মানিয়ে নেয়া জীবন নাকি নির্যাতন

মানিয়ে নেয়া জীবন নাকি নির্যাতন
স্ত্রীর গায়ে হাত তুললেন আয়মান চৌধুরী। মনের ইচ্ছা মিটিয়ে,শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে মেরেছেন স্ত্রীকে। মেরে নাক-মুখ ফুলিয়ে দিলেন। স্ত্রীর কপাল,চোখ উঁচু হয়ে ফুলে উঠলো। বেচারি খুব চেষ্টা করেছিলেন মুখটাকে নিজের হাতের তালু দিয়ে ঢেকে রেখে বাঁচাতে। কিন্তু পারলেন না। ঠোঁটের এককোনায় নখের আচর আর ঘুসি লেগে কেটে গিয়ে ফুলে উঠেছে। স্বামী চলে যাওয়ার পর আরজুমান তারাতাড়ি আয়নায় নিজের চেহারার কেটে যাওয়া ফোলা অংশগুলোতে দেখে দেখে বরফ দিচ্ছেন। একবার কপালে,একবার ঠোঁটে, একবার চোখের নিচে। খুব চেষ্টা করেও পারেন নি মুখটাকে বাঁচাতে। শরীরের টর্চার দেখা না গেলেও চেহারার এমন বিশ্রী অবস্থা দেখলে মানুষ ঠিকই বুঝে যাবে। কি করে মুখ দেখাবেন তিনি মানুষকে?
সকালে উঠেই যে তাকে সংসারের জন্য হাটবাজার, বিল-বাট্টাসহ, স্বামীর অনুপস্থিতিতে তার এক অফিস ম্যানেজমেন্টের যাবতীয় কাজ করতে হয়। আবার বাসায় এসেও কাজ করতে হয়। আয়নায় দাঁড়িয়ে নিজের চেহারার এমন বিশ্রি অবস্থা দেখে তিনি অঝোরে কেঁদে যাচ্ছেন। লজ্জায় মাথা হেট হয়ে আসছে তার। এখানে মনের অবস্থার চেয়ে চেহারার অবস্থা নিয়েই তিনি বেশি আফসোস করছেন। মন! আহা মন! মন সে-তো বহুবছর আগেই জীবনযুদ্ধের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন। মন নিয়ে ভাবার আজ আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। তখন মনে হতো “এভাবে জবানের আঘাতে কষ্ট না দিয়ে যদি দুটো থাপ্পড় দিতো তবু এতো কষ্ট হতো না”। আর আজ যখন মন নিয়ে ভাবার আর কিছুই অবশিষ্ট নেই আজ শুধুই সমাজে ভদ্র সেজে থাকার জন্য চেহারার সৌন্দর্য বা কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে রাখা জরুরি। আজ সেটাও নষ্ট হয়ে গেলো।
মারার সময় আয়মান চৌধুরী বলেছিলেন,” তোর চেহারার এমন হাল করবো যাতে কাউকে মুখ দেখাতে না পারিস।”
সত্যি বড্ড নিষ্ঠুর আচরণ করে ফেললেন। আজ আর আরজুমানের সংসারে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে ইচ্ছে হচ্ছে না। কিন্তু ছেলে-মেয়ে! আরজুমান ছেলেমেয়ে দুজনকে কাছে নিয়ে “কার কাছে থাকতে চায় ” জিজ্ঞেস করায় এরা দুজনকেই চায় বললো। এদের বাবাও লাগবে।মাও লাগবে। কোনো উপায় নেই সংসার ত্যাগ করে চলে যাওয়ার। চোখ-মুখে অন্ধকার দেখতে লাগলেন আরজুমান। কি করবেন তিনি! কি করা উচিত? আর কতো মানিয়ে নিয়ে চলা যায়? আর কতো মানাতে মানাতে নিজের অস্তিত্বই মাটিতে মিশে যায়? আবার উঠে দাঁড়িয়ে কার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করবে সে? নতুনভাবে মার খাওয়ার জন্য এ প্রস্তুতি?
ভাবতে ভাবতে মনের শক্তি কমে গিয়ে শরীরটা নিস্তেজ হয়ে এলো তার। মাটিতে শুয়ে দু-একটা চিৎকার করে শুধু উপরওয়ালার দিকে তাকিয়ে হাজারটা প্রশ্ন করলেন তিনি। “এ্যাই প্রভু! তুমি শুনতে পাও আমায়? দেখো আমাকে কি করেছে! তুমি না বান্দার মুখ নিজহাতে সৃষ্টি করেছো! দেখো তোমার আরেক সৃষ্টি এই মুখটাকে কি বিশ্রী করে দিলো! দেখো চেয়ে একবার প্রভু। আচ্ছা প্রভু! তোমার এতো ধৈর্য কি করে হয়? কি করে তুমি ওপরে বসে দুনিয়ার এই রঙ্গলীলা সহ্য করো? কি করে এতো এতো নির্যাতনেও তুমি চুপটি মেরে থাকো? কি হলো কথা বলো! বলো আমার অপরাধ? আমি ন্যায়-নীতির বিরুদ্ধে চলতে পারিনা। এটাই কি আমার অপরাধ?” হঠাৎ কলিং বেলের শব্দ! নিজ প্রভুর সাথে বুলি আওরাতে আওরাতে কখন যে আরজুমান ঘুমিয়ে গেছে নিজেও জানে না। তড়িঘড়ি করে উঠে গিয়ে দরজা খুলতে গেলো। ততক্ষণে দরজায় লাথি দেয়া শুরু হয়ে গেছে আয়মান চৌধুরীর। তিনি দেরি সহ্য করতে পারেন না।
কিছুক্ষণ পর পাশের ফ্ল্যাটের প্রতিবেশী এসে বলে গেলো,” অশিক্ষিত হতদরিদ্র লোকজন সাধারণত এমন কাজ করতে পারে। দরজায় লাথি মারা,ভাঙচুর করা তাদের ক্ষেত্রে হলেও চলে। তাও সবাই সমান না। অনেকের শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকলেও তাদের আচার-আচরণে কেউ বুঝতেই পারে না যে,তারা হাইস্কুলের গন্ডিও পেরোয় নি। অথচ আপনার স্বামীর উদ্ধত আচরণ সবসময়ই মূর্খের পরিচয় বহন করে। আজকাল ঘরে মারামারি,ভাঙচুরের মতো অতি নিম্নশ্রেণীর কাজও তিনি করছেন। উনি না একজন সনামধন্য ব্যবসায়ি! আপনি না শিক্ষিত (ডাবল পোস্ট গ্র্যাজুয়েট)! কিভাবে থাকেন আপনি এমন স্বামীর সাথে? এভাবেই কেটে যায় আরজুমানের দিনগুলো। দিন পেরিয়ে বছর গড়ায়,বছর কয়েক যুগে পরিণত হয়। কিন্তু স্বামীর স্বভাব পরিবর্তন হয় না। উল্টো আরজুমানের মানিয়ে নেয়ার ধর্মপালনের ত্রুটি-বিচ্যুতি হলে আজকাল তিনি নিজেই নিজেকে গালি দেয়। মনে হয় এমন যেনো মানিয়ে নেয়ার জন্যই তার জন্ম হয়েছে।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত