আমার স্ত্রীর নাম রোকেয়া বেগম। অত্যন্ত গুনবতী মহিলা। স্বামীর প্রতি তাঁর ভালবাসা ও শ্রদ্ধার কোন শেষ নেই। চল্লিশ বছরের সংসার জীবনে কখনো আমার কথার অবাধ্য হয়নি। সংসারের যাবতীয় হিসেব নিকেষ সব আমার স্ত্রীই করে এসেছে। ছেলেদের মানুষের মত মানুষ করেছি। আমি অবশ্য ছেলেদের দিকে খেয়াল রাখতে পারিনি। সবকিছু ওদের মা ই সামলিয়েছে। আমার দুই ছেলে। বড় ছেলের নাম রায়হান আহমেদ। অনেক মেধাবী ছেলে। কথা ও কাজে সবসময় এক ও অবিচল।
এখন বড় ব্যবসায়ি। কখনো আমার কথার অবাধ্য হয়নি। আমাদের গ্রামের অনেক ছেলে মেয়েদের চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছে। আমার ছোট ছেলের নাম সোহেল রানা। দু তিন গ্রামের মধ্যে ওর মত মেধাবী ছেলে আর একটিও নেই। নিজের ছেলে বলে বলছি না, ও শুধু মেধাবী তা নয়, ওর মত ভদ্র ছেলেও দু তিন গ্রামে আর একটিও নেই। ৩০ তম বিসিএস ক্যাডার। বর্তমানে ডেপুটি কমিশনার। ছেলেকে বিয়ে করিয়েছি বড় ঘরে। ছেলের শ্বশুর পুলিশের বড় অফিসার ছিলেন। আমি আর আমার স্ত্রী গ্রামেই থাকি। এ নিয়ে ছেলেরা সবসময় দুশ্চিন্তাগ্রস্থ থাকে । কখন ঔষধ লাগে, কখন বাজার লাগে এসব নিয়ে ওরা এখনো ভাবে। শত ব্যস্ততার মাঝেও প্রতিদিন অন্তত দুই তিন বার ফোন করে সব খবরা খবর নেয়।
রোকেয়া প্রায়ই অসুস্থ থাকে। বেশ কয়েকবার ঢাকাতে নিয়ে ছেলেরা ডাক্তার দেখিয়ে দিয়েছে। বছর পাঁচেক হল আমি অবসর নিয়েছি। বাড়ির পাশে হাই স্কুলটায় শিক্ষকতা করতাম। গ্রামের মানুষ আমাকে মকবুল মাষ্টার বলে ডাকে। ঘরের বারান্দায় যখন বসে থাকি তখন এই পথ ধরে যত মানুষই চলাফেরা করে সবাই আমার খোঁজ খবর নেয়। মাষ্টার সাব কেমন আছেন, এসব জিজ্ঞেস করে। সবাই অনেক সমীহ করে। গ্রামের মানুষের এই ভালবাসা ছেড়ে আমার কিছুতেই শহরে যেতে ভাল লাগে না । আমার স্ত্রীও মাটির মানুষ। এই মাটিতেই থাকতে চায়। কিন্তু ছেলেরা তো আমাদের জন্য সারাক্ষণ টেনশান করে। তাছাড়া আমাদের কয়েকটা নাতি নাতনী আছে। ওদেরও তো দাদা দাদীর সাথে গল্প করতে ইচ্ছে করে। মাঝে মাঝে ভাবি ছেলেরা এত করে বলছে , একবার গিয়ে দেখি শহরে কী আছে । কিন্তু আমার স্ত্রী কিছুতেই রাজি হয় না।
গত কয়েকদিন ধরে আমার শরীরটাও ভাল নেই। ছেলেরা এ খবর শুনেছে। কাজের লোক দিয়ে অবশ্য সব কাজ হয় না। আমি ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করতে পারি না। রোকেয়া সব সময় পানি গরম করে দিত। এখন ও নিজেই অসুস্থ। আমার সেবা আর কখন করবে। বরং আমি নিজেই ওর সেবা করি। হঠাৎ খেয়াল করলাম রোকেয়ার চোখে পানি। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কাঁদছো কেন? রোকেয়া বলল, স্বামীর পায়ে নিচে স্ত্রীর বেহেশ্ত কিন্তু আমি আপনার সেবা করতে পারছি না। আমি বললাম, তুমি তো সারা জীবনে অনেক কিছু করেছো। বরং স্বামী হিসেবে আমি কিছু করতে পারিনি। তুমি আমাকে মাফ করে দিও। আমার কথা শুনে রোকেয়া আরো জোরে কান্না করে দিল। ওর কান্না দেখে আমিও স্বাভাবিক থাকতে পারলাম না।
রোকেয়াকে যখন বিয়ে করেছিলাম তখন ওর বয়স খুবই কম ছিল। বালিকা বধূ পর্যায়ের। সেই বালিকাই একটু একটু করে আমার অগোছালো জীবনকে গুছিয়ে দিল। আমাকে উপহার দিল দুটি সোনার টুকরা ছেলে। প্রথম জীবনে ভাত কাপড়ে অনেক কষ্ট পেয়েছে রোকেয়া । কিন্তু কখনো মুখ ফুটে কিছু বলে নি। আজ আমাদের কোন অভাব নেই। দুজনার অফুরন্ত সময়। সারাদিন বসে বসে গল্প করি। মনে হচ্ছে সংসার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় এটি। তবে ছেলেরা ,পুত্রবধুরা ও নাতী- নাতনী সবাই একসাথে থাকলে মনে হয় আরো আনন্দ হত। কিন্তু গ্রামের এই নির্মল বাতাস রেখে শহরে যেতে ভাল লাগে না। নির্মল বাতাসের চেয়েও আরেকটি জিনিস সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ । তা হল বাপের ভিটা। এই ভিটার কাঁদা মাটি মেখেই আজ বৃদ্ধে পরিণত হয়েছি। এই ভিটা ছেড়ে যাই কীভাবে?
দুপুরের দিকে বিরাট একটি কান্ড ঘটে গেল। আমার দুই ছেলে একসাথে বাড়িতে উপস্থিত। ওরা দুজন একসাথে সর্বশেষ কবে এসেছিল আমার মনে নেই। ছোট ছেলে থাকে চট্রগ্রাম। আর বড় ছেলের ব্যবসা ঢাকায়। ছেলেদের দেখে রোকেয়া যেন সুস্থ হয়ে গেল। আমিও শরীরে শক্তি পাচ্ছি এখন। রোকেয়া বিছানা ছেড়ে উঠলো। ছেলেদের জন্য রান্নার আয়োজন করতে লাগলো। কিন্তু ওর দুর্বল শরীর নিয়ে কীভাবে কী করবে কে জানে? আমি জিজ্ঞেস করলাম, বউ , নাতীদের নিয়ে আসলি না কেন? বড় ছেলে রায়হান বলল, বাচ্চাদের পরীক্ষা তাই নিয়ে আসিনি। ওরা দুই ভাই বাড়ি এসেছে এ খবর গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে। গ্রামের লোকজন ওদের সাথে দেখা করতে এসেছে। আমার খুব ভাল লাগছে। আনন্দে কান্না আসছে। আমার ছেলেদেরকেও গ্রামের মানুষ ভালবাসে। ছোট ছেলের অনেক দায়িত্ব। একটু পর পর ওর মোবাইলে কল আসে। পুরো একটি জেলার সবকিছু ওকে সামলাতে হয়। অথচ ছোটবেলায় নিজের প্যান্টটা ঠিকমত পরতে পারতো না। মাছের কাঁটা বেছে খেতে পারতো না। কিন্তু পড়ালেখায় ছিল সবার সেরা। আজ আমার ছেলে কত বড় অফিসার ! এসব ভাবলে গর্বে বুকটা ভরে যায়।
