“তুমি যার রূপে-গুণে মাতাল হয়ে আমায় ছেড়ে ছিলে, তার সঙ্গে কি শেষমেশ বিয়ে হয়েছিলো তোমার অনিরুদ্ধ?”
ছয় কি সাত বছরের একটা মিষ্টি মেয়ে আমার সামনে বসা। তার পাশে যে মহিলাটি বসা, সে হলো আমার প্রাক্তন প্রেমিকা রূপা। কাকতালীয়ভাবে আজ প্রায় এক যুগ পর তার সাথে আমার দেখা এই রেলস্টেশনে। ঝুম বৃষ্টিতে আটকে গিয়েছিলাম। স্টেশনের পাশের ছাউনিতে দাঁড়াতে চোখ পড়লো কোনো এক চিরচেনা নারীর দিকে। প্রথম দেখাতেই চিনতে মোটেও ভুল হয়নি। এ যে আমার খুব চেনা কেউ।
রূপার সাথে প্রেমটা শুরু হয় কলেজ জীবনের শুরুতে। মেয়েটা তখন সবে দশম শ্রেণীতে তখন। আমার কলেজের ঠিক পাশের স্কুলেই পড়তো। দু’পাশে সবসময় বেণী করে রাখতো, কেমন যেন দেখতে খুব বাচ্চা বাচ্চা লাগতো।
রূপাকে প্রথম দেখেছিলাম স্কুল ছুটির পর বান্ধবীদের সাথে ঝালমুড়ি খেতে। মেয়েটার সেদিন ঝালে প্রায় নাক-মুখ লাল হয়ে গিয়েছিলো, তার উপর প্রখর রোদ।সেই দূরের টং দোকানটায় মাত্র কুড়ি ছুঁয়ে যাওয়া আমি অপলক মৌহে ডুব দিয়েছিলাম খানিকের জন্য। “কেমন আছো অনিরুদ্ধ?” রূপার অনাকাঙ্ক্ষিত প্রশ্নে আমার ঘোর কাটলো। সেই কখন থেকে মেয়েটাকে দূর থেকে তাকিয়ে দেখছিলাম।তবে সে আমায় চিনলো কিভাবে?
– ভালো।তুমি?
– এইতো।
– এখানে যে?
– বাবার বাড়ি থেকে ফিরলাম মাত্র। যা বৃষ্টি হচ্ছে, চলো ভেতরে গিয়ে বসা যাক।
আমি কোনো প্রতি উত্তর না দিয়ে তার সঙ্গে গেলাম।মেয়েটার চঞ্চলতা আজ ও একই রকমই আছে।তবে পার্থক্য একটাই, শাড়ীতে আজ তাকে দেখতে পূরিপূর্ণ একজন নারী লাগছে। বাইরে টংয়ের দোকান থেকে দু’কাপ চা নিয়ে আসলাম।আমি জানি রূপা বৃষ্টিতে ভিজে চা খেতে কতটা ভালোবাসে।
– চায়ের জন্য ধন্যবাদ।
– মেয়েটা নিশ্চয়ই তোমার?
– হ্যাঁ… কিভাবে বুঝলে?
– দেখতে ঠিক তোমার মত হয়েছে। একদম অদল বদল করে ফেলা যাবে।
রূপার সাথে প্রেমটা বেশ কাকতালীয়ভাবে হয়েছিলো।একদিন হুট করে দেখি মেয়েটা আমার কোচিং সেন্টারে। পরে জানতে পারি মাধ্যমিকের প্রস্তুতি নেয়ার জন্য ভর্তি হয়েছে। সেই থেকে স্কুলের সামনে বা কোচিংয়ে চোখাচোখি হতো। তবে কখনো ভালোবাসি বলার সাহস পাই নি।
একদিন কোচিংয়ের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ক্লাসের এক মেয়ে বান্ধবীর সাথে কথা বলছিলাম। ঠিক তখন রূপা আড়চোখে আমাদের দেখে ক্লাসে ঢুকলো। এরপরে যতবার দেখেছি, চোখ সরিয়ে নিতো সে। যেন ভেতরে ভেতরে অভিমাণ জমিয়ে রেখেছে মেয়েটা। এভাবে চলছিলো দিনগুলো। ওদিকে রূপার মাধ্যমিক সামনে, কোচিংয়ে সেদিন ছোট করে বিদায় অনুষ্ঠান করা হয়েছিলো। কেমন যেন খারাপ লাগছিলো সেদিন। যার জন্য প্রতিদিন আসা হতো তাকে যে আর দেখা যাবে না।ছুটির পর যেই বাড়ি ফেরার জন্য পা বাড়িয়েছি, রূপার এক বান্ধবী আমার ছোট একটা চিরকুট ধরিয়ে দিয়ে গেলো হাতে। তাতে লিখা ছিল, ” অন্য মেয়েদের সাথে কথা বললে যে আমার খুব জ্বলে তা কি বুঝতে পারেন না? আর কোনো মেয়ের সাথে দেখলে হাড্ডি সব গুড়ো করে ফেলবো। বুঝলেন? ” বৃষ্টি বেড়েছে।মনে হচ্ছে ঝড় হবে হয়তো।এদিকে রূপা এক পলকে বাইরে তাকিয়ে আছে।
– তারপর স্বামী-সন্তান নিয়ে কেমন আছো?
– এইতো ভালো। তোমার কি খবর?
– আমার আর কি খবর। চাকরী করছি এই আরকি!
– বিয়ে করো নি? আমি স্মিত হেসে প্রশ্নটা এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করলাম।ভএ প্রশ্নের উত্তর নেই আমার নিকট।
– এই ঝড়-বাদলে কতক্ষণ বসে থাকবে?বাসায় জানিয়েছো?
– হুম, ও আসছে নিতে।
আমি আবার আমাদের ফেলে আসা অতীতে ডুব দিলাম। রূপা ব্যস্ত তার মেয়েকে ঘুম পাড়াতে। রূপা ও আমার প্রেম হয়েছিলো শেষমেশ। সাধারণ কপোত-কপোতিদের মতই চলছিলো আমাদের প্রেমের দিনগুলো। লেকের ধারে হাতে হাত রেখে বসা, তার মায়ের ফোন চুরি করে এনে রাত জেগে কথা বলা সবই নিয়ম-মাফিক ছিল। বলতে গেলে রূপা ছিল প্রেমিকা হিসেবে যথেষ্ট যোগ্য। এমন যোগ্য প্রেমিকা সবার ভাগ্যে জুটে না আবার কারো কারো ভাগ্যে জুটলেও তার সঠিক কদর করতে পারে না। এই যেমন আমি করতে পারিনি। সময়ের সাথে সাথে আমি ভার্সিটি উঠলাম।নতুন জায়গা, নতুন পরিবেশ। রূপার সাথে সম্পর্কের এক পর্যায়ে মনে হলো, মেয়েটা কেমন যেন সেকেলে। যেখানে আমার বন্ধুদের প্রেমিকারা তাদের নিয়ে ফ্ল্যাট পর্যন্ত চলে গিয়েছে, সেই রূপার হাত ধরা ছাড়া আমি এতগুলো বছরে অন্য কিছুই পাইনি।একটা সময় অবহেলা বাড়লো। ক্লাসের এক সুদর্শন মেয়ের প্রেমে আমি হাবুডুবু খাচ্ছি। আমাদের প্রেমও হলো। কিন্ত রূপা জানতো না।
রাতের পর রাত ফোন ওয়েটিং দেখেই মেয়েটা আঁচ করে ফেললো, আমি আর ওর নেই। কত চেষ্টা করেছিলো আমায় ফিরে পেতে, কিন্ত আমি ফিরিয়ে দিয়েছি ওকে বারবার। একটা সময় রূপা হাল ছেড়ে দেয়। পারিবারিকভাবে কার সাথে যেন বিয়ে ঠিক হয় কয়েক মাস পর। তবে এতে আমার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। আমি ততোদিনে অন্য কারো স্বপ্নে বিভোর। একজন লোক হুট করে এসেই “রূপা” বলে ডেকে উঠলেন।ভদেখতে শুনতে সুদর্শন, বেশ ভদ্র। রূপার কোল থেকে বাচ্চাটাকে কোলে নিয়েই কপালে চুমু একে দিতে লাগলেন ভদ্রলোক। রূপা এবার আমায় উদ্দেশ্য করে বললো, ” ইনি আমার স্বামী, নিহান। আর নিহান ও হচ্ছে অনিরুদ্ধ।” ভদ্রলোক “ও আপনি সেই অনিরুদ্ধ ” বলেই হাত মেলাতে নিজের হাত বাড়িয়ে দিলেন।
– আচ্ছা, রূপা আমি বরং লাগেজগুলো গাড়ীতে উঠিয়ে আসি।কেমন?
– আচ্ছা।
এই বলেই ভদ্রলোক চলে গেলেন। রূপার চোখ দুটো চকচক করছিলো বেশ বুঝতে পারলাম। খানিক চুপ থেকে মেয়েটা আমায় উদ্দেশ্য করে বললো, ” আচ্ছা, তুমি যার রূপে-গুণে মাতাল হয়ে আমায় ছেড়ে ছিলে, তার সঙ্গে কি শেষমেশ বিয়ে হয়েছিলো তোমার অনিরুদ্ধ?” ততোক্ষণে নিহান ছাতা মাথায় করে সামনে দাঁড়িয়ে রূপাকে ফেরার তাড়া করলেন। যাবার সময় রূপা আমায় ” আসি অনিরুদ্ধ ” বলে পা বাড়ালো।ভদ্রলোক হাসি মুখে বললেন, ” আসছি তাহলে অনিরুদ্ধ। ও হ্যাঁ, আপনাকে ধন্যবাদ “
তবে কেন ধন্যবাদ দিলেন তা জিজ্ঞেস করার আগেই দু’জনে তাড়াহুড়ো করে একই ছাতায় হাতে হাত রেখে পা বাড়িয়েছে। কি সুন্দর নিহান নিজে ভিজে রূপাকে ছাতার পুরোটা মাথার উপর ধরেছে। অথচ আজ ওএ জায়গাতে আমার থাকার কথা ছিল। তবে নিহান যতটা মূল্য দিয়েছে আমি কি ততোখানি দিতাম? বৃষ্টিতে কাক ভেজা প্রায়। হাটছি আর আনমতে ভাবছি, রূপার প্রশ্নের উত্তরটা যে দেয়া হয়নি। আচ্ছা মেয়েটা কি জানে, যার জন্যে আমি তাকে ছেড়ে দিয়েছিলো তার সাথে আমার বিয়ে হলেও তা বেশিদিন টিকে নি।মেয়েটা হয়তো দেখতে সুন্দরী ছিল ঠিক কিন্ত সে যে রূপার মত তাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায়নি। আজও কানে বাজে রূপা তার বিয়ের দিন অব্দি অপেক্ষা করেছিলো। ফোনের উপর ফোন দিয়ে মেয়েটা কেঁদে কেঁদে সেদিন বলেছিলো,
” অনিরুদ্ধ, তুমি চাইলে আমি এখনো তোমার হতে পারি। একবার হ্যাঁ বলে দাও প্লিজ। আমি বিয়ের আসর ছেড়ে তোমার কাছে চলে আসবো।” সেদিন মেয়েটার আচরণ হাস্যকর মনে হচ্ছিলো। কয়টা ধমক দিয়ে বলেছিলাম, ” শুনো, ন্যাকা কান্না বন্ধ করো। তোমাকে বিয়ে করবো কেন আমি?কি যোগ্যতা আছে তোমার?আমি তোমার মত মেয়েকে ডিজার্ভ করি না! বুঝলে? “
আজ এতোগুলো বছর পর মনে হলো, আসলে রূপা ই আমার মত কাউকে ডিজার্ভ করে না। বরং সে নিহানের মত যোগ্য কারোর প্রাপ্য ।তা ই তো হলো। সবটাই ঈশ্বরের ইচ্ছা। যে যেমন তার ভাগ্যে তেমন কেউ জুটবে সেটাই তো স্বাভাবিক। আমি আবার হাটতে লাগলাম। বৃষ্টি ক্রমশ বাড়ছে। এতে বেশ সুবিধাই হলো। চোখের কোণে ঝড়তে থাকা জলের ফোটাগুলো অন্তত লোকলজ্জার আড়ালে বৃষ্টির জলের সাথে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
গল্পের বিষয়:
গল্প