বড় বৌ

বড় বৌ
আমি বাড়ির বড় বৌ।আমার শশুর শাশুড়ীর দুই ছেলে দুই মেয়ের মধ্যে আমার হাজবেন্ড সবার বড়।তারপর দুইবোন আর এক ভাই সবার ছোট।আমার বিয়ের আগেই আমার দুই ননদের বিয়ে হয়ে গেছে।ননদরা নিজেরা নিজেদের সংসারে বেশ ভাল ভাবেই আছেন বলেই আমি জানি।আমি যখন বৌ হয়ে আসি তখন বাসায় আমি আর আমার শাশুড়ী এই দুইজন মেয়ে মানুষ আর তারা তিনজন পুরুষ।বিয়ের আগে সংসারের সব কাজ আমার শাশুড়ী আর এক বান্দা বুয়া আছে সে মিলে করতেন।আমি আসার পর আমার শাশুড়ী এক প্রকার রান্নাঘর থেকে রিটায়ার্ড করলেন।
নিজেদের রান্না হলে আমি একাই করে নেই কিন্তু মেহমান আসলে আমাকে আমার শাশুড়ী আম্মা হেল্প করেন।দুই ননদ তাদের ফ্যামেলী নিয়ে বেড়াতে আসলে আমরা বৌ শাশুড়ী মিলে রান্নাবান্না করে সুন্দরমতো পরিপাটি করে সবাই কে আপ্যায়ন করি,তাই তেমন কোন ঝামেলায় পড়তে হয় না। শাশুড়ীর বয়স হওয়ার সাথে সাথে গায়ে নানান রোগের বসতবাড়ি করে রেখেছেন।রেখেছেন বললাম একটু রাগ করেই।তার কলেস্টেরলের লেভেল খুব বেশি কিন্তু তারপরও তিনি লুকিয়ে লুকিয়ে চিংড়ি ভাজি করে খাবেন,গরুর মাংস তার সবচেয়ে বেশি প্রিয়।ডায়াবেটিস মানে ব্লাডে সুগার খালি পেটে ৯/১০ থাকে তারপরও ডিমের পুডিং, মিষ্টি,সেমাই যা পাবেন ফ্রিজে তাই খাবেন।ওজন কমানোর জন্য ডাক্তার যে ডায়েট দিয়েছেন আমার শাশুড়ী তা গুলি মেরে উড়িয়ে দিয়েছেন এক কথায়।জোর পূর্বক হাটতে পাঠালে দেখা যায় পাশের বাসার আন্টির সাথে বসে বেশ খোশ মেজাজে গল্প করে ফিরে আসেন।
তাই তিনি মোটামুটি ইচ্ছা করেই রোগ পুশে রেখেছেন বলি।কিন্তু তাতেও তেমন কোন লাভ হয় না।যখন বলি তখনই একটু রিয়েক্ট করে পরে আবার যেই লাউ সেই কদু।তারপরও চেষ্টায় থাকি তার সুস্থতার কথা চিন্তা করে তাকে খাবার দাবারের কন্ট্রোলে রাখতে।শশুর নিতান্তই সাদামাটা ধরনের।বাজারে একটা বড়সড় মুদিদোকান আছে তার।সারাদিন ওখানেই সময় কাটান।দুপুরে একবার বাসায় আসেন, গোসল করেন খাওয়াদাওয়া করে আবার চলে যান।আমার শাশুড়ি বলেন ওইটা নাকি আমার শশুরের আরেক বৌ।ওইটা ছাড়া নাকি তিনি দিন দুনিয়া চিনেননা।ছোট দেবরটা ইউনিভার্সিটিতে পড়ে।ফাঁকে ফাঁকে দুই একটা টিউশনি করে।বেশ শান্ত স্বভাবের ঠিক ওর বড় ভাইয়ের মত।ওর রুমে প্রথম যেদিন ঢুকি সেদিন আমার মাথাটা ঘুরে যায়।এক মশারী মনে হয়না ওর মনপড়বে ঠিক কবে টাঙিয়েছে।
বিছানার এককোনে ময়লা কাপড়ের স্তুপ।পড়ার টেবিল মনে হয়েছিল একটা বইয়ের গুদাম।আমি সেদিন এগুলো দেখে একটা জোরে চিৎকার দিয়েছিলাম “হায় আল্লাহ!” বলে।এরপর ওকে হাতে ধরিয়ে ধরিয়ে এগুলো সব পরিস্কার করিয়েছিলাম দুই ঘন্টা সময় নিয়ে।এরপর আর কোনদিন আমি ওর রুম অগোছালো দেখি নাই।এবার আসি আমার জনের কথায়।জীবনে বই ছাড়া মনে হয় আর কিছুই দেখেনাই।একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে জব করেন।তাই অফিসের কাজের বাইরে অন্যকিছু সে ঠিক বুঝেনা।তাই আমি এখন মাঝে মাঝে তাকে দিন দুনিয়া দেখাই সাথে কিছু কিছু শিখাই।যেমন সংসারের কিছু কিছু কাজ তাকে দিয়ে করাই যখন আমি আর একা সেরে উঠতে পারিনা।কারন আমিওতো সবে মাত্র পড়াশোনা শেষ করেছি সাংসারিক কাজকর্মে খুব একটা পারদর্শিতা আগে ছিল তা বলা যাবেনা। যাবতীয় কাজকর্ম আমাকেই সামলাতে হবে এমন কেন কথাতো নাই, তাই না?মাঝে মধ্যে যখন নিজে একা কুলাতে পারিনা তখন বাধ্য হয়ে আমার হাজবেন্ড কিংবা দেবরকে কাজে লাগাই।ওরাও আমার বেসামাল অবস্থা দেখে নিজ থেকেই এগিয়ে আসে হেল্পের জন্য।নিজের সংসার নিজের মত করে গুছিয়ে নিয়েছি একরকম আরকি।
হটাৎ করেই শাশুড়ী খুব অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন।তখন একা আমি সারাদিন আর রাত বাসা হাসপাতাল ছুটাছুটিতে দিগবেদিক ভুলে গেলাম।ননদরাও পালাক্রমে হাসপাতালে আসে মায়ের পাশে থাকে।তখন আবার আমি বাসায় আসি রান্না করার জন্য। হাসপাতালে খাবার নিতে হয় সবার জন্য। এই করে করে আমি একেবারে ক্লান্ত হয়ে পরি।যেদিন বাসায় আসি আম্মাকে নিয়ে সেদিন মনে হল আমার সারা শরীর একেবারে ছেড়ে দিয়েছিল।বাসায় আসার পর পর আমার হাজবেন্ড আমাকে জোড় পূর্বক ছুটি দিলেন।তার এক কথা, আমি কোন কাজ করতে পারবনা।শুধু রেস্ট নিব আর সব কাজ তারা দুই ভাই মিলে করবে।আমার ও খুব মজা লাগল কথাটা শুনে।তারা কিভাবে কি করে তা দেখার জন্য আমিও প্রস্তুত।
হাসপাতাল থেকে ফিরে গোসল করে পেটভরে খেয়ে দিলাম এক ঘুম। আম্মার রুমে আম্মা ঘুমায় আর আমার রুমে আমি ঘুম শুয়ে শুয়ে দারুন লাগছিল পুরো বিষয়টা কল্পনা করতে।কিন্তু বেশি একটা সময় মনে হয়না আরাম করতে পারলাম খুব চিৎকার চেচামেচিতে ঘুম ভেঙে গেল।বিছানা ছেড়ে উঠে রুমের বাহিরে এসে দেখি আমার ননদরা আর তাদের হাজবেন্ডরা বসে জোড়ে জোড়ে চিৎকার করছে।ঘটনা কি তা জানার জন্য এক পা এগুতেই আমার বর আমাকে আমার রুমে চলে যেতে বললেন।আমি ঠিক কি করব তা বুঝতে পারছিলাম না।এর পর রুমে চলে এলাম। রুম থেকে শুনতে পেলাম আমার ঘুম নিয়ে তর্ক হচ্ছে।ঘরে শাশুড়ী অসুস্থ আর আমি কেন এই সময়তে ঘুমাচ্ছি!আমার হাজবেন্ডও কম যান না বুঝলাম।এমনিতেই চুপচাপ থাকে কিন্তু এত কথা জানে যে তা ওই দিনই বুঝতে পারলাম।
সে যাই হউক ওই দিনের পর আমার ননদরা দুইজনই আমাকে একেক করে জিজ্ঞেস করেছিল যে আমি ওদের ভাইকে কি খাইয়েছি যে ওদের ভাইয়ের এতটা চেঞ্জ! আমি কোন উত্তর দেইনি শুধু হেসে ছিলাম। এরপর আরেকদিন আমার বড় ননদের জামাই আসলেন বাসায় আম্মাকে দেখতে।এসে দেখেন আমার দেবর আর আমার বর দুইজন বসে মটরশুটি বাছতেছেন।দুলাভাইয়ের চোখমুখ সত্যিসত্যিই সেদিন দেখার মত ছিল।আমার কেন জানি খুব লজ্জা লাগছিল তাই ওদেরকে রেখেদিতে বললাম।কিন্তু দুজনই তাদের কাজে অনড়।কেউ শেষ করার আগে ছাড়লেন না।দুলাভাই যাওয়ার সময় আমাকে বলে গেলেন “ভাবিতো ভালই কামলা মিলাইছেন দেখছি!” সেদিনও আমি তার কথায় কোন উত্তর দিলাম না শুধু একটু হাসি দিয়ে বিদায় দিলাম।
আম্মার অবস্থা এই ভাল এই খারাপ।খাবার দাবারের বড় কড়া কড়ি চলছিল।যেভাবেই হউক বিপি আর ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখতেই হবে।এমনই একদিন বিকেলে বড় ননদের শাশুড়ী সহ আরো কয়েকজন এলেন আম্মাকে দেখতে।আমি সবার জন্য নাস্তা নিয়ে গেলাম।কেন জানিনা আমার বড় নন্দাই উঠে এসে পুডিংয়ের বাটি গুনতে শুরু করলেন পরে আমার উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন।কি ব্যাপার ভাবি! অবেলায় ঘুমিয়েওতো ব্রেন ভাল কাজ করেনা আপনার, বাটি একটা কম এনেছেন মনে হচ্ছে? নাকি অংকে খারাপ ছিলেন তাই গুনতে ভুল করেছেন?তার কথা শেষ হতে না হতেই আমার ননদ বলে উঠলেন অবেলায় ঘুমালেই যদি ব্রেন ঠান্ডা থাকত তাহলে সবাই অবেলাতেই ঘুমাত! সবসময় হাসি দিয়ে মনে হয় চুপ থাকা যায় না।
আমি সেদিন শুধু হাসি দিয়ে চুপ থাকতে পারলাম না।সবাইকে পুডিংয়ের বাটি এগিয়ে দিতে দিতে বললাম। “না ভাই আমি বরাবর অংকে ভাল, আর তাই হিসাবটাও ভাল বুঝি।সবেমাত্র আম্মা হাসপাতাল থেকে আসলেন।ঠিক এখনই আবার তাকে ওখানে পাঠাতে চাই না।তাই আম্মার জন্য পুডিংটা আনি নাই।” আমি এভাবে উত্তর দিব তা হয়ত উনি আশা করেন নাই। তাই একটু বিরক্ত হয়েই আবার বললেন হাসপাতালেইতো ভালো থাকেন আম্মা।সব কিছু মেইনটেইন হয়।হাসপাতালের খরচের ভয়েই কি বাসায় নিয়ে আসছেন নাকি হিসাবি ভাবি? আমার মেজাজ তখন চতুর্থ আসমানে উঠে গেছে কিছু একটা বলতে যাব ঠিক তখনই আম্মা বলে উঠলেন “কিযে বলেন জামাই, হাসপাতালে কি মানুষ থাকে? কি এক অবস্থা! বাসাতেই ভালো আছি।শত্রুকেও যেন আল্লাহ হাসপাতালে না নেয়”।
আমি আর তখন কেন কথা বললাম না।চা আনার জন্য রুম থেকে বের হয়ে এলাম।যাওয়ার সময় বড় ননদ আমাকে ডেকে জানতে চাইলেন,কি দরকার ছিল তার হাজবেন্ডের সাথে বেয়াদবি করার? আমি কেন জানি তখন তাকে কিছু বললাম না।তার দিকে একবার তাকিয়ে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলাম।আমার উত্তর না পেয়ে তিনি আবার বললেন যে জিনিস আম্মার খাওয়া নিষেধ সে জিনিস কেন বাসায় বানানো হয়? আমি উত্তর দিব কিনা ভাবতেই দেখি আমার দেবর বলে উঠল বড়আপু আমি খাই ভাইয়া খায় বলে ভাবি বানায়। আর সাথে সাথে সব রাগ গিয়ে পরল ওর উপর। আপা রাগে গজ গজ করতে করতে বললেন বেয়াদবের সাথে চলতে চলতে বেয়াদব হয়ে যাচ্ছিস।আমার দেবরও দেখলাম কোন উত্তর না দিয়ে আমার মত মিষ্টি করে একটা হাসি দিয়ে নিজের রুমে চলে গেলন।
