আমি যখন ২য় বারের মত কন্যা সন্তানের বাবা হলাম তখন আমার ফুফু আমাকে ফোন করে খুব স্বান্তনার স্বরে বলল, বাবা মন খারাপ করো না, সবই আল্লাহর ইচ্ছা। আল্লাহর উপরে কারও কোনও হাত নাই। আমার ফুফুর তিন ছেলে এক মেয়ে। দুই ছেলে অস্ট্রেলিয়া আর এক ছেলে ঢাকাতে ভীষণ প্রতিষ্ঠিত এবং ব্যাস্ত। আমি বললাম, ফুপু আপনাকে এখন দেখাশোনা করে কে? ফুপু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, পাশেই মমতা আছে, জামাই আছে, নাতিরা আছে, আমার খুব যত্ন কর। খুশীতে ফুপু ওদের গল্প শুরু করে দেয়। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ছেলেরা কবে আসবে? ফুপু বলল, ওরা খুব ব্যাস্ত, ছেলেমেয়েদের পরীক্ষা, আসতে পারবে না।
মমতা, আমার ফুপর একমাত্র মেয়ে যে তার মায়ের সমস্ত দায়িত্ব নিজের ঘাড়ে নিয়ে বসে আছে, কোনও রাগ, ক্ষোভ, ক্লান্তি নেই মায়ের উপর, ভাইয়েদের উপর। হয়তো আরও বৃদ্ধকালে ফুপুর গু মুত ও মমতাই পরিষ্কার করবে অতি যত্নের সাথে। আমার ২য় বার কন্যা সন্তান হওয়ার সংবাদে, অনেক আত্মীয়স্বজন, বন্ধু বান্ধব হা হুতাশ শুরু করে দিল, অনেকে জড়তায় ফোন দিল না, অনেকে দেখা হলে করুনার চোখে তাকাতে লাগলো। আমি বিস্মিত হতে লাগলাম আর সেই সাথে অনেক অভিজ্ঞ হতে লাগলাম। বিশ্বাস করুন আমার একটু ও খারাপ লাগেনি এখনও খারাপ লাগে না। পরিচিত অপরিচিত যে কেউই যখন জিজ্ঞাসা করে তোমার কয় ছেলেমেয়ে? আমি খুব স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলি আমার দুই মেয়ে। তারা খুব হতাশ হয়ে বলে, দুইটাই মেয়ে!!
আমি বলি, জ্বী, দুইটাই মেয়ে। বিশ্বাস করুন, আমি কখনোই তাদের উপর হতাশ হই না। কারন এগুলোতে মানুষের কোনও দোষ নাই। বিভিন্ন পারিপার্শ্বিকতা, সামাজিকতা, ধর্মীয় বিধিনিষেধ এবং অযাচিত হয়রানির কারনেই মানুষ কন্যা সন্তানকে প্রত্যাশা করে কম। আমার নানী বলতো, মেয়ে হলো আগাছা, এরা কখন কোথায় জন্মালো, কে তার খোঁজ রাখে। ছেলে হল বংশের প্রদীপ, শক্তি, সন্মান সবকিছু। যার ছেলে নাই তার কোনও বংশধর নাই, সামাজিক প্রতিষ্ঠা নাই, উচ্চাকাঙ্খা নাই, ভবিষ্যৎ নাই, সম্পত্তি ধরে রাখার ক্ষমতাও নাই। যখন বাবা ছিলাম না, তখন বুঝতাম না একটা কন্যা সন্তান কতটা অবহেলার সাথে পৃথিবীতে আসে। পেটে থাকতেই কন্যা সন্তান কে নিয়ে শুরু হয়ে যায় পিতামাতার অযাচিত এবং অনাকাঙ্ক্ষিত দুঃশ্চিন্তার রাত্রিপার।
সম্পত্তির অসম বন্টন, সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা অভাব, পিতামাতার বৃদ্ধকালীন নিরাপত্তা, বিবাহের ঝামেলা এসব কারনে কন্যা সন্তান অবহেলার শিকার। একটা ছেলে সন্তানকে নিয়ে এসব দুঃশ্চিন্তা অপেক্ষাকৃত কম। একটা মেয়ে কালো হলে সমস্যা, বেটে হলে সমস্যা, মোটা হলে সমস্যা, ধর্ষিত হলে সমস্যা, অন্তঃসত্ত্বা হলে সমস্যা, বিয়ে না হলে সমস্যা, বাচ্চা না হলেও সমস্যা। এখন কথা হচ্ছে এত সব সমস্যা মেয়েদের উপরে চাপালো কে? এইসব সমস্যা নিয়েও হাজার হাজার উদাহরণ আছে যেখানে মেয়েরা প্রতিষ্ঠিত। লক্ষ লক্ষ মেয়েরা পরিবারের ধারক ও বাহক। স্বামী, সন্তান, শ্বশুর, শ্বাশুড়ি, বাবা, মা, ভাই, বোনের নির্ভর জায়গা। একসময় মেয়েরাই হয়ে ওঠে পরিবারের প্রধান, সমাজের প্রধান ও রাষ্ট্র প্রধান।
এখন সবার কাছে আমার প্রশ্ন? আমরা কি কখনো মেয়েদের পিছনে যথেষ্ট শ্রম দিই? পর্যাপ্ত যত্ন করি? তাদের নিরপত্তা নিশ্চিত করি? করি না, করি না। আমরা তাদের বোঝা মনে করি, ঘাড় থেকে নামাতে সচেষ্ট থাকি। প্লিজ এসব থামান। বন্ধ করুন এসব নিয়মনীতি। কন্যা সন্তানের প্রতি সদয় হোন, নির্বোধের মত লিঙ্গ বৈষম্য করবেন না। একটা জিনিস মনে রাখবেন যে পুত্র সন্তানই যদি সবকিছুর উর্ধ্বে হতো তবে সব ছেলে সন্তানেরাই জজ, ব্যারিষ্টার হতো। কেউ রিকশাওয়ালা হতো না, মুচি হতো না, খুনি হতো না, মাদকাসক্ত হতো না, ধর্ষক হতো না। মনে রাখবেন প্রকৃতির প্রয়োজনেই নারী পুরুষ উভয়ের দরকার।
সমস্ত বোঝা পুরুষদের মাথায় তুলে না দিয়ে নারীদেরকেও তৈরী করুন কারন পুরুষরাও অনেক অসহায়, দুজনে মিলে বোঝা বহন করলে, অাদর্শ জীবন যাপন সহযেই সাধিত হবে। তাছাড়া বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির আর একটা প্রধান কারন হলো পুত্র সন্তান। এমনও দেখা যায় যে একটা পুত্র সন্তানের জন্য বছর বছর কন্যা সন্তান জন্ম হচ্ছে। এসব বন্ধ করুন, জনসংখ্যা কমে যাবে। কদিন বাঁচবেন? এত লোভ লালসা কেন? আল্লাহ আপনাকে যা দিয়েছেন, সেগুলোকেই যত্ন করুন, পরিশ্রম করুন। ফল অবশ্যই পাবেন। মনে রাখবেন, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকই কন্যা সন্তান, এই অর্ধেক জনসংখ্যাকে অবহেলায় রেখে কোনওদিনই রাষ্ট্রের উন্নতি সম্ভব নয়।
দিনশেষে বলে যায়, আসুন আমরা আমাদের সন্তানদের শুধুই সন্তান মনে করি, কোনও বৈষম্য, জাত পাতে বিভক্ত না করি। সঠিকভাবে পরিচর্যা করে একটি সুন্দর জাতি উপহার দিই।
গল্পের বিষয়:
গল্প