। একই ক্লাসে বারবার ফেল করে ডিপ্রেশন ফ্লাসটেশনে ভুগতো। আর সেখান থেকে বেরোনোর জন্য তার আশ্রয় হল মদ সিগারেট। মেঘা টুটাই কে খুব ভালোবাসত। তাই তার জীবনের সমস্ত অন্ধকার থেকে একটা নতুন আলোর দিকে নিয়ে গিয়েছিল। তার সব ব্যর্থতাকে সাফল্যে পরিনত করেছিল। সব খারাপ গুলো মেনে নিয়ে ভালো গুলো খুজে বের করে ছিল। পড়াশুনা শেষ করে বাবার ব্যাবসায় সাহায্য করার কথা, বাবা মায়ের খেয়াল রাখার কথা সব মেঘা তাকে বলেছিল। হ্যাঁ মেঘার কথা শুনে চলত টুটাই। বিগরে যাওয়া ছেলেটা এখন দায়িত্ব কর্তব্য পালন করতে পারে।
কিন্তু ঐ যে টাকার অহংকার মানুষকে বদলে দেয়। বাবা অসুস্থ হয়ে যাওয়ার পর টুটাই এর হাতে ব্যাবসার সমস্ত টাকা পয়সা আসে। আর আবার শুরু হয় তার মদ সিগারেট বন্ধু বান্ধব, সারাদিন ব্যাবসা সামলে সন্ধ্যায় তার ঠিকানা মদের দোকান। ভালো sports bike কিনে বন্ধু বান্ধব দের সাথে বাইক রেসিং। আবার শুরু হয়েছিল তার বেপয়া জীবন যাপন। মেঘা চেয়েছিল আবার নতুন করে টুটাইকে বদলে দিতে কিন্তু এই বার সে পারে নি। তারপর থেকেই শুরু হয় তাদের সম্পর্কের ভাঙন। অনেক চেষ্টা করেও মেঘা তার জীবনে টুটাইকে ধরে রাখতে পারেনি। টুটাই তখন অন্য মেয়েদের সাথে ব্যস্ত। শত অবহেলা, অপমানের সত্তেও মেঘা টুটাইকে ছেড়ে যায়নি। কিন্তু যেদিন টুটাই মেঘার আত্মসম্মান নিয়ে প্রশ্ন তুললো, মেঘা নাকি ওকে ওর টাকার জন্য ভালোবাসে, মেঘা বড়লোক ছেলের গলায় ঝুলে পড়তে চাই। তাই এত কিছুর পরও মেঘা টুটাইকে ছেড়ে দেয় নি। নিজের কোনো আত্মসম্মান বোধ নেই। হ্যাঁ সেদিনই মেঘা ছেড়ে এসেছিল টুটাই কে।
কিন্তু এই আঘাতটা ভিতরে ভিতরে শেষ করে দিচ্ছিল মেঘাকে। তাই ডিপ্রেশনে এসে মেঘাও টুটাই এর পথ অবলম্বন করল। যে মেঘা মেডিকেল কলেজে দু’বছর পড়ার সত্তেও কোনো দিনও ঐ সব মদ সিগারেট ছুঁয়েও দেখেনি,আজ সেই মেঘায় সিগারেট ছাড়া থাকতে পারে না। প্রতিদিন ড্রিংস না নিলে ঘুম আসে না, স্লিপিং পিল নেওয়াটাও এখন তার ডেইলি অভ্যাসে পরিনত হয়েছে। অদ্ভুত ভাবে বদলে যাচ্ছে মেয়েটা। একদিন বান্ধবির বার্থডে পার্টি থেকে নেশায় চুড় হয়ে হাতে একটা বেয়ার এর বোতল নিয়ে মেসে ফিরছিল। তখনই তার দেখা রাজের সাথে। মেঘা আর বাঁচতে চাই না তাই রাস্তায় বেসামাল হয়ে হেঁটে যাচ্ছিল,যাতে কোনো কোনো গাড়ি হাই স্পিডে এসে তাকে ধাক্কা দিয়ে দেয়। আর হচ্ছিলও তাই, সময় মতো রাজ তাকে গাড়ির সামনে থেকে না সরিয়ে নিলে হয়তো মেঘা আজ আকাশের তারা হয়ে যেত।
তারপর থেকেই শুরু হয় রাজ আর মেঘার বন্ধুত্ব। রাজ মেঘার কলেজের পাশের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সুডেন্ট, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়েও রাজ কোনো রকম নেশা করে না। ভদ্র নম্র স্বভাব। বেশ ভালো কথা বলে ছেলে টা। তারপর ফোন মেজেসে কথা হত। মাঝে মাঝে খুব মনটা খারাপ থাকলে দেখাও করত দুজন। রাজ মেঘাকে তার ডিপ্রেশন থেকে অনেকটা বের করে এনে ছিল কিন্তু তার সিগারেট খাওয়াটা ছাড়াতে পারেনি। যাই হোক মেঘার কলেজ কমপ্লিট হলো, লাস্ট ইয়ারে মেঘা কলেজের টপার। সবই রাজের জন্য। রাজ যদি তাকে মোটিভেট না করত তাহলে হয়তো মেঘা এত কিছু এচিভমেন্ট করতে পারত না। তারপর মেঘা তার একটা নিজের ক্যানসার স্পেশালিস্ট হসপিটাল খুলল। সব থেকে বেস্ট ট্রিটমেন্ট হত তার হসপিটালে। রাজ আর মেঘার সম্পর্কটাও এখন আর শুধু বন্ধুত্বের নয়। সম্পর্কটা ভালো লাগা পর্যন্ত গড়িয়েছে। মেঘা আর রাজের পরিবারের লোকজন সবাই চায় তাদের চারহাত এক করতে। কিন্তু তারা আর একটু সময় নিতে চায়।