ছোট ছেলে সোহেল আমার কাছে এসে বসলো। আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। কত দিন এই মাথায় হাত রাখি না! ও বলল, আব্বা আপনার শরীর এখন কেমন? আমি বললাম, বয়স হয়েছে এখন তো সব সময় ভাল থাকা যায় না। তোরা কাছে থাকলে তো কোন রোগই থাকে না। বড় ছেলে আর ওর মা দুজনে কী বিষয়ে যেন কথা বলছে। বেশ খুশি খুশি লাগছে দুজনকে। খুব ভাল লাগছে আমার। রোকেয়াকে এতটা হাসিখুশি দুএক বছরে দেখিনি। বড় ছেলে আমাকে বলল, আব্বা এবার আর এখানে থাকতে দিব না। সোহেল ও আমি এ জন্যই একসাথে এসেছি। আমি বললাম, আমার আপত্তি নেই। আগে তোমার মাকে রাজি করাও। রায়হান বলল, মা কখনো আপনার উপরে কথা বলবে না। আপনি রাজি হলেই মা রাজি হবেন। ছেলেরা যেহেতু এতকরে বলছে, আমাদের রাজি হওয়া দরকার। এখন আমরা দুজনই অসুস্থ। ঠিকমত চলতে ফিরতে পারি না। আমাদেরকে দেখতে না পেরে ছেলেরাও কষ্টে থাকে। ওদের কষ্ট দূর করা তো আমাদেরই দায়িত্ব। এসব কথা রোকেয়াকে বুঝালাম। রোকেয়া বলল, আপনি যা বলবেন তাই হবে।
রাতে সবাই মিলে এক টেবিলে খাবার খাচ্ছি। সবাই এক সাথে সর্বশেষ কবে খেয়েছিলাম ঠিক মনে নেই। জীবনে এরকম আনন্দের মুহূর্ত আর হয় না। আমার দাদু ভাইরা যদি আসতো তবে আরো আনন্দ হত। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। কাল সকালেই ছেলেদের সাথে শহরে যাব। ভাল না লাগলে আবার গ্রামে চলে আসবো। কিন্তু ছোট একটা সমস্যা দেখা দিল। শহরে ছেলেরা তো এক জায়গায় থাকে না। একজন থাকে ঢাকায়, অন্যজন চট্রগ্রাম। তাহলে কার বাসায় যাব? আমি বড় ছেলেকে জিজ্ঞেস করলাম, রায়হান আমরা কার বাসায় যাব? রায়হান হেসে বলল, আপনাদের ইচ্ছে। যার বাসায় খুশি যেতে পারেন। আমি ঝামেলায় পড়ে গেলাম। রোকেয়ার সাথে আলাপ করলাম । রোকেয়াও কোন সিদ্ধান্ত দিতে পারলো না। একজনের বাসায় গেলে অন্যজন কষ্ট পাবে। আমাদের উপর তো দুই ছেলেরই সমান অধিকার। এখন কী করা উচিত ঠিক বুঝতে পারছি না।
আমি বারান্দায় বসে বসে ভাবছি। মা ও ছেলেরা মিলে গল্প করছে। আমি সোহেলকে ডাকলাম। সোহেল আমার পাশে বসলো। আমি বললাম, তোরা দুজন তো দুই জায়গায় থাকিস, আমরা কার বাসায় যাব। সোহেল বলল, আব্বা একটা কাজ করলে মনে হয় ভাল হয়। আপনারা একজন আমার বাসায় আর আরেকজন ভাইয়ের বাসায় চলেন। সোহেলের কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু রোকেয়া আর আমি আলাদা হয়ে যাব, এটা কী করে হয়? কিন্তু এ ছাড়া তো আর কোন সমাধান দেখছি না। রোকেয়াকে ডাকলাম। দুজন মিলে ভাবছি কী করা যায়। আমার স্ত্রী কিছুতে এই সিদ্ধান্তে রাজি হচ্ছে না। আমি আর রোকেয়া শেষ বয়সে আলাদা থাকবো এটা ভাবতে কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু ছেলেদের মুখের দিকে তাকিয়ে আমরা রাজি হলাম। কাল সকালেই আমরা চলে যাব।
