সুতপা হিসেবের গড়মিলটা মিলবে না জেনেও বারবার মিলাতে চেষ্টা করে। শুরু থেকে শেষাবধি তার ছকে বাঁধা জীবনটার ছন্দ পতনতো সে হতে দেয়নি। তবে ফলাফলটা এমন পরাজয়ের কেন?
সুতপার একাকিত্ব ভরা সময়গুলোতে ভর করে জীবন পাতার লেন দেনগুলো।
সেবার হঠাৎ করেই বাবা মায়ের আগমন ঘটলো সুতপার বাড়িতে। মেঘ না চাইতেই জল যেন। তার এই বিশ বছরের গড়া সংসারটিতে বাবা মা এসেছেন হাতে গুনে ক’বার। তাও অনেক সাধাসাধির পর। প্রথম দিকে বলতেন—– “চাকুরীজীবনটা ফুরোলে অঢেল সময়ে শুধু বেড়াবো। এখন সংসারের বেড়াজাল টপকানো বড্ড ঝক্কি।”
বাবা মা দুজনেই কর্মজীবী বিধায় যুক্তিটা অকাট্য মনে হতো। এর মধ্যে সুতপা উড়াল দিল। বেশ কটি বছর সংসার পাতলো প্রবাসী স্বামীর কর্মস্হলের সাগর ঘেঁষা কোয়াটারে।
ফিরলো ছেলেমেয়েদের নিয়ে, লেখাপড়ার দৌড়ঝাঁপের প্রতিযোগিতায়। ও দেশটায় বাংলা ইংরেজি মাধ্যম দুটোর অপ্রতুলতার কারনে।
ততদিনে অবসরে বাবা মা দুজনেই। তাঁদের ছেলের কর্মজীবনে প্রবেশ, স্বভাবতই জীবনটা গড়ে দেবার দায়টা সম্পন্ন করলেন। ভাবলেন সংসারের জোয়ালটা এবার নামাবেন। প্রস্তুতিটা নিতে না নিতেই নতুন মেহমানের আগমনী ঘোষনা।
আনন্দের বন্যায় ভাসিয়ে মেহমানও যথাসময়ে হাজির। দাদা দাদীর পদোন্নতিতে বিভোর হলেন।
না হয়েও উপায় কি। ছেলে – ছেলে বৌ দুজনেই কর্মজীবী। দাদা দাদীর উপস্হিতি দিনমান অপরিহার্য।
দিন বদলায় এক সময়। সোনামনি হাঁটিহাঁটি করে একপা দু’পা চলতে শিখে। সুতপা অধীর হয় দূরের শহর থেকে, ফোনে ভেসে আসে মেয়ের আহ্বান। “কবে আসবে বাবা? কবে আসবে মা তোমরা?”
বাবা আশা জাগিয়ে বলেন, যাব রে তপা, যাব। ঠান্ডা লেগে বুকটা কেমন যেন ভার ভার লাগে মা। একটু স্বস্তি মিলুক, যাব তোর কাছে।
মাও তাই। —-“কোমরের ব্যাথাটা কেমন যেন বেড়েই চলেছে দিনে দিনে। একটু না কমলে জার্নি করা কষ্ট রে তপা।”
কমে না কিছুই, আরও যোগ দেয় চোখের ছানি, হাঁটুর হাড় ক্ষয় ইত্যাদি আরও কত কি।
সুতপা সন্তানদের ছুটি ছাটায় ঈদ, পার্বন কিংবা আনুষ্ঠানিকতায় ঠিক হাজির হয়, তার আশৈশব বেড়ে ওঠা ছোট্ট শহরটার প্রিয় বাড়িটায় বাবামায়ের স্নেহের ছায়াতলে।
তারপর একটা সময় আসে সুতপা ক্রমেই ডুবতে থাকে ছেলেমেয়েদের ভাবনার অতলে। স্কুল, কোচিং, প্রাইভেট, পরীক্ষা—– একের পর এক। সময়গুলো যেন পৃথিবী চেঁছে মুছেও কুলোয় না। আরও, আরও সময় চাই। বাবা মায়ের জন্য দু,চারদিন কিংবা সপ্তাহান্তে একদিনও আর বরাদ্দ থাকে না।
অবশেষে পথ চেয়ে চেয়ে ফোন করেন বাবা, কখনো বা মা।
——- খুব ব্যস্ত নাকি মাগো? ভাল আছিসতো?
