ডিভোর্স পেপারে সইটা করেই কোনো রকম নিজেকে সামলে কোর্ট থেকে বেরিয়ে আসলো নীলা। কয়েক সেকেন্ড আগেও তো এই সম্পর্ক থেকে মুক্তি চেয়েছিলো সে। তাহলে এখন কেন খারাপ লাগা কাজ করছে তার ভেতর? অদ্ভুত তাইনা? অনেক চেষ্টা করেও কোনো ভাবে সংসারটা টিকিয়ে রাখা গেল না। কেননা কোনো মেয়েই চাইবে না রোজ রোজ স্বামির হাতে নিয়ম করে চারপাচঁ বার মার খেতে। যদিও নীরবের এত নির্যাতন সহ্য করার পরেও নীলা ভিটে আকড়ে ধরে থাকতে চেয়েছিলো। নিজের সন্তানের পরিচয়টা সে কখনো খারাপ করতে চায়নি। তবুও ভাগ্যের কাছে হেরে গেল সে। হুট করে চোখের পলকে এক কাগজে সই করে সাত বছরের একটা সম্পর্ককে একদম জীবিত কবর দেয়া হলো। চোখটা ঘোলাটে হয়ে আসছে তার। কেন যেন নিজেকে ক্ষমা করতে পারছেনা।
এদিকে নীরব এক দলিলে সই শেষ করে নতুন দলিলে সই করছে। নতুন সম্পর্কে নিজেকে জুড়ে এবার এক পরকিয়া প্রেমকে বাস্তবে রূপ দিচ্ছে। একটা গভীর সম্পর্ক ছিন্ন করেও তার ভেতর কোনো খারাপ অনুভূতি নেই। তার জীবনে সাত বছর বলে একটা মুহূর্ত ছিল কে বলবে? অথচ এই নীরবই একসময়ে নীলা কে স্বপ্ন দেখাতো। তাদের চার বছরের পিচ্ছি মেয়ে নিধিরাকে নিয়ে কত স্বপ্ন দেখাতো। হাহ্ কে মনে রাখে এসব? কি লাভ এগুলো মনে রেখে? এখন তো সব স্বপ্ন অপূর্ণ। সব স্মৃতি গুলো যেন নীলার বুকে পাথরের মত দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। মানুষের জন্য এই স্মৃতির বোঝা সবচেয়ে ভারী। পৃথিবীর কোনো কিছুই এই ভারের চেয়ে ভারী নাহ্।
শুধুমাত্র হতাশা ব্যাতিত কিচ্ছু করার নেই এখন, কিচ্ছুটি করার নেই । এদিকে নতুন বিয়ের কাগজে সই করে কোর্ট থেকে বেরোচ্ছে নীরব। চোখে মুখে তৃপ্তির হাসি। নীরবকে কোর্ট থেকে বেরোতে দেখে নীলার মা তার হাত শক্ত করে ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। তবে নীলার সেদিকে খেয়াল নেই। এক প্রকার জোরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয় সে। মন চাচ্ছে এক প্রকার দৌড়ে গিয়ে শেষ বারের মত নীরবের বুকে ঘুচে যেতে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে। তবে সেসব ইচ্ছে গুলো বিবেকের কাছে হেরে যায় বারংবার। নীরবের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে নীলা। প্রেয়শীকে ফেলে এবার নীলার দিকে নজর যায় নীরবের। এখন খারাপটা তারও লাগছে। নীলা সোজা হেঁটে গিয়ে নীরবের নতুন স্ত্রী রিনার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। মুচকি এক হাসি দিয়ে বলে,
-“এই পরিবারের মানুষগুলোর ভালোবাসা বড্ড আলাদা। এত ভালোবাসা সহ্য করার যোগ্য আমি না বিধায় আজ স্বামি ধরে রাখতে পারলাম না। তুমি শক্ত করে ধরে রেখো সবার যত্ন নিও। আমি জানি আমার মত সহজে তুমি হাল ছাড়বেনা।” উত্তরের অপেক্ষা করেনা নীলা। দু পা এগিয়ে নীরবের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় সে।
-“ভালো থেকো। নিজের খেয়াল রেখো। আর আমাদের নিধিরা। নিধিরা! নিধিরা কোথায়?” এবার একটা ঘোর থেকে হুস ফিরে সবার। আশেপাশে কোথাও নিধিরা নেই। সবাই খুঁজছে তাঁকে কোর্টের ভেতর এগিয়ে যায় নীরব। যে ঘরে বসে নীরব আর নীলার ডিভোর্স হয়েছে ঠিক সেই ঘরে এক কোনায় চেয়ারে চুপটি মাথা করে বসে আছে সে। দৌড়ে গিয়ে ওকে কোলে তুলে নেয় নীরব। আদর করে চুমু খায়। কোনো কথা বলছে না নিধিরা। তার মাথায় হাত রাখে নীরব।
-“বাবাই! মাম্মাম কি তোমাকে আর আমাকে রেখে চলে যাবে?”
-“হ্যাঁ রে মামনি।”
-“তাহলে আমাকে কে পার্কে ঘুরতে নিয়ে যাবে? কে স্কুলে নিয়ে যাবে? রাতের বেলা ঘুম না পেলে কে আমায় গল্প শোনাবে? আমায় কে ভাত খাইয়ে দেবে? পুতুল কে খেলবে? পুতুলের মত আমায় কে সাজিয়ে দিবে?”
-“তোমার রিনা আন্টি আছে তো। সে ই এখন থেকে তোমার খেয়াল রাখবে। কি রিনা রাখবেনা?”
-“ন..না মানে ইয়ে আমাদের কাছে কেন রাখতে হবে… নি.. নিজের মায়ের প্রতি ত..তো পরে ও…ওর একটা কষ্ট জমাবে তাইনা।”
-“নিধিরা! আমার সোনা মা টা কোথায়?” এক লাফ দিয়ে নীরবের কোল থেকে নেমে যায় নিধিরা। জোরে জোরে দৌড়াতে থাকে সে। এক লাফ দিয়ে মায়ের বুকের ভেতর চলে যায়। নীলাও এখন সমানে কাঁদছে। নিধিরা মায়ের চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে জোরে জোরে বলে,” রিনা আন্টি তুমি পচাআআআআআ।” নীলার ভাই এসে টেনে নিয়ে যাচ্ছে নীলাকে।
-“চলো মা! আমরা দুজন আজ থেকে তোমার নানুর বাসায় থাকবো।”
-“ওয়েট! তোরা দুজন মানে কি? নীলা? আর ইউ ম্যাড? ঐ বাচ্চা ওর বাবার কাছে থাকবে। ওর মেয়ে ওকে যেভাবে খুশী পালতে দে। খুব শীঘ্রই তোর বিয়ের ব্যাবস্থা করা হবে। সেখানে থাকবি সংসার করবি। দ্যাটস্ ইনাফ।”
-“ভাইয়া পাগল হয়ে গেছিস তুই? কাকে কি বলছিস? ও আমার মেয়ে। আমার জন্ম দেয়া সন্তান। ওকে আমি কার কাছে রেখে যাবো?” নিধিরাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নীলা। নিধিরা মায়ের কানের কাছে গিয়ে ফিস ফিস করে বলে,”মাম্মাম, তুমি কি আমাকে একা ফেলে চলে যাবে?”
-“না সোনা মা আমি কোথাও যাবো না। তোমাকে ফেলে আমি যেতে পারি বলো?”
-“আমাকে রেখে চলে গেলে আমি কিন্তু মরে যাবো।”
-“ছিঃ ছিঃ এমন কথা বলতে নেই আমার সোনাটা।
আমি কিভাবে থাকবো তোমায় ছাড়া। কোথাও যাবো না আমরা।”
মা মেয়ে দুজনে কেঁদেই চলেছে। নিধিরার ফুপু এসে জোর করে টেনে নিয়ে যাচ্ছে নিধিরাকে। কেঁদেই চলেছে সে। খুব জোরে জোরে কাঁদছে নিধিরা। তার কাতর কন্ঠে চিল্লানোটা বার বার নীলার বুকে গিয়ে লাগছে। নীলার মা ভাই টেনে নিয়ে যাচ্ছে তাঁকে। বারবার পেছন ফিরছে নীলা। জীবনের শেষ চাওয়া। গুলো কেন অপূর্ণ হয়? কেন অপুর্ণ থাকে মানুষের জীবনের সবচেয়ে চাওয়া ইচ্ছে গুলো?
গাড়ি ছেড়ে অনেকটা দূর চলে গিয়েছে। তবুও জানলা দিয়ে বারবার পেছন ফিরে চেয়ে আছে নীলা। নিধিরাও বারবার দৌড়ে মায়ের কাছে আসতে চাইছে। তবে তাদের মাঝে এখন এক বিশাল খাদ। কেউ ছুঁতে পারবেনা কাউকে। শুধু দূর থেকেই এভাবে ভালোবাসবে মা মেয়েকে। কোর্টের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা উকিল এনামুল সাহেব তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বাশার সাহেবের দিকে উদ্দেশ্য করে বলছে, “বুঝলেন, রোজ রোজ কোর্ট চত্তরে এমন ঘটনা গুলো দেখে আর খারাপ লাগেনা। অভ্যাসে পরিনত হয়েছে এমন দৃশ্য গুলো।
গল্পের বিষয়:
গল্প