আমি আর আমার স্ত্রী শুয়ে আছি। ভাবছি বিয়ের প্রথম জীবনের কথা। রোকেয়া খুব লাজুক প্রকৃতির মেয়ে ছিল। একদম আমার কাছে ঘেঁষতো না। আমিই সবসময় কাছাকাছি থাকতাম। স্কুলের বিরতিতে বাড়ি এসে ওকে দেখে যেতাম। একবার ট্রেনিং এর জন্য সাত দিন বাড়িতে ছিলাম না। রোকেয়ার সে কি কান্না। সে কথা মনে হলে আজও কষ্ট হয়। বিয়ের প্রথম জীবনে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে যে মধুর সম্পর্ক থাকে তা আবার বৃদ্ধ বয়সে জেগে ওঠে। মাঝখানে সংসার জীবনে দুজনেই ব্যস্ত থাকে। আগামিকাল থেকে আমাদের আর দেখা হবে না, এটা ভাবতেই মনের মধ্যে কেমন যেন করে উঠছে। কিন্তু এর কোন বিকল্প নেই। এই অচল জীবনে ছেলেদের সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়া ঠিক হবে না। রোকেয়াকে বললাম, তুমি চিন্তা কর না। আল্লাহর উপর ভরসা রাখ। খুব ভোরে ঘুম ভাঙলো আমাদের ।ফজরের নামাজ পড়ে আমার বাবা মায়ের কবর জিয়ারত করলাম। শহরে যাচ্ছি আর তো নাও ফিরতে পারি! রোকেয়া কাপড় চোপড় গোছাচ্ছে। রায়হান বলল, মা বেশি কিছু নিতে হবে না। প্রয়োজন হলে ঢাকায় গিয়ে সবকিছু কিনে দিব। কিন্তু পানের বাটা, জায়নামাজ, কোরআন শরীফ এগুলো তো নিতেই হবে। আমি কী কী নিব তাই ভাবছি। আমার লাঠি, চশমা, কিছু বইপত্র, কোরআন শরীফ ইত্যাদি নিলাম। গ্রামের আত্বীয় স্বজনরা আমাদের বিদায় জানাতে এসেছে।
আমি রায়হানের সাথে ঢাকায় যাব, আমার স্ত্রী যাবে চট্রগ্রামে। জীবনের এই বিচ্ছেদ যে অনিবার্য তা কখনো ভাবিনি। রোকেয়া বলল, রায়হান তোর আব্বার দিকে খেয়াল রাখিস। উনি কিন্তু ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করতে পারে না। কথাটি বলে রোকেয়া হু হু করে কেঁদে উঠলো। আমিও নিজেকে সামলাতে পারলাম না। ছোট ছেলেকে বললাম, তোর মায়ের যেন কষ্ট না হয়। উপস্থিত আত্বীয় স্বজনরা কেউ কেউ চোখ মুছছে। বড় ছেলে বলল, আব্বা কাঁদছেন কেন? আপনারা তো বেড়াতে যাচ্ছেন। কয়েকদিন পরেই আমরা সবাই একসাথে থাকবো। আমি রোকেয়াকে শান্ত করার চেষ্টা করলাম। আমরা তো আমাদের ছেলেদের কাছে যাচ্ছি। পৃথিবীতে সন্তানের চেয়ে বড় আপন আর কেউ নেই। তাহলে আমরা কাঁদছি কেন? আমার কথা শুনে রোকেয়া শান্ত হল।