কাজ শেষ করে যখন মেহমানকে বিদায় জানাতে তাদের কাছে এলাম তখন আবার ননদাই বললেন। কিছু হিসাব আমরাও জানি,আমরা কিন্তু অংকে একেবারে কাঁচা ছিলাম না।আমি তখনও একটা হাসি দিয়ে তাদের বিদায় দিলাম।এই রকম হুটহাট ঝামেলা ছাড়া মোটামুটি ভাল মতেই কেটে যেতে লাগল আমার সংসার জীবন। ও আর একটা কথা সেদিন আমার ননদ কি বলে ছিল আমার শাশুড়ীকে তা আমি জানিনা।তবে আমার শাশুড়ী আম্মা পরে একদিন আমাকে তার জামাইদের সাথে মেপেমেপে কথা বলতে বলেদিলেন। ছোট ননদের সেকেন্ড বেবী হওয়ার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হল।আমি আমার সাধ্যমত সহযোগিতার হাত বাড়ালাম।ননদরা কেউই তাদের শশুর শাশুড়ীর সাথে থাকেননা।তাদের সবার আলাদা সংসার।তাই ননদের এই সময়ে তার পাশে কেউ নাই।যেহেতু আম্মা অসুস্থ তাই আমিই চেষ্টা করছি যতটুকু সাপোর্ট দেওয়া যায়।ছোট ননদাই খেতে বসে শুরু করলেন “ভাবি এইসব কি রান্না করছেন?
ভাত মুরগী ডাল সবজি এই টুকুই? কোন মাছ নাই।এইসব কি ফকিন্নি মার্কা খাবার,এই খাবার আনার কি দরকার ছিল? ” আমার মেজাজটা আবার খারাপ হল। আমার ননদ বলে উঠলেন ভাবি সারারাত এখানে ছিল তুমি কি দেখনাই? তোমার পছন্দ না হলে কিনে খাও।ননদের উত্তরে দেখলাম সে একটু চুপ।আমি নবজাতক বাচ্চা নিয়ে বারান্দায় চলে এলাম, কেনজানি ওখানে আর থাকতে ইচ্ছে করছিলনা।এর কিছুক্ষণ পর ননদের শশুর বাড়ির লোকজন আসল বাবু দেখতে।তাদের সামনে দেখি ননদাই একটু পর পর আমাকে নানান হুকুম দিচ্ছে শুধু তাই না একটু চটাংচটাং কথাও বলছে।তার ব্যবহারে আমার খুব কান্না পাচ্ছিল।সেদিন হাসপাতাল থেকে বাসায় এসে আমি পণ করলাম যে আর ওখানে যাব না।
আমার হাজবেন্ডকে সব কথা বুঝিয়ে বললাম।সেত সব শোনার পর পারলে তখনই হাসপাতালে যায় ননদাইকে উচিৎ জবাব দিতে। কিন্তু আমি কোন ঝামেলা চাইলাম না।একটা জিনিস আমি বুঝতে পারি যে আম্মা জানেন তার মেয়ে জামাইদের আর মেয়েদের আচরন কিন্তু তার পরও তাদেরকে তিনি খুব ভালবাসেন।তাদের সম্পর্কে কোন নেতিবাচক কথা তিনি শুনলে কষ্ট পান।আমি আম্মাকে কোন কষ্ট দিতে চাইনা।তিনি আমাকে যথেষ্ট আদর করেন আমি এই নিয়েই ভাল থাকতে চাই।হাসপাতাল থেকে এরপর কয়েকবারই ডাক এসেছিল কিন্তু আমি নানান অযুহাত দেখিয়ে যাই নাই। শেষের দিকে ননদাই খাবারের জন্যও ফোন দেয় পরে দেবরকে দিয়ে একদিন খাবার রান্না করে পাঠিয়েছিলাম মানবতার খাতিরে।যে যেটার যোগ্য না তাকে সেটা দেওয়ার কোন মানে হয় না, কি বলেন ঠিক না? ছোট ননদ কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছিলেন আর তাই এই বিষয় নিয়ে আর কোন কথা বলেন নাই।
