তারিখ ছিলো ৮ ই ফেব্রুয়ারি ২০১২। অন্য দিনের মতোন আজও অফিসে গেলাম। সব কাজ চলছিলো স্বাভাবিক ভাবে। হঠাৎ দুপুর ১২.৩০ মিনিটের পরে বুকের বাম দিকে কেমন যেনো একটু ব্যাথা করতে লাগলো। মনে মনে ভাবলাম হয়তো গ্যাসের ব্যাথা তা ছাড়া দুপুরের লান্চ হয়নি বলে ব্যাথা করতে পারে।
তার পর দুপুরের খাবার খেলাম। মেনুতে ছিল সবজি আর মাছ। পেট ভরা আছে তবুও বুকের মধ্যে কেমন একটা চাপ অনুভব করছি। প্রচন্ড অস্বস্তি লাগছে। ঔষধের দোকান থেকে একটা গ্যাসের ঔষধ কিনে খেলাম কিন্তু কোন কাজ হচ্ছে না। ব্যাথাটা আস্তে আস্তে বাড়ছে। তবুও যেটুকু সম্ভাব নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছিলাম । মনে হচ্ছে দম নিতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। এভাবে কাটলো সারাটা দিন। বিকেলে সামান্য নাস্তা করলাম। কিন্তুু তখনও বুকের ব্যাথাটা কমছে না।
সন্ধ্যার দিকে বাসার আসার জন্য গুলশান থেকে গাড়িতে উঠলাম। রাস্তায় প্রচন্ড যানজট আর ধুলা। গাড়ির এসিটা পুরো চলছে কিন্তু আমার অস্বস্তি কোন ভাবে কমছে না। রাত ৭ টার দিকে বাসায় এলাম। বাসায় এসে ভাবলাম গোসল করলে হয়তো ভালো লাগবে। গোসল করলাম। গোসল করে রূমের এসির মধ্যে এলাম,না কিছুতেই কাজ হচ্ছে না।
ক্রমে ক্রমে বুকের ব্যাথাটা বেড়েই চলছে। আর সারা গায়ে প্রচন্ড ঘাম ঝড়ছে। এর মধ্যে ছোট ভাইকে খবর দেওয়া হয়েছে। দেখি ও গ্যাসের কিছু লিকুইট নিয়ে এসেছে।ওর ধারনা এটা হয়তো গ্যাসের ব্যাথা।
আমি খাটের উপর বসে ছিলাম ও ডাকতেই পা দুটো বাড়ার চেষ্টা করলাম, দেখলাম আমার পা দুটো শক্ত হয়ে গেছে।কোন ভাবেই নাড়াতে পারছিলাম না। আস্তে আস্তে ঘাড়টাও শক্ত হয়ে যাচ্ছে। একটু পরে খেয়াল করলাম ঠোট দুটো কাঁপছে। নিজেও কেমন যেনো ঘাবড়ে গেলাম।
এতো কিছু ঘটছে তার পরেও দেখলাম আমার বউ সম্পুর্ন নির্বিকার, কারন সে কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলো না, কি থেকে কি করবে। তার উদাসী চোখ কেবলি অজানা ভয়ে লাল হয়ে উঠছিলো। সে আমার সাথে যেতে চেয়ে ছিলো কিন্তুু রাত গভীর হবার কারনে তাকে আর সাথে নেয়নি। বলে ছিলাম মেয়ে দুটির খেয়াল রাখতে।
রাত তখন প্রায় ১১.৪৫ হবে। ছোট ভাই আর আমার ড্রাইভার আমাকে ধরে নিচে নামাচ্ছে। সে সময় আমি হাতে পায়ে কোন শক্তি পাচ্ছিলাম না। আমাদের বাসার সবচেয়ে কাছে প্যান প্যাসিফিক হাসপাতাল ৭ মিনিটের মধ্যে চলে গেলাম সেখানে। এদিকে বুকের তীব্র ব্যাথায় আমার দম যায় যায়। ডাক্টার প্রথমেই প্রেশার দেখলো, তাতে ডাক্টারের তো চরম অবস্হা। তার পর ইসিজি করারর সব আয়োজন শেষ করে ইসিজি করলো। তখনও আমার কিছুটা চেতনা ছিলো। হালকা সব শুনতে পারছিরাম।ডাক্টার ইসিজি করে আমার ছোট ভাইকে বল্ল “উনার বিট পাওয়া যাচ্ছে না,কয়েক মিনিটের মধ্যে কাডিয়াক হাসপাতালে নিতে হবে।” তখনও আমার কিছুটা বোধ ছিলো।