দুই ছেলের দুইটি গাড়ি। আমরা গাড়িতে উঠলাম। আমি বড় ছেলের গাড়িতে আর রোকেয়া ছোট ছেলের গাড়িতে। বাড়িতে বড় বড় দুটি তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে ছেলেরা। তালাবদ্ধ ঘরটি দেখতে খুব কষ্ট হচ্ছে। রোকেয়া আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ঠিকমত ঔষধ খাইয়েন। আমার জন্য চিন্তা করবেন না। আমি কিছু বলতে চেয়েও পারলাম না। গলাটা কেন যেন ধরে এল। গাড়ি চলছে। যদি আর কোনদিন রোকেয়ার সাথে দেখা না হয়? আমি যদি ঢাকায় গিয়ে মরে যাই? এরকম হাজার প্রশ্ন মনের মধ্যে উঁকি দিচ্ছে। মনের অজান্তে চোখের কোনে পানি জমলো। রায়হান আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আব্বা আপনি কাঁদছেন কেন? ঢাকায় গেলে আপনার ভাল লাগবে। মায়ের সাথে যখন খুশি মোবাইলে কথা বলতে পারবেন। ছেলে ঠিকই বলেছে। এমনটা তো আগে ভাবিনি। রোকেয়ার কথা মনে পড়লে মোবাইলে তো কথা বলতে পারবো। আমি অহেতুক মন খারাপ করছি।
দুপুরেরদিকে বড় ছেলের বাসায় পৌঁছলাম। বউমা খুব খুশি হয়েছে। রায়হানের এক ছেলে, এক মেয়ে। মেয়ের বয়স নয় কি দশ হবে। আর ছেলের বয়স দুই বছর। নাতী-নাতনীরা আমার কাছে ছুটে এলো। খুব ভাল লাগছে। রায়হানকে বললাম, তোর মা কি পৌঁছিয়েছে? রায়হান বলল, তাঁদের পৌঁছাতে আরো সময় লাগবে। আমার জন্য একটা রুম রেডি করা হয়েছে। বিছানাটা বেশ নরম। বিছানায় একটা কোলবালিশ । এটাও বেশ নরম। সন্ধ্যার দিকে আমি শুয়ে আছি। মাথাটা একটু ব্যাথা করছে। রায়হান মোবাইল নিয়ে এসেছে। ওর মায়ের সাথে কথা বলিয়ে দিল। রোকেয়ার সাথে আমি কখনো মোবাইলে কথা বলিনি। প্রথমবার তো তাই কথা বলতে একটু লজ্জা করছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, রোকেয়া পথে কোন অসুবিধা হয়নি তো? রোকেয়া বলল, না কোন অসুবিধা হয়নি। রোকেয়ার সাথে কথা বলার পর একটু ভাল লাগছে।
কত পদের যে খাবারের আয়োজন তার ইয়াত্তা নেই। বউমার হাতের রান্না বেশ মজার তবে রোকেয়ার মত নয়। অবশ্য বউমা যখন রোকেয়ার বয়সি হবে তখন হয়তো আরো ভাল রাঁধবে। শহরে থাকতে আমার তেমন কোন অসুবিধে হচ্ছে না। রায়হান নিয়মিত আমার খোঁজ খবর রাখছে। বউমাও সবকিছুর দেখভাল করছে। আমার বড় নাতনীর নাম রয়া। সবাই রয়া মনি বলে ডাকে। আর ছোটটার নাম আয়াশ । প্রথমদিকে নামটা আমি ঠিকমত উচ্চারণ করতে পারতাম না। এখন পারি। একদিন সন্ধ্যায় রয়া মনি আমার কাছে গল্প শুনতে এসেছে। এসে বলল, দাদু তুমি নাকি টিচার ছিলে। আমি শুনেছি টিচাররা অনেক ইন্টারেস্টিং স্টোরি বলতে পারে। একটা ফানি স্টোরি শুনাও তো! আমার নাতনীর ইংরেজিতে বেশ ভাল দখল। আমাদের যুগে মেট্রিক পাশ করা ছাত্ররাও এত ইংরেজি জানতো না। কী গল্প বলা যায় তাই ভাবছি। শিক্ষক জীবনে ছাত্র ছাত্রীদের অনেক গল্প শুনিয়েছি। আজ নাতনীর কাছে সবচেয়ে মজার গল্পটি বলতে হবে।
