আজ উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার রেজাল্ট ঘোষণা করা হয়েছে। অনলাইনে সব ছাত্রছাত্রীরা তাঁদের রেজাল্ট গুলো দেখছে অধীর আগ্রহের সাথে। নিশিতা কাঁধে ব্যাগ নিয়ে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে কলেজের ক্যাম্পাসে উপস্থিত হয় রেজাল্ট দেখার জন্য। রেজাল্ট শিট রেখে যেতেই স্টুডেন্টদের ভীড় জমে যায় সেখানে। নিশিতা সবার ভেতরে ঢুকে নিজের রেজাল্ট দেখার চেষ্টা করে। নিশিতা রোল নাম্বার চেক করে নিজের রেজাল্ট দেখে খুশিতে চোখের পানি ফেলে দেয়। খুশিতে দিশেহারা হয়ে একটা চিৎকার দেয় নিশিতা। নিশিতার রেজাল্ট জিপিএ ফাইভ। গোল্ডেন এ প্লাস গ্রেড অর্জন করেছে নিশিতা। এই রেজাল্ট দেখে নিশিতার চাইতে নিশিতার মা বেশি খুশি হবেন। নিশিতা তাঁর শত পরিশ্রমকে এইভাবে জিতিয়ে দিয়েছে। নিশিতা বাড়িতে আসার পথে রওনা দিতেই প্রেসের লোকজন নিশিতাসহ আরো ছাত্রছাত্রীদের ঘিরে ফেলে। এতক্ষণে পুরো জেলা জেনে গেছে নিশিতার রেজাল্টের কথা। সবাইকে টপকিয়ে উঁচু স্থানে আছে নিশিতার রেজাল্ট। প্রেসের লোকজন নিশিতার এই রেজাল্টের ব্যাপারে জানতে চেয়ে নিশিতাকে বলল,
_“মিস নিশিতা আপনার এই রেজাল্টে আপনার অনুভূতিটা কেমন?”
_“আমার অনুভূতি তো এক্সাইটেডে ভরপুর। আমার এই রেজাল্টে আমার থেকেও বেশি খুশি অন্য একজন। তাঁর স্নেহ, মায়া, মমতা তাঁর সাহায্য সহযোগিতায় আজকে আমি এই স্থানে এসেছি। আমাকে এই স্থানে দাঁড় করাতে সে অনেক কষ্ট করেছে। আজ এই রেজাল্টটার মাধ্যমে আমি তাঁর শত কষ্টকে লাঘব করতে পেরেছি।”
_“কে সেই ব্যক্তি?”
_“সে আমার মা। আমার গর্ভধারিণী মা।”
_“মানুষ নিজের কঠোর পরিশ্রমে জয় লাভ করে কিন্তু আপনি আপনার মা কে এখানে টানলেন, তাঁর কারণটা কী জানতে পারি?”
_“আমার পড়াশোনা যখন বন্ধ হয়ে গেছিলো তখন আমি প্রায় সব আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম।”
_“পড়ালেখা ছাড়তে হলো কেন?”
_“এই সমাজে সবার সব চাহিদা পূরণ হয় না। তাই আমার স্বপ্নটাও ভেঙে গেছিলো। কিন্তু আমার মায়ের কঠোর পরিশ্রম আমাকে আজ সাফল্যের দাঁড় প্রান্তে এনে পৌঁছে দিয়েছে। আমি চাইলেও আমার মায়ের ঋণ শোধ করতে পারব না। কারণ আমার মা যে আমার প্রথম ভালোবাসা।”
নিশিতা এর থেকে বেশি কিছু বলার প্রয়োজন মনে করে না। কারণ সে জানে এরা গল্প ঠিকই শুনবে কিন্তু কেউ অন্যায় প্রতিবাদে এগিয়ে আসবে না। সবাই হয়তো মিডিয়ার সামনে দু’চারটে ভালো কথা বলে ভালো সাজবে, কিন্তু; কেউ সামনে থেকে কাছে থেকে এর প্রতিবাদ করতে এগিয়ে আসবে না।
নিশিতা বাড়ির দিকে রওনা দেয়। বাড়িতে গিয়ে দেখতে পেল মা উঠোন ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করছেন। নিশিতা দৌঁড়ে মায়ের কাছে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরলো। নিশিতা মায়ের বুকে মাথা রেখে বলল,
_“মা তোমার মেয়ে গোল্ডেন এ প্লাস পেয়ে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে।”
_“কী! তুই প্লাস পেয়েছিস?”