দেখতে দেখতে আমার শাশুড়ী আম্মা সুস্থ হয়ে উঠলেন এরপর আমিও আমার বাবার বাড়ি বেড়াতে গেলাম এক মাসের জন্য। খুব আনন্দে কেটেছে এই কয়টাদিন।কিন্তু তারপরও কিছু একটা টান অনুভব করতাম প্রতিনিয়ত।আমার মা বলেন এটা নাকি সংসারের টান।কেননা আমার হাজবেন্ড প্রতি বৃহস্পতিবার চলে যেতেন আবার শনিবার চলে আসতেন।তার জন্য যে খুব ছটফট করতাম তা না। আবার আম্মা আব্বা দেবর সবার সাথেই দিনে অন্তত একবার কথা হত।কিন্তু এসবের পরও কেমনজানি একটা পিছুটান কাজ করত এই এক মাস।মা বলেন যে মেয়ে যত বেশি তার সংসারেরর জন্য শ্রম দেয় সে তত বেশি সংসারের মায়াজালে জড়িয়ে যায়।আমি মনে হয় সেই রকমই সংসারের মায়াজালে আটকে যাচ্ছি।
কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে আবার ফিরে এলাম নিজ ঠিকানায়।কোরবানি মানে বাড়তি একটা আনন্দ। এবার ঈদে আম্মা আব্বা তার সব সন্তানকে সাথে নিয়ে উদযাপনের আয়োজন করলেন। আমার শাশুড়ী আম্মা ভাল করেই তার মেয়েদের জানেন তাই হয়ত দুইজন বাড়তি কাজের লোক রাখলেন যাতে আমার উপর তেমন চাপ না পরে।বাসা ভরা লোকজন,একসাথে সবার সাথে মিলে ঈদ করার আনন্দই অন্যরকম।আমি যথাযথ ভাবে চেষ্টা করতে লাগলাম যাতে কেউ কোন দোষ ধরতে না পারে।আমার সাথে আমার হাজবেন্ড দেবরও হাতে হাত মিলিয়ে সুন্দরভাবে সব গুছিয়ে নিচ্ছে সবসময়।এরজন্য দেবরকে দুলাভাইরা বারবার খোঁচা দিচ্ছে বলছে ভালোই কামলা গিরি শিখছ, নিজেরটারেতো একটা কামলা বানাইছে সাথে তোমারেও ট্রেনিং দিছে, এই মেয়ে একটা আস্ত কামচোর, এর মা মনে হয় কাজকাম কিছুই শিখায়নাই।মহিলা শুধু একটা সুন্দরী মেয়ে জন্মদিছে আর তারে কোনমতে বিয়ে দিয়ে বিদায় করে দায় সারছে।আমি সব শুনি কিন্তু কিছু বলিনা।
আমার হাজবেন্ডকে দেখি শুধু ফোঁস ফোঁস করে আর আম্মার সাথে কথা বলে,আম্মা যথা সম্ভব তাকে বুঝিয়ে ঠান্ডা রাখেন।খাওয়ার পর সবাই যেযার মত টেবিল থেকে উঠে যায়।আমিও তখন আম্মাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকি ইনসুলিন দিতে হয় খাওয়ার আগের ঔষধ খাওয়াতে হয় আবার পরের ঔষধ বের করে দিয়ে পরে খাবার বেরে দেই।এতক্ষণ অপেক্ষা না করে আমার দেবর টেবিলটাকে পরিস্কার করে ফেলে আর তখন থেকেই শুরু করে বিনা পয়সার কামলা বলে ওকে ক্ষেপানো শুরু।ও নিজেও বেশ বিরক্ত হয় তাদের উপর কিন্তু আম্মার খুশির কথা ভেবে আর কিছু বলেনা।ঈদের সারাদিনের ঝামেলা শেষ করে গরুর মাংসের ভাগাভাগি, রান্না,ফ্রিজে রাখা এই সব একা নিজহাতে করে একেবারে অসুস্থ হয়ে পরলাম।রাতে বিছানায় যাওয়ার পর আর পৃথিবীর কোন কিছু মনে থাকলনা। সকালে যখন ঘুম ভাঙল তখন এগারোটা বাজে। সবার নাস্তা করা শেষ।
আমার কেমন জানি একটু লজ্জা লাগল, এতটা বেলা হয়ে গেল আর আমি টেরই পেলাম না?নাস্তা কে রেডি করল? চিন্তা হতেই মাথাটা ব্যাথা শুরু হল।হায় আল্লাহ! আম্মা এই শরীর নিয়ে এতগুলো মানুষের জন্য নাস্তা বানিয়েছে,ভাবতেই চোখ ভিজে গেল।একটু পরেই হুশ হল বড় নন্দাই এর কথায়।ভাবির তাহলে ঘুম ভাঙল? ভাইতো আপনাকে রাজরানী করে রেখেছেন।মেহমানকে হোটেলের পরোটায় ভালোই চালায় দিলেন! ভাইজানতো দেখি পুরাই চেঞ্জ! আগেতো গ্লাসে পানি ঢেলে না দিলে পানিটাও খেত না। আমি জানি আমার হাজবেন্ড রেগে গেলে বাজে একটা পরিবেশ তৈরি হবে তাই তাড়াতাড়ি কথার প্রসঙ্গ পরিবর্তন করলাম বললাম আম্মা আপনি ঔষধ খেয়েছেন? আম্মাও হেসে হেসে উত্তর দিলেন খেয়েছি বৌমা,এখন তুমি নাস্তা করে নাও দেখ পরোটা সব শক্ত হয়ে যাচ্ছে।
এরপর বড় ননদ বলে উঠলেন তোমার বৌমার জন্যতো আর পরোটা নরম হয়ে বসে থাকবেনা! আম্মা বড় আপার দিকে তাকিয়ে একটু রাগ দেখিয়ে বললেন।ভাল মত কথা বলাটা এখনও শিখলিনা? আমি এরপর আরও কি শুনতে হবে সেই ভয়ে রান্নাঘরে চলে গেলাম।একটু পর চা নিয়ে এলাম সবার জন্য। তখন দেখি আমার হাজবেন্ড আম্মাকে বলছেন যে তার অফিসের বসের বাসায় তাদের কয়েকজনকে ওয়াইফ সহ দুপুরের দাওয়াত দিয়েছেন সেখানে যেতে হবে। সাথে সথে আম্মা রাজি হয়ে গেলেন।আমি কিছুই বলার সময় পেলাম না। আমার হাজবেন্ড আমার হাত ধরে টেনে রুমে নিয়ে এলেন রেডি হওয়ার জন্য। কেনজানি এই মানুষটা একটা মন্ত্র মুগ্ধ করে রেখেছেন আমাকে।আমি সারাক্ষণ মনে হয় তার আছড়ে থাকি।তার অবাধ্য একেবারেই হতে পারিনা।মনে হয় আমি নিজেও হতে চাইনা।রেডি হয়ে বাসা থেকে বের হওয়ার আগে আমার কানে এল প্রথম খোঁচাটা ছোট ননদ তার হাজবেন্ডকে বলছে, বড় ভাইয়াকে দেখে কিছু অন্তত শিখো।
কিভাবে বৌকে নিয়ে বেড়াতে যাচ্ছে দেখ।এর উত্তরে শুনলাম বড়জন বললেন, দিনদিন কত কিছু দেখব আর শিখব।এখানে আরও বেশি কিছু সময় থাকলে নিজের নাম ও ভুলেযাব।এতসব নতুন নতুন শিখতে যেয়ে।যত জলদি পার ভায়া বিদায় হও। বিপদ হবে পরে বলে হো হো হো করে হাসতে লাগলেন সবাই।আমার হাজবেন্ড আর দাড়ালেন না আমাকে নিয়ে বের হয়ে এলেন। রাতে যখন বাসায় ফিরলাম দেখি সবাই যারযার বাসায় চলে গিয়েছেন। ভেবেছিলাম আম্মা মনে হয় একটু রাগ থাকবেন।কিন্তু আমি পুরোপুরি ভুল ছিলাম।আমরা দুজন রাত পর্যন্ত বাইরে ঘুরে আসায় আম্মা অনেক খুশি হলেন।আমার খুশি দেখে আম্মা সেদিন তার বড় ছেলেকে বললেন মাঝে মাঝে আমাকে নিয়ে বাইরে বেড়াতে নিয়ে যেতে।সত্যি সেদিনটা খুব ভাল লাগার একটা দিন ছিল।এরপর বেশ ভাল মতই কেটে গেল বেশ কিছু দিন।