মজার একটি গল্প বললাম। অভিনয় করেও দেখালাম। কিন্তু নাতনী মনে হয় মজা পেল না। বলল, ওহ্ দাদু ডিজগাস্টিং! আরেকটু ফানি স্টোরি বল। যে গল্পটি বললাম এটি শুনে আমার ছাত্ররা হাসেনি এমন কেউ নেই। কিন্তু রয়া মনি বিরক্ত হল। যুগের পরিবর্তন তো তাই এমন হয়েছে হয়তো। বাড়ির জন্য মন কাঁদে, রোকেয়ার জন্য মন কাঁদে । কিন্তু কিছু করার নেই। সরাদিন একটা ঘরের মধ্যে একা বসে থাকি। সময় হলে খাই, ঘুমাই। রায়হান অনেক ব্যস্ত। কখন বাসায় আসে কখন চলে যায় আমি টেরও পাই না। ঢাকাতে আসলাম মাস ছয়েক হল। রোকেয়ার সাথে কথা হয়না অনেকদিন। কেমন আছে কে জানে? প্রথমদিকে সবাই একসাথে খাবার খেতাম। এখন আমি একা একাই খাই।
একদিন রাতে , রায়হান আমার রুমে এলো। আমার পাশে বসলো। বউমাও এসেছে। আমি উঠে বসলাম। রায়হান বলল, আব্বা একটা কথা বলার ছিল। আমি বললাম, বল কী কথা? কথাটা বলতে রায়হান কেমন যেন সংকোচবোধ করছে। একবার বউয়ের দিকে আরেকবার আমার দিকে তাকায়। বউমা রায়হানকে বলল, বাবাকে বুঝিয়ে বল। তিনি নিশ্চয়ই বুঝবেন। আমার পুত্রবধূ সবসময় খুব গুছিয়ে এবং সন্মান দিয়ে কথা বলে। বড় ঘরের মেয়ে তো ! রায়হান বলল, আব্বা আমাদের বানিজ্য মন্ত্রী ইতালী যাবেন। তাঁর সাথে বেশ কিছু ব্যবসায়ীরাও যাবে। আমার নামও আছে সে লিস্টে। আমি বললাম, সে তো খুব ভাল সংবাদ। যাও দোয়া করি। ভালোয় ভালোয় ফিরে এসো। রায়হান বলল, আব্বা মন্ত্রী সাহেব আমার স্ব-পরিবারের টিকেটের ব্যবস্থা করেছেন। আমি বললাম, কী বল এসব? আমি এই বয়সে বিদেশে কীভাবে যাব? আমি তো এই রুম থেকে পাশের রুমেই যেতে পারিনা। রায়হান বলল, তাহলে কী করা যায় আব্বা? আমি বললাম, বিদেশে গেলে নিশ্চয়ই তোমার ব্যবসায়ে অনেক উন্নতি হবে। তোমার অবশ্যই যাওয়া উচিত। আমাকে বাড়িতে দিয়ে এসো। না হলে সোহেলের কাছে রেখে যাও। রায়হান কিছু বলছে না।
ছেলেটাকে আমি মনে হয় ঝামেলায় ফেলে দিলাম। রায়হান বলল, আব্বা কাল দুপুরেই আমার ফ্লাইট। সোহেলের বাসায় যেতে তো অনেক সময়ের প্রয়োজন। হ্যাঁ , তাইতো। তাহলে কী করা যায়? রায়হানকে বললাম, তোমরা চিন্তা করনা, আমি এ বাসায় একা থাকতে পারবো। বউমা বলল , না বাবা তা কী করে হয়? কাজের লোকদের কাছে আপনাকে রেখে যাই কী করে? বউমার কথায় যুক্তি আছে। রায়হান বলল, আব্বা আমার এক বন্ধুর বাড়িতে কয়েকদিন থাকেন। আমরা সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই চলে আসবো। আমি বললাম, ঠিক আছে, তোমরা যা ভাল মনে করে। আমার কোন অসুবিধে নেই। কথাটি বলার পর আমার ছেলে ও ছেলের বউয়ের মাথা থেকে যেন একটা ভারী বোঝা নেমে গেল। ওরা রুম থেকে চলে গেল। আমি ঘুমানোর চেষ্টা করছি।
