বিয়ে বাড়িতে, আমার স্বামীর আড়াই বছরের ছেলেকে কোলে নিয়ে দাড়িয়ে আছি। ছেলেটা আমার কোলে ঘুমাচ্ছে আর আমার স্বামী অবকাশ তার এক ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলতে অন্য দিকে গিয়েছে। হঠাৎ পিছন থেকে একটা কন্ঠস্বর ভেসে এলো। সেই কন্ঠটা আমার খুব পরিচিত। এক সময়এই কন্ঠস্বর না শুনলে ঘুম আসতো না। আমার সামনেই দাড়িয়ে আছে আমার প্রাক্তন নিঝুম। যার সাথে বছর দুয়েক আগেও আমার সাত বছরের সম্পর্ক ছিলো। বড্ড ভালোবাসতাম তাকে, কিন্তু সে বাসতো নাকি তা নিয়ে এখন আর আফসোস নেই। আরে স্নিগ্ধা যে, তুমি এখানে কি করছো? চেয়েছিলাম পাশ কাটিয়ে চলে যেতে, কিন্তু কি মনে করে দাড়িয়ে গেলাম।
___এইতো হাসবেন্ডের সাথে তার কলিগের বিয়েতে এসেছিলাম। সে কিছুটা আমার দিকে চমকিয়ে তাকালো।
___বাহ বিয়েও করে ফেলেছো। আমি আসছিলাম আমার কাজিনের বিয়েতে।আর ছেলেটা কি তোমার নাকি? হ্যাঁ দেখতেই তো পাচ্ছো। ও আমার ছেলে, মিন্ময়। বাহ খুব সুন্দর নাম।আ’ম জাস্ট শকড,এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে করে ফেললে। আর তোমার ছেলেকে তো দেখে মনে হচ্ছে আড়াই বছর হবে। ব্যাপারটা আমি বুঝতেই পারছি না।
ওর কথা শুনে বুঝতে পারলাম কটাক্ষ করতে এসেছে।___ও আমার হাসবেন্ডের প্রথম স্ত্রীর ছেলে আর হাসবেন্ডের
ছেলে তো আমারো ছেলে তাই না? আমি একটা মুচকি হাসি দিলাম। আমার কথার প্রতিউত্তরে নিঝুমও হেসে দিলো কিন্তু তার হাসির মধ্যে ছিলো কিছুটা ঠাট্টা। ঠাট্টা করারই কথা। ও তো চেয়েছিলোই আমি যেনো এমন একটা সংসার ডিজার্ভ করি, কিন্তু না তার থেকে অনেক ভালোই আছি। ওয়াও সতীনের সংসার করছো। তা সতীন কি আছে না গেছে? বেশ ভালো ব্যাপারটা। আমার বউ কিন্তু অনেক ভালো, সুখেই আছি। আমার সব কথা মেনে চলে। যাক গে আমার বউয়ের শুনাম শুরু করলে শেষ করতে পারবো না। তোমার জন্য কষ্ট হচ্ছে যে বিয়ে করতে না করতেই অন্যের বাচ্ছা নিয়ে ঘুরছো।
নিঝুমের প্রতি আমার একহ্রাস ঘৃণা হচ্ছে। এক সময় এই মানুষটাই আমার সব জুড়ে ছিলো আর আজ ওকে সহ্য হচ্ছে না। আমার ইচ্ছে হলো ওকে কিছু কথা ফিরিয়ে দিতে তাই বলেই ফেললাম, আমার হাসবেন্ডের প্রথম স্ত্রী মারা যায় মিন্ময়ের ডেলিভারির সময়। জানো আমার হাসবেন্ড কে? __মনে আছে তোমার পাঁচ বছর আগে অবকাশ নামের একটি ছেলের সাথে আমার বিয়ের কথা চলছিলো কিন্তু তুমি সেই ছেলেটাকে ফোন দিয়ে অনেক কান্নাকাটি করে আমার বিয়েটা ভেঙেছিলে। হ্যাঁ মনে আছে। তো কি হয়েছে? হয়নি কিছুই কিন্তু,তখন তাকে বিয়ে করলে আমি তার প্রথম ভালোবাসা হতাম আর আজ তার শেষ ভালোবাসা হলাম।আর জানো তো শেষ ভালোবাসাটার শক্তিই সবচেয়ে বেশি। নিঝুম চুপ করে রইলো।আমিও আর কিছু বললাম না। একসময় সে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। সে মনে হয় ভাবতে পারে নি যে এতো তাড়াতাড়ি মুভ অন করতে পারবো।
এই ছেলেটার সাথে আমি যখন ইন্টার প্রথম বর্ষে ছিলাম তখন রিলেশনে জড়াই। সমবয়সী ছিলাম আমরা। ভাবতাম আমাদের বন্ডিংটা অন্যদের থেকে আলাদা। যখন অনার্সে ভর্তি হলাম তখন বিয়ের জন্য নানা সম্মন্ধ আসছিলো কিন্তু বরাবরই আমি আর ও মিলে বিয়েগুলো ভেঙেছিলাম। কোন বাবা মাই বেকার আর সেম এইজের ছেলের সাথে মেয়ে বিয়ে দিতে চায় না। আমার ক্ষেত্রেও সেই রকমই ছিলো। যখন অনার্স তৃতীয় বর্সে উঠলাম তখন অবকাশের সাথে আমার বিয়ের কথা উঠলে নিঝুম অবকাশের নাম্বার নিয়ে প্রচুর কান্না করে বিয়েটা ভেঙেছিলো। তখন দিন গুলো স্বপ্নের মতো যাচ্ছিলো। মনে ছিলো একহ্রাস ভালোবাসার অনুভুতি, ছিলো ভালোবাসার মানুষটাকে নিয়ে সংসার করার অকুল আবেদন। এভাবেই সাত বছর পার করেছিলাম। বাসা থেকেও অনেক চাপ দিচ্ছিলো বিয়ের জন্য, তাই কিন্টারগার্ডেন স্কুলে একটা জব নিলাম। নিঝুমেরও চাকরি হয়ে গেলো। ভেবেছিলাম এবার হয়তো আমাদের পূর্নতা পাবে আমার ভালোবাসার। কিন্তু আমার সুখ সইলো না। নিঝুমের মা আর বোন বলেছিলো আমার নাকি বয়স বেশি হয়ে গিয়েছিলো। তখন আমার বয়স সবে পঁচিশ। তাদের নাকি ইন্টার পরুয়া মেয়ে দরকার।
নিঝুমও এর কোন বিরোধিতা করেনি। বুঝে গিয়েছিলাম ওর মতামত কি।অথচ নিজের বয়সটা এই মানুষটার জন্যই বাড়ালাম।এই মানুষটাই আমায় দেখিয়েছিলো এতো গুলো স্বপ্ন। সব অপেক্ষা সুখকর হয়না, এমন কিছু স্বার্থপর মানুষগুলোর জন্যই হয়তো মানুষের মনোভাব হয়েছে যে, সেম এইজ রিলেশন নাকি টিকে না। ___সেই দিন গুলো বাসার মানুষেরাই আমার সাপোর্ট দিয়েছিলো।যাদের কথার মূল্যই দেই নি, বুঝি নি তাদের ভালোবাসা, তখন তারাই আমার প্রতি ভরসার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলো। এর মধ্যে আমাদের পাশের ফ্লেটে আসে নিউ ফ্যামেলি। যাকে আমি এক সময় অনেক কিছু বলে বিয়েটা ভেঙেছিলাম। অবকাশের চার মাসের ছেলে ছোট্ট মিন্ময়ের সাথে দেখা হয় আমার। ছেলেটার মায়ায় ডুবে নিজের ব্যাথা ভুলেছিলাম।
ছোট মা মরা ছেলেটা আমায় পেলেই হেসে দিতো। আমি চাইলে কেউর প্রথম স্ত্রী হতে পারতাম কিন্তু তখন আমার মন এই মানু্ষটাকেই চাইতে লাগলো। আমি চাইলে এই মানুষটার ভালোবাসার প্রথম স্থানই পেতে পারতাম কিন্তু আফসোস নেই , আর এই ছোট বাচ্ছাটার মায়াও ছাড়তে পারছিলাম না। অবকাশ চাইছিলো না আমায় বিয়ে করতে। সে তার প্রথম স্ত্রী মৃন্ময়ীকে নাকি ভুলতে পারবে না। অনেক কষ্টে অবকাশকে রাজি করিয়েছিলাম। বেশ ভালো আছি এখন।কারন একবার তো একজনকে পার্ফেক্ট মনে করে ভুগেছি, এবার নাহয় সেই বিচ্ছেদটাকে কাজে লাগিয়ে অন্য ভাবে সব শুরু করি। কিছুক্ষন পর অবকাশ এসে আমায় পিছন থেকে ডাক দিলো আর আমার ধ্যান ভাংলো। ___কি হলো কিছু ভাবছিলে বুঝি? না ভাবছিলাম না কিছুই। তুমি কই চলে গেছিলা। সেই কখন থেকে দাড়িয়ে আছি। অবকাশ আমার কোল থেলে মৃন্ময়কে কোলে তুলে নিলো। __সরি স্নিগ্ধা, এতোক্ষন এক কলেজ ফ্রেন্ডকে পেয়ে গিয়েছিলাম।তাই লেট হয়ে গেলো। চলো বাসায় যেতে হবে।
আমরা চলে এলাম, কিন্তু খেয়াল করলাম নিঝুম পিছন থেকে তাকিয়ে আছে। আমার তাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে কিছুটা করুনা হলো। ও যে আমায় ওর বউর এতো গুনোগান গাইলো, তার বউ বিয়ের তিনমাস পর তার প্রেমিকের কাছে চলে গিয়েছিলো। মেয়ের বাবা মেয়েকে আবার ফিরিয়ে এনেছিলো। মেয়ের বাবা কমিশনার বিধায় নিঝুমের উপায় ছিলো না সেই মেয়েকে ডিভোর্স দেওয়া। তার পার্ফেক্ট বউ বলে কথা, আবার পরিবারের সবার পছন্দের। এগুলো সব আমি আমার এক ফ্রেন্ডের কাছ থেকে শুনেছিলাম। আমি চাইলে তার বউয়ের গুন গুলো শুনিয়ে দিতে পারতাম কিন্তু কাউকে ছোট করার ইচ্ছা আমার ছিলো না। আল্লাহ যা করে তা নিশ্চয়ই ভালো।তেমন আমারো ভালোই হয়েছে, কারন একজন আদর্শ মানুষের স্ত্রী হতে পেরেছি।ওকে বিয়ে করলে আর যাই হোক সুখী হতে পারতাম না। কিছু প্রাক্তন বিচ্ছেদ দিয়ে অনেক ভালো করে, কারন তারা কখনো যোগ্যই ছিলো না। আর সেই ভালো থেকেই নতুন জীবনের সূচনা হয়।
গল্পের বিষয়:
গল্প