প্রায় মাঝরাতে আমার স্ত্রী আফরা ঘুম ছেড়ে উঠে ছোট বাচ্চাদের মতো কান্নাকাটি শুরু করে। সকালে সে সম্পর্কে প্রশ্ন করলে ও তার কিছুই বলতে পারে না। ইদানিং সমস্যাটা আর মাঝামাঝির মধ্যে আটকে নেই। এখন রোজ রাতেই এই সমস্যাটা বেড়েই চলেছে। এর কোনো হদিস এখনো পর্যন্ত বুঝে উঠতে পারিনি আমি। কাউকে যে বলবো সেটা বলতেও দিধা দন্দের মাঝে আছি৷ লোকসমাজে একত্রে বসবাস করি এখানে এক কান দুই কান করতে করতে আবার না পুরো এলাকায় ছড়িয়ে যায় যে অমুকের বউ পাগল হয়েছে। তাই আর কাউকে না বলে শুধু আমার মায়ের কাছে ব্যপারটা খুলে বলি। মা সব শোনার পর ভয়ে জড়সড় হওয়ার মতো অবস্থা। আমি কারণ জানতে চাইলে আমায় যা বলে তা শুনে বিশ্বাসও করতে পারিনি আবার অবিশ্বাসও করতে পারিনি, দোটানায় পড়ে আছি।
মা সেদিন বলেছিলো আফরা কে নাকি ভূতে ধরেছে। আমি প্রথমে বিশ্বাস না করলেও পরে একদিন রাতের ঘটনায় আর বিশ্বাস না করে থাকতে পারিনি। সেদিন আম্মার খুব পচ্ছন্দের ইলিশ মাছ কিনে এনেছিলাম। রাতে কারেন্ট চলে যাওয়াতে রান্না করতে করতে বেশ দেরিই হয়ে যায়। এশার নামাজ পড়ে এসে রাতের খাবার খেয়েছিলাম। গ্রামের বাড়িতে সাধারণত টয়লেটগুলো ঘড় থেকে বেশ খানিক দূরে হয়। আর আমাদের টয়লেট’টা ছিলো পেয়ারা গাছের নিচে। উপরে পেয়ারা গাছের ডালপালা দিয়ে বিস্তৃত আর নিচে গাছের গোড়ার পাশেই টয়লেট অবস্থিত। সেদিন রাতে খাওয়া দাওয়া শেষে ঘুমিয়ে যায় আমি। মাঝরাতে হাতটা বালিশে পড়তেই দেখি একদম ফাঁকা। হুড়মুড় করে উঠে পুরো ঘড়ে চোখ ঘুড়িয়ে দেখি আফরা কোথাও নেই।
হঠাৎ করেই দেওয়াল ঘড়িটা বেজে ওঠে৷ আমি তখন ঘেমে নেয়ে একাকার। পিছন ঘুরে দেওয়াল ঘড়িতে তাকাতেই দেখি রাত দুইটা বাজে। আমার মাথায় যেন ভয় চেপে বসলো। এত রাতে আফরা একা কোথায় গেলো? একজন পুরুষ মানুষ হয়েও এই প্রথম আমি এতো ভয় পাচ্ছি। খাট থেকে নেমে ধীরে ধীরে ঘরের বাইরে চলে এলাম। বারান্দার খুটিটা ধরে দাঁড়িয়ে দেখলাম আফরা কোথায় আছে? কিন্তু না এখানেও কোথাও নেই। বাধ্য হয়েই উঠোনে পা ফেলে এগিয়ে গেলাম টয়লেটের দিকে। হঠাৎ করেই মা’র বলা ভূতের কথাটা আমার মাথায় চেপে বসলো। মুহূর্তেই আমি আরো বেশি ঘামতে শুরু করলাম। মনে মনে দোয়া দরুদ পড়ে টয়লেটের সামনে যেতেই দেখলাম আফরা ভেতর থেকে বের হচ্ছে। তৎক্ষনাৎ পেয়ারা গাছের পাতাগুলো ভীষণ নড়েচড়ে উঠলো। আমি সেদিকে তাকিয়ে বুকে থু থু দিতেই আফরা উচ্চস্বরে খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। আমার তখন জান যায় যায় অবস্থা। কোনোমতে নিজেকে সামলে আফরাকে ধমক দিয়ে বললাম,
-পাগল নাকি তুমি হ্যা? এত রাতে কে একা বাইরে বের হয়? আমাকে ডাকতে পারলে না? আফরা সে কথায় ভ্রুক্ষেপ না করে আমি ভয় পেয়েছি কেন সেই কারণটা তুলে ধরে বললো,
–তুমি এত বোকা কেন হুম? পেয়ারা গাছে বাদুড় বসেছিলোতো, আর তুমি তাতেই ভয় পেয়ে গেছো হা হা হা এটা বলেই আফরা আবার হাসতে শুরু করলো। এই রাতের আধারে ওর হাসির শব্দটা যেন আমার কানে বিষের মতো লাগছে। আমি আর কিছু না বলে ওর হাত ধরে টানতে টানতে ঘরে নিয়ে গেলাম। ওইদিন রাতে আর আফরা কান্না করে ওঠেনি। পরদিন সকালে উঠেই সেসব কথা মা’কে খুলে বললাম। মা আবারো বলতে শুরু করলো, রাতে ইলিশ মাছ খেয়েছিলো বলে ভূতে ডেকে নিয়েগেছিলো, ভূতের আছড় থেকে বাঁচা মুশকিল ইত্যাদি ইত্যাদি৷ এক প্রকার আমার মনে শান্তি নেই তার ওপর মা’র এসব কথায় যেন আমি আধুনিক যুগে থেকেও সেইসব মনে প্রাণে বিশ্বাস করতে শুরু করলাম।
