একটা অর্ধনগ্ন মেয়েকে হা করে দেখার কী আছে বুঝলাম না! পাড়ার মোড়ে বসে থাকা যুবতী পাগলী মেয়েটার সামনে দাঁড়িয়ে ৪/৫টা যুবক যেন মেয়েটাকে চোখ দিয়ে গিলে নিচ্ছে। এমন বিচ্ছিরি দৃশ্যের ভেতর দিয়ে বাবলুদার সাথে হাঁটতে সত্যিই অস্বস্তিবোধ করছি। কিন্তু কী আর করা! রাস্তাটা তো পেরোতে হবে!
রাস্তা পার হয়ে মেয়েটার দিকে তাকালাম। ও তখনও ওর ছেঁড়া পোশাক সম্পর্কে অসচেতন। অপরদিকে কিছু নগ্ন দৃষ্টি ওর নগ্নতাকে চরমভাবে আকর্ষণ করছে। মেয়েটাকে দেখে আমার একদম ঘৃণাবোধ হলো না, তবে যারা ইচ্ছাকৃতভাবে এই আপত্তিকর দৃশ্যটা দেখে লালসাগ্রস্ত হচ্ছে তাদের লোলুপ দৃষ্টি দেখে গা ঘিনঘিন করে উঠল।
বাবলুদা ব্যাপারটা টের পেয়ে গম্ভীর হয়ে বলল,”এটাই বর্তমান সমাজের আসল রূপ। এখানে কিছু লোকের চোখে নারী মানেই ভোগ্যবস্তু। হোক সে পাগলী বা বোবা। এই সমাজে মানবতার না, দেহের চাষ হয়। ওসব নিয়ে ভাবিসনে নীলু।”আমি ক্লান্ত হয়ে বললাম,”কেন বাবলুদা? কিছু বাজে লোকের হিংস্র দৃষ্টি থেকে কি ঐ পাগলীরাও রেহাই পাবে না? এ কোন সমাজে বসবাস করছি? আমার আর বাঁচতে মন চায় না। ঐ মেয়েটার নাহয় মানসিক সমস্যা, তাই বলে এদের সমস্যা কোথায়?”
বাবলুদা হেসে বলল, “এদেরও সমস্যা আছে। এদের সমস্যা বিবেকে, মনুষ্যত্বে। শুধু ওদের দৃষ্টি না ওদের দেহ দ্বারাও এসব পাগলীরা শিকারে পরিণত হয়। রাত বাড়লেই এই শহরের হিংস্র কিছু কীট ওদের কাছে সুযোগ নেয়। তবে সুযোগই নেয়, দায়ভার নেয় না। সেদিন দেখলি না, এক পাগলীর কোলে সন্তান? ও তো আমাদের মতো এই সভ্য সমাজের চার হাত পা ওয়ালা মানুষেরই কুকীর্তি।” আমি আর কোনো কথা খুঁজে পেলাম না। দৃশ্যগুলো দেখে ভয় লাগে। না জানি আমি নিজেও কবে এসব লালসার শিকার হই। এজন্যই তো সন্ধ্যার পর প্রাইভেট শেষে একা বাসায় ফিরি না। বাবলুদা পাশেই কোচিং করায়। উনি আমাকে নিয়েই বাসায় ফেরে। বাবলুদা আমাকেও বিকালে বাসায় পড়ায়। আমরা এই ছোট্ট শহরে পাশাপাশি দুটো বাসায় বসবাস করি। তবে আমার বাবা বড় চাকরি করায় আমাদের বাড়ির স্বাস্থ্যটা একটু বেশিই ভালো। সদ্য তিনতলায় ঘর তোলা হয়েছে। অপরদিকে বাবলুদার বাড়িটা দোতলা পর্যন্তই থেমে আছে।
বাবলুদা পড়াশুনা শেষ করে আপাতত কোচিং করাচ্ছে। হয়তো কিছুদিনের ভেতর আমাদের কলেজে জয়েন করবে। কথাবার্তা চলছে। বিকালে ছাদে বসে দুজনে চা খাওয়া, লুডু খেলতে বসে ঝগড়া করা এসব যেন আমাদের নিত্যদিনের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। উনার মাথায় টাক পড়তে শুরু করেছে। মাথার সামনে চুল কম। মাঝারি উচ্চতার মানুষটার ভুড়িও বাড়ছে। এই নিয়ে প্রতিদিন উনাকে টাকু, ভুড়িওয়ালা বলে হাসাহাসি করি। বাবলুদা রসিক মানুষ। উনি হেসে বলে যে, দেখিস নীলু, তোর কপালেও এমন টাকলু, ভুড়িওয়ালা বরই জুটবে।” অমনি দুজনার ঝগড়া লেগে যায়। তবে এটুকু বুঝেছি যে দিনেদিনে মানুষটাকে পূর্ণভাবে চিনতে শিখেছি। মানুষটা খাঁটি।
হঠাৎ বললাম,”কই? তুমিও তো পুরুষ। কখনও তোমার চোখে তো ওরকম বিশ্রী দৃষ্টি দেখিনি! ঐ পাগলীটার দিকে চোখ পড়তেই তো দৃষ্টি সরিয়ে আনলে! তবে ওরা এমন কেন? ওরাও তো শিক্ষিত মানুষ মনে হলো!”
বাবলুদা আবার হেসে বলল,”ওরা বইয়ের শিক্ষা হয়তো শেষ করেছে, তবে মানবতার শিক্ষা, মনুষ্যত্বের শিক্ষা, খাঁটি মানুষ হবার শিক্ষা ওরা শেষ করতে পারেনি। ওরা জানেই না কীভাবে আত্মসংযম করতে হয়। কীভাবে আত্মসম্মান ধরে রাখতে হয়। মনে কর আমার সামনে দিয়ে একটা নগ্ন নারী ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমার পুরুষ সত্তা, কামসত্তা কিন্তু জাগতে চাইবে। আমি কী করবো? নিজের ভেতরের পশুত্বকে দমন করে দৃষ্টি সরিয়ে সেই স্থান ত্যাগ করবো। এটাই তো প্রকৃত আত্মসংযম। আর আমি যদি নিজের লুকায়িত পশুত্বের কাছে হেরে যাই তবে ঐ দৃশ্যটা তাড়িয়ে-তাড়িয়ে উপভোগ করবো। আমি ওসব আবেগীয় বয়স পার করে এসেছি রে নীলু।” বাবলুদার কথাগুলো শুনে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। আসলে একটা পুরুষ কতটা সুন্দর চেতনার হলে এমন কথা বলতে পারে। এমন মানসিকতা ধারণ করতে পারে? মনে-মনে ধিক্কার দিলাম ঐ ছেলেদের, “হায় রে পুরুষ! তোমরাও পুরুষ, আর বাবলুদারাও পুরুষ! তোমাদের বোধোদয় হোক।”
বাড়ির কাছাকাছি আসতেই আচমকা একটা কুকুর সামনে এসে ঘেউ-ঘেউ করে উঠল। আমি কুকুর বড্ড ভয় পাই। ভয়ে চিৎকার দিলাম। বাবলুদা হঠাৎ আমার ডানহাতটা শক্ত করে ধরে বলল,”ভয় পাসনে নীলু। তোর বাবলুদা আছে। কোনো ভয় নেই।” আমি সমস্ত ভয়ডর ভুলে বাবলুদার দিকে তাকিয়ে বললাম,”এই হাতটা আজীবন এভাবে ধরে রাখবে তো? পথের ঐ কুকুর আর এই কুকুরে যে আমার বড় ভয়!” বাবলুদা মুচকি হেসে বলল,”অবশ্যই থাকবো। চাকরিটা হয়ে গেলেই তোর বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবো। এবার বাড়ি চল তো…”
গল্পের বিষয়:
গল্প