অফিস থেকে ফিরে সন্ধ্যে বেলা ঘরে শুয়ে সমীর ভাবছে, আজ যা হল তা সিনেমার মতো মনে হলেও তা তারই জীবনে ঘটেছে। কি অদ্ভুত একটা ঘটনা, যদিও ঘটনার শুরু থেকেই ব্যাপারটা অদ্ভুত।
তিন-চার মাস হল চাকরিতে join করেছে সমীর। চাকরি সুত্রেই পলাশডাঙ্গায় পোস্টিং হয়েছে তার। BDO-তে চাকরি করে। তাই মাঝে মাঝে গ্রামে ঘুরে ঘুরে কাজ করতে হয়।
প্রথম দিকে যখন সে গ্রামে যেত, তখন সে এক দাদুকে দেখতে পায়। মুখটা দেখেই চিনতে পারে সমীর। যখন সে ছোট ছিল তখন এই দাদুই তাদের পাড়ায় যেত হাওয়াই মিঠাই বিক্রি করতে। আজ তার ২০ বছর পর এভাবে সেই পূর্ব-পরিচিত দাদুকে দেখে ভাবতেই পারছে না এমন ঘটনা বাস্তবে ঘটা সম্ভব।
“আমায় চিনতে পারছ?”, জিজ্ঞাসা করলো সমীর।
ভাঙা কাঁচের চশমা চোখে নিয়ে ভালো করে চেয়ে দেখল দাদু। “নাহ, চিনতে পারছি না তো, কে আপনি?” প্রশ্ন করলো দাদু।
“আমায় আপনি বলতে হবে না, তুমি করে বলো। আমি সেই বাপি। সেই যে তুমি বাগবাজারে হাওয়াই মিঠাই বিক্রি করেতে যেতে, মনে পড়ছে?”
“হ্যাঁ, আরে বাবুমশাই, তুমি কত বড়ো হয়ে গেছো, কত বড়ো মানুষ হয়ে গেছো”।
দাদুর বয়স হয়ে গেছে। এখন আর হাওয়াই মিঠাই বিক্রি করতে কলকাতায় যেতে পারে না। চোখে ভালো দেখতে পায় না। বাড়ির লোক ওনাকে ধরে ধরে হাটায়। কলকাতায় যাওয়া তো দূরের কথা, একা একা বাথরুমে অবধি যেতে পারে না দাদু।
-“আমি তোমার কাছে ৭৫ পয়সা পাই এখনো”, খুনসুটি করে মনে করিয়ে দিলো দাদু।
লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু হয়ে গেলো সমীরের। ছোটবেলায় কি না করেছে সে।
-“থাক, ও টাকা তোমার আর দিতে হবে না, ওটাই তোমার কাছে এই বুড়ো মানুষটার স্মৃতি হিসেবে থাকুক”।
যাই হোক, সেদিন কাজ মিটিয়ে চলে আসে সমীর। তারপর থেকে মাঝে মাঝে সে যায় দাদুর সাথে দেখা করতে। ফল, মিষ্টি, বিস্কুট, তেলে-ভাজা যেদিন যা পায় তাই হাতে করে নিয়ে যায় দাদুর জন্য। ছোটবেলায় এই দাদুও তো তাকে কম আনন্দ দেয়নি। এইভাবে ধীরে ধীরে সম্পর্ক গভীর হয় সমীরের সাথে হাওয়াই মিঠাই ওয়ালা দাদুর।
একদিন দাদু বলল, “আমিতো তোমায় ছোটবেলায় হাওয়াই মিঠাই খাইয়েছি, আজ আমায় ‘হাওয়াই মিঠাই’ খাওয়াবে? মহাদ্বন্দ্বে পড়ে গেলো সমীর। কারণ, সে জিনিস তো এখন প্রায় পাওয়াই যাই না। দাদুর ভাঙা কাঁচের চশমার সাথে স্নিগ্ধ হাসি দেখে সে না বলতে পারল না। বলল, “ঠিক আছে দাদু, আমি যদি কোথাও দেখতে পাই নিয়ে আসব তোমার জন্য”।
তার কিছু দিন পর সে যখন তার অফিসের বন্ধু অজয়ের মেয়ের জন্মদিনে যাচ্ছিল তখন সে দেখতে পায় ‘হাওয়াই মিঠাই’। দেখা মাত্রই তার দাদুর কথা মনে পড়ছিল। কিন্তু সে ভেবে দেখল যদি সে এখন দাদুর বাড়ি যায় তাহলে অজয়ের বাড়ি যেতে অনেক দেরি হয়ে যাবে। থাক আজ, অন্য দিন পেলে দাদুর জন্য অবশ্যই নিয়ে যাবে। আজ দুপুরে বাজারে গিয়ে দেখতে পেয়েছিল ‘হাওয়াই মিঠাই’। হাতে সময় থাকায় কিনে ফেলল দুটো প্যাকেট। সে আর দাদু একসাথে বসে খাবে।
একি! দাদুর বাড়ির উঠোনে এতো ভিড় কেন? ভিড় ঠেলে সামনে গিয়ে যা দেখল তাতে তার গা শিউরে উঠল। ছোট একটা খাটে দাদু শুয়ে আছে, নাকে তুলো আর চোখে তুলসি পাতা দেওয়া। নিথর অবস্থায় কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে রইল সমীর। হাতে দু’প্যাকেট হাওয়াই মিঠাই। এমন পরিস্থিতির জন্য তৈরি ছিল না সমীর। অবশেষে এই ঘটনা মেনে নিলেও পূর্বের ঘটনাটা সে যেন মানতেই পারছে না। সেদিন সে যদি হাওয়াই মিঠাই কিনে নিয়ে আসত তাহলে দাদুর মনের আশা মিটত। কি হতো? একটু না হয় দেরিই হতো অজয়ের বাড়ি যেতে।
এখন যে হাওয়াই মিঠাই দাদু আর খেতে পারবে না, কোনোদিনও না। নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হচ্ছে সমীরের। যে দাদু তাকে ছোটবেলায় অনেক আনন্দ দিয়েছে, তার একটা ছোট্ট চাওয়া সমীর পূর্ণ করতে পারল না। দরজায় আওয়াজ হচ্ছে। কে যেন এসেছে। উঠে গিয়ে দরজা খুললো সমীর। “কি রে, মুখটা শুকনো শুকনো দেখাচ্ছে, মন খারাপ নাকি তোর?” ঘরে ঢুকে জিজ্ঞাসা করলো অজয়। সাথে তার তিন বছরের মেয়েও এসেছে।