প্রতিদিনের মতো সাধারণ একটি দিন। আকাশে সূর্য উঠেছে, হালকা মেঘ আছে সেই মেঘ মাঝে মাঝে সূর্যকে ডেকে দিচ্ছে। সাধারণ দিন হলেও আমার জন্য সাধারণ দিন নয়। কেননা আজকে আমার রেজাল্ট। বার বার মনে হচ্ছে পাশ করবো তো? রোল ঠিকভাবে ভরাট করছি তো? সেট কোড যদি ভুল করেছি? কত রকমের চিন্তায় সকাল বিষাদময় হয়ে গেছে। তখনি বাঁধন, মারুপ আমার বাসা আসলো। চিন্তায় তারাও বাসায় থাকতে পারে নি। বাঁধন বললো চল স্টেশন গিয়ে বসে থাকি, মানুষের ভিড় দেখতে হয়তো চিন্তা দূর হয়ে যাবে। আমি বললাম চল তাই করি। তবে আমাদের কাছে তেমন টাকা ছিল না। আমার কাছে ০৫ টাকা, মারুপের কাছে ১৮০ টাকা আর বাঁধনের কাছে ২০০ টাকা, মোট ৩৮৫ টাকা। আমাদের বাসা থেকে রংপুর স্টেশনের দূরত্বে ১৮/১৯ কিলো হবে যেতে সময় লাগলো প্রায় ঘন্টা খানেক আর ভাড়া লাগলো ৭৫টাকা। স্টেশনে গিয়ে দেখি মানুষ জন খুব কম, মনে হচ্ছে তাদেরও রেজাল্ট দিবে তাই তারা স্টেশন আসে নি। গুটি কয়েক মানুষ ট্রেনের জন্য অপেক্ষায় আছে। ১১ টায় ট্রেন আসবে তবে এখন বাজে ১০:৩০। আমি বললাম চল ট্রেন যত দূর যায় আমরাও যাই কিন্তু তাদের সাহস হল না। তবে লালমনিরহাট যাওয়ার ৩টা টিকিট কাটলো মারুপ,রংপুর স্টেশন থেকে লালমনিরহাট স্টেশন ৩৬ কিলোমিটার তিন জনের ভাড়া ৬০ টাকা। আমাদের কাছে আছে আর মাত্র ২৫৫ টাকা। আমরা অধীর আগ্রহে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতেছি, এর মাঝে ২ জন ভিক্ষুককে ১৫ টাকা দান করা হয়েছে রেজাল্টের অছিলায়। ট্রেন আসলো ১১:২০ টায়, অনেক কষ্টে ট্রেনে উঠে দেখি সিট নাই। ট্রেন টা ছোট ছিল কারণ এটা ডেমো ট্রেন খুব সম্ভবত চীন কিংবা জাপান থেকে আনা হয়েছে। দাঁড়ায় থাকতে থাকতে পা একটু বিশ্রাম চাচ্ছিলো কিন্তু কোনো উপায় নেই। ট্রেন ছাড়লো ১২:১০ এ, পুরো ৫০ মিনিট দেড়িতে তবে আমাদের এ ভালো হয়েছে। ট্রেনের গতি আস্তে আস্তে বাড়ছে, আর আমাদের রেজাল্টের চিন্তাও বাড়ছে। রেজাল্ট প্রকাশ করবে ১টায়। এর মাঝেই বাঁধন ৩ বার ম্যাসেজ দিয়ে ৬ টাকা নষ্ট করে ফেলেছে। ট্রেন একে একে মীরবাগ স্টেশন, কাউনিয়া স্টেশন ছেড়ে লালমনিরহাটের দিকে এগিয়ে চলছে। কিছুক্ষণ পর আমরা তিস্তা নদীও পারলাম। এদিকে ঘড়ির কাঁটা ১টা ছুঁই ছুঁই। আমি বললাম ট্রেন থেকে নেমে রেজাল্ট দেখবো। কথা মতো তাই হল প্রথমে আমার রেজাল্ট দেখলাম, তারপর বাঁধন সবশেষে মারুপ। সবার রেজাল্ট আশানুরুপ হয় নি তবে খারাপ যে হয়েছে সেটাও না। তবে একটু মন খারাপ হল কিন্তু খুব বেশি না। এরই মাঝে সবার বাসা থেকে খোঁজ নেওয়া শুরু করছে। তাড়াতাড়ি বাসায় আসতে বলছে কিন্তু আমরা যে অনেক দূর আসছি সেটা বলতে পারছি না। আবার রেজাল্ট দেখে প্রচন্ড খিদা লেগেছে কিন্তু খেলে যাওয়ার টাকা হবে না। আবার না খেলে যেতেও পারবো না। আমি অনেক শুনেছি রেজাল্ট খারাপ হলে নাকি খেতে ইচ্ছা করে না কিন্তু আমাদের না খেলে শরীর শক্তি পাচ্ছে না। আমি উৎসকে কল করে বললাম অনেক দূর চলে আসছি যাওয়ার টাকা নাই কিছু টাকা বিকাশ করে দে, সে ও বললো তার কাছে টাকা নাই। তবে মারুপ ২০০ টাকা কোনো রকমে রকেটের মাধ্যমে ম্যানেজ করেছে। হোটলে গিয়ে বসে ভাত, ভর্তা, ডিম, ভাজি দিয়ে পেট ভরে খাওয়া করলাম, বিল আসলো ১৪০ টাকা, তখন বাজে ৩ টা। ফিরার পথে ট্রেন নেই কোনো আমাদের বাসে করে যেতে হবে। স্টেশন থেকে গেলাম বাস স্ট্যান্ডে। বাস স্ট্যান্ডে গিয়ে মীরবাগের টিকিট কাটলাম, তিন জনের ১৫০ টাকা। এর মধ্যেই বাসা থেকে ৪ বার কল দিয়ে বলছে বাসায় আসতে কিন্তু আমাদের এখনো ঘন্টা দুইয়েক লাগবে। আমি ভয়ে ফোন বন্ধ করে রাখলাম। এদিকে বাস যাচ্ছে আর একটু পর পর থেমে যাত্রী তুলছে কি বিরক্তিকর অবস্থা! প্রায় দুই ঘন্টা মত লাগলো মীরবাগ আসতে, এখন মীরবাগ থেকে সোজা বাসা তবে সময় লাগবে ৩০/৪০ মিনিট। আমরা রিক্সা ঠিক করলাম বাঁধন কোনো রকমে উপরে উঠে বসলো। আমি আর মারুপ সিটে শান্তি করে বসে আছি। আহা! রিক্সায় চড়ার অন্য রকম একটা মজা আছে সেটা যে চড়ে নি সে বুঝবে না। ৪০ মিনিট পর বাসার সামনে এসে নামলাম এখন যে যার বাসা চলে যাবে। আমার বাসায় ঢুকতে একটু ভয় করছে, ভয় ভয় করে বাসায় ঢুকলাম ছোট ভাইয়া দৌড়রে এসে মিষ্টি মুখে দিয়ে বললো খা, ভালো রেজাল্ট করছিস। আমি ভাবতেছি ছোট ভাইয়া মজা করতেছে না তো? পরে দেখলাম আম্মু বলছে খা। আমরা রেজাল্টে তারা হয়তো কষ্ট পেয়েছে কিন্তু মুখে জানি ধরে রেখেছে। আমিও ভাবলাম যাক সব ঠিক আছে। সামান্য এই রেজাল্টের জন্যে কি কান্ডই না করলাম। কোথা থেকে কোথায় চলেছিলাম কিন্তু বাবা-মা ব্যর্থতার দিনে পাশেই ছিল। এখন এই গুলা কথা মনে করি আর হাসি। কি পাগলামোটাই না করেছিলাম!
গল্পের বিষয়:
গল্প