আমার মায়ের সাথে বাবার যেদিন ডিভোর্স হয় সেদিন বাবার চোখে আমি জল দেখতে পেয়েছিলাম।তিনি কিছু বলতে চেয়েও কিসের বলয়ে আটকা পড়ে যেন বলতে পারেননি।আমার বয়স তখন কত হবে,চৌদ্দ বছরে পা দিয়েছিলাম মাত্র।এক মাস আগে ছোটখাটো একটা জন্মদিনের অনুষ্ঠান হয়েছিল বাসায়।বাবা-মা আমার মাথায় হাত রেখে হাসিমুখে বলেছিলেন,আমার সন্তান যেন সবসময় এমন আনন্দে থাকে।কিন্তু তখনও বুঝতে পারিনি,এই জন্মদিনই দুজনের সাথে শেষ জন্মদিন হতে চলেছে আমার জীবনের।ছোট বোন তন্নী সবেমাত্র ছয় বছরে পা দিয়েছিল।ডিভোর্স নামের কঠিন শব্দটা তখনও তন্মীর ছোট্ট মাথায় আসেনি।কিন্তু আমি ততদিনে বুঝতে পেরেছিলাম,বাবা-মা আলাদা হতে চলেছে এবার।আর একসঙ্গে থাকা হবে না আমাদের।
আমার মাথায় তখন একটা প্রশ্ন ঘুরপাক করছিল,আমরা দুই ভাই-বোন এবার কার সঙ্গে থাকবো?বাবার সঙ্গে,নাকি মায়ের সঙ্গে? আড়ালে আড়িপেতে শুনেছিলাম,ডিভোর্সের কাগজপত্র হাতে আসার পর দুজনে আলাদা হবেন।কাগজপত্র হাতে আসতে প্রায় দুইদিন সময় লাগবে।এই দু’দিনই বাবা-মায়ের সাথে আমরা দুই ভাই-বোনের একসঙ্গে শেষবারের মতো থাকার সুযোগ।কিন্তু সেদিন রাতে খাবার টেবিলে খেতে কেউ আসেনি।আমি রুমে গিয়ে দুজনকে খাবারের কথা বললেও দুজনের একজনও উত্তর দেয়নি।মা শুধু বলেছিলেন,”আমার ক্ষিধে নেই।তোমরা ভাই-বোন খেয়ে নাও।” তন্নীকে নিয়ে খাবার টেবিলে খেতে বসে হুঁ হুঁ করে কেঁদে ফেললাম।ছোট্ট বোন আমার কান্না দেখে জিজ্ঞেস করল,ভাইয়া,কাঁদছো কেন?আম্মু বকা দিছে?
আমি কান্নাজড়িত কন্ঠে কিছু বলতে পারিনি।সেদিন রাতটা কিভাবে যে কাটলো তা শুধু অন্ধকার রুমের ভেজা বালিশই ভালো জানে।পরদিন সকালবেলায় ময়মনসিংহ থেকে নানু আসে।আম্মুর সঙ্গে যখন তন্নী চলে যাচ্ছিল, আমি নানুর হাত ধরে বললাম,নানুভাই,আমি যাবো না?আমাকে সঙ্গে নিচ্ছো না যে? নানুভাই আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,তুমি ঠিক ছয়মাস পর তোমার আম্মুর কাছে আসবে। ওনার কথায় তখন আমি কিছুই বুঝতে পারিনি।শুধু তন্নীর দিকে তাকিয়ে বললাম,”আমিও আসবো কিছুদিন পর।”তবে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই বাড়ি-ওই বাড়ি আসা-যাওয়ার নিমিত্তে বুঝতে পেরেছিলাম,বছরের অর্ধেক সময় আমি থাকবো বাবার কাছে,আর তন্নী থাকবে মায়ের কাছে।কিন্তু দুই ভাইবোন আর কখনো একসঙ্গে বাবা-মায়ের আদর চোখে দেখিনি।আমি বাবার কাছে,তো তন্নী মায়ের কাছে।