ওদের পড়তে বসিয়েছিস বুঝি, নাকি রান্না ঘরে?
তোর দেরি করাবো না তপা। একটুখানি কথা বলেই রেখে দিবো।
——-না, না সেকি। রাখবে কেন? তোমরা ভাল আছোতো?
এভাবেই কুশলটা জানা হতো প্রায়ই।
কখনোবা সুতপা বলতো—- কতদিন তোমাদের দেখতে যেতে পারি না, চলে এসো তোমরা।
বাবা মায়ের জবাব ছিল বরাবরই একই।
——-” ওদের পরীক্ষাটাতো হোক।”
কিন্তু পরীক্ষা ফুরোয় না।
সুতপাকে অবাক করে দিয়ে এই প্রথম এমন বিনা নোটিশে বাবা মায়ের হঠাৎ আগমন। সেই ছেলেবেলার মত উচ্ছল প্রাণবন্ত হয়ে ওঠলো সুতপা। অন্তরাত্মা যে কত তৃষ্ণার্ত ছিল সুতপার এই স্নেহমাখা পরশের জন্য, তা নিজেও বুঝে নি এতগুলো দিন। এবার বাবা মাকে আর যেতে দিবেনা সহজে, মনে মনে প্রতিজ্ঞা কষে মেয়ে।
সন্ধ্যায় চায়ের টেবিলে বিষয়টা পরিস্কার হলো।
বাবা পাশের চেয়ারে বসা মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন,
—— তপা,একটা ইচ্ছের কথা বলবো। ‘না’ করবি না কিন্তু। তোকে একবার রহনপুর যেতে হবে।
——- রহনপুর?কেন বাবা?
——- শরীরটা ভাল যায় না আজকাল। দায়বদ্ধতাগুলো শেষ করতে চাই।
—— শরীর ভাল না লাগলে ডাক্তার দেখাতে হবে। চলো ডাক্তার দেখাই।
হাসলেন বাবা।
—– বোকা মেয়ে আমার। গন্তব্য কি আটকানো যায় রে। ডাক আসলে কার সাধ্যি আটকায়।
যা বলছিলাম, ছেলেকে বসতভিটা আর মেয়েকে ফসলি জমিটুকু দিতে চাই। যৎসামান্য এই তোর বাবার। সুষ্ঠ বন্টন করতে চাই মা।
——- বাবা, তুমি কি আমার ইচ্ছেগুলো ভুলে
গেছো? আমি হার মানি নি। মানতে চাই না বাবা।
—— ভুলি নি বলেইতো অনুমতির জন্য আমাদের আসা তোর কাছে।
মা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন,
—— মাগো, বাবা মার দায় বাবামাকে সারতে হয়। আগে অবুঝ থাকলেও এখনতো মা হয়েছিস বুঝিস না, সন্তান কি?
সুতপার অবুঝ সময়টা ভেসে ওঠে মুহূর্তে। কি জেদ ই না ছিল সুতপার। পড়াশুনা শেষে করে সবে কলেজটায় জয়েন করেছে তখন। দেখতে এসে বিয়েটা পাকা হয়ে গেলো। ছেলে প্রবাসী। হাতে ছুটি কম। ক’ মাস পর এসে বিয়ে।
বাবা মা প্রবল উৎসাহে আয়োজনের লিস্ট তৈরিতে ব্যস্ত।
মা সোজা সাপটা আহ্বান করলেন,
—— তপা বিকেলে আমার সংগে একটু বেরুতে হবে অলংকার নিকেতনে। হাতের মাপটা লাগবে ক’ গাছি চুড়ি আর একজোড়া বালার জন্য।
ফোঁশ করে ওঠে সুতপা।
—— মানে, যৌতুক? ক ভরি?
ছি মা, তুমি জানো না আমি ওজনে বিক্রি হতে চাই না।আইবুড়ো হয়ে বসে থাকবো তবু এ বিয়েতে রাজী না, রাজী না।
মা হাড়ে হাড়ে চেনেন এই গোঁয়ার মেয়েকে। আত্মীয় স্বজনের মধ্যে এমনটি ঘটলেই ও প্রতিবাদ করতে ছাড়ে না। বলে,
—–“মেয়েদেরকে মেয়ের বাবা মাই ছোট করে। কাঠখড় পুড়িয়ে উপযুক্ত করে গড়ে তোলার পরেও সদ্য জাতে ওঠা পাত্র পেলে অর্দ্ধেক রাজত্বসহ রাজকন্যা দান । আমি বাপু নিজ যোগ্যতায় কেউ নিলে যাব নইলে নিজের পায়ে ভর করেই জীবন কাটিয়ে দিব। বাবা মাকে নিঃস্ব করে যৌতুকের বলি হতে চাই না।”
মা কথাগুলি মনে করে আর দ্বিতীয়বার ঘাটালেন না ওকে।
বিয়ের আসরে পাত্রপক্ষের গা ভরা গহনার উপর চাপিয়ে দিলেন নিজের বানানো গহনার বেশ কয়েকটি পদ।
কনে সাজে বসে নতমুখি সুতপার জল ভরা চোখ মুছিয়ে দিয়ে নিচু কন্ঠে বললেন,
—– রাগ করিস না মা। এটাই রীতি। বাবা মায়ের মানটাও যে রাখতে হবে। শুধু জেনে রাখ্, ওদের কোন দাবী দাওয়া নেই, তোকে ভাল লাগাতেই ওরা নিয়ে যাচ্ছে। সুখে থাকবি তপা, মা আমার।
কপালে চুমু এঁকে আঁচলে চোখ মুছলেন মাও।
সুখেই আছে সুতপা বাবা মার এত এত দোআ আর বুক ভরা ভালোবাসায়।
কিন্তু এতকাল পরে আবার তার নীতি বিরুদ্ধ প্রসংগের আবির্ভাব কেন? সেই কবে বিয়ের বাজারতো সে সম্মানের সাথেই অতিক্রম করেছে।
সেই ছেলেমানুষী আচরণ আর এখন মানায় না, তারপরও বাবা মাকে যুক্তি তর্কে বুঝানোর ব্যর্থ চেষ্টায় একটা সিদ্ধান্তে মনকে বুঝালো, বাবা তার কর্তব্য করে শান্তি খঁজছেন, খুঁজুন। সুতপাও তার যোগ্য উত্তরসুরীকে তা পৌঁছে দিবে না হয় পরে।
কার্য সমাধার পরে ছেলেবেলার মত গাল ফুলিয়ে বাবাকে বললো সুতপা,
—–বেশতো জিৎ তোমারই হলো বাবা।
বাবা চিরাচরিত সরল হাসিটি সারা মুখে ছড়িয় বললেন,
——- মাগো, মাঝে মাঝে বাবা মাদেরও জিততে হয়, দায়ভার থেকে মুক্ত হবার জন্য।
বাবা তাঁর জীবনের সব কর্তব্য সুনিপুনভাবে সাঙ্গ করে বছর দুয়েক পরেই নিশ্চিত গন্তব্যে পাড়ি জমালেন অনেকটা হঠাৎ করেই। মেয়েকে পাই পাই করে তার প্রাপ্য বুঝিয়ে দিলেন, কিন্তু সুযোগ দিলেন না বাবার জন্যে একটা কানা কড়ি ব্যয় কিংবা যত্ন আত্তি করবার।
মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান হয়ে চাওয়ার আগে কোন কিছু হাতে আসে নি ঠিকই, তবে চাওয়ার পরে বাবা মা তা যে কোন মুল্যেই সুতপার হাতে তুলে দিয়েছেন। হিসেব নিকেশের এই দোলাচালে সুতপার অতীত সুতপাকে নস্টালজিয়ায় ভোগায় সারাক্ষন। টুকরো স্মৃতিতে আপ্লুত হয় বার বার। বাবার ফেলে যাওয়া গন্ডিতে শান্তি খুঁজে ফেরে। মনে পড়ে রহনপুরের কথাও।
পৌঁছে যায় সেই দিগন্ত জোড়া সবুজে একদিন। অবারিত ফসলের মাঠ। দূরে আকাশ আর মাটির মিলে যাওয়া দেখতে দেখতে অভিভুত হয়। কতটা পথ পাড়ি দিলে পৌঁছানো যাবে ওখানে?
আধিয়ার লোকমান এক জমি থেকে আরেক জমি চেনায়। ক্ষেতের আল ধরে ধরে অনভ্যস্ত পা ফেলে সুতপা একের পর এক।
একসময় উঁচু টিলাটায় দাঁড়িয়ে পড়ে লোকমান। অদূরে আঙুল তুলে ঘাড়ের গামছাটায় ঘামে ভেজা মুখটি মুছতে মুছতে বলে, পাশের এই জমিটাও একদিন সুতপার বাবার ছিল।সবচেয়ে ভাল জমি। সেচ লাগেনা তেমন, উর্বর অবস্হান।
বিক্রি করে দিয়েছেন জমিটা মেয়ের বিয়েতে প্রয়োজন পড়ায়।
তড়িতাহতের মত ফ্যাকাশে হয়ে যায় সুতপার শ্যামা বরন মুখখানি। কর্ণকুহরে এক গাদা গরম সীসা যেন হিস হিস করে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে, বিক্রি করে দিয়েছেন জমিটা মেয়ের বিয়েতে প্রয়োজন পড়ায়।
সুতপার ক্ষীণ কন্ঠ জানতে চায়,
—— কতদিন আগে মনে করতে পারেন?
আপাদমস্তক কৃষক লোকমান তার শীর্ণ মুখটিতে বয়সের বলিরেখা ফুটিয়ে ভ্রু কুঁচকিয়ে হাঁ সুচক মাথা নেড়ে বলে,
—— তা পনের বিশ বছরতো হবেই।
সুতপার হিসেবটা এবার মিলে যায়। বিশ বছর ধরে লালন করা তার মিছে অহমিকাটা হেরে যায়। মধ্যবিত্ত সংসারের একটি শিক্ষিত বোধ সম্পন্ন মেয়ে বেরিয়ে আসতে পারেনি প্রচলিত সংস্কার ভেঙ্গে। পারে নি বাবা মায়ের অসহায়ত্বকে জিতিয়ে দিতে। বাঁধ না মানা কান্নার ধারায় ঝাপসা চোখে সুতপা দেখে বাবা মার তিলে তিলে গড়া সঞ্চয়গুলো এই সবুজের মাঝে সৌন্দর্য্যের হানি ঘটিয়ে গহনার বেঢপ বাক্সটা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ভেতর থেকে ভেংচি কাটছে গলার সীতাহার, কানের ঝুমকা, মাথার জ্বলেজ্বলে টিকলি, অঙ্গুরীয়, চুড়ি আর বেলি ফুলের ছবি অংকিত বালাজোড়া।
অবাধ্য অশ্রু লুকাতে দুহাতে মুখ ঢাকে সুতপা।
কৃষক লোকমানের চোখে মুখে সদ্য পিতৃহারা কণ্যার জন্য সহানুভুতি জাগে। কন্ঠে দ্বিধা নিয়ে বলে, —–মাগো চলেন। গরীবের হাড়িতে দুটো ভাতের বন্দোবস্ত হয়েছে, খেয়ে তবেই যাবেন।”
সুতপা কোন জবাব দেয় না। লোকমানকে অনুসরন করে এগোয় ক্ষেতের সরু আল ধরে।
দূরের দিগন্ত ছুঁয়ে যাওয়া আকাশ থেকে ভেসে আসে বাবার হাস্যোজ্বল মুখের কথাকটি——
” মাগো মাঝে মাঝে বাবা মা দেরও জিততে হয় দায়ভার থেকে মুক্ত হবার জন্য।”
একটু দাঁড়ায় সুতপা। কথাগুলি বাতাসে ভাসছে নাকি তার কানে বাজছে ঠাউর করতে পারে না। শুধু মন গহীনে থাকা জমাট কষ্টের বরফটা আর একটু গলে যায় একটা প্রলম্বিত দীর্ঘশ্বাসে,মনের কোনে অব্যক্ত সুর ছড়ায়,
—— তুমিই জিতে গেলে বাবা। যুগ যুগ ধরে অসহায় বাবারা যেভাবে জিতে যায়, ঠিক সেভাবেই।