কাজের পর হাতে সময় থাকলে মাঝে মাঝে ট্রামে করে ফিরি। ট্রামে চড়ার একটা আলাদা মজা আছে। আজও ট্রামে করে ফিরছি। জ্যামে ট্রামটা বউবাজারে দাড়িয়ে আছে অনেকক্ষণ। আমি জানলা দিয়ে বাইরে দেখছি লোকের ঠেলাঠেলি আর গাড়ির ভিড়। এমন সময় আমার ফোনটা বেজে উঠল। পকেট থেকে ফোনটা বার করে দেখি পমি জোড়া শালিক গল্পের পমি। ফোনটা তুললাম, হ্যাঁ বল।
-“তোমার কাছে কলেজস্ট্রীটের ওই বই-এর দোকানের নাম্বার আছ? ওই যে student না কি, যেটা কফি হাউসের পাশে?
-“ও, Student Book Stall? হ্যাঁ আছে, একটু ধর দিচ্ছি।”
পকেট থেকে মানিব্যাগটা বার করে ওই দোকানের কার্ডটা বার করলাম।
-“নে লেখ, 98…30…16…54…94
-“thank you”
-“আরে, ঠিক আছে, ভাল আছিস তো?”
এইসব কথার পর ফোন টা রেখে দিল। ওই দোকানের কথা বললেই আমার একটা গল্প মনে পড়ে যায়।
ওই দোকানে একটা ছেলে কাজ করত। নাম জিতেন, বিহারি ছেলে,বয়স ২৫ কি ২৬ হবে, ভাল ছেলে। বই পড়তে ভালবাসত, তাই বইয়ের দোকানে কাজ নিয়েছিল। বিহারি হলেও কলকাতায় থেকে বাংলা লেখা ও পড়া টা শিখে নিয়েছিল।
একদিন একটা বইয়ের সন্ধান করতে গিয়ে দেখি সে মন মরা হয়ে আছে। কাজ তো করছে, কিন্তু কাজে মন নেই জিতেনের। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “জিতেন, কেমন অন্যমনস্ক হয়ে আছো, কি ব্যাপার?” দোকানের মালিক অজয় কাকু বললেন, “পরশু দিন দেশ থেকে ফিরেছে, তারপর থেকেই এমন অবস্থা।”
জিতেনকে বললাম, “জিতেন, চলোতো একটু আমার সাথে।” অজয় কাকুও সম্মতি দিলেন, “যা, ঘুরে আয়।” আর এদিকে আমারও খিদে পেয়েছে। হাতের কাছে কফি হাউস থাকতে আর অন্য কিছু ভাবতে হল না। গিয়ে দেখি একটা টেবিলও খালি নেই। সৌভাগ্যবশত তার পরের মুহূর্তে একটা টেবিল খালি হল। গিয়ে দখল করলাম সেটাকে। জিতেনকে জিজ্ঞাসা করলাম, “কি হয়েছে বলো এবার।” জিতেন বলতে শুরু করল।
“দাদুর ১০বছরের মৃত্যুবার্ষিকীতে দেশে গিয়েছিলাম। অনুষ্ঠান ঠিক ভাবেই হয়েছে, কোনো ঝামেলা হয়নি। মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে দাদুর কথা খুব মনে পড়ছিল। দাদু ভীষণ গরীব ছিলেন। নিজের বলতে তেমন কিছুই ছিল না। বাবারা ছোট থাকতেই ঠাকুমা মারা যান। দাদু একা হয়ে পড়েন, আর বিয়েও করেননি। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের বড় করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। দাদু আগেকার দিনের মানুষ, তবে সেই তুলনায় ওনার সন্তান কমই ছিল। চার মেয়ের পর এক ছেলে (আমার বাবা)। বাবা উত্তরাধিকার সুত্রে সম্পত্তি তেমন কিছুই পান নি তার বাবার কাছ থেকে। যাই হোক, অন্যের জমিতে কাজ করে টাকা জমিয়ে বাড়ির জমিটুকু কিনেছেন।”
ইতিমধ্যে আমাদের খাবারের অর্ডার নিতে এসেছে। আমি নিলাম কফি আর চিকেন কাটলেট। জিতেনের আপত্তি না থাকায় ওর জন্য ও একই খাবারের অর্ডার দিলাম। তারপর জিতেন আবার বলতে শুরু করলো। “পরবর্তীকালে দাদু অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়ে। আর বাবাও চাষআবাদ ছেড়ে বাড়িতে মুদি দোকান খোলেন। রাস্তার উপর বাড়ি, দোকানটা ভালোই চলে।
কিন্তু শয্যাশায়ী দাদুর সেবা কে করবে? পিসিরা আসে, দেখে চলে যায়, বাবা ছাড়া আর কোনো ছেলেও নেই। তাই আমাদেরই দেখতে হবে। বিছানায় তার সবকিছু, ঘরও খুব নোংরা করে। তাই স্বাভাবিকভাবেই দাদু আমাদের সবার ঘৃণার পাত্র হয়ে ওঠে। সবাই খারাপ কথা বলে, বকাবকি করে। কিন্তু এটা কেউ বুঝতে চাইল না মানুষটা অসুস্থ, আর বয়স বাড়লে মানুষ শিশুসুলভ আচরণ করে।” আমাদের খাবার এসে গেল। খেতে শুরু করলাম আমরা, খেতে খেতে জিতেন আবার বলা শুরু করলো।
“আমায় দেখে হাসত, ‘দাদুভাই’ বলে ডেকে পাশে বসাতো, মাঝে মাঝে আমি ও বিরক্ত হতাম। এইভাবে অন্যের ঘৃণার পাত্র হয়ে দাদুর দিন কাটছিল। তারপর একদিন ভোরবেলা মায়ের কান্নায় আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। কান্নার শব্দতা দাদুর ঘর থেকে আসছে। আমি বুঝে গেলাম, দাদু আর আমায় দেখে হাসবে না, আমায় ‘দাদুভাই’ বলে ডাকবে না।
দাদু তো আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। কিন্তু দাদুর স্মৃতি! আমার কাছে দাদুর স্মৃতি বলতে ছিল ১ টা বাঁশ দিয়ে বানানো বসার বেঞ্চ, দাদুই বানিয়েছিল, আমাদের দোকানের সামনে মাটিতে লাগানো ছিল, ওটাকে সরানো যেত না। এবার বাড়ি গিয়ে দেখি রাস্তা চওড়া হবার কাজ শুরু হয়েছে। আর এই কাজের বলি হয়েছে সেই বাঁশের বেঞ্চটা। মাটি থেকে উপড়ে ফেলা হয়েছে বেঞ্চটাকে, ভেঙ্গে গিয়েছে ওটা। বাবা দোকান খোলার পর দাদু নিজে হাতে ওটা বানিয়েছিলেন, সকালে ওখানে পাড়ার বয়স্কদের আড্ডা বসতো।
আজ খুব miss করি দাদুকে, সেই হাসি, সেই নির্মল দাড়ি ভরা মুখ, সেই বিড়ির গন্ধ, আর সেই ‘দাদুভাই’ ডাকটা।” ভেবে আমার চোখে জল এসে গেল। কোনোমতে রুমালে চোখ মুছে বাস্তব জগতে ফিরে দেখি ট্রামটা অনেকক্ষণ আগে ছেড়ে দিয়েছে। এখানে আর জ্যাম নেই, ফাঁকা রাস্তায় ছুটছে ট্রামটা। এই ঘটনার দেড় বছর পর জিতেন নাকি পুলিসের চাকরি পেয়ে দেশে ফিরে গেছে। বিয়ে করেছে, মেয়েও নাকি হয়েছে তার। তারপর আজ, আর ১২ টা বছর কেটে গেছে। আমার সাথে আজ জিতেনের আর কোনো যোগাযোগ নেই।