“চলো বাবা, আমাদের ট্যাক্সি এসে গেছে”, বলে বিমল বাবুর ট্রলিটা নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ওনার ছেলে বিজয়।
ঘর থেকে বেরোনোর আগে দেওয়ালে টাঙ্গানো বিজয়ের মায়ের ছবিটার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বিমল বাবু বললেন, “এদের তুমি দেখো, জানিনা বেঁচে থাকতে এই ঘরে আর ফিরতে পারব কিনা।” বিয়ের পর বিমল বাবু এই ঘরেই এসে উঠেছিলেন বিজয়ের মাকে নিয়ে।
“ভালো থেকো দাদুভাই, মন দিয়ে পড়াশুনা করো মা-বাবা যা বলে শুনো”, নাতির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন বিমল বাবু। নাতি ওনার হাতে একটা টেপ রেকর্ডার দিয়ে বলল, “দাদু এটা সাথে করে নিয়ে যাও, এতে গল্প রেকর্ড করে রেখো, বাবা যখন পরে যাবে তখন বাবার হাতে পাঠিয়ে দিয়ো।” একথা শুনে বিমল বাবুর চোখে জল এসে গেল। রেকর্ডারটা হাতে হাতে নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলেন তিনি।
ছোট বেলায় ভালো ছাত্র ছিলেন বিমল বাবু। অবশ্য সে ব্যাপারে নিজের মধ্যে একটা অহংকারও ছিল তাঁর। পরবর্তী কালে ভালো চাকরিও করেন তিনি। কেমিস্ট্রিতে Ph.D, মানিকপুর আনান্দমোহন কলেজের Principal ছিলেন। একবার একটা research-এর জন্য prize-ও পেয়েছিলেন KCL (King’s College London) থেকে। ওনার ছেলে MNC-তে চাকরি করে। সে software engineer। এতদিন কলকাতাতেই posting ছিল। এবার promotion পেয়ে Bangalore চলে যাবে। বউ-এর অসুবিধা হবে বলে বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে যাচ্ছে। বউতো সারাদিন ছেলেকে নিয়েই ব্যস্ত। শ্বশুরকে দেখার সময় তাঁর নেই। ট্যাক্সি পৌঁছে গেল ‘মিষ্টি ছায়া’ বৃদ্ধাশ্রমের গেটে। একজন বয়স্ক দারোয়ান গেট খুলে দিল। ব্যাগ গুলো সব নামানো হয়ে গেছে গাড়ি থেকে। Official কাজ ও সারা হয়ে গেছে। বাবার হাত ধরে বিজয় বলল, “চিন্তা করছ কেন বাবা? আমি বললাম তো Bangalore-এ join করেই আবার কলকাতায় ফেরার জন্য company-তে apply করে দেবো। আর তো রোজই ফোন করব তোমায়। ওকে বলেছি, রনিকে নিয়ে মাসে একবার ওরা এখানে এসে তোমার সাথে দেখা করে যাবে। আমি তাহলে চলি?”
বাবাকে প্রণাম করে চলে গেল বিজয়।
কিছু দিন কেটে গেল বিমল বাবুর বৃদ্ধাশ্রমে। বেশ কিছু বন্ধুও হয়েছে বিমল বাবুর। সবার বাড়িতেই প্রায় একই সমস্যা। সবাই প্রায় এখন নিজেদের সাজানো সংসারে বাড়তি বোঝা। তাই তাদের স্থান হয়েছে বৃদ্ধাশ্রমে। স্বাভাবিক ভাবেই অধিকাংশের বাড়ির লোকই আর নিয়মিত খোঁজ নেয় না।
আর সবার মত কিছু কাজ করে বিমল বাবুর সময় কেটে যায়। কিন্তু একটা চিন্তা সব সময়ই তাঁর শান্তি কেড়ে নেয়। মা মরা বিজয়কে তিনি একাই বড় করেছেন। কোনো কোনো সময় বুঝতেও পেরেছেন ছেলেটা বিপথে চলে যাচ্ছে, তাও বাঁধা দেননি, মা মরা ছেলে যদি মানসিক আঘাত পায়। ভোরবেলা বাবা না ডাকলে ছেলের ঘুম ভাঙে না। কে জানে এখন সে ঠিক সময় ঘুম থেকে উঠতে পারে কিনা! বাড়ি থেকে চলে আসার দিন সকালে ঘুম ভাঙিয়ে বলেছিলেন, “কাল থেকে তো আর ডেকে দিতে পারব না, মোবাইল অ্যালার্ম দিয়ে ঘুমাস।” আর মনে পড়ে বাড়ির কথা, যে বাড়িটা তাঁর নিজের হাতে গড়ে তোলা, নিজের হাতে সাজানো। তবে সব থেকে বেশি মনে পড়ে বিজয়ের মাকে। এখানে এসে তিনি মানসিক ভাবে আরও একা হয়ে পড়েছেন।
অন্যদিনের মতো সেদিন সকালে গাছে জল দিচ্ছেন বিমল বাবু। নতুন কুঁড়ি এসেছে গাছে। ক’দিন পরই নতুন ফুল ফুটবে গাছ গুলোতে। এমন সময় বৃদ্ধাশ্রমের দারোয়ান নিতাই বাবু এসে বিমল বাবুকে বললেন, “যদি কিছু মনে না করেন আপনাকে একটা প্রশ্ন করবো?” বিমল বাবু সম্মতি দিয়ে বললেন, “হ্যাঁ বলুন।”
-“register খাতায় দেখলাম আপনার নাম বিমল, আপনি কি হলদিগ্রাম হাই স্কুলের বিমল দাস?”
-“হ্যাঁ, আপনি কি করে জানলেন?”
-“আমি নিতাই, নিতাই পাল, মনে পড়ে কিছু?”
-“আরে নিতাই, তুই এখানে, এই অবস্থায়? ভাবতেই পারছি না, স্কুল ছাড়ার ৪০ বছর পর স্কুলের বন্ধুকে এভাবে ফিরে পাবো। ‘আপনি’ না, ‘তুই’ করেই বল।”
-“পেপারে দেখেছিলাম তুই লন্ডনে গিয়ে প্রাইজ এনেছিস।”
নিতাই বাবু খুব একটা ভালো ছাত্র ছিল না। গরীব ঘরের ছেলে সে। তাই কোনোদিক থেকেই সমগোত্রীয় না হওয়ায় বিমল বাবুর সাথে কোনোদিনই খুব গভীর বন্ধুত্ব হয়নি নিতাই বাবুর।
নানা সুখ-দুঃখের গল্প হল। ৪০ বছরে দু’জনের জীবনেই অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। অনেক ঝড়-জলের মধ্যে দিয়ে গেছে দু’জনে জীবনই। এমন পরিস্থিতিতে যে ছোটবেলার বন্ধুকে পাবেন তা দু’জনেই ভাবতে পারেননি।
এমন সময় একটি মাঝ বয়সী ছেলে এসে দাঁড়ালো ওনাদের সামনে। নিতাই বাবু তাকিয়ে দেখলেন ওনার ছেলে বাবলু এসেছে। বিমল বাবুর সাথে তার পরিচয় করিয়ে দিলেন নিতাই বাবু। বাবলু পেশায় অটোচালক। এগিয়ে এসে বিমল বাবুকে প্রণাম করলো বাবলু। তারপর নিতাই বাবুকে বলল, “চলো বাবা।”
বিমল বাবুকে নিতাই বাবু বললেন, “আমি এদের জানিয়েছি আজ ডাক্তারের কাছে যাবো। ছেলে অনেকদিন থেকেই জোড়াজুড়ি করছে, হাঁটুতে ব্যথা, অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারি না, বসলে আর উঠতে পারি না, উঠলে আর বসতে পারি না। তাই আজ আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়েই যাবে, বৌমাও অনেক জোড়াজুড়ি করছে ক’দিন ধরে। আমি আজ চলি, কাল আবার গল্প হবে।”
নিতাই বাবু চলে গেলেন। কাল আবার আসবেন তিনি। বিমল বাবু মনে মনে ভাবলেন, “ নিতাই পড়াশুনায় ভালো ছিল না, আজও হয়তো আর্থিক অবস্থা অতটা ভালো নয়। কিন্তু ছেলে-বউমা কত যত্ন করে, বুড়ো বাবার খেয়াল রাখে। আর আমার ছেলে-বউমা?” আসার পর থেকে নাতির দেওয়া রেকর্ডারটা পড়ে পড়ে ধুলো খাচ্ছে। আজ একটু নিয়ে বসা যাক। নিজের স্কুলের বন্ধুর সাথে অনেক বছর পর দেখা হওয়ার গল্পটা আজ তিনি নাতির জন্য রেকর্ড করবেন। আর মাত্র তিনদিন পরই নাতি আসবে দেখা করতে।