হটাৎ একদিন আমার বড় ননদাইএর কল এল আমার মোবাইলে। আমিতো একেবারে অবাক,কারন সে এর আগে কখনও আমাকে কল করে নাই।ধরব কি ধরব না দ্বিধাদন্দের মধ্যে ধরলাম।আর সাথে সাথে শুরু হল তার দুঃখের গল্প।যার সারমর্ম বড় আপা একেবারেই ভাল না।তার শশুর শাশুড়ীকে একেবারেই দেখতে পারেনা।বাসার কাজকর্ম ও তেমন একটা জানেনা।ভালমন্দ রান্না করতে পারেনা।প্রচন্ড রকমের বেহিসেবী একজন মহিলা, প্রচন্ড ঝগড়াটে স্বভাবের একজন মানুষ।তাকে নিয়ে তার জীবন একেবারে তছনছ হয়ে যাচ্ছে। আমি চুপচাপ শুনছিলাম আর মনে মনে হাসছিলাম। এরপর শুরু করলাম জবাব দেওয়া- প্রথমেই বললাম ভাই আপনিতো হিসাবে অনেক পাকা,তা হলে আর ভয় কি? আপাকেও হিসাবটা শিখিয়ে দেন।
এতবছর সংসার করলেন আর এখনও সাংসারিক হিসাবটাই শিখাতে পারলেননা বৌকে? আর ভাই আমার মত আপাও হয়ত বিয়ের আগে কিছুই শিখে যায়নাই।আমি যেমন ভাবে হাজবেন্ড দেবর দিয়ে চালিয়ে নিচ্ছি আপাকেও বলেন সেইভাবে চালিয়ে নিতে।কিছুমনে করবেন না ভাই আমার মত কামচোরকে বললেনতো তাই একটা সহজ উপায় বললাম। আর ভাই আপা তার শশুর শাশুড়ীর টেক কেয়ার করেন না।সেটা কিন্তু আপার কোন দোষ না।কারন আপনি নিজেইতো আপনার বাবা মায়ের দায়ভার না নিয়ে নিজে বৌ নিয়ে আলাদা হয়ে গেছেন।নিজ সংসার নিয়েআলাদা থাকেন।আপাতো শুধু আপনার দেখানো পথে হাটছেন।শুধু শুধু আপাকে দোষবেন না।ভাই আপা একা কতদিক সামলাবেন বলেনতো? কিছু কিছু দায়িত্বতো আপনিও নিতে পারেন, তাতে আপা ভালমন্দ রান্নায় মনোযোগ দিতে পারবেন।
ভাই ঘরের কাজ করলে কেউ কামলা হয় না।এতে একে অপরের সাথের সম্পর্কটা মুজবুত হয়।এই যে দেখেন না, আপনার ভাই আমাকে রানী বানিয়ে রেখে কিন্তু নিজে ঠকে যায় নাই।বরং জিতে গেছে অনেক কিছু যেমন ধরেন, আমার মন,আমার সারাটা সময়,আমার সারাটা অস্তিত্ব আর তার সাথে আমার বর হওয়ার সুবাদে রানীর একমাত্র রাজা।বলে খুব হাসলাম। আমাকে রানী বানিয়ে নিজে তার রাজা হয়ে বসে আছেন বুঝলেন।তারপর বললাম আপনিও এই সুবিধাটা নিতে পারেন।নিজেকে রাজা বানানোর সুযোগ হাতছাড়া করা মনে হয় লস হয়ে যাবে।আপনিতো আবার বেশ ভালই হিসাব জানেন।সো রেডি হয়ে যান আপার রাজা হওয়ার জন্য। বলে হাসতে হাসতে মোবাইলটা রেখে দিলাম।মনটা কেমন জানি একটা ভালো লাগায় ছেয়ে গেল কাউকে তা বোঝাতে পারবনা।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত