কুয়াশা কেটে গিয়েছে

কুয়াশা কেটে গিয়েছে

কলিংবেলের আওয়াজ শুনে ফোনটা কানে দিয়েই দরজা খুলল লাবন্যপ্রভা।আগন্তুকের মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল সে। সে আজ প্রায় ছ’বছর আগের কথা। লাবণ্য তখন নর্থবেঙ্গল ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে ড্রামা নিয়ে।সেই সময় ওর আলাপ হয় ওই ইউনিভার্সিটির বাংলা বিভাগের ছাত্র শৈপায়নের সাথে। সে দিনটার কথা খুব মনে পড়ছে লাবণ্যর। প্রচন্ড বৃষ্টিতে ও আটকে গিয়েছিল ইউনিভার্সিটিতে। ছাতাটাও সেদিন সঙ্গে ছিল না, এদিকে সন্ধ্যা হয়ে আসছিল। কী করবে ভাবছিল, এমন সময় “তুমি আমার ছাতায় আসতে পারো”—- শুনে পিছন ঘুরে লাবণ্যর চোখ পড়ল কাঁধে ব্যাগ নিয়ে নীল ফুলশার্ট আর ফর্মাল প্যান্ট পরে দাঁড়িয়ে থাকা শৈপায়নের দিকে।সেই থেকেই ওদের আলাপ, তারপর প্রণয় আর তা থেকে পরিণয়।

বর্তমানে লাবণ্য একটি নিজস্ব নাট্যদল গড়েছে, বেশ নাম ডাকও হয়েছে,একটা নিজস্ব ফ্লাটও আছে ওর। আর শৈপায়ন একটা কলেজে লেকচারারশিপে জয়েন করেছে। পেশা আর ব্যস্ততা নিয়ে কেটে যাচ্ছে ওদের জীবন। সকালে তড়িঘড়ি করে ব্রেকফাস্ট আর শৈপায়নের লাঞ্চ রেডি করে ফেলে লাবণ্য। শৈপায়নও কোনো রকমে বাজারটা করেএসে স্নান সেরে ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়ে পড়ে। নিউজ় শুনতে শুনতে রেডি হয়ে এগারোটার মধ্যে বেরিয়ে যায় লাবণ্যও। সারাদিন চলে নাটকের মহড়া, স্ক্রিপ্ট লেখা, পোশাক ঠিক করা নিয়েও কম হ্যাপা হয় না। ও বাড়িতে ফেরে শৈপায়নেরও পরে। ঢং-ঢং করে ঘড়িতে রাত ন’টার ঘন্টা বেজে গেল।থিসিস পেপারটা রেখে গীটার হাতে শৈপায়ন ব্যালকোনিতে এসে দাঁড়ালো,কিন্তু কোনো সুর খেলছে না ওর গীটারে। দূরে কুয়াশায় পাহাড়ের নীল রেখা ঢাকা পড়ে গিয়েছে।কুয়াশা না থাকলে এখান থেকে পাহাড়গুলোকে বেশ চোখে পড়ে।এখন আর আগের মতো পাহাড়ের আড়ালে সূর্যোদয় দেখা হয় না। বেশির ভাগ সময়ে আকাশ কেমন মেঘলা থাকে। ব্যালকোনি থেকে ও লাবণ্যর পড়ার ঘরে বিছানায় এসে বসল। লাবণ্যর হারমোনিয়াম, শেলফে গুছিয়ে রাখা বই সব কিছুর মধ্যেই একটা শ্রী আছে। কিন্তু আজ পনের দিন হ’ল শ্রীমতী এখানে অনুপস্হিত।

নতুন বিয়ের পর এই ঘরে বসে ওরা কত গান করেছে, দেশ-বিদেশের সাহিত্য নিয়ে আলোচনা চলেছে ঘন্টার পর ঘন্টা,তবু ক্লান্তি আসেনি কখনও।এখন শুধু সারাদিন অফিস আর সন্ধ্যাবেলা ক্লান্তির বোঝা নিয়ে বাড়ি ফিরে ঘুমে ডুবে যাওয়া। পরদিন আবার অফিস। ঠিক যেন পাখিদের মতো রাতে মাথা গোঁজার জন্যেই বাসায় ফেরে ওরা।শুধু উইক এন্ডে লংড্রাইভে যাওয়াটা দায়সারা ভাবে এখনও টিকে আছে কোনো রকমে।চাপা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শৈপায়ন।চারবছর আগের জীবনটাতে ফিরে যেতে বড়ো ইচ্ছা করে ওর। শেষ রক্ষা তবু হ’ল না।সেদিন রাতে একটা বাজতে যায়, তবু লাবণ্য লাইট জ্বেলে স্ক্রিপ্ট লিখে চলেছে দেখে ধৈর্য হারায় শৈপায়ন—–“কী রাজকার্য করছো এত রাতে?” লাবণ্য বলল —–“তুমি জানো না,কী রাজ কার্য করছি?”

—–ওই ঘরে গিয়ে যা খুশি করো।আমাকে ঘুমাতে দাও।”
—–“তাই যাচ্ছি ।কুম্ভকর্ণ কোথাকার”,বলে শৈপায়নের দিকে তীব্র দৃষ্টি হেনে বেরিয়ে গেল লাবণ্য।

সে রাতে আর লেখা, ঘুম কোনোটাই হ’ল না লাবণ্যর।শৈপায়নেরও একই অবস্হা হ’ল।নিজের ব্যবহারে নিজেই লজ্জিত বোধ করল শৈপায়ন।তাই সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে লাবণ্যকে বলল —–“২৩ তারিখ থেকে লকডাউন ঘোষণা করেছে।চলো,শপিংমল থেকে আজ দরকারি শপিংগুলো সেরে আসি।”

“আমার সময় হবে না”—– লাবণ্যর সাফ জবাব।শৈপায়ন একাই তখন বেরিয়ে গেল।তিন ঘন্টা পরে ফিরে এসে দেখল লাবণ্য বাড়িতে নেই এমনকি ওর ফোনটাও সুইচ অফ বলছে। লাবণ্য ইদানীংওর নিজস্ব ফ্লাটে একাই আছে।ফোনে কথা হয় ওদের।শৈপায়ন লাবণ্যকে চলে আসতে বললে লাবণ্য বলে—-“আমি গেলে তোমার ঘুমের ডিস্টার্ব হবে”। আবার শৈপায়নকেও লাবণ্য ওর ফ্লাটে আসতে বারণ করে। এত সব সত্ত্বেও দু’জনের ফোনের কোনো কামাই নেই—-‘চায়ের প্যাকেট কোথায় ‘, ‘চিনির ডিব্বা কোথায় ‘—সামান্য সব ব্যাপারেও শৈপায়নের ফোন আসে।আবার ‘আমার কিচেন গার্ডেনে জল দিচ্ছো তো ‘, ‘ঘুমাতে বেশি রাত ক’রো না

—ফোনে শৈপায়নকে সতর্ক করে দেয় লাবণ্য। এদিকে এক সপ্তাহ,দুই সপ্তাহ করে বেড়েই চলেছে লকডাউনের মেয়াদ।দু’জনেই উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে দু’জনের জন্য।আজ ওরা বুঝতে পারছে বাইরে যত কিছুই হোক না কেন ,অন্তরে ওরা কতটা একাত্ম।খুব আপশোশ করে, সেদিনের বিষয়টা নিয়ে অতটা বাড়াবাড়ি করা কারুরই উচিত হয়নি।

আজ ৭ই এপ্রিল। সকাল সকাল স্নান সেরে, জিনিসপত্র গুছিয়ে, মাস্ক পরে ,বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়ল শৈপায়ন।
আজ লাবণ্যর পরনে সাদা-নীল রঙের ঢাকাই শাড়ি।আগের বার শৈপায়ন ওকে দিয়েছিল বিবাহ বার্ষিকীতে । খোঁপাটা বাঁধতে বাঁধতে ও ফোনটা হাতে তুলে নিল,’হ্যাঁ, এতক্ষণে রিং হচ্ছে ‘। এমন সময় বাইরে কলিংবেল বেজে উঠল।দরজা খুলে শৈপায়নকে দেখে অবাক হয়ে গেল লাবণ্য ।শৈপায়নের পরনে আগের বছর বিবাহ বার্ষিকীতে লাবণ্যর দেওয়া নেভিব্লু পাঞ্জাবী। হাতে ফুলের তোড়া।শৈপায়নের দিক থেকেই কথা শুরু হ’ল—- “এক্ষুনি ফোন করলে যে আমাকে?”লাবণ্য বলল ——“ভিতরে এসো।” ঘরে গিয়ে শৈপায়ন ওদের বাগানের গোলাপ দিয়ে নিজে হাতে বানানো তোড়াটা লাবন্যর হাতে দিয়ে বলল—-“শুভ বিবাহ বার্ষিকী”। লাবন্যও বলল —– “হ্যাপি ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি “। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে লাবণ্য আবার বলল

—– “বার বার মনে হয়েছিল, যদি মারণ রোগে আক্রান্ত হই, তবু যাওয়ার আগে অন্ততঃ একবার যেন দেখা হয় আমাদের।”

—– “ছিঃ লাবণ্য! এমন কথা বলতে নেই।আমরা চিরদিন একসাথে পথ চলবো বলেই অঙ্গীকার করেছিলাম। ফিরে চলো বাড়িতে।”

শৈপায়নের হাত ধরে পরম নির্ভরতায় বাড়ির পথে পা বাড়াল লাবণ্য।কুয়াশা কেটে গিয়েছে।সামনে দিগন্ত বিস্তৃত নীল আকাশের বুকে পাহাড়ের রেখা সুস্পষ্ট। ঘন সবুজ বনানীর ফাঁকে স্বচ্ছতোয়া তিস্তা বয়ে চলেছে। গাছে গাছে পাখি ডাকছে। রাস্তাঘাট নির্জন। দু’চারটে হরিণ চোখে পড়ল ওদের। প্রকৃতি যেন হাসছে । মিলিত হওয়ার আনন্দে ওদের কন্ঠে ফুটে উঠল— ” পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্হি, আমরা দুজন চলতি হাওয়ার পন্হী রঙিন নিমেষ ধুলার দুলাল পরানে ছড়ায় আবীর গুলাল।”

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত