আম্মা’কে খাইয়ে দিচ্ছিলাম, সেই সময় কলিং বেলের আওয়াজে এঁটো হাতটা নিয়েই এগিয়ে গেলাম দরজা খুলতে। পাশের ফ্ল্যাটের আন্টি এসেছেন হাতে একটা বক্স নিয়ে। আমি সালাম দিয়ে আন্টিকে ভিতরে আসতে বললাম। আন্টি আমার হাতে ঝোল লেগে থাকা দেখে প্রশ্ন করলেন,
-হায়াত, বাবা তোমার হাতে ঝোল কেন? ও খাচ্ছিলে বুঝি? এই সময়ে এসে বিরক্ত করলাম। আসলে দুপুরে আজকে মাংস রান্না করছিলামতো তাই একটু তোমাদের জন্য আনলাম।
–আরে না না আন্টি ঠিকআছে। আর আজকেও আপনি এসব আনতে গেলেন কেন? আন্টি আর বেশি কিছু না বলে রোজকারের মতো বক্সটা রেখে আম্মার সাথে দেখা করে চলে গেলেন।
এমনটা যে শুধু উনিই করেন তা নয়। আমাদের ফ্ল্যাটেরও অনেক আন্টি আছেন যারা ভালো মন্দ রান্না করলেই আম্মাকে দিতে আসেন। খুব ছোটোবেলায় দেখতাম এই কাজগুলো আমার আম্মা নিজেও করতেন। আম্মা তখন বলতেন কাউকে দিয়ে খেলে খাবারে কখনো কম পড়ে না। আব্বাও এই বিষয়গুলো নিয়ে কখনো কোনো কথা বলতেন না। বরাবরই তিনি আম্মার সব কথাকে প্রাধান্য দিতেন কারণ আম্মা কখনোই অন্যের উপকার ব্যতীত ক্ষতির কাজ করতেন না। কিন্তু এইসব বিষয়গুলো কখনোই আমার দাদীর পচ্ছন্দ ছিলো না। দাদী সবসময় এটা ওটা নিয়ে আম্মাকে কথা শোনাতেন। কড়া গলায় বলতেন, টাকাতো তোমার কামাই করতে হয় না, বুঝবা কি? আমার পোলার কষ্টের টাকার জিনিসগুলো তুমি দয়ালু দাতার মতো সারাদিন শুধু বিলাবিলিই করো। আম্মা কথাগুলো শুনে কখনোই দু কথা উচ্চারণ করতেন না। আব্বা মাঝে মাঝেই আম্মাকে ডেকে বলতেন, ‘জয়নব তুমি আমার মায়ের কথাগুলোতে কষ্ট পেয়ো না। মারতো খুব বয়স হয়েছে তাই একটু কড়াভাবে কথা বলেন’।
আম্মা আব্বার কথা জবাবে কিছুই বলতেন না, শুধু হাসিমুখে মাথা নাড়িয়ে বাধ্য স্ত্রীর মতো সকল কর্তব্য পালন করতেন। আমার দাদী মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে অনেক অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে যায়। তখন দেখেছি আমার আম্মা তার খাওয়া দাওয়া থেকে শুরু করে সকল কাজ নিজের হাতে করে দিতেন। দাদী বিছানা প্রায় নষ্ট করে ফেলতেন। আম্মা কিঞ্চিৎ পরিমাণ রাগ বা ঘৃণা না দেখিয়ে সেসব নিজের মেয়ের মতো পরিষ্কার করতেন। আমার ফুফিরাও যখন আসতো আম্মা তাদের বারণ করতেন ওসব পরিষ্কার করতে। ফুফিরা আম্মাকে ভীষণ ভালোবাসতো৷ কখনো ভাবীর মতো দেখতো না নিজেদের আরেকটা বোনের নজরে দেখতো। শুধু দাদী একটু বেঁকে ছিলেন কিন্তু সেটাও অসুস্থ হওয়ার আগ অবদি।
দাদী অসুস্থ হওয়ার পর বুঝতে পারলেন যে আম্মা তাকে কতটা শ্রদ্ধা, সম্মান আর ভালোবাসতেন। তখন নিজের ভুলগুলোর জন্য অনুতপ্তবোধ প্রকাশ করেই পৃথিবী ত্যাগ করেন। দাদী যেদিন মারা যান আমার আম্মা সেদিন এতো কেঁদেছিলো সাতদিন পর্যন্ত আম্মার গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ স্পষ্ট বের হয়নি। আজ আমার সেই আম্মাই অসুস্থ। ডাক্তার বলেছেন বয়স বাড়ার কারণে মেরুদন্ডের হার ক্ষয় হয়ে গেছে। ঝুঁকে খুব ভারী কাজগুলো করা একদম বারণ। আমি আর আম্মা ছাড়া এই চারদেয়ালের মাঝে আর কোনো তৃতীয় প্রাণী নেই। একজন ছিলো আমাদের সাথে, আমার বিয়ে করা স্ত্রী। কিন্তু সে যোগ্য ছিলো না যেটা খুব দেরিতে হলেও আমি বুঝতে পারি। আম্মার পচ্ছন্দ করা পাত্রীকেই আমি বিয়ে করি। কিন্তু সে যে আম্মাকেই অপচ্ছন্দ করবে সেটা বুঝতে পারিনি।
বিয়ের কয়েকমাস খুব ভালোভাবে গেলেও পরে শুরু হয় আমার আম্মার নামে আমার কানে হাজারটা নালিশ। আম্মার যে হাড়ের সমস্যা সেটা জানার পরেও আমার স্ত্রী তার কোনো যত্ন করেনি। একজন অসুস্থ মানুষ হিসেবেও তাকে যে মনুষ্যত্বের খাতিরে একবেলা ঔষধ দেখিয়ে দেবে সেটা পর্যন্ত আমার স্ত্রী করেনি। এসব আমি কিছুই বুঝতাম না, কারণ আমার সামনে আমার স্ত্রী ভালো ব্যবহারই করতো। অফিস থেকে রোজ বাসায় ফিরলে সেই এক কাহিনী।
তোমার আম্মা এটা চাই, ওটা চাই, নিজে নিয়ে খেতে পারে না, এতো কাপড় চোপড় আমার পরিষ্কার করতে ইচ্ছে করে না ইত্যাদি ইত্যাদি। ওর কথাগুলো শুনে খুব অবাক হতাম। সবচেয়ে বেশি অবাক হতাম যখন ও বলতো আমার আম্মা নাকি ওকে দেখতে পারে না পাশের ফ্ল্যাটের আন্টিদের কাছে ওর নামে বদনাম রটায়। যে আম্মা কখনো নিজের শাশুড়ির কটু কথাগুলো নিজের স্বামীর কাছে পর্যন্ত বলেনি সে আম্মা কি করে নিজের একমাত্র ছেলের বউয়ের বদনাম অন্যের কাছে রটাবে? এটা আমি কখনোই বিশ্বাস করতে পারিনি। একদিন প্রচন্ড পেট ব্যথার কারণে অফিস থেকে ছুটি নিয়ে বাসায় ফিরছিলাম। পথিমধ্যে পাশের ফ্ল্যাটের সেই আন্টিটার সাথে দেখা হয়। আন্টি আমায় দেখে সামনে এসে কিছুটা ইতস্তত করতে করতে বলেন,
-হায়াত, বাবা তোমার কি মনে হয় তোমার মা এমন কাজগুলো করতে পারেন? উনার মতো এতো ভালো মনের মানুষ আমাদের এখানে আর একটাও নেই। তুমিতো দেখেছো ছোট থেকে কত জ্বালাতন সহ্য করেও উনি শাশুড়ির সেবা করে গেছেন। আমি কিছু না বলে সেখান থেকে সোজা বাসায় চলে এলাম৷ কলিং বেলে হাত রাখতেই দরজার ওপাশ থেকে উচ্চস্বরে গলার চেচামেচির আওয়াজ ভেসে আসছে। কলিং বেলটা না বাজিয়ে চুপচাপ কান পেতে দাঁড়িয়ে রইলাম। আওয়াজগুলো ছিলো এমন,
-বউমা আমিতে শুধু বললাম এতো খাবার নষ্ট করে ডাস্টবিনে না ফেলে বাসার নিচে অনেক গরীব মানুষ আছে ওদেরকে দিয়ে এসো। তুমি এটাকে কেন এত বড় বানিয়ে ফেলছো?
–আপনি চুপ করুন, আমার স্বামীর টাকার জিনিস আমি যেভাবে ইচ্ছা নষ্ট করবো আপনি বলার কে? তিনবেলা ঠিকমতো খাবার পেলেইতো হলো আপনার। কাকে কি দেবো না দেবো এতো দেখতে বলেছে কে আপনাকে?
-বউমা খাবার এভাবে নষ্ট করতে নেই। কত মানুষ না খেয়ে পড়ে আছে রাস্তায় একমুঠো খাবারের জন্য। আর তুমিতো রোজ ভাত, তরকারি ডাস্টবিনে ফেলে দাও এগুলো ঠিক নাগো মা।
–আপনার থেকে কি শিখতে হবে এখন আমাকে হ্যা?
-আস্তে কথা বলো বউমা, সবাই শুনতে পাবে।
–কেন আস্তে কথা বলবো? আমি কাউকেই ভয় পায় না। আপনি আমার কোনো ব্যপারে নাক গলাবেন না। নইলে আপনাকে এই বাসা ছাড়া করতে আমার একটুও সময় লাগবে না।
আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো আমি আর দাঁড়াতে পারলাম না। কপালের ঘাম মুছে কলিং বেলটা এক নাগাড়ে চেপে গেলাম। মুহুর্তেই ওপাশ থেকে আমার স্ত্রী দরজা খুলে দিলো। আমায় দেখে কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে বললো, এই অসময়ে এলে যে? আমি খুব শান্ত গলাতেই বললাম, কেন এখন এসে সমস্যা করে ফেললাম বুঝি? ওর কোনো উত্তরের আশা না করে চোখ বুলিয়ে দেখলাম আম্মা আশে-পাশে কোথাও নেই। আম্মার রুমে গিয়ে একটু উঁকি দিতেই দেখলাম আম্মা চোখে চশমাটা লাগিয়ে বসে বসে কোরআন তেলওয়াত করছেন। এটা আমার আম্মার অনেক আগের একটা অভ্যাস। যখন দাদী বকতো আম্মা ওজু করে তৎক্ষনাৎ কোরআন নিয়ে বসতেন। আমি আম্মাকে প্রশ্ন করলে উত্তর দিতেন মন খারাপ হলেই আমি কোরআনটা খুলে পড়তে বসি। তেলওয়াত করতে করতে এতো মধুর লাগে যে আগে পিছে কখন কি ঘটেছিলো সব ভুলে যায়।
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আম্মার রুমের ভেতরে না ঢুকে ফ্রেশ হতে ওয়াশরুমে চলে গেলাম। সেদিনও শান্ত ভদ্র স্বামীর ভূমিকা পালন করেছিলাম আমি। কারণ আমি সেদিনও আমার স্ত্রীকে মনে মনে একটা সুযোগ দিয়েছিলাম শুধ্রে যাওয়ার জন্য। কিন্তু সে শোধরালো না। একদিন অফিস থেকে জানতে পারলাম আম্মাকে হসপিটালে নেওয়া হয়েছে। আমি দ্রুত সেখানে পৌঁছে কি হয়েছিলো সেসব সম্পর্কে জানতে চাইলে আম্মা চুপ হয়ে থাকেন। কিন্তু ডাক্তার এসে জানায় আম্মা বাথরুমে কাপড় চোপড় পরিষ্কার করার সময় পা পিছলে পড়ে যায়। মেরুদণ্ডের সমস্যার সেই জায়গাতেই আঘাতটা বেশি লাগে। আমি খুব কেঁদেছিলাম সেদিন আম্মাকে জড়িয়ে ধরে। বাসায় এসে সেদিনও আমার স্ত্রীকে কোনো প্রশ্ন করিনি। এর কিছু দিন পরেই আমার স্ত্রী একদিন রাতের বেলায় আমায় এসে বলে,
-তোমার মা বিছানায় পড়ার আগেই ভালো কোথাও রেখে আসো। আমি না বোঝার ইঙ্গিতে প্রশ্ন করলাম ভালো কোথাও সেই জায়গাটা আবার কোথায়? আমার স্ত্রী খুশিতে গদগদ হয়ে উত্তর দিলো,
-কোথায় আবার বৃদ্ধাশ্রম। আমার বান্ধবীর শাশুড়িকেও রেখেছে ওইখানে। থাকা খাওয়া কোনো সমস্যা হবে না। আমরা মাসে না হয় দুইবার করেই দেখে আসবো। এখানে থেকে শুধু শুধু আরো বেশি অসুস্থ হবেন, আবার যদি এই অসুস্থতার মধ্যে ডায়াবেটিস ধরা পড়ে তাহলে বুঝতে পারছো কি হতে পারে? আমি সবকথা শুনে মনে মনে ভাবলাম কার সাথে এতদিন সংসার করলাম? যে আজও বুঝতে চাইলো না আমার সুখ কিসে? আমার স্ত্রীকে আর কিছু বুঝতে না দিয়ে বললাম,
-হুম ঠিকই ভেবেছো। ওইটাই সঠিক জায়গা আম্মার জন্য তাইনা? যে বয়স হয়েছে একা একা রুমে থেকে আর কি করবে? দাঁড়াও আমি এখনিই কল করছি ওখানে। ঘন্টা খানেক পর আমার শ্বশুর-শাশুড়ি আসলেন। আমার স্ত্রী ওনাদের দেখে বেশ অবাক হয়ে গেলো। কৌতুহল থেকেই আমায় প্রশ্ন করলো ওনাদের কেন এত রাতে ডাকা হয়েছে? আমি ওর কথায় ভ্রুক্ষেপ না করে আমার শ্বশুরের উদ্দেশ্যে বললাম,
-ক্ষমা করবেন আমায় বাবা বলতে বাধ্য হলাম, আপনার মেয়েকে আপনারা সেই শিক্ষা দিতে পারেননি যে শিক্ষা একজন অসুস্থ মাকে দেখভাল করতে শেখায়। একজন ছেলের বউ হিসেবে না হলেও অন্তত মানুষ হিসেবে অন্যের খারাপ সময়ে পাশে দাঁড়ানোর মতো শিক্ষা ও পায়নি। তাই আপনাদের ডাকতে বাধ্য হয়েছি ওকে আপনাদের সঙ্গে নিয়ে যান৷ ডিভোর্স পেপারটা সময়মতো পৌঁছে যাবে। আমার শ্বশুর আমার কথাগুলো শুনে লজ্জায় মাথা নিচু করে রুম থেকে বের হয়ে গেলেন। আর আমার শাশুড়ি ছিঃ ছিঃ করতে করতে তার মেয়েকে সাথে নিয়ে চলে গেলেন। এখনো ডিভোর্স হয়নি আমাদের। আমার আম্মা আমায় ডেকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বলেন ডিভোর্সটা যেন কোনোমতেই না হয়। এছাড়াও আমার শ্বশুর আরো কিছুদিন সময় চেয়েছেন আমার কাছে।
সেই থেকেই আম্মার সমস্ত দেখাশোনা আমিই করি। অফিস সামলিয়েও আম্মাকে খাইয়ে দেওয়া, রান্না করা, কাপড় ধোওয়া সবকাজ আমিই নিজে হাতে করি। আর তাছাড়াও আমি অফিস থাকাকালীন সময় ফ্ল্যাটের আন্টিরা এসেও আম্মাকে দেখে যান। ওয়াশরুমে ঢুকে মুখে পানি দিচ্ছিলাম। আবারও কলিং বেলের আওয়াজ হলো। আমি মুখ মুছতে মুছতে দরজাটা খুলে দিতেই দেখলাম আমার শ্বশুর দাঁড়িয়ে আছেন। আমি ভেতরে আসতে বলতেই উনি আমার হাতদুটো ধরে বললেন, ‘আমি লজ্জিত! আমার মেয়েকে ক্ষমা করে দাও বাবা। ও ওর নিজের ভুলটা বুঝতে পেরেছে’। পিছন ঘুরতেই দেখলাম আম্মার পায়ের কাছে বসে কাঁদছে আমার স্ত্রী। আম্মা হাসিমুখে ওর সব ভুল ক্ষমা করে দিয়ে বললেন,
-সংসারে এমন টুকিটাকি ঝগড়াতো হবেই বউমা। তাই বলে কি সংসার থেকে ঘরের লক্ষীকে তাড়িয়ে দেওয়া যাবে? সন্তান ভুল করলে কোনো মা কি পারে ক্ষমা না করে থাকতে? আমার স্ত্রী তখন কাঁদতে কাঁদতেই বললো,
-আমি যা করেছি তা ক্ষমার অযোগ্য মা। তবুও আপনি আমায় ক্ষমা করে দিলেন। আমার মা ঠিকই বলেছিলেন, এ যামানায় আপনার মতো শাশুড়ি পাওয়া ভাগ্যের ব্যপার। এই প্রথম দেখলাম আমার স্ত্রীর চোখে অনুতপ্তবোধের অশ্রু। আর আম্মার চোখে ওর জন্য বরাবরের মতোই সেই ভালোবাসা। আমার শ্বশুর চোখ মুছতে মুছতে বেড়িয়ে গেলেন। আজ আমারও খুব করে বলতে ইচ্ছে করছে, আমার আম্মাই পৃথিবীর সেরা ”আম্মা’।
গল্পের বিষয়:
গল্প