টুটাই এর বেপরোয়া জীবন যাপনের জন্য তাদের সমস্ত জমানো ভান্ডার খালি হতে শুরু করেছে। ব্যবসায় মন না দিয়ে আনন্দ ফুর্তি তে মেতে থেকেছে টুটাই। তার বাবার ক্যনসার ধরা পড়েছে। আর ক্যানসারের মতো রোগের চিকিৎসা করার মতো সামর্থ্য তাদের নেই। তবুও আত্মীয় স্বজনদের সাহায্যে টুটাই তার বাবার চিকিৎসা শুরু করেছে,
আর সেটা মেঘার হসপিটালে। আর আবার সেখানেই দেখা মেঘার সাথে তার প্রাক্তন প্রেমিক টুটাই এর। অন্য ডক্টরের কাছে থেকে হেলথ কনডিসন জানার পর মেঘা অবাক। ইমিডিয়েট অপেরেশন না করলে মানুষটাকে বাঁচানো যাবে না। ওর ফ্যামিলির সাথে কথা বলে মেঘা জানতে পারে অপারেশনের খরচ তারা বহন করতে পারবে না। কিছু না ভেবেই মেঘা সমস্ত কিছু ফ্রি অফ কস্ট করে দেয়। যদিও মেঘা তার হসপিটালে অনেক গরীব মানুষের জন্য ফ্রী চিকিৎসা প্রভাইড করে। তাই এটা নতুন কিছু নয়।
অপারেশন এর পর মেঘার কাছে টুটাই ক্ষমা চাই। ফিরে পেতে চায় তাদের পুরনো সম্পর্কটা। কিন্তু না হয়তো অনেক দেরি হয়ে গেছে। আজ রাজের বার্থডে , বারবার রাজের ফোন। রাজ এই সবের কিছুই জানে না, মেঘা রাজকে বলেছিল আজ কোনো কাজ রাখবে না। আর খুব তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাবে রাজের বাড়িতে। কিন্তু হঠাৎ ই অপারেশনটা করতে হলো। অন্য ডক্টর করতে পারত কিন্তু মেঘা নিজেই করতে চাইল। রাজের বার্থডে পার্টিতে তাদের এনগেজমেন্ট এর ডেট টা এনাউন্স করা হবে। দু পরিবারের কেউ ই আর সময় দিতে রাজি নয়। পরিবারের মুখের উপর আর কিছু বলতে পারে নি দুজনেই। টুটাই আজ নিজের ভুলটা বুঝতে পেরেছে কিন্তু আর সত্যিই অনেক দেরি হয়ে গেছে। জীবনের সাথে সাথে সম্পর্কের সমীকরণ গুলো বদলে যায়। আজ সত্যিই যারা মেঘাকে অপমান অবহেলা করেছিল তারা আজ মেঘার সাফল্যে হাততালি দিচ্ছে। যারা খারাপ সময়ে তাকে দূরে ঠেলে দিয়েছিল তারা আবার কাছে আসতে চাইছে। সত্যিই রাজের বলা সেদিনের কথা গুলো সব মিলে যাচ্ছে।
রাজ মেঘার জীবনে সত্যিই নতুন আলোর আশা। পড়ন্ত বিকেলের নয় নতুন সূর্যের আলোর মতো আলোকিত করেছে তার জীবন। বার্থডে পার্টিতে এনগেজমেন্ট এর দিন ঠিক হয়ে গেল। গভীর রাতে একা মেঘা ছাদে দাঁড়িয়ে হাতে একটা জ্বলন্ত সিগারেট নিয়ে তারা গুনছিল। আর ভাবছিল সত্যিই জীবনটা অনেক সুন্দর, হেরে গিয়েও জেতা যায়। একবার স্বপ্ন ভেঙে গেলে আবার নতুন করে স্বপ্ন দেখতে হয়। রাতের অন্ধকারে হারিয়ে না গিয়ে দিনের আলো ফোটার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। হয়তো কালকের দিনটা অন্য রকম হবে। পুরনো সব ভুলে গিয়ে নতুন করে শুরু করার একটা দিন আসতে পারে। নতুন করে আশার আলো দেখতে পারে । বেঁচে থাকার লড়াইয়ে হেরে যেতে নেই।
এই সব ভাবতে ভাবতে সিগারেটের কাউন্টারটা হঠাৎ মেঘার আঙ্গুলে ছেঁকা লাগল। গভীর ভাবনায় এতটাই বিভোর হয়ে গেছিল মেঘা যে খেয়ালই করেনি সিগারেট টা শেষ হয়ে গেছে। শেষ থেকেই শুরু হোক আবার নতুন করে। নতুন করে স্বপ্ন দেখা। নতুন করে আশার আলোয় বাঁচার মানে খুঁজে নিতে হবে রাজের সাথে। না আর অন্ধকারে নয়, এবার আলোর পথে এগিয়ে যাবে দুজনে। সিগারেটের প্যাকেটা ফেলে দিল মেঘা। রাজ যে পছন্দ করে না।।