রঙ বেরঙের মানুষ

রঙ বেরঙের মানুষ
আমার এক ‘মেয়ে বন্ধুকে’ দেখতে এসেছে ‘পাত্রপক্ষ’। মেয়ের বাবা প্রবাসী, তিনি ফোনে মেয়েকে বললেন,
— মা, ছেলে পছন্দ হয়েছে?
— [মেয়েটির নির্লিপ্ত জবাব] নাহ্!
— [অবাক বাবা] কেন মা? ছেলে উচ্চ শিক্ষিত, ভাল জব করে, বংশ ভাল, ছেলের আচার-ব্যবহার, চরিত্রও ভালো!
— তাতে কী বাবা, ছেলেতো কালো!!
— [বাবার সরল উত্তর] আমিও তো কালো, কালো বলে আমাকে বাবা বলতে খারাপ লাগে? মনে হয়, তোমার মা আমার মত কালো মানুষকে বিয়ে করে ভুল‌ করেছে? “মেয়ে কোন কথা বলল না, সে চুপ করে রইল!”
একবার শহুরে আন্টিদের এক আলোচনা শোনার অভিজ্ঞতা হয়েছিল। সেখানে এক আন্টি অন্য আন্টিদের বলছিলেন– ”দেখছেন ভাবী, অমুকের ফর্সা, সুন্দর মেয়েটারে অইরকম কালা একটা ব্যাটার সাথে বিয়া দিছে! কুচকুইচ্যা কালা। টাকার লোভ, টাকা- টাকা!” অন্য আন্টিও বললেন– ”বেশি কালা?” আগের আন্টি বললেন– ‘না, বেশি না তবে আরেকটু ফর্সা হইলেই নিগ্রো হইতে পারত। হা হা হা হা হা!
দুর্দান্ত সেন্স অফ হিউমার, “আরেকটু ফর্সা হইলেই নিগ্রো হইতে পারত!” পুরো আড্ডা অট্টহাসিতে ভেঙে পরল। এর চেয়ে বড় আনন্দ যেন আর নেই। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। হাসতে হাসতে অনেকের চোখেই পানি চলে আসছে। আমার তাদের কোন একজনকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয়েছিল, ”আচ্ছা, আপনার সন্তান যদি কালো হয়?”
আমি জানি না, তিনি কি উত্তর দিতেন তবে আমার ধারণা “জগতের সকল বাবা মায়ের কাছে তাঁর সন্তান সুন্দর ও জগতের সবচেয়ে সুন্দর মুখ, সবচেয়ে মিষ্টি চেহারা।” সম্ভবত জৈনিক রূপকথা—“প্রচণ্ড ঝড়ে একটা পেঁচা, তার ছোট ছোট বাচ্চাকাচ্চা সহ এক গাছের কোটরে ঢুকে পড়ল। ঢুকে দেখে সেই কোটরে আরও অনেক পাখি, তাদের ছানা-পোনারা। ভোরে ঝড় থামল। সারারাত কিছু খাওয়া হয়নি। সব পাখিরা বাচ্চাকাচ্চা রেখে বের হল খাবার সংগ্রহে। সবার শেষে বের হল পেঁচা। বের হতে গিয়ে দেখে, কোটরের মুখে বিশাল এক অজগর। পেঁচা অনেক অনুনয় বিনয় ও কান্নাকাটি করল। সব শুনে অজগরের মনে মায়া হল। সে বলল– “আচ্ছা, তুমি যাও, আমি তোমার বাচ্চাদের খাব না।”
পেঁচাতো দারুণ খুশি। অজগর হঠাৎ বলল– ”কিন্তু তোমার বাচ্চাদের চিনব কি করে?” পেঁচা বলল– ”ওই কোটরের সবচেয়ে সুন্দর যেই বাচ্চাগুলো সেগুলো আমার আর কুৎসিতগুলো অন্যদের। কুৎসিতগুলো খেয়ে ফেল।” পেঁচা খুশি মনে চলে গেল। দিন শেষে খাবার নিয়ে ঘরে ফিরল। ফিরে দেখে, আর সকল বাচ্চারাই আছে, শুধু তার বাচ্চারাই নেই। সে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে অজগরের কাছে গেল, গিয়ে বলল– ‘তুমি আমার বাচ্চাদের খেয়েছ?’ অজগর বলল– ”নাতো, আমিতো তোমার কথামত সবচেয়ে কুৎসিত বাচ্চাগুলোকে খেয়েছি।” পেঁচাতো আর জানে না– “তাঁর মত মায়ের চোখে, তাঁর সন্তানদের আর কে দেখবে!”
আমার নানু বাড়ির ‘কাইল্লা’ জাহাঙ্গির ছিল কালো, কুচকুচে কালো! তাঁর মা- বাবা অনেকদিন বেঁচে ছিলেন, বৃদ্ধ বয়সেও তাকে ডেকে বলতেন- “আমার কালামানিক ও আমার কালামানিক একটু বুকে আয় বাপধন, তোর সোনা মুখখান একটু দেখে পরানডা জুড়াই!‘‘ অথচ জগতের আর সকলের কাছে সে ছিল ‘কাইল্লা জাহাঙ্গীর’। আহা মা, আহা বাবা, কি তাদের ভালোবাসা!
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত