ঈদের এক ফালি নতুন চাঁদ

আপনারা যারা নিয়মিত আমার লেখা পড়েন সবাই আমার বর্তমান অবস্হা সমন্ধে অবগত আছেন। 

আমি অত্যান্ত সাধারন একজন মানুষ,অনেক দিন থেকেই আমি হার্টের জটিল রোগে আক্রান্ত। তার পরেও নিজের সংসার আর দুটি মেয়ের দিকে চেয়ে বেশ নিরিবিলি একটা বেসরকারী চাকরী করে আসতে ছিলাম। চাকুরীতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটা পদেও ছিলাম। 

আমি সব সময় সহজ সরল ভাবে সব কিছুকে দেখতে চেষ্টা করেছি। তার পরেও আজ বেশ কিছুদিন যাবৎ আমি সম্পুর্ন চাকুরী হীন বেকার। রোজার মাস চলছে, এ মাসটা নাকি রহমতের মাস। হায়বে রহমত! কপালে জুটছে শুধুই অবহেলা।

নেই কারো সামান্য তম সহানুভুতি। দুটি সন্তান নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছি।

রোজার শুরুতেই আমার স্বপ্ন ছিল,হয়তে সবার চেষ্টায় ভালো একটা চাকুরী হবে। অন্তত রহমতের মাসে আমার উপর রহমত নেমে আসবে। কিন্তু বাস্তব যে এতোটা কঠিন তা আমি স্বপ্নেও ভাবি নাই।

কিছু পরিচিত জন সামান্য কিছু সাহায্য করেছে যা দিয়ে কোন রকমে পার করছি রোজার এ দিন গুলো। আসলে এবারে রোজার দিনগুলো বেশ কষ্টের মাঝে কাটছে।

আজও পারলাম না মেয়ে দুটোকে ভালো কোন ইফতার খাওয়াতে। সারাটা দিন রোজা রাখার পর মনটা চাই একটু ভালো ইফতার করতে। কিন্তু সীমাবদ্ধতার জন্য সেটাও সম্ভাব হয় না।

কি ভাবে যে দিন গুলো কাটছে সেটা আসলে কোন শব্দ বা বাক্য দ্বারা বোঝানো সম্ভাব নয়।

একজন মহান মানুষ আমাকে কিছু অর্থ দিয়ে ছিলো মেয়েদের কিছু কিনে দেবার জন্য,আমিও টাকাটা রেখে ছিলাম অন্তত ঈদে ওদের কিছু কিনে দিবো। বাস্তবতা এতোটায় নির্মম যে সে টাকাটা সংসারেই খাবারে জন্য খরচ করতে হলো।

প্রচন্ড গরম আজ মনে হয় জানটা এখনি বের হয়ে যাবে। ঘামে সমস্ত শরীর ভিজে গেছে। তাই আর সহ্য হচ্ছে না। সামনে খোলা পার্ক তাই গাছের নীচে একটু বসলাম। কেমন যেন চোখের পাতাটা ভারী হয়ে উঠলো আর মনে হতে লাগলো কবে যে শেষ বার নিজের জন্য ঈদে কিছু কিনে ছিলাম সেটাই মনে করতে পারছি না। হঠাৎ দমকা ঝড়ো বাতাসে আমার তন্দ্রা ভাঙলো চারি দিকে প্রবল বাতাস মনে হয় প্রচন্ড ঝড় হবে। আসলে বিধাতার লীলা বোঝা ভার কখন যে উনি ককি করেন তা উনিই জানেন।

অবশেষে প্রচন্ড বৃষ্টিতে ভিজে বাসায় আসলাম।

আমার ছোট মেয়ের যেন বায়নার কোন শেষ নেই, তাকে এটা ওটা কিনে দিতে হবে। কিনে দিতে হবে ঈদের নতুন পোশাক।

বাসায় আসা মাত্রই তার আবদারের ঝুড়িটি মেলে ধরে আমার সামনে।

”আব্বু আমাকে তুমি কিছু কিনে দিবে না?”

দিবো মা, কটা দিন পরে।

“আর কতো পরে? ঈদ যে চলে এসেছে?”

আমি শুধু ওর মাথায় হাত দিয়ে বললাম তোমারও সব হবে। এ সময় আমি ওর দিকে কোন ভাবেই তাকাতে পারিনাই কারন পাছে ও আমার চোখের জল দেখে ফেলে!

মনে মনে ভাবছিলাম এ যেন নিজের সাথে নিজের সুনিপুণ প্রতারনা।

মাঝে মাঝে চিন্তা করি অনেকে জাকাতের টাকা দেবার লোক খুঁজে পায় না আর আমাকে কটা টাকার জন্য আজ নিজের চোখের জল লুকিয়ে রাখতে হয়। হেরে যেতে হয় বার বার আমার মেয়েদের কাছে। জানি না কি বড় অপরাধ ছিলো আমার বিধাতার কাছে?

এ সব চিন্তা করতে করতে সময়ের সাথে বাড়তে থাকে আমার বুকের ব্যাথা। তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে এক সময় আমি আমার চেতনা শক্তি হারিয়ে ফেললাম।

হ্যাঁ সে সময় আমার হার্টে আবারো ব্লক হলো। বুকে প্রচন্ড ব্যাথা নিয়ে আমি বাসায় । মেয়ে দুটি আমার কাছে আসলো,ওদের দুচোখে পানি টলমল করছে।

মেয়েরা বলল, –

”আব্বু ঈদ তো সারা সময় করলাম,সামনে তো আবার ঈদ আসবে তখন নয় আমরা ঈদ করবো।”

এ কথা শুনে যেন আমার বুকের সমস্ত পাজরগুলো ভেঙতে লাগলো,আমি আমার চোখের পানি ধরে রাখতে পারলো না হাওমাও করে কাঁদতে শুরু করলাম। মেয়েদের সান্তনা যেন আমার বুকের মাঝে এক প্রবল ঝড় সৃষ্টি করলো।

সারাটা সময় আমি ভাবতে লাগলম কি ছিল আমার অন্যায়? যার কোন উত্তর আমার জানা নেই। আগেই বলেছি আমি খুব সাধারন তাই সব কিছুই আমাকে মুখবুজে সহ্য করতে হয়।

সমাজের সমঅধিকার এর জন্য প্রতিবাদ করার মতোন আমার পাশে কেউ নেই। এ যেন স্বাধীন দেশে পরাধীনতার এক অনণ্য সহ অবস্হান।

এদিকে দিন গড়াতে থাকে ঈদের আর কিছু দিন বাকী আমার হার্টের ব্লকটা আস্তে আস্তে যেন আমার সমস্ত জীবনীশক্তি ম্ল্যান করতে থাকে। এ দিকে আমার মেয়ে দুটি বার বার আমার কাছে আসে নানা সময় এটা ওটার বায়না করে ওরা, ছোট মেয়েটা বেশী করে বায়না করে, কারন সে তো বুঝতে পারছে না কোন অজানা ঝড়ে আজ আমি বিধ্বস্ত। কেবল আমার চোখের জল আজ আমার এক মাত্র সম্বল। ছোট মেয়েটাকে সরাসরি না করতে পারলাম না শুধু মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম ,

” মা তোমার যা লাগে সব এনে দিব।”

মেয়ে আমার অশ্রূশিক্ত নয়নের দিকে তাকিয়ে কি যেন এক অজানা শান্তনা নিয়ে পাশের রুমে চলে যায়।

আমার বড় মেয়েটা শুরু করে টিউশনি, হয়তো সে বুঝে গেছে তার জীবনের পড়াশুনার পাঠটা বোধ হয় এবার চুকলো।

ও আপনারা সবাই হয়তো নিশিকে চিনেন, হ্যাঁ সে আমার ভালোবাসা। আমার চাকুরী যাবার পরে সে যেন কেমন হয়ে গেছে।

সময় হয়তো আমার সংসারটাকে আর এক সূতায় বাঁধতে পারবে না। ঈদের বাকী আর কদিন দিন ক্রমে ক্রমে রাত গভীর থেকে গভীর হতে লাগলো আর আমি একান্ত মনে ভাবতে লাগলাম আমার জীবনের কথা, জীবনে বয়ে যাওয়া হঠাৎ ঝড়ের কথা।

কদিন পরে ঈদ হবে, সবাই আনন্দে মাতোয়ারা হবে। কেবল সবার অড়ালে আমি আর আমার মেয়েরা পার করবে ভয়াবহ এক দীর্ঘ্য দিন।

চরম বাস্তবতার কাছে হেরে গেল আজ আমার সমস্ত জীবন।

সমাজের কেউ কি পারে না একটা সাজানো সংসারের ভাঙ্গা রুখতে ?

কেউ কি পারে না আমার মেয়েদের দুচোখের স্বপ্ন পূরণ করতে?

সমাজের লোকদের চরম অবহেলা দিয়েছে আমাকে মৃত্ত্যর অদৃশ্য সনদ।

এ সব ভাবতে ভাবতে আমার সমস্ত শরীর ঘেমে উঠলো,বুকের চাপটা চারিদিক দিয়ে ক্রমশ বাড়তে লাগলো, ঐ দূরে জ্বলে থাকা আলোটা কেমন যেন আরো দূরে সরে যেতে লাগলো,চারপাশের শব্দগুলো কেমন যেন অস্পষ্ট মনে হতে লাগলো আমার কাছে। এর মাঝে আমার চোখে ভেসে উঠলো ঝলমলে আমার মেয়েদের মুখ আর আবছা সরু ঈদের এক ফালি নতুন চাঁদ।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত