–আমাদের বাড়ির বাকি দুই বউও উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত।কিন্তু তাদেরকে বাড়ির বাইরে কোনো কাজ করতে আমরা দেইনি। দেখো মা, তোমাকে আমার ছেলের আগের থেকেই পছন্দ ছিলো বলে,আমরা দেখতে এসেছি।কিন্তু তুমি নাকি কোনো এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করো? আমাকে দেখতে আসা রূপমের মা বাবা প্রশ্ন করছে তখন থেকেই। আমি উনাদের প্রশ্নের উত্তরে বললাম,
–জ্বি।
–তাহলে ছেড়ে দাও।আমরা চাইনা ঘরের বউ বাড়ির বাইরে গিয়ে কোনো কাজ করুক।কারণ ঘরের মেয়েদের কাজ হচ্ছে ঘর সামলানো।
বাঙালী মেয়েদের সংসারধর্ম হচ্ছে বড় ধর্ম। কিছু পেতে হলে কিছু ছাড়তেই হয়।রূপমের সাথে সংসার করতে হলে আমাকে উনাদের আদেশকে সম্মান করে মেনে নিতে হবে।সেই শ্রদ্ধাবোধ থেকে আমি উনাদের মতের সাথে সম্মতি প্রকাশ করলাম। কিছুদিন পর বেশ ধুমধাম করেই আমাদের বিয়েটা হয়।আমার সংসারটা যেন সোনায় সোহাগা ছিলো!জা,ভাসুর,দেবর,শ্বশুর, শাশুড়ি সবাই অল্প কিছুদিনেই আমায় আপন করে নিলেন। বেশ চলছিলো সবকিছু। হঠাৎ একদিন সকালে আমার শ্বশুরের চিৎকারে আমাদের সকলের ঘুম ভেঙে যায়।ঘুম ভাঙতেই নিচে এসে দেখি উনি একজন অপরিচিত ভদ্রমহিলার সাথে কথা কাটাকাটি করছেন।ভদ্রমহিলাকে পারিপাটি ড্রেসে বের হয়েছেন।দেখে মনে হচ্ছিলো তাড়া আছে। আমার শ্বশুর যা তা বলে সেই ব্যক্তিকে কটু কথা শোনায়। আমার শ্বশুরের কথার ধরণ দেখে বুঝলাম,ভদ্রমহিলা চাকরি করেন।
এন জন্যই এত কথা শোনাচ্ছেন আমার শ্বশুর।তার কারণ হচ্ছে,আমার শ্বশুরের ভাষায়, ভদ্রঘরের মেয়েরা বাইরে কাজ করে না।তার উপর সকাল সকাল ভদ্রমহিলা পানির বোতল থেকে পানি মুখে নিয়ে সেটা অনিচ্ছায় আমার শ্বশুরের পায়ের উপর ফেলে।তার জন্য উনি চটেছেন।যতদূর জানি,এই ভদ্রমহিলা আমাদের পাশের বাসায় থাকেন। পরবর্তীতে বাবাকে কোনোরকম থামিয়ে আমরা ঘরে নিয়ে আসি। কিছুদিন পর ঐ ভদ্রমহিলার সাথে আমার ছাদে আলাপ হয়।উনি আমাদের বিল্ডিং এর দোতলায় থাকতেন। উনার সম্পর্কে অনেক কিছুই জানতে পারি।বর অসুস্থ,শয্যাশায়ী। তার জন্যই উনাকে জব করতে হয়।পুরো বিষয়টা জানতে পেরে আমার খুব খারাপ লেগেছিলো উনার জন্য এবং বিব্রতবোধ করেছি আমি, সেদিন আমার শ্বশুরের আচরণের জন্য। বিয়ের পর এই বাড়িতে আমার বছরখানেক সময় কেটে যায়।এর ভেতরে আমার একটা কন্যাসন্তান হয়।
মেয়ে হওয়ার বছরখানেকের মাথায় আমার স্বামী হঠাৎ অসুস্থ হয়ে উনার প্যারালাইজড হয়ে যায়। রূপমের অসুস্থতার পরেই পরিবারের সকলের ভালোমানুষের খোলশটা ধীরে ধীরে সরতে শুরু করে।এক সংসারের সব কাজ আমাকেই করতে হতো।কারণ আমার স্বামীর উপার্জনের ক্ষমতা ছিলো না। পরিবারের বাকিদের উপার্জনে আমাদের তিনজনের খরচ চলে। আমার শ্বশুর ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত,উঁচুশ্রেণীর একজন সরকারি কর্মকর্তা।মোটা অঙ্কের পেনশন পেতেন। রূপমের অসুস্থতার প্রায় বছরখানেক কেটে যায়।এই একবছর সবার আমাদেরকে নিয়ে ভীষণ সমস্যা হয়েছে।সবার টাকা পয়সা আমাদের পেছনে খরচ হয়ে যাচ্ছে। এক পর্যায় গিয়ে আমার শ্বশুর আমাকে সবার সামনে ডেকে নিয়ে বললেন,
–বরটারে তো পঙ্গু বানাইছো।আবার ছেলে না হয়ে, হইছে মেয়ে।আর কদ্দিন মাইনষের ঘাড়ের উপরে বইসা খাবা ?