খুব ভোরে ঘুম ভাঙলো আমার। ফজরের নামাজ পড়লাম। আমার ব্যাগ গুছিয়ে নিলাম। যা যা এনেছিলাম বাড়ি থেকে সব ব্যাগে ঢুকালাম। শুধু জামা কাপড় ঢুকাইনি। মাত্র তো এক সপ্তাহ। এরপর তো আবার চলেই আসবো।
সকালের নাস্তা খেয়ে আমরা রওনা দিলাম। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই পৌঁছলাম। বাড়ির সামনে একটা সাইনবোর্ড লাগানো। এতে লেখা আছে “ভালবাসার ঘর”। ভিতরে প্রবেশ করলাম। আমি একটা রুমে বসে আছি। রায়হান অন্য একটি রুমে কার সাথে থেন কথা বলছে। আমি চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখছি। চারপাশটা গাছ গাছালিতে ঘেরা। এখানের ঘরটিতে কোন সিঁড়ি নেই। একতলা বাড়ি। একটা লোক এসে আমার ব্যাগটা নিয়ে গেল। কিন্তু কেন নিল আমি বুঝলাম না। একটু পর আমার ছেলের সাথে একটা লোক আসলো। রায়হান বলল, আব্বা ইনিই আমার বন্ধু। উনি খুব ভাল মানুষ। উনিই আপনার দেখা শুনা করবে। আমি কিছুদিনের মধ্যে এসে আপনাকে নিয়ে যাব। আমি বললাম, ঠিক আছে , সাবধানে যেও। বিদেশে পৌঁছে এখানে ফোন করে জানাবে।
রায়হান চলে গেল। রায়হানের বন্ধু আমাকে একটি রুমে নিয়ে গেল। রুমটি বেশ আলো বাতাস পূর্ণ। অনেকটা আমার গ্রামের বাড়ির মত। রায়হানের বন্ধুর নাম মামুন। দেখতে খুবই সহজ সরল মনে হল। মুখে সব সময় হাসি লেগে থাকে। এখানে আমার মত অনেক মানুষই আছে। কেউ সপ্তাখানেকের জন্য এসেছে, কেউ মাসখানেকের জন্য, কেউবা তার চেয়েও বেশি সময়ের জন্য। রোকেয়ার সাথে কথা হয়না অনেকদিন। এ জায়গায় রোকেয়া থাকলে খুব ভাল হত। দুজন মিলে সারাদিন গল্প করতে পারতাম।
আজ বিশদিন হল এখানে আছি । আমার বড় ছেলের কোন খবর পেলাম না। বিদেশ থেকে ঠিকঠাকমত এসেছে কিনা কিছুই জানি না। কোন বিপদ হল কিনা তাও জানি না। বিপদ অবশ্য হতে পারে না। কারন প্রতিদিন নামাজ পড়ে আল্লাহর দরবারে ছেলেদের জন্য আমি দোয়া করি। আমার রুমের পাশেই একটি বারান্দা। এখানে বসে বসে চারপাশের গাছপালা দেখছি। কয়েকদিন ধরে মামুনকেও দেখছি না। একটা ফোন করতে পারলে ভাল হত। রোকেয়া কেমন আছে? এতটা সময় রোকেয়াকে ছেড়ে থাকতে হবে তা কোনদিন ভাবিনি। রোকেয়া কি আমার কথা ভেবে কষ্ট পায়? নাকি রোকেয়াও আমার মত এরকম কোনো ঘরে ঠাঁই পেয়েছে।
আমার সংসারে টাকা পয়সার অভাব ছিল কিন্তু শান্তির অভাব ছিল না। গ্রামের ঘরটি এখন কীভাবে আছে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। বাড়ির পাশে মসজিদের আজান খুব শুনতে ইচ্ছে করছে। সবাই মিলে একসাথে বসে তিনবেলা ভাত খেতে ইচ্ছে করছে। রোকেয়ার সাথে বারান্দায় বসে যদি গল্প করতে পারতাম ! আমার এই ইচ্ছেগুলো কোনোদিন কি পূরণ হবে?
গল্পের বিষয়:
গল্প