এই সময়ে জীবন যেন আমাকে বাস্তবতার দিকে বারবার আঙুল দেখিয়ে বলছিল,”এই বাস্তবতায় তোমাকে চলতে হবে।”আমিও যেন নিয়তির এই বিধান মেনে নিয়েছিলাম খুব সহজেই।বন্ধু মহলে প্রায়ই একটা কথা শুনতে পেতাম,দেখবি,তোর বাবা-মা দুজনে একদিন আরেকটা বিয়ে করবে।তখন তুই কোথায় থাকবি?তোর ছোট বোনকে নিয়ে কোথায় যাবি?তোদের তো বাসায় জায়গা দিবে না।সৎ কেউ কখনো আগের ঘরের সন্তানদের মেনে নেয় না। আমি এই কথাটা খুব কঠিন হলেও মনে মনে মেনে নিয়েছিলাম।প্রতি রাতে বালিশে শুয়ে শুয়ে ভাবতাম,বাসা থেকে বের করে দিলে কি করবো?ছোট্ট একটা বাসা নিবো।একটা চাকরি করবো।কিন্তু এই বয়সে আমার জন্য কি চাকরি আছে?সে পরে দেখা যাবে।হাতে-পায়ে ধরে হলেও একটা চাকরির ব্যবস্থা করে ছোট বোনকে পড়াতে হবে।এমন কত শত কল্পনায় রাত কাটিয়েছি শুধু এই খারাপ দিনটি আসার জন্য।
কিন্তু অদ্ভুদ হলেও সত্য,দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে অনেকবার দেখেছিলাম,নানা কিংবা বাবার আত্মীয়রা বিয়ের জন্য বাবা-মাকে জোর করতে।কিন্তু ওনাদের একটা কথাই শুনেছিলাম,”নাহ,এই জীবনে আর সংসার করবো না।এভাবেই বাকি জীবন পার করে দিবো।”আমার ছোট্ট মস্তিষ্কে আজও একটি প্রশ্ন ঘুরপাক খায়,তাহলে ওনারা দুজন ডিভোর্স নিয়েছিল কেন যদি বাকি জীবন একা কাটিয়ে দিতে চায়?কিন্তু আমি কখনো উত্তর পাইনি নিজের ছোট্ট মস্তিষ্কের জ্ঞানের ভান্ডারে।সেই উত্তরটা আজও খুঁজে বেড়াই।তন্নীর বিয়ে হয়েছে গত বছর।শুনেছি,সংসার জীবন বেশ সুখেই কাটছে।তবে আমাদের এখনও একসঙ্গে থাকা হয়না।ছয় মাসের বাঁধানো নিয়মের বেড়াজাল থেকে এখনও বের হতে পারিনি কেউ।হয়তো,কখনো হতেও পারবো না।
-এই সাদমান,টেবিলে নাস্তা দিয়েছি।খেতে আয় তাড়াতাড়ি। মায়ের ডাকে কল্পনার ছেদ পড়ল।বিছানা ছেড়ে উঠে রুম থেকে বেরিয়ে টেবিলে বসে পড়লাম।এই বাড়িতে আমি আর মা একাই থাকি।মা একটা স্কুলে শিক্ষকতা করছেন।আত্মীয়ের যন্ত্রনা থেকে বাঁচতে মা নিজেই এই বাসা ভাড়া নিয়েছেন।টেবিলে বসে বললাম,আজ কি খুব তাড়া আছে মা?
-হ্যাঁ,স্কুলে এবছর ভর্তির ব্যাপারে জরুরি সভা বসবে।বাসা থেকে একটু আগেই বের হতে হবে,বললেন তিনি।
-আচ্ছা মা,তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো যদি কিছু মনে না করো?
আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন,এটা আবার কেমন কথা?আমি কি তোর আত্মীয় নাকি?মায়ের কাছে বলবি,মনে করার কি আছে। অনেক সাহস নিয়ে বললাম,আচ্ছা মা,তুমি কি বাবাকে মিস করো? আমার কথা শুনে মনে হয় তিনি কিছুটা ধাক্কা খেলেন।খাওয়া বন্ধ করে জানালার দিকে তাকালেন।বললেন,হয়তো করি।হঠাৎ এই প্রশ্ন?
-মা,অনেক বছর ধরে আমি একটা প্রশ্ন নিয়ে ভীষণ যন্ত্রনায় প্রহর ঘুনছি।প্রতিনিয়ত নিজের মানসিক শক্তির সাথে যুদ্ধ করছি।কিন্তু এত বছর পরও কেউ আমাকে এর উত্তর দিতে পারেনি।তুমি কি আমাকে এই উত্তর দিয়ে যন্ত্রনা থেকে মুক্তি দিবে?জিজ্ঞেস করলাম আমি। মা বললেন,বলো,কি এমন প্রশ্ন?
