এই লেখা আমার প্রাইমারি স্কুলের একটা স্মৃতি নিয়ে। তখন বয়স ৯ বছর মতন হবে, আর সেই সময়তেই শিখেছিলাম জীবনের কঠিন সময়ে নিজেকে নিজের পাশে দাঁড়াতে হবে।
পরিবারে আমরা চারজন – মা, বাবা, দিদি আর আমি। ছোট হিসেবে আদরটা বরাবরই একটু বেশি ছিল কিন্তু কথার গুরুত্ব কোনোদিন পাইনি। বয়সে সবার থেকে ছোট, স্বাভাবিক ভাবেই বুঝবো কম, বুদ্ধিও নিছকই কম হবে। অতএব যা আদেশ দেওয়া হতো সেভাবেই চলতে হতো। তবে এই সমস্ত আদেশের মধ্যে একটা আদেশ আমার খুব ভালো লাগতো। মা বলতো ‘সবসময় সত্যি কথা বলবে, সৎ পথে চলবে আর এমন কোনো কাজ করবেনা যে কেও তোমাকে খারাপ বলে আর আমাদের শুনতে হয় যে তোমার ছেলে খুব খারাপ সত্যি কথা বলতে প্রত্যেক কাজ করার আগে ভাবতাম, ভয় পেতাম, কিছু কিছু সময় বুঝতে পারতাম না এটা আদেও ভালো না খারাপ। তবে এটা শুনে ভালো লাগতো যে আমি যদি ভালো ভাবে চলি তাহলে সবাই আমাকে ভালো বলবে, আর দেখতামও সবাই ভালো বলছে, আনন্দ পেতাম, খুশি হতাম। সুতরং ঠিক করে নিয়েছিলাম এই ভাবেই চলবো।
সব ঠিক ঠাক চলছিল, হয়ত একটু আধটু ভুল হত আর তাতে বকা শুনতাম। এর মধ্যে একদিন বাড়ির পাশ দিয়ে ৮ বছর থেকে ১১ বছর বয়সী দুটি বাচ্চা যাচ্ছিলো আর খেলার চলে কোনো গান করছিলো যার মধ্যে “আই লাভ ইউ” কথাটি ছিল। পাশ থেকে একজন তাদের খুব বকা দেয়।
কারন জানতে চাইলে মা বললো ওগুলো বাজে কথা বলতে নেই, যারা বলে তারা খারাপ হয়। তার সঙ্গে আরও দুটি শব্দ যুক্ত হলো “প্রেম”, “ভালোবাসা”. আমার মাথাতে এটাই ঢুকলো যে এই শব্দগুলো উচ্চারণ করা যাবে না আর যদি কেও করে তাদের থেকে দূরে থাকতে হবে নয়তো সবাই খারাপ বলবে। বেশ এভাবেই চলতে থাকলো। তখন ক্লাস ৪ এর মাঝামাঝি সময়, ক্লাস- এ একদিন একটি মেয়ে হটাৎ করে চিৎকার করে ওঠে আর সবাই – এর কানে কানে কিছু একটা বলছে আমার দিকে পয়েন্ট করে। কিছু জনকে জিগ্যেস করলেও কোনো কারন জানতে পারলাম না। আমি ও কিছু বুঝতে পারলাম না। স্কুল শেষ হলে বাড়ি চলে এলাম, মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেলো। সবাই যেন আমার দিকে খারাপ ভাবে তাকাচ্ছে, একটু ভয় ও করছে, বাড়িতে যদি জেনে যায়। কিন্তু পরে ভাবি আমি তো কিছু করিনি। ছেড়ে দিলাম ওসব ভাবা।
পরের দিন স্কুল যাওয়ার সময় একা একাই গেলাম। একটু দেরি হয়েছিল তাই রাস্তাতে আর কারোর দেখা মেলেনি। স্কুলে যাওয়া বা আসার কোনো সঠিক সঙ্গী ছিল না, যে দিন যার সাথে দেখা হতো সেদিন তার সাথেই চলে যেতাম আবার আসার সময়টাও তেমনটা হতো। স্কুলে সেই কালকের মতন সবাই একটু অন্য ভাবেই তাকাচ্ছে। মন মরা হয়ে থাকলাম। আসার সময় দেখলাম বাড়ির পাশের দিদি আসছে, বয়সে আমার চেয়ে ৩-৪ মাসের বড়ো তাই মা ছোটো থেকেই দিদি বলতে শিখিয়েছে, কিন্তু আমরা একই ক্লাস এ পড়ি… ডাক দেওয়াতে দাঁড়ালো কিন্তু বুঝলাম কেমন যেন অন্নরকম লাগছে, মনে হচ্ছে সঙ্গে যাওয়ার ঠিক ইচ্ছে নেই। আগেও তো একসাথে গিয়েছি এরকম তো করেনি, অন্য কোথাও যাওয়ার হলে বলে দিতো পরে যাবো। যাইহোক শেষে একসাথেই যাচ্ছিলাম। কিছু কথা হবার পর বললো-
— আমি আর তোর সাথে কথা বলতে পারবো না, একসাথে স্কুলে আসতে বা যেতে ও পারবো না।
— কেন?