ট্রলিতে করেই আমাকে গাড়িতে তোলা হলো।রাজার বাগ থেকে গাড়ি ছুটছে শাহাবাগের দিকে। গাড়ি যখন মৎস্য ভবনের সামনে তখন আমি মনে হয় সব বোধ হারাচ্ছি। মনে হলো বুকের ভীতরের কোন রগ ছিড়ে গেছে। মাথাটা ঘুড়ছে। সমস্ত পৃথিবী ঘুড়তে লাগলো। আমার চোখের সামনে থেকে রাস্তার আলো গুলো সরে যেতে লাগলো দূর থেকে দূরে। শব্দ গুলো মনে হলো দূর থেকে শোনা যাচ্ছে। আর চোখের সামনে সব রং উবে গিয়ে কেবলি ধুসর কেমন যেনো অচেনা এক রং আর সব কিছু স্তব্ধ হয়ে গেলো।
এখন আমি যা বলবো সেটা আমার বউ এর কাছ থেকে শোনা কারন মৎস্য ভবনের সামনে থেকেই আমার কোন চেতনা ছিলো না। রাত ১২.০৩মিনিটে আমাকে নিয়ে গাড়ী গেলো ইব্রাহিম কাডিয়াক হাসপাতালে। সেদিন হাসপাতালে রূগীর অনেক চাপ ছিলে। সব রুগীকে কেবল প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে অন্য হাসপাতালে পাঠাচ্ছে। এর মধ্যে আমার বউ হাসপাতালে চলে এসেছে। যেহেতু আমার কোন চেতনা ছিলোনা, তাই আমাকে জরূরী ভিত্তিতে জরূরী বিভিগে নেওয়া হলো।
সমস্যা হলো আমার কোন হার্ট বিট পাওয়া যাচ্ছিলো না। অনেক ডাক্তাররা মিলে প্রানপণ চেষ্টা করছে। কিন্তু সমস্যা হলো ওদের আই,সি,ইউ, তে কোন সিট নাই। আবার আমার অবস্থা খুবই খারাপ।আমার পরিচিত একজন এ হাসপাতালে চাকুরী করে। অবশেষে তার বিশেষ সহযোগিতায় জরূরী বিভাগে ডাক্টার আমাকে আনলেন। আমাকে বেডে রেখে সকল ডাক্টার মিলে তাদের প্রান পন চেষ্টা করতে লাগলো।একের পর এক শর্ক দিতে লাগলো। ৬ শর্কের পর আমি নাকি একটু নড়ে উঠে ছিলাম। তার পর আবারো নিস্তেজ।
বিশেষ ব্যাবস্হাপনায় আই,সি,ইউ এর পাশে সিজার রূমে আমাকে রেখে লাইফ সাপোর্ট দেওয়া হলো। আর এর মধ্যেই ডাক্টার বলে দিয়েছে মৃত্তুর পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহন করার জন্য। কারন আমার হিট টা ছিলো এম আই এর প্রধান রক্ত শিরায়। জানিনা কি ভাবে কাটলো সময় গুলো।
হঠৎ করে দুর বহু দুর থেকে কানে ভেসে এলো হালকা কোন শব্দ। মনে হলো অনেক গুঞ্জন। হালকা চোখটা মেলতেই মৃদু লাইট গুলো চোখের মধ্যে কেমন যেনো জ্বালা দিতে লাগলো। তার পরে খেয়াল করে দেখলাম আনন্দে ডাক্তাররা দিশেহারা। কেউ বলছে যাক কিছুটা সাড়া পাওয়া গেছে।
অবাক হয়ে দেখলাম আমার মাথার কাছে আমার বউ বসে আছে। ওর গড়িয়ে পড়া চোখের পানি গুলো আমার কপালে এক শীতলতার পরশ বইয়ে দিচ্ছে। দেখলাম ওর চোখ দুটো লাল,মুখটা বেশ শুষ্ক,হয়তো সারা রাত পানিও স্পর্শ করেনি। ওর কান্না ভেজা মুখে সরু এক ফালি চাঁদের হাসি। যেনো দিগন্ত জয় করা হাসি। ওর চোখের দিকে তাকাতেই বুকের তীব্র ব্যথা আবার আমার চেতনা কেড়ে নিলো।
যে সময় আমান চেতনা ফিরে এলো সে সময় ভোরের আলো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়িয়েছে। হালকা চোখটা খুলে দেখলাম আমার চার পাশে অনেক অপারেশনের রুগী। তখন সময় আনুমানিক ৮.৩০ হবে। ডাক্টার এসে দেখলো। যে সময় ডাক্টার এলো সে সময় আমার প্রেশার অনেক বেশী।হাতে ক্যানেল, চলছে স্যালাইন। ডাক্তার বললেন সময় খুব কম। তাড়াতাড়ি ওটিতে নিতে হবে।
আমাকে ট্রলিতে তোলা হলো। যে সময় আমার এ অবস্হা সে সময় আমি একটা বেসরকারী ব্যাংকের বেশ বড় একজন কর্মকর্তা। তার পর ট্রলি যে সময় ওটির দিকে যাচ্ছে, সে সময় বাইরে আমার ব্যাংকের সব কলিগরা দাড়ানো। সবাই কাছে এলো নান সান্তনার বানী নিয়ে।আমি মুখে কিছু বলতে পারছিলাম না। আমার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়া লোনা পানিই ছিলো তাদের প্রতি আমার সহমত। সবার চোখ সে সময় ছল ছল করছে।
ট্রলি কেবলি সামনের দিকে চলছে। আমার বউ এর ফোলা লাল চোখ আমাকে দুর্বল করে দিচ্ছিলো। আমার মেয়ে দুটোর দিকে তাকালাম ,ওরা শান্ত ভাবে দাড়িয়ে আছে সবার চোখে কেবলি অনন্ত অশ্রূধারা। সব শেষে ট্রলি এসে গেছে ওটি রূমের দিকে। দড়জা ঠেলে আমাকে ভিতরে নেওয়া হলো।
চারিদিকে কেবলি নিরবতা। বিশাল বিশাল সব লাইট, আরো সুসজ্জিত ভাবে সাজানো আছে অপারেশনের নানান উপকরন।আমাকে ওটি টেবিলে উঠানো হলো । সব ডাক্টার মিলে তাদের নিদৃষ্ট পোশাক পড়ে কাছে আসলো। এক প্রচন্ড ভীতিকর অবস্হা। সবাই আমাকে সান্তনা দিচ্ছে।
ইতোমধ্যে নার্স একটা ইনজেকশন আমার হাতের রগে দিলো। তার পরে চোখ দুটো আবারো ভারী হয়ে আসলো। আরেকটা ইনজেকশন আমার পায়ের কুচকির উপর দিলো। আমার জানা মতে এ ধরনের এনজিওগ্রামে পুরোপুরি অচেতন করা হয় না। কিন্তু আমার প্রেশার আপ-ডাউন করার কারনে আমাকে অচতেন করা হলো।
অচেতনের সময় পায়ের কুচকির উপর গরম কিছু টের পেলাম। এটা আসলে রক্ত ছিলো।একটা বড় ডায়া ( হাই রেজুলেশন ক্যামেরা) আমার বুকের উপর ধরা হলো। তার পর পায়ের কুচকির রগের মধ্যে দিয়ে সরূ তারের মতোর কি যেনো ক্রমেই ভিতরের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। তার পরের টুকু আমার আর মনে নেই ,কারন সে সময় আমার ইনজেকশন কাজ আরম্ভ করে দিয়েছে।
এর পরের টুকু আমার বউ আমাকে বলেছে যে, অপারেশনের সময় ডাক্তার বাইরে এসে বলেছে যে, রোগীর অবস্থা ভালো না । তবে তাঁরা রিং লাগিয়ে চেষ্টা করতে পারে । এতে আমার বউ সন্মত্তি দেয়। তার পর আরম্ভ হয় রিং লাগালোর প্রস্তুতি। রিং লাগানো শেষ হলো। তেখনও আমি অচেতন। আমাকে নেওয়া হলো সিসিইউতে ।
হাসপাতালের সিসিইউ এর নিরবতায় নিজেক কেমন যেন অসহায় করে তুলছে।
আমার চারপাশের রোগীদের বাঁচার তীব্র আকূতি আমাকে ব্যাকূল করে তুলছে। সাদা শুভ্র বিছানার মাঝে পড়ে আছি আমি।
অক্সিজেন চলছে আর মেশিন এর নাইট্রো গ্লিসারিন স্যালাইনের এক এক ফোট যেনো শরীলের সমস্ত শিরাতে প্রবাহিত হতে লাগলো প্রবাহমান নদীর মতো।চেতনানাশকের প্রভাবে চোখ দুটি কিছুতেই স্থির রাখতে পারছিনা।
বেঁচে থাকার নিরন্তর চেষ্টা কিছুতেই চোখের পাতা এক করতে দিচ্ছেনা। হঠাৎ হাট মনিটরের টু টু শব্দটা কানের শ্রবন শক্তিকে জাগিয়ে তুলছে। তার পরে শব্দটা আস্তে আস্তে মৃদু থেকে মৃদুতর হতে লাগলো। আর আমার ক্লান্ত দেহটা আস্তে আস্তে ঢলে পড়লো গভীর শুন্যতার মাঝে।
কত সময় যে গভীর ঘুমের মাঝে ছিলাম তার হিসাব আমার কাছে নেই। হঠাৎ কপালে শীতল কিছুর ছোঁয়ায় চেতনা ফিরে পেলাম।
সমস্ত ক্লান্তহীনতাকে পাশে রেখে ভারী চোখ দুটি মেলে তাকালাম,দেখলাম আমার কপালে ছোট হাত দিয়ে দাড়িয়ে আছে আমার ১১ বছরের মেয়েটি। আর ওর চোখ দুটি পানিতে ছল ছল করছে, হয়তো যে কোন সময় তা ঝড়ে পড়বে অঝর ধারায়। এই প্রথম নিজের বুকের মাঝে অনুভাব করলাম ভালোবাসার এক অন্য রূপ, দেখলাম শর্তহীন ভালোবাসার এক জীবন্ত অবায়ব। আমি নির্বাক হয়ে ছিলাম। কেমন যেনো নিজের মাঝে বেঁচে থাকার এক আকূলতা আমাকে গ্রাস করছে।
মনে হলো আধার ঠেলে যেনো উদয় হলো নতুন এক সোনালী দিনের।এটাই হয়তো বা বেঁচে থাকার মানে। দৃশ্যপট বদলে যেতে থাকে আমার ছোট মেয়ের ছল ছল চোখের জলের আড়ালে, তার নিষ্পাপ চোখের জলের কাছে আমার সব ক্লান্তি মেলেছে ডানা নানা রংয়ে। জীবনের ভাঁজে ভাঁজে অনেক পসরা-তবুও বৃত্তবন্দী হতে থাকা মানস সরোবর জুড়ে কেবলি বাঁচার তীব্র আকুতি।
মৃদু হয়ে যাওয়া বাঁচার আশা ক্রমে ক্রমে বেড়ে যাচ্ছে।
এ এক বন্ধন-হিমবাহে,হিমবাহে ক্রমশ এক নদী জ্বলে উঠে ভালোবাসার রসায়নে।ওর চোখের জলে জ্বলে উঠে শুকনো পাতার আগুন-এ আগুনে পুড়ে না আশা – পুড়ে যায় নিস্ফলা মৃত্যুর সমস্ত শক্তি- দূরের বসতিতে তখন সান্ধ্য বাতি ধীরে ধীরে জ্বলে উঠে কিছু বৃত্তবলয় হয়তো – ওর চোখের জলে কিছু স্বপ্ন – থেকে থেকে কথা বলে- এ যেন জীবনের নতুন আরেক অধ্যায়।