_“হ্যাঁ মা। আর সেসব শুধু তোমার পরিশ্রমে। সেদিন যদি তুমি আমাকে না বাঁচাতে তাহলে আমি আজকে এই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতাম না।”
_“বাজে কথা বলিস না মা। সাফল্য নিশ্চিত হয়েছে তোর চেষ্টার ফলে। আমি তো শুধু তোকে তোর বেঁচে থাকার রাস্তাটা দেখিয়ে দিয়েছিলাম।”
_“মা তুমি পাশে থাকলে আমি সব পরীক্ষায় জয়ী হতে পারবো।”
_“আমার দোয়া সবসময় তোর পাশে আছে। আয় ঘরে আয় তোর বাবা তোর জন্য অপেক্ষা করছে। খুশির খবরটা তাকে দিবি না।”
_“হ্যাঁ চলো।”
নিশিতা রুমের ভেতরে গিয়ে দেখে বাবা আধশোয়া হয়ে বিছানায় পড়ে আছে। নিশিতা কাছে গিয়ে বাবার পা ধরে সালাম করে বাবাকে জড়িয়ে ধরলো। নিশিতার বাবা নিশিতার মাথায় হাত রেখে কেঁদে ফেললেন। নিশিতা বাবার চোখের জল মুছে বাবা-মা দু’জনের মুখে মিষ্টি তুলে দিয়ে খুশিতে মেতে উঠলো।
কিছুসময় পর রুমে এসে সবাইকে ফোন করে নিজের রেজাল্টের কথা জানালো। আত্মীয়স্বজন সবাই খুব খুশি নিশিতার রেজাল্টে। নিশিতা ফোন হাতে নিয়ে ভাবনাতে হারিয়ে গেল।
প্রায় ৬ মাস আগের ঘটনা। কলেজ থেকে বাড়ি ফেরার পথে কিছু বখাটেদের হাতে নিজের সতীত্ব হারায় নিশিতা। প্রাণে বেঁচে ফিরলেও রক্ষা পায়নি সেদিন নিশিতার দেহ। হায়নার দলেরা নিশিতার ফুলের মতো পবিত্র সম্মানটা নষ্ট করে দিলো। গ্রামে বিচার চাইলে গ্রামের বিচারক কোনো পাত্তা দেননি। নিশিতাকে মিথ্যেবাদী বলে অপমান করেছিলেন। কোনো উপায় না পেয়ে থানায় জি.ডি করতে যায়, কিন্তু; হাতে ওই ধর্ষকদের বিরুদ্ধে একটাও অভিযোগ ছিলো না নিশিতার। থানার অফিসার কোনোরকম জি.ডি জমা নেয় নি। নিশিতার বাবা প্রতিবাদ করতে গেলে ওই ধর্ষকদের একজন নিশিতার বাবার এক্সিডেন্ট করিয়ে তাকে সারাজীবনের জন্য পঙ্গু করে দেয়। বেঁচে থেকেও মৃত লাশ হয়ে আছেন নিশিতার বাবা। এতো কষ্ট সব সহ্যের বাইরে চলে যায়। একলা একা নিশিতা সেদিন নিজেকে শেষ করার প্রস্তুতি নিয়ে সিলিং ফ্যানের সাথে বিশাল কাপড় ঝুলিয়ে রাখে। যেই নিজের মাথাটা ফাঁসির কাপড়ে দিলো তখনই নিশিতার মা ঘরের ভেতরে আসেন। মেয়েকে এই অবস্থায় দেখে চিৎকার দেন নিশিতার মা। কিছু হওয়ার আগেই নিশিতাকে বুকে টেনে নেন তিনি। গ্রামের লোকজন এসব দেখে শুধু নিশিতাকেই একতরফা অপবাদ দিতে লাগলো। এমনকি শেষমেশ ওনাদের মিথ্যে অভিযোগের দায়ে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দিলো।
অবশেষে অন্য জায়গায় এসে ঘর সংসার গড়ে তুলেন নিশিতার মা। সেলাইয়ের কাজ করে নিজের স্বামীর চিকিৎসার টাকা জোগাড় করেন। নানারকম ভাতা নিয়ে নিশিতার পড়াশোনা চালিয়ে যান। নিশিতাকে নিয়েই যেন ওনার একমাত্র বেঁচে থাকা। নিশিতাকে সাফল্যের দরজায় পৌঁছে দেওয়াটাই ছিলো ওনার অন্যতম লক্ষ্য। সেদিন নিশিতার চোখের কান্না মুছে তিনি নিশিতাকে অভয় দিয়ে বলেছিলেন,
_“ভয় পাস না। গোটা দুনিয়া যদি তোকে ঘৃণা করে। তোকে অপমান করে। তোর গায়ে যখন কলঙ্কের দাগ লাগিয়ে দিলো, মনে রাখিস একদিন তারাই তাঁদের অন্যায় অপরাধের ফল পাবে। তুই কেন আত্মহত্যা করবি? তুই কেন জাহান্নামের আগুনে একা পুড়ে মরবি? তোকে বাঁচতে হবে মা। একদিন এই পাপিষ্ঠাদের শাস্তি দিতে তোকে বেঁচে থাকতে হবে।”
_“আমি পারবো না মা। আমার যে সব হারিয়ে গেল?”
_“কিছুই হারায়নি তোর। এখনও তোর মা-বাবা বেঁচে আছে। আমি বেঁচে থাকতে আমার মেয়ে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করবে এটা আমি হতে দিবো না। তোকে আমি গড়ে তুলবো। গড়ে তুলবো আমার দেওয়া শিক্ষায়। একদিন তুই নিজেই এই নরপিশাচদের শাস্তি দিবি। শক্ত কর নিজেকে, আর সাহস রাখ। তোর পাশে কেউ থাকুক আর না থাকুক আমি তোর পাশে সারাজীবন থাকবো। হারকে মেনে নিবি না। সর্বদা সৎ পথে থাকলে একদিন তুই সফলতার দ্বারে পৌঁছাবি। এইভাবে মৃত্যুর পথ বেছে নিতে পারিস না তুই নিশি।”
_“সবাই যে আমাকে দেখলেই ছিঃ ছিঃ দেয়।”
_“ওরাও যে পিশাচ রে মা। কেউ সত্যটা খুঁটিয়ে দেখার চেষ্টা করে না। সবাই শুধু দুর্বল মানুষের ক্ষতি করতে এগিয়ে আসে। তবে আমার বিশ্বাস আমার মেয়েটা পারবে নিজের একটা পরিচয় গড়ে নিতে। একদিন তুই ও গোটা দেশকে দেখিয়ে দিবি তোর মাঝে কী ট্যালেন্ট আছে?”
_“ঠিকই বলেছো। আর কোনদিনও আমি এই পথ বেছে নিবো না। আজকের পর থেকে আমার নতুনভাবে নিজেকে গড়ে নেওয়ার লড়াই শুরু হবে। শুধু তুমি আমার পাশে থেকো।”
নিশিতার মা নিশিতাকে অভয় দিয়ে সেদিন আত্মহত্যার পথ থেকে ফিরিয়ে আনতে পেরেছিলেন। নিশিতা আজ বুঝতে পারছে নিজের এই ভালো রেজাল্ট, এতো কিছু। সবটাই মায়ের পরিশ্রমের ফল। সেদিন যদি নিশিতার মা নিশিতাকে বাঁচার জন্য নতুনভাবে আগ্রহ না দেখাতো। বাঁচার জন্য উৎসাহ না দিতো। তাহলে আজ নিশিতা হয়তো পৃথিবীতেই থাকতো না। মনে মনে মায়ের প্রতি অজস্র শ্রদ্ধা জন্মায় নিশিতার। ভালোবাসার থেকেও আরো বেশি ভালোবাসা জন্মায় মায়ের প্রতি। যে মা নিজে এতো কষ্ট করে আজ তাঁর মেয়েকে সাফল্যের প্রথম পদক্ষেপে জিতিয়ে দিয়েছে সে মা পারবেই তাঁর মেয়েকে আগামীর পথে এগিয়ে দিতে। সব কিছু থাকুক আর নাইবা থাকুক এমন একজন মা পেয়েছে নিশিতা এটাই জীবনের পরম পাওয়া।
পরিশেষে, মা সন্তানকে বাঁচতে শেখায়। সাহস জোগায়। বেঁচে থাকার লড়াই শেখায়। মাকে দেখলেই বুঝা যায় ‘এ যে ভালোবাসার প্রথম ধাপ।’ প্রতিটা মায়ের ইচ্ছে আর স্বপ্ন গুলো এইভাবেই পূরণ হোক। ভালো থাকুক প্রতিটা মা। ভালো থাকুক প্রতিটা মায়ের সন্তান। ভালো থাকুক প্রথম ভালোবাসার মানুষগুলো।
সমাপ্ত…