–আমি কি করবো বাবা ?
–তুমি কি করবা,সেটা আমি কি জানি?কিন্তু আমার পেনশনের টাকা থেকে আর একটি টাকাও আমি তোমাদের জন্য খরচ করতে পারবো না।
–তাহলে আমি কি চাকরি করবো? আপনার ঘরের বউকে তো আপনি চাকরি করতে দিবেন না বলে নিয়ে আসছেন।
–বাপের বাড়িতে কইরা বাপ মায়েরে খাওয়াইছো।
কিন্তু আমার বাড়িতে থেকে এসব হবেনা।তোমার চাকরি করার হলে,আমার বাড়ি ছেড়ে দাও। বেশ অবাক হয়ে এই মানুষটাকে দেখছি।দুঃসময় আসলে যে আপনও পর হয়ে যায় তার জ্যান্ত প্রমাণ আমার শ্বশুর নামক মানুষটাই। আমি বাবার রুম থেকে চলে এসেছি নিজের রুমে।রূপমকে সবকিছুই বলেছি। রূপম আর মেয়েকে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে যাবো বলে সব গোঁছগাঁছ করছি।হঠাৎ ফারিয়ার ফোন আসলো।ফারিয়া আমার ননদ।ও দেশের বাইরে থাকে। ফারিয়া ফোন করে বললো,
–ভাবি,দোয়া করবেন। আমার চাকরিটা হয়ে গেছে।আর ফোনটা বাবাকে দেন তো,উনার সাথে কথা বলি।বাবার ফোনে অনেকবার ট্রাই করছি, নেটওয়ার্ক সমস্যা হয়তো।বাবাকে পাচ্ছি না। আমি ফোন বাবার কাছে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি,উনার পাশে। ফোন কানে দিয়ে কিছুক্ষণ পর বাবা বললো,
–আলহামদুলিল্লাহ।মন দিয়ে কাজ কর মা।সুখে থাক। বাবার থেকে ফোন নিতে নিতেই বললাম,
–বিষয়টা কি সুন্দর! তাই না বাবা?
–মানে?
–বাড়ির বউ চাকরি করতে পারবেনা কিন্তু বাড়ির মেয়ে চাকরি করতে পারবে।
দেখুন বাবা,ফারিয়া চাকরি করবে এতে খারাপ কিছুই না।বরং ও স্বাবলম্বী হবে,এটা আমাদের জন্য অনেক খুশির কথা। কিন্তু বাবা,আমার বেলায় কেন ঘর ছাড়তে হবে? তবে কি আমি আপনার বাড়ির মেয়ে হয়ে উঠতে পারলাম না? যাকগে,বাবা আমি আপনার ঘর ছেড়ে দিবো।আপনি সবসময় ভালো থাকুন। কথাটা বলেই চলে আসলাম শ্বশুরের ঘর ছেড়ে।আজ অনেকদিন যাবৎ চাকরি করছি নিজের মেয়েকে মানুষ করানোর জন্য, এবং রূপমের পাশে থাকার জন্য। অন্যের অনুদানে থেকে তার বাধ্যগত হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে আত্মসম্মানসহ নিজের যোগ্যতায় স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকা ঢের ভালো।
গল্পের বিষয়:
গল্প