দেড় বছরের ছোট্টো মেয়ে রুমার রাতে প্রস্রাব করে ভিজিয়ে দেওয়া কাঁথাগুলো ধুয়ে শুরু হলো কুলসুমার দিন। এই রমজান মাসেও স্বামীকে সাত সকালে উঠে যেতে হয় অফিসে। তিনি তো রাতে ঘুমান আরাম করে। কিন্তু, ছোট্টো রুমা সারারাত কাঁদে বলে ঘুমোতে পারেন না কুলসুমা। মেয়েটা এখন ঘুমোচ্ছে। ঘরের কাজ শেষ করতে হবে এখুনি।
এমনিতেই রোযা রেখে কাজ করতে মন চায় না। কাপড় ধুয়ে তা মেলে দিয়ে এলেন ছাদে। ঘর ঝাড়ু দিতে শুরু করলে হঠাৎ মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখলেন একটি ছবি। তার আর রুমার বাবার যৌবনকালের একটি ছবি কোনোভাবে হয়তো পড়ে গিয়েছিল অ্যালবাম থেকে। ছবিটি দেখে নস্টালজিক হয়ে গেলেন কুলসুমা। কতই না রঙিন ছিল সে দিনগুলো। দুজনের রূপে হাস্যোজ্জ্বল ছিল ছবিটি। এখন বার্ধক্যে পদার্পণ করতে শুরু করেছেন তারা দুজনেই। বড়ো মেয়ে সোমার জন্মের পর তিনটে ছেলে জন্ম নিয়ে মারা গেল৷ কঠিন সময়ে ভালোবাসার মানুষকে কাছে পেলে নিজেকে ভাগ্যবতী মনে হয়। সোমার বাবাকে সবসময় পাশে পেয়েছেন তিনি। ছবিটি তাদের দ্বিতীয় সন্তান মৃত্যুর কয়েক বছর পরের। সোমার বিয়ে দিয়েছেন মাস তিনেক আগে। মেয়ে সংসার নিয়ে আছে ভালোই।
ঘর ঝাড়ু দেওয়া শেষ হতেই হাঁপিয়ে গেলেন কুলসুমা। আজকের ক্লান্তির মাত্রাটা একটু বেশিই৷ ইচ্ছে করছে, এখনই পানি খেয়ে নিতে। সারাদিন কীভাবে রোযা রাখবেন, ভেবে পাচ্ছেন না।
ইফতারির জন্য ছানা ভিজিয়ে রাখলেন জলে। তারপর রুমার জন্য তৈরি করলেন খাবার। কলা মাড়িয়ে তাতে দুধ, সুজি দিয়ে খাওয়ান রুমাকে। মেয়ে তার তবু মায়ের বুকের দুধ ছাড়া কিছুই বুঝে না। কলা-সুজি মুখে দিলে থু দিয়ে ফেলে দেয়। তারপরও তাকে খাওয়ালেন কষ্ট করে। না খেলে বড়ো হবে কী করে! মেয়েটার জন্মের পর প্রতিবেশী আর আত্মীয়দের কম কথা শুনতে হয়নি তাকে!
তারপর ফ্রিজ থেকে গরুর মাংস বের করলেন কুলসুমা। সোমার বাবার গরুর মাংসের প্রতি বেজায় ঝোঁক। পেঁয়াজ কাটতে গিয়ে বুদ করলেন, ব্যথা বাসা বেঁধেছে বুকে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তার। মাংসের কারি চুলোয় বসিয়ে কল দিলেন বড়ো মেয়েকে। মেয়ের শ্বশুর বাড়ি এখান থেকে বেশ দূরে৷ তাকে ফোন করে বললেন, “মা, আমার! একবার আসবি বাসায়? আমার শরীরটা ভালো লাগছে না।”
সোমা তখনই বেরিয়ে পড়ল আসবে বলে। কিন্তু, রাস্তায় রাজ্যের জ্যাম, এত দূরের পথ বেরিয়ে তার আসতে লেগে গেল প্রায় দু’ঘণ্টা। ঘড়িতে বেলা চারটা বাজে তখন। গরুর মাংস হয়েছে রান্না, ইফতারও তৈরি করেছেন কুলসুমা। গোসল করে নামাজ পড়তে গিয়ে ব্যথা বাড়ল যেনা আরেকটু। সোমা এসে পেল, মা শুয়ে আছেন। আর ছোট্টো রুমা মায়ের বুকের দুধ খাচ্ছে। এ দেড় বছরে যতবার মা শুয়েছেন, রুমার বুকের দুধ চাই। অন্য কিছু মুখেও রচে না তার।
সোমার বাবা অফিস করে ফিরলেন খানিক পরে। উনি প্যান্ট ছেড়ে লুঙ্গি পরতে চাইলে কুলসুমা বললেন, “সোমাও এসেছে আজ। চব্বিশ রমজান হয়েছে পার। আজকে বরং ঈদের শপিংটা করে নেবো আমরা। আমার শরীরটা ভালো লাগছে না। রোযা রেখেছি বলে হয়তো। ইফতার করে ঠিক হবে।”
আসরের নামাজ পড়ার জন্য যখন উঠলেন তিনি, এরপর মেলা কাজ করলেন। ঘরের খুঁটিনাটি সবকিছু গুছালেন নিজের মতো করে, রুমার সবকটি কাপড় আলাদা করে হাত বুলিয়ে সুভাস নিলেন। ছাদ থেকে নিয়ে আসলেন কাপড়। তারপর সোমাকে সাথে নিয়ে ইফতার পরিবেশনের কাজ সারলেন।
মাগরিবের আযান হলে একটা খেজুর মুখে দিয়ে সোমাকে বললেন, “মা, আমি ঘুমাই একটু। তোর বাবাকে ইফতারের পর চা দিস। আমার ঘুম পুরো হলে উঠব, ডাক দিস না। রুমার খেয়াল রাখিস।”
মাগরিবের ফরজ তিন রাকাত নামাজ পড়ে বিছানায় গেলেন তিনি। মেয়ে রুমা মায়ের বুকের দুধ খাবে বলে তাকিয়ে আছে। রুমার চোখ দেখেই তিনি বুঝতে পারেন সব।
তাকে নিয়ে শুয়ে পড়লেন তিনি। সোমা তার বাবাকে চা করে দিলো ইফতারের পর। ভদ্রলোক কুলসুমার ঘুম ভাঙ্গার অপেক্ষা করতে করতে তারাবিহতে গেলেন অতঃপর।
ফিরে এসে দেখলেন, কুলসুমা ঘুমোচ্ছেন এখনো। রুমাও ঘুমোচ্ছে মায়ের বুকের দুধ খেয়ে খেয়ে। রাত সাড়ে দশটার দিকে কেঁদে উঠল রুমা। সোমা দৌড়ে গেল সে ঘরে। রুমা কাঁদছে, অথচ মা ঘুমিয়ে আছেন। এমনটা তো কখনো হয় না। রুমার একটু নড়াতেই মা জেগে উঠেন। মাকে ডাক দিলো সোমা। মা তবুও উঠেন না। মায়ের স্তন থেকে রুমার মুখ ছাড়িয়ে তাকে কোলে নিল সোমা। বাবাকে দিলো ডাক। তার ডাক শুনেও ঘুম ভাঙলো না ঘুমন্ত কুলসুমার।
ডাক্তার ডেকে আনা হলো। চেকাপের পর ডাক্তার জানালো, তিন ঘণ্টা আগেই পৃথিবী ছেড়েছেন কুলসুমা। ছোট্টো মেয়েটা পুরো তিন ঘণ্টা অপেক্ষা করেছে মায়ের বুকের দুধ পান করার জন্য। মৃত মায়ের বুক জুড়ে সে খুঁজে চলেছিল এক ফোঁটা অমৃত।