-আচ্ছা মা,তুমি আর বাবা আলাদা কেন হয়েছিলে?ছোট থেকে আমি প্রতিটা সময়ে একটা ভয় নিয়ে বড় হয়েছি,তোমরা নতুন বিয়ে করবে।আর তন্নী আর আমাকে বের করে দিবে বাসা থেকে।কিন্তু তোমরা তা করোনি।তাহলে কি এমন হয়েছিল যে তোমরা আলাদা হয়ে গেলে?
মা চোখ থেকে চশমা খুলে টেবিলে রাখলেন।চেয়ার ছেড়ে উঠে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন।বাইরে চোখ রেখে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন।হঠাৎ নিরবতা ভেঙে বললেন,বড্ড ভুল হয়ে গেছে রে মানুষটার প্রতি।মানুষের কথায় কান দিয়ে আজ এই অবস্থা।জানিস,তোর বাবার মতো মানুষ হয়না।আমাদের বিয়ের দিন তিনি শুধু একটি কথাই বলেছিলেন,”যদি কখনো মনে করো আমি ভুল করছি,তাহলে সরাসরি বলে দিবে।কিন্তু কখনো কিছু না বলে অভিমানে কোথাও যেও না।তাহলে খুব আঘাত পাবো।”তুই যখন আমার পেটে,ওনি আমাকে কোনো কাজ করতে দেয়নি।বরং হাসিমুখে বলেছিলেন,”তুমি শুধু আমার বাবুর দিকে খেয়াল রাখো।আর বিছানায় বসে বলো,কি লাগবে?আমি সব করবো।”কখনো বিরক্ত হতে দেখিনি।আমরা তখন বদলী হয়ে নতুন শহরে।পাশের বাসায় একজন ভাবীর সাথে বেশ সখ্যতা গড়ে উঠে।
ওনার স্বামী ছিলেন বড় ব্যবসায়ী।বাসায় খুবই কম দেখা যেতো।সেই ভাবির সাথে এতটাই সখ্যতা যে,তা কখন আমার সংসারে ঝড় আসবে তা বুঝতে পারিনি।একদিন কথায় কথায় বলল,ভাবি,আপনি এত শিক্ষিত কিন্তু বাসায় বসে থাকেন যে?একটা চাকরি করলেও তো পারেন।আমি বললাম,আপনার ভাইয়ের যা বেতন তা দিয়েই ভালোই চলে যাচ্ছে।তিনি বললেন,তবুও একটা স্বাবলম্বী ব্যাপার আছে না?এভাবে সবসময় হাত পেতে টাকা নিবেন নাকি? ওনার কথায় আমি তোমার বাবাকে গিয়ে বললাম,আমি চাকরি করবো।এভাবে বাসায় বসে থাকতে পারবো না।আমি ভেবেছিলাম,ওনি রাগ করবেন।বকা দিবেন।কিন্তু তোমার বাবা হেসে বললেন,ইসলাম ধর্মে নারীদের চাকরি করতে নিষেধ করা হয়নি।তবে তুমি তোমার পর্দার হেফাজত করবে এটাই আমি চাই।দুজনের খুশিতেই সংসারে শান্তি বিরাজ করে।সেদিন ওনার কথায় এতটা ভালো লাগল মনে হয়েছিল,সত্যিই,আমি ভীষণ ভাগ্যবতী।
নিজের যোগ্যতায় ভালো চাকরিও কপালে জুটে গেল।কিন্তু তখন আবার মাথায় নতুন কুমন্ত্রণা দিতে শুরু করে সেই মহিলা।একদিন বলল,আপনি এর থেকেও ভালো জীবন আশা করেন।এভাবে সারাজীবন পরে থাকবেন নাকি।জীবনটাকে উপভোগ করেন।আমার কি হয়েছিল জানিনা,ওনার কথাগুলো মাথায় যেন গেঁথে গিয়েছিল।তারপর থেকেই তোমার বাবার সাথে অশান্তির শুরু।ওনি বারবার আমাকে বুঝাতে থাকেন,ঝগড়া থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করেন।কিন্তু আমার তখন মনে হতো,আমিই ঠিক।আমি আরও ভালো জীবন চাই।তারপর একসময় বলেই ফেললাম,আমার ডিভোর্স চাই।তোমার বাবা কথাটা শুনে,পুরো দুইঘন্টা এক জায়গায় থঁ মেরে বসেছিলেন।ওনি যেন কথাটা শুনে ভীষণ ধাক্কা খেলেন।তারপর যখন বুঝলেন,আর কিছু করার নেই।তখন খুব কষ্টে বললেন,ঠিক আছে তুমি যা চাও।আমার জোর করার অধিকার নেই।তবে আমি স্পষ্টই ওনার চোখে পানি দেখেছিলাম।তারপর আর কি,বাকিসব তো তুমি নিজেই জানো।
-আচ্ছা,ওই আন্টি কি শেষপর্যন্ত তোমার সঙ্গে ছিল,জিজ্ঞেস করলাম আমি।
-না,যখন শুনেছে আমার ডিভোর্স হয়েছে,তখন ভীষণ খুশি হয়েছিল।প্রথম প্রথম কথা বললেও একসময় দূরত্ব বাড়তে থাকে।তারপর শুনি,ওর সংসারেও ফাটল ধরেছে।এখন আর যোগাযোগ হয়না।তবে ওই মহিলা আমার সাজানো সংসার শেষ করে দিয়েছে।
-মা,আমাদের আশপাশে কিছু মানুষ আছে যারা নিজ জীবনে সুখী হয়না তাদের আচরনের জন্য।কিন্তু অন্যের সুখ দেখে ঠিকই হিংসা করে।তখন সেখানে ঢুকে তাদের সংসারেও অশান্তি লাগিয়ে তারপর শান্ত হয়।আমরা যারা সেই মানুষগুলোর কথা শুনে বিশ্বাস করি,তারাই নিজ হাতে নিজের সুন্দর সম্পর্ক নষ্ট করি। ওনি চুপ করে তাকিয়ে আছেন বাইরে।
-মা,একটা শেষ প্রশ্ন করবো তোমাকে?জিজ্ঞেস করলাম আমি। ওনি চোখের পানি মুছে বললেন,হুম করো।
-বাবার সাথে যদি সুযোগ হয়,কখনো দেখা করবে তুমি?অনেকটা কৌতূহলী হয়ে বললাম আমি।
-নারে,মানুষটার প্রতি খুব অবিচার করে ফেলেছি।কাগজে সই করার আগ মুহূর্তেও মিনতি করে বলেছিল,
“আর একটিবার সুযোগ দেয়া যায় না?আমার কোথাও ভুল হলে বলে দাও।একটা সম্পর্ক গড়া যতটা সহজ,সেটা ভেঙে গেলে সহজে জোড়া লাগে না।”আমি সে কথা শুনিনি।তবে খুব মিস করি রে,মা টেবিল থেকে ব্যাগ নিয়ে খুব দ্রুত বেরিয়ে গেলেন।হয়তো আর সহ্য করতে পারছেন না। হঠাৎ পাশে থাকা ফোনটা কেঁপে উঠল।দেখতে পেলাম,রাকিব কল দিয়েছে।ফোনটা রিসিভ করতেই শুনতে পেলাম,রাইসা আমাকে ঠঁকিয়েছে।আমি ওর সাথে সম্পর্ক নষ্ট করে দিবো। স্বাভাবিকভাবেই বললাম,তুই ব্যাপারটা তৃতীয় কেউ থেকে শুনে তারপর বললি তাই না? রাকিব অবাক হয়ে বলল,হ্যাঁ,কিন্তু তুই কিভাবে জানলি?
হেসে বললাম,সেটা পরে বলবো।শোন,নিজ চোখে না দেখে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়াটা বড্ড বোকামি।তৃতীয় মানুষের কথা বিশ্বাস করবি,তো জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল করবি।নিজে গিয়ে দেখ,যা বলেছে সেটা সত্যি কিনা।তারপর না হয় রাখা বা না রাখার সিদ্ধান্ত।আমি এখন ফোন রাখছি। আমরা মানুষ বড্ড অদ্ভুদ।নিজ চোখে দেখার চেয়ে অন্য কারো শোনা কথায় বেশি বিশ্বাস করি।আর সেটা শুনেই জীবনের বড় বড় সিদ্ধান্ত নিতেও দুবার চিন্তা করিনা।আর তার মাসুলও পোহাতে হয় সারাজীবন।যেমনটা আমার বাবা-মা করছে।আর মাঝখানে আমরা ভাই-বোন হারিয়েছি তাদের দুজনের স্নেহ-ভালোবাসা।
গল্পের বিষয়:
গল্প