– আমি মজা করছি না। আমি সত্যিই আপনাকে বিয়ে করতে চাই।
– তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? জানো আমার বয়স কত?
– জানি। চল্লিশ।
– ভুল জানো। আমার বয়স বিয়াল্লিশ। আর তোমার মাত্র পঁচিশ।
– আমি যখন রাজি আছি আপনার সমস্যা কি?
– তোমার আজ আমাকে ভালো লাগছে। এমনিতেই আমার দু-একটা চুল পাকতে শুরু করেছে। কাল যখন আমার পুরো চুলে পাক ধরবে তখন তোমার পাশে আমাকে বেমানান মনে হবে। তোমার যখন ভরা যৌবন তখন আমার বয়স বাড়ার সাথে শারীরিক সক্ষমতা কমে যেতে পারে। যদি এমন হয় তখন তুমি সুখী হবে না। হয়তো আমাকে তোমার অসহ্য মনে হবে, নতুবা পরকীয়া করবে, সেটা না করলেও আমাকে ছেড়ে অন্য কারো সাথে চলে যাবে।
– আপনার জায়গায় আপনি হয়তো সঠিক বলছেন। অনেক মেয়ের ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য। কিন্তু আমি এমন কিছুই করবো না।
– কি গ্যরান্টি আছে যে তুমি এমন করবে না?
– আপনি যে বিয়ের পর আমাকে খুন করবেন না তার কি গ্যারান্টি আছে?
– আজব! আমি এটা কেন করবো?
– কেন করবেন না? অহরহ শোনা যাচ্ছে স্বামীর হাতে স্ত্রী খুন। আমার যদি আপনাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তাহলে আমি কোনো দোষ করলে, বড়ো কোনো ভুল করলে আপনারও আমাকে খুন করার সম্ভাবনা আছে। কই আমি কি সেটা বলেছি?
– আজব মেয়ে তুমি!
– জানি। আজব বলেই আপনাকে বিয়ে করতে চাই।
– তুমি প্লিজ এখান থেকে যাও। আমার অনেক কাজ।
– যাচ্ছি বাবা যাচ্ছি।
– আর কখনও আমার অফিসে এসো না।
– আমার ইচ্ছা হলে আসবো, আপনি মানা করার কে?
বেরিয়ে এলাম ওনার অফিস থেকে। নেহাল সাহেব। বিয়ের জন্য পাত্রী খুঁজছেন। উনি খুঁজছেন বললে ভুল হবে। ওনার মা খুঁজছেন। শুনেছি উনি বিয়েটাই করতে চান না। ওনার মায়ের জিদের কাছে হার মেনে রাজি হয়েছেন। কিছুদিন আগে ঘটক সাহেব, উনি আর ওনার মা আমাকে দেখতে আমাদের বাড়িতে আসেন। ঘটক প্রথমে বলেছিলেন পাত্রের বয়স কিছুটা বেশি। কিন্তু সে যে আমার চেয়ে সতেরো বছরের বড়ো সেটা বলে নি।
ওনারা আমাদের বাড়িতে আসার পর ওনাকে দেখে আমার মা আর বড়ো বোন নাক সিটকান। তাদের মেয়েকে এমন আধা-বুড়ো একটা লোকের সাথে তারা বিয়ে দিতে রাজি নন। বাবা যদিও অমত করেন নি। মা তো আমাকে ওনাদের সামনে নিয়েই যাবেন না। বাবা অনেক অনুরোধ করার পর মা রাজি হলেন। পাত্রপক্ষ বাড়ি আসার পরও যদি পাত্রীকে তাদের সামনে আনা না হয় তাহলে ওনাদের অপমান করা হবে। শুধু এটা ভেবেই আমাকে ওনাদের সামনে নিয়ে যাওয়া হলো। মা আর বড়ো বোন রাগে গজগজ করছিলেন। মায়ের মুখে ওনার বয়স সম্পর্কে শুনে আমি খুব বিরক্ত হয়েছিলাম। এক প্রকার রেগে গিয়েছিলাম বাবার উপর। কিন্তু ওইযে, সম্মান রক্ষার্থে ওনাদের সামনে যেতে রাজি হলাম।
ওনার মা আমাকে টুকটাক কিছু প্রশ্ন করছিলেন। আমার বাবাও ওনাকে ওনার অফিস সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। উনি যখন বাবাকে উত্তর দিচ্ছিলেন ওনার শান্ত শীতল কণ্ঠ শুনে আমি ওনার দিকে তাকাই। যেমন ওনার কণ্ঠে শীতলতা তেমন ওনার চেহারায়। শ্যামলা গায়ের রং ওনার। মাথা ভর্তি চুল। সুঠাম দেহ। মাঝারি উচ্চতা হবে। মুখে অদ্ভুত মায়া। চোখে কষ্টের ছাপ। বয়স কিছুটা বোঝা গেলেও ওনার ব্যক্তিত্বের কাছে বয়স হার মেনে যায়। ভালো লাগলো ওনাকে। ভালো লাগলো? না কি প্রেমে পড়ে গেলাম? না, প্রেমে পড়লাম এটা বলা যাবে না।
একটা বয়সের পর মানুষের যখন ম্যাচিউরিটি আসে, মানুষ যখন নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে শেখে, তখন প্রেমে পড়ার আগে শতবার ভাবতে হয়। যদি প্রেম পূর্ণতা না পায় তখন কষ্ট হয়। তাই সহজেই প্রেমে পড়তে নেই। আমি বাবাকে ইশারায় সম্মতি দিলাম। বাবা আমাকে বরাবরই খুব ভালো বোঝেন। আমার চোখের এক ইশারায় বাবা মনের কথা বুঝে গেলেন। মুচকি হাসলেন। ওনার মা আমাকে খুব পছন্দ করলেন। তিনি আংটি পরিয়ে যেতে চান। কিন্তু আমার মা বাঁধা দিলেন। তিনি বললেন একটু ভেবে তারপর জানাতে চান। একথা শোনার পর ওনার মায়ের মন খারাপ হলো হয়তো। হওয়ারই কথা। ওনারা আমাদের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় থাকবেন বলে চলে গেলেন।
এদিকে ওনারা যাওয়ার পর আমার মা যখন জানতে পারলেন যে বিয়েতে আমার মত আছে, তার মাথায় যেন বজ্রাঘাত হলো। এইটুকু মেয়ে একটা আধা-বুড়ো লোককে বিয়ে করতে চায়? তাছাড়া ওনাকে মায়ের অপছন্দ করার পেছনে আরও বড়ো একটা কারণ ছিলো। সেটা পরে বলছি। মাকে বোঝাতে বেশ বেগ পেতে হলো। ওনার সম্পর্কে বাবা খোঁজ নিলেন। সবকিছু পজিটিভ মনে হলো। অবশেষে মা রাজি হয়ে যখন ওনার মাকে জানালেন, তখন ঝামেলা শুরু হলো ওনাকে নিয়ে। উনি এতটুকু মেয়েকে বিয়ে করতে চান না। ওনার কম হলেও ত্রিশ বছর বা তার বেশি বয়সের মেয়ে চাই। পিচ্চি একটা মেয়ের সাথে উনি সংসার করবেন না। ওনার সাথে আলোচনা করতেই আজ ওনার অফিসে এসেছিলাম। আমার মাকে বোঝাতে যতটা বেগ পেতে হয়েছে, ওনাকে বোঝাতে আরও বেগ পেতে হবে মনে হচ্ছে।
– তুমি যাবে কখন?
– যখন আপনি হ্যাঁ বলবেন।
– শোনো আমি তোমাকে বিয়ে করছি না। তো এটা নিয়ে রোজ রোজ কথা বলে লাভ নেই।
– আমি তো লাভ লস হিসাব করতে আসি নি। আপনার মত নিতে এসেছি।
– আমি কোনোভাবেই মত দেবো না। আচ্ছা তোমার কি লজ্জা নেই? মেয়ে হয়ে রোজ রোজ একটা ছেলেকে বিয়ের জন্য বলছো। সেদিন তোমাকে আমি ফিরিয়ে দিলাম। আজ আবার এসেছো।
– ওমা! হবু বরের সামনে কিসের লজ্জা?
– হবু বর মানে?
– আপনি হবু বর মানে জানেন না? হায় কপাল! শেষ পর্যন্ত আমাকে একজন মূর্খকে বিয়ে করতে হবে?
– মাইন্ড ইওর ল্যাঙ্গুয়েজ ওকে? কে মূর্খ?
– আপনি। আর কে? যে হবু বর মানে বোঝে না তাকে মূর্খ বলা কি অযৌক্তিক?
– তুমি আমারই অফিসে আমারই সামনে বসে আমাকেই অপমান করছো?
– আপনি যদি আমাকে নির্লজ্জ বলে অপমান করতে পারেন তাহলে আমি আপনাকে মূর্খ বলে অপমান করবো না কেন? শুনুন আপনার অফিস বা আপনার বাড়ি যাই হোক না কেন আমি ভয় পাই না। আমাকে যতটুকু বলবেন ততটুকু শুনবেন। ঢিল মারলে পাটকেল তো খেতেই হবে তাই না?
– কি সাংঘাতিক মেয়ে! এই মেয়েকে মা ঘরের বউ বানাতে চায়? সংসার ধ্বংস করবে তো এই মেয়ে!
– সংসারে কি করবো সে বিষয়ে আমার হবু শ্বাশুড়ির সাথে অলরেডি কথা হয়ে গেছে।
– আচ্ছা তুমি আমার অতীত জেনেও আমাকে বিয়ে করতে চাও কেন?
– আপনার অতীতই আমাকে আপনার প্রতি আকৃষ্ট করেছে।
– তুমি শিক্ষিতা। সুন্দরী। চাইলেই তোমার সাথে ম্যাচ হয় এমন কোনো যুবককে বিয়ে করতে পারবে। আমাকেই কেন?
– অনেস্টলি বলুন তো! আপনি কি বুড়ো হয়ে গেছেন?
– তা ঠিক না….
– আপনি কি নিরক্ষর?
– না।
– আপনি দেখতে কুৎসিত?
– তাও না।
– ব্যাস। আপনার সব কথার উত্তর আপনি নিজেই দিলেন। আর কি চাই?
– তুমি কি ভেবে সিদ্ধান্তটা নিচ্ছো? দেখ বিয়ে পুরো জীবনের জন্য হয়। এমন না হয় যে বিয়ের কিছুদিন পর তুমি মনে মনে পস্তালে। তখন না পারবে আমার সাথে সুখী হতে না পারবে আমাকে ছাড়তে।
– আর বলতে হবে না। বুঝে গেছি আপনি পটে গেছেন। হুররররাহ। শ্বাশুড়ি আম্মাকে এখনই কল দিয়ে বলছি।
উনি আমার কান্ড দেখে মুচকি হাসলেন। এই প্রথম আমি ওনার হাসি দেখলাম। ওনার হাসিটাও চমৎকার। হয়তোবা, আমি ওনার প্রেমে পড়ে গেছি। তাই ওনার সবকিছুই আমার ভালো লাগছে। আজ আমাদের বিয়ে হয়েছে। বাসর ঘরে বসে আছি। আমার পছন্দের সাদা ফুল দিয়ে ঘরটা সাজানো হয়েছে। উনি বই পড়তে ভালোবাসেন। শেল্ফ ভর্তি বই। আমিও বই পড়তে ভালোবাসি। উনি বলেছেন আমি যত চাইবো বই কিনে দেবেন। এসব ভাবতে ভাবতে উনি রুমে আসলেন। এতদিন ওনার সাথে কথা বলার সময় কখনও লজ্জা পাই নি। আজ প্রথম লজ্জা পাচ্ছি। উনি হয়তো ব্যাপারটা বুঝলেন।
– তুমি কি চেঞ্জ করবে?
– হ্যাঁ আমি চেঞ্জ করতে চাই। এই শাড়ি গহনার ভীড়ে নিজেকে খুঁজে পাচ্ছি না।
– আমি কফি খাবো। তুমি কি কফি খাবে?
– মন্দ হয় না।
– তুমি চেঞ্জ করো তাহলে। আমি কফি বানিয়ে আনি। একটু পর দুকাপ কফি নিয়ে রুমে আসলেন। আমাকে দেখে হো হো করে হেসে দিলেন।
– এভাবে হাসছেন কেন?
– তোমাকে যা লাগছে না আমার টি-শার্টে হাহাহা।
– হাসবেন না। আমার ব্যাগ মা গুছিয়েছেন। উনি হয়তো টি-শার্ট দিতে ভুলে গেছেন। আমার কামিজ পরে ঘুম আসে না। আপনার টি-শার্ট অনেক লুজ বাট প্রবলেম নেই।
– কফি নাও।
– ধন্যবাদ।
– একটা কথা বলো তো।
– কি?
– আমি বিবাহিত এটা জেনেও কেন তুমি আমাকে বিয়ে করলে? (এটাই মা রাজি না হওয়ার বড়ো কারণ ছিলো)
– কারণ যার হারায় সেই অন্যের হারানোর ব্যথা বোঝে।
– তোমার কি হারিয়েছে?
– আপনার যা হারিয়েছে। সঙ্গী।
– কে সে?
– ছিলো কেউ…. আপনার প্রথম ওয়াইফ মারা গিয়েছেন তাই না?
– হুম।
– আমি একজনকে ভালোবাসতাম। প্রচন্ড ভালোবাসতাম। সে একদিন আমাকে ছেড়ে পৃথিবী থেকে চলে গেল। খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। সেই কষ্ট সামলে নিতে অনেক সময় লেগেছিলো। আপনার আর আমার পার্থক্য হলো সে আপনার বিয়ে করা বউ ছিলো, আর আমার সাথে তার বিয়ে হয় নি। আপনি যতটা ভালোবাসতেন, আমি হয়তো ততটাই ভালোবাসতাম। আপনাকে দেখে, আপনার সম্পর্কে জেনে আমার মনে হলো আমার আপনাকেই প্রয়োজন। আপনারও আমাকে প্রয়োজন। দুটো ভাঙা হৃদয় এক হলে পূর্নতা পাবে। সেই ভাবনা থেকেই আপনার কাছে আসা, আপনাকে ভালো লাগা।
– ছাদে যাবে? আজ আমরা জোৎস্না বিলাস করবো।
– চলুন।
(সমাপ্ত)
গল্পের বিষয়:
গল্প