আফরাকেও এসব বলে কোনো লাভ হয় না। ও কোনোমতেই বিশ্বাস করতে চায় না যে রাতে উঠে কান্না করে। এখনতো ওর শরীরটাও বেশ খারাপ যায়। তাই আমিও বেশি জোড় দিয়ে ওকে আর কিছু বলি না। মাত্র কয়েকমাস হলো মেয়েটা একটা শোক সামলে উঠেছে। এরই মাঝে যদি ওর মাথায় এসব কথা ঢুকিয়ে জোড়াজুড়ি করি তাহলে হিতে বিপরীত হতে পারে। তাই আমি একাই ডাক্তারের সাথে এই ব্যপারে কথা বলতে যেতে চাইলাম। মা ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা শুনে আরো বেঁকে বসলো। হাজার টাকার খরচাপাতি হবে এসব নিয়ে রীতিমতো রাগারাগি শুরু করে দিলো। তাছাড়াও মা চায় আফরাকে ভূত তাড়ানোর মতো কোনো কবিরাজের কাছে নিতে। এখন আমি কোনদিকে যাবো সেসব নিয়ে চিন্তা করতে করতে বিকেলের দিকে একটু শুয়েছিলাম। কখন ঘুমিয়ে গেছি আমার জানা নেই। ঘুম ভাঙ্গে ঠিক মাগরিবের ওয়াক্তে।
দ্রুত বিছানা ছেড়ে উঠে ওজু করতে বারান্দায় যেতেই দেখলাম মসজিদের ইমাম সাহেব বাড়ির পাশ দিয়ে আমায় ডাকতে ডাকতে হেঁটে যাচ্ছেন। আমি আর ওজু করলামনা, ভাবলাম একেবারে মসজিদে গিয়েই করে নিবো। দৌঁড়ে ইমাম সাহেবের সাথে যেতে যেতেই সবকিছু খুলে বললাম। উনি বললেন এসব ভূত প্রেতে বিশ্বাস না করে ভালো কোনো ডাক্তার দেখাতে। হুজুরের কথায় মনে একটু সাহস পেয়ে আমি আর কিছু না বলে সম্মতিসূচক মাথা নাড়ালাম। সেদিন রাতে আবার আফরা কেঁদে ওঠে। আমি তখন গ্লাসে রাখা পানিটা ওর চোখে ছিটে দিতেই কান্না বন্ধ করে আমার দিকে করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়। খুব মায়া হচ্ছিলো মেয়েটাকে এভাবে দেখে। আমি বললাম কি হয়েছে তোমার আমায় বলো? আফরা আমায় জড়িয়ে ধরে খুব ভয়ে ভয়ে বললো,
-আমাদের বাচ্চাটা খুব কাঁদছে। খুব কাঁদছে আমায় ছাড়া। ও কি একা একা থাকতে পারে বলো? চলো আমরা ওকে নিয়ে আসি চলো না তুমি চলো? কথাটা বলেই আবার কান্না শুরু করলো। আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। মনে পড়ে গেলো আমাদের সন্তানের কথা।
আফরা যখন ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা তখন একদিন দুপুরবেলায় গোসল করতে যাওয়ার সময় টিউবওয়েল-পাড়ে পা পিছলে পড়ে যায়। আফরার চিৎকারে প্রতিবেশীরা ছুটে আসে। তারা এসে দেখে আফরা মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি করে চিৎকার করছে। বহমান রক্তের স্রোতে ভেসে গেলো আমাদের সন্তানের শেষ চিহ্ন। সেই থেকে আফরা কিছুদিন পাগলের মতো বিলাপ শুরু করতো। রোজ রাতে কেঁদে কেঁদে বালিশ ভিজিয়ে ঘুমাতো। কয়েকমাস হলো একটু নিজেকে সামলে নিয়েছে ঠিকই। কিন্তু মাঝরাতে কান্নাটা তাহলে কিসের জন্য? প্রশ্নটা মাথায় আসতেই বুঝতে পারলাম মা’তো হয় আফরা, তাই আজও সন্তানের পৃথিবীর আলো না দেখতেই চলে যাওয়াটাকে পুরোপুরি ভুলতে পারছে না। আমি আফরাকে শান্তনা দিয়ে রাতে কোনোমতে ঘুমিয়ে গেলাম। ভোর হতেই মা’কে সবটা খুলে বললাম। মা সবটা শুনে বললো,
-বাপজান আমিতো ভূতে ধরছে বিশ্বাস কইরছিলাম। আইজকা বাড়িতে কবিরাজও ডাকতে চাইছিলাম। আল্লাহ বাঁচাইছে আমার পোলার বউডারে কোনো ভূতে ধরেনাই। তুমি বউডারে নিয়া তাইলে ডাক্তারের কাছে চইলা যাও বাপজান।
আমি মা’কে আর কিছু না বলে আফরাকে নিয়ে ডাক্তারের উদ্দেশ্যে শহরের পথে রওনা হলাম। আফরা আমায় রিক্সাতে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে প্রশ্ন করলো, ‘কি হয়েছে তোমার, এত চুপচাপ কেন’? আমি মুখে মিথ্যে হাসি টেনে বললাম, কই কিছু নাতো। কিন্তু মনে মনে খুব করে ভাবছি, কাল রাতে আফরার মুখে আমাদের বাচ্চার কথাটা না শুনলে হয়তো আফরা আজ ডাক্তারের কাছে নয় অন্য কোথাও শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের মুখোমুখি হতো।
গল্পের বিষয়:
গল্প