— শুনিসনি ওরা কি বলছে?
— কি বলছে, আমাকে তো কিছু বলছেই না।
— ওরা বলছে তুই আমার সাথে নাকি প্রেম করছিস, ওরা কিভাবে বুঝেছে।
— কিন্তু কিজন্য, কি করলাম।
— আমি জানি না ওরা ওরকম বলছে।
কিছুদূর যাওয়ার পর বললো আমি আগে আগে চলে যাচ্ছি তুই পরে পরে আয়। বেশ খারাপ লাগলো। বাড়িতে একা একা গেলাম। খাওয়া সেরে বাগানে চলে গেলাম। বাগান টা ছিল খুব প্রিয়, যেহেতু বেশিরভাগ সময়টা একা একা থাকতাম, সময়টা বাগানে কাটতো। তারপর থেকে যেন একটু বেশি একা একা হয়ে গেলাম। কিছু দিন এভাবে চলার পর বাড়িতে মাটি তোলার জন্য কয়েক জন কাকু এসেছিলো কাজ করতে। আমার সেদিন ছুটি ছিল। ঘুরতে ঘুরতে সেখানে যাওয়ার পর একজন মজার ছলে বলে “”শুনলাম তুই নাকি “পা**তা” -র সাথে প্রেম করছিস।”” বেশ রাগ হলো। বিনা কারনে আমার নামে বাজে কথা বলছে। ছুটে গেলাম মায়ের কাছে, বললাম–
–মা দেখো ওই কাকুটা আমার নামে বাজে বাজে কথা বলছে।
–কি বলছে ?
–দেখো আমার নামে বাজে বাজে কথা বলছে, গিয়ে দেখো।
–বলবিতো কি বলছে।
–বলছে আমি নাকি ওর সাথে প্রেম করি।
–দেখেছিস, আমি বার বার করে বলেছিলাম কারোর সাথে মিশবিনা, কি দরকার ছিল ওর সাথে কথা বলার, মেশার। এখন বলছে শোনো।
আমি পুরো চুপ হয়ে গেলাম। যে আমাকে একদিন শিখেয়েছিলো ভালোথাকতে, আজ ভালো থাকার পরও যখন মিথ্যা অপবাদ শুনতে হচ্ছে, সে একটু বোঝার চেষ্টা করলো না, কারণ জানতে চাইলো না বা আর কারো কাছে শুনলনা কেন ওরা আমাকে ওরকম বলছে। সত্যি আমি সেরকম কিছু করেছি কিনা।
সেদিন বড্ডো একা লাগছিলো যে একাকীত্ব সেদিন মাঝরাস্তা থেকে একা বাড়ি আসার সময়ও লাগেনি। সেদিন বুঝেছিলাম জীবনের সবথেকে কঠিন সময়ে শুধু আমি মানুষটাই আমার কাছে থাকবে আর আমি মানুষটাই পারে সেই কঠিন সময় থেকে আমাকে বের করতে।