ঝিরঝিরে বৃষ্টি পড়ছে এখন। দুই পকেটে হাত ঢুকিয়ে মাথা নিচু করে হাঁটছি। ঝিরঝিরে বৃষ্টিটা উপভোগ করছি। ঝুম বৃষ্টি নামলে কোথায় আশ্রয় নেয়া যায় এমন ভাবনায় বিভোর। এর মাঝেই শুরু হলো কান ফাটানো বজ্রপাত। ভেবেছিলাম হবে বৃষ্টি। মুরব্বিরা বলেন বেশি বজ্রপাত হলে নাকি বৃষ্টি তেমন একটা হয় না। এমনটা ভেবেই নির্ভার হয়ে হাঁটা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ ঝুম বৃষ্টি শুরু হলো। নিমিষেই ভিজে গেলাম। তাতে অবশ্য আমার অত ঝামেলা ছিল না। সাথে তেমন প্রয়োজনীয় কিছুও নেই। কিছুক্ষণ পর প্রচণ্ড ঠান্ডা লাগতে শুরু করল। নাহ, এখন আর ভেজা যাবে না। বন্ধ একটি চায়ের দোকান দেখতে পেয়ে এগিয়ে গেলাম। দোকানের সামনের অনেকটা জায়গা চালা দিয়ে আটকানো।কয়েকজন অনায়সে আশ্রয় নিতে পারবে। ওখানে কেউই নেই। একা দাঁড়িয়ে বৃষ্টির ফোঁটাগুলোকে আছড়ে পড়তে দেখছি মাটিতে।
কিছুক্ষণ পর কাউকে দৌড়ে আসতে দেখলাম। আরো ভালো করে বললে একটি নারী অবয়ব দৌড়ে আসছে। রাত বেশি না হলেও বৃষ্টির সময় রাতটা একটু বেশিই মনে হয়েছিল। কোন দিকে না তাকিয়ে সোজা দোকানে এসে উঠল। বৃষ্টির কারনে চুলগুলো সব লেপ্টে আছে মাথায় আর গালের সাথে। ভ্রু জোড়া ঘন। ঘন মানে একেবারেই ঘন। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে ঘন ঘন। মাথায় চিন্তা ভর করল, মেয়েটা এদিকে কেন। সন্ধ্যার পর এদিকে আড্ডাবাজ ছেলে ছাড়া তেমন কেউ পা দেয় না। তাহলে মেয়েটা কেন। আমাকে চমকে দিয়ে মেয়েটা বলেছিল “আমি এদিকে কেন সে চিন্তা না করে অন্য ভাবনা ভাবতে পারেন।।” হা করে তাকালাম মেয়েটার দিকে। আমি কি ভাবছি সেটা জানল কেমন করে!
এদিকে সন্ধ্যার পর তেমন কেউ আসে না তাই আপনার ভাবনা জানতে আমার কেন কারোরই সমস্যা হবার কথা না।”
কোন উত্তর না দিয়ে তাকিয়ে আছি ওর দিকে। অদ্ভুতুড়ে লাগছিল।
“আপনার নাম তো শহীদ তাই না?”
এবার কি আমার ভয় পাওয়া উচিৎ? চেনা জানা হীন একটা মেয়ে নাম জানে আমার।
“ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আপনি যেই বাসায় থাকেন তার তিন তলায় আমরা থাকি। আজ কাজ থেকে ফিরতে দেরি হলো তাই আটকে গেছি।”
আটকে রাখা নিঃশ্বাসটা ধীরে ছাড়লাম। যাক এবার তাহলে চিন্তামুক্ত থাকা যায়।
“আপনি দেখবেন কিভাবে! নিজের ঘরের লোকেরই তো খবর নেন না। আবার অন্য মানুষের খবর কিভাবে নিবেন!” কন্ঠে রাগ ছিল কিছুটা।
ঠিকই বলেছে। মামা মামীর সাথে থাকি আজ পনের বছর। কিন্তু ঠিক মতো খবর নিই না। চুপচাপ থাকি। হয়তো ছোটবেলার ভয়টা এখনো তাড়িয়ে বেড়ায়। পান থেকে চুন খসলেই মামীর মার একটাও মাটিতে পরত না। তাদের প্রতি বিতৃষ্ণা চলে এসেছিল। এখনো আছে। যাওয়ার মতো জায়গা পাচ্ছি না বলে এখনো আছি। আরো একটি কারন আছে। না হলে কবে চলে যেতাম!
তারপর উনিও চুপ ছিল আমি চুপ। কিছুক্ষণ পর বৃষ্টি কমে আসল। আগের মতো ঝিরঝিরে। বিদ্যুৎ চমকটা ছিল না আর। তাই কিছুটা অন্ধকার হয়ে আছে। অন্ধকার ভেদ করে মেয়েটা আবার বলে উঠল, “চলুন একসাথে যাই। জানা মতে আপনার কোথাও থাকার জায়গা নেই। রাগ করে কি হবে! চলুন বাড়ি যাওয়া যাক।” কথাটা বলেই মিহি স্বরে হেসে উঠল।
কিছু না বলে হাঁটা ধরলাম তার সাথে। মেয়েটা ঠিকই বলেছে। রাগ করে আমার মতো ছাপোষা মানুষের পৃথীবিতে বেঁচে থাকা অমুলক।
অফিসে প্রমোশন হয়েছে। পারিশ্রমিকও বেড়েছে। কিন্তু সেটা আর বলতে যাইনি মামা মামী কাউকে। কিন্তু বিষয়টা কিভাবে যেন জেনে যায়। সকালে এনিয়ে কথা কাটাকাটি হয়েছে। খুব ছোট থেকে আমাকে দেখে আসছে বলে তাদের ছেড়ে কোথাও যেতে পারি না। বিবেক বাধে। তার চেয়ে বেশি বাধে জুলিয়ার জন্য। পিচ্চিটা এবার নবম শ্রেণীতে। পিচ্চি বলা ঠিক হলো না। অনেকটা বড় হয়েছে। মামার একমাত্র মেয়ে। পিচ্চিটা হয়তো বসে আছে এখনো। একসাথে খাবে। তাদের মায়াটা ও ই ধরে রেখেছে। “দাদা” বলে যখন ডাক দেয় তখন শত মন খারাপ থাকলেও মনটা খুশি হয়ে যায়। হয়তো দড়জা খুলতে খুলতে বলবে “এতক্ষণে আসার সময় হলো দাদা! সেই কখন থেকে বসে আছি।”
এসব ভাবতে ভাবতে বাড়িতে এসে গেলাম। ঘরের সামনে দেখি জুলিয়া দাঁড়িয়ে। মেয়েটার দিকে তাকালাম। লাইটের আলোতে এবার ভালোমতো দেখলাম। গড়পড়তা গায়ের রং। তবে চোখ দু’টো মায়া মেশানো। অল্প করে হাসলাম।
“এবার যাই তাহলে। পরে আবার কথা হবে।” মৃদু হেসে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল। আমিও “আচ্ছা” বলে মাথা নাড়িয়ে ঘরের দিকে পা বাড়ালাম।
“কার সাথে কথা বলছিলে দাদা?” প্রশ্নটা স্বাভাবিক। কিন্তু কন্ঠটা যেন কেমন শোনালো।
“দেখতেই তো পেলি।”
ও কিছু বলল না আর। অদ্ভুত চাহনি দিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। তারপর নিজের ঘরে চলে গেল।
রিক্সায় আমি আর জুলি। আমি ছোট করে ডাকি। ও কোচিংয়ে যাচ্ছে আর আমি কাজে। যদিও এখনো ঘন্টা দুই বাকি। কিন্তু এই সময়টা আমি বাইরেই কাটাই। আজকে কোথাও বসব না। পোস্তগোলা ব্রিজের উপর যাব। উপর থেকে নদী দেখব। যদিও বুড়িগঙ্গায় দেখার মতো কোন সৌন্দর্য নেই। নিরামিষ জীবনে এটাই বিনোদন।
জুলির ডাকে ভাবনা থেকে ফিরে এলাম। এখন নেমে যাবে। আজকে আমাদের মাঝে কোন কথা হয়নি। অন্যদিন কত হাসি তামাশা হয়। হয়তো আমি নিজের ভাবনায় ডুবে থাকায় ও আর বাধা দেয় নি। অল্প হেসে জিজ্ঞেস করলাম, “তোর কিছু লাগবে জুলি?”
কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল আমার দিকে। “তুমি নিজের খেয়াল রেখ দাদা। তারাতারি ফিরো আজকে। তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে।”
“সেটা কি?”
“এখন বলব না। তবে তুমি ইদানিং কেমন যেন হয়ে গেছ। খেয়াল রেখ।”
“এটা কি আজ নতুন দেখিস? যা ঠিকমতো পড়ালেখা কর।”
“আচ্ছা! তুমি কিন্তু তাড়াতাড়ি ফিরবে। ঠিক সাতটায়। এর আগেই তোমার অফিস ছুটি হয়ে যায়।”
“আচ্ছা ফিরব।”
ওর চলে যাওয়া দেখছি। পিছন ফিরে হাত নাড়ল, সাথে মৃদু হাসি। আমিও হাসি দিয়ে জবাব দিলাম।
ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে আছি। বাতাসটা ভালোই লাগছে। কিছুক্ষণ পরপর গাড়ি ছুটে যাচ্ছে ফেরিঘাটের উদ্দেশ্যে। কতক্ষণ ছিলাম জানি না। মোবাইলের শব্দে ঘোর কাটল। জামান ভাই ফোন করেছে। উনি হয়তো চলে এসেছে। কলটা কেটে দিলাম। অফিসের দিকে পা বাড়ালাম। ব্যাস্ততা শুরু হবে, চলে যাবে একটি দিন।
নিয়মিত কাজ শেষে যখন বাড়ির পথ ধরলাম তখন ভিক্টোরিয়া পার্কের ভিতর থেকে কেউ একজন ডাক দিল। পাশ দিয়েই যাচ্ছিলাম। তাকিয়ে দেখি কালকের সেই মেয়েটা। হাত নেড়ে যাওয়ার জন্য বলছে। পাশে একটি ছেলেকে দেখতে পেলাম। বেশ হাসিখুশি। আমার জীবনটাও যদি হাসিখুশি হতো!
ওদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। হাসিমুখে জিজ্ঞেস করল, “কেমন আছেন?”
“জ্বী ভালো।”
“বাড়ি যাচ্ছেন?”
“হুম!”
“আজ এত তাড়াতাড়ি?”
“এমনি।”
“আপনি কি এমনই? এত অল্প কথা কিভাবে বলেন?”
কিছু বললাম না। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম।
“আচ্ছা বাদ দিন। পরিচয় করিয়ে দেই। এ হচ্ছে আমার বন্ধু মাহতাব। মাহতাব, উনি শহিদ। ওনার কথাই বলেছিলাম।”
ভ্রু কুচকে তাকালাম। এখানে এমন নাম। হতেই পারে এমনটা। লম্বায় প্রায় ছয় ফুটের মতো হবে। চওড়া কাঁধের অধিকারী ছেলেটা। হাসি মুখে হাত মেলালো আমার সাথে।
“আপনার নামটা তো জানা হলো না?”
“পরে জানতে পারবেন। এখন না হলেও চলবে।” হেসে উত্তর দিল মেয়েটা। আবার বলতে শুরু করল, “আজকে মাহতাবের জন্মদিন, আমাদের আজকে ও ট্রিট দিবে। তাই না মাহতাব?” ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল মেয়েটা। হাসিমুখে মাথা নাড়ল মাহতাব। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। বাড়িতে যেতে হবে, জুলি কি জানি সারপ্রাইজ দিবে। ওটার জন্য মন উতলা হয়ে আছে।
ইতস্তত করছি দেখে মেয়েটা বলল, “জুলিকে আপনার জন্য বেশি সময় অপেক্ষায় থাকতে হবে না। ছেড়ে দেব আপনাকে তাড়াতাড়িই। অল্প সময় লাগবে চলুন।” বলেই হাঁটা শুরু করল। আমি এবারও বেশ অবাক হলাম। আমাদের খবর ও জানল কেমন করে? হয়তো জুলির সাথে ভাব জমিয়ে ফেলেছে তাই খবরাখবর মোটামুটি জানে। আমি পা বাড়ালাম ওদের পিছুপিছু।
একইসাথে হাঁটছি আমরা। ওরা নানা ধরনের কথা বলছে ওদের মাঝে। কিছুটা ফিসফিসিয়ে। তাই গতি একটু কমিয়ে ওদের পিছনে গেলাম। চারদিকে চোখ বুলালাম এবার। মানুষজন কেমন যেন কমতে শুরু করেছে। এদিকের মানুষজন তো এত তারাতারি বাড়ি ফিরে না। হয়তো আজ ব্যাতিক্রম। সবসময় যে নিয়ম মানতে হবে এমন কোন কথা নেই।
একটু পর খেয়াল করলাম আশপাশ কেমন যেন অপরিচিত লাগছে। চেনা রাস্তাঘাট এখন অচেনা ঠেকছে। কিছুটা ভয় পেয়ে গেলাম। জন মানুষের কোন চিহ্ন দেখছি না এখন। শুনশান নিরবতা গ্রাস করেছে চারদিক। ওদের দিকে তাকালাম এবার। সোজা আমার দিকে চেয়ে আছে। কয়েক ফুট দুরে আছে অবশ্য। কিন্তু চাহনিতে কেমন যেন একটা বিষয়, ঠিক ধরতে পারছি না। ধীরে হেঁটে এলো আমার কাছে। ছেলেটা গাল প্রসারিত করে হেসে উঠল। ঘেমে উঠছি এবার। ভয়টা একেবারে বুকের গভিরে গিয়ে আঘাত করেছে। এরা আমার চেনা পৃথীবির কেউ না। অন্য কোথাও থেকে এদের আগমন। কিন্তু ওরা কি চায় আমার কাছে।
পায়ে যেন শিকর গজিয়ে গেছে। এমন পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। কি থেকে কি হলো বুঝতে পারছি না। মেয়েটা সামনে এগিয়ে আসছে। দাঁড়াল মুখোমুখি।
“শহিদ! তুমি তো তোমার জীবন নিয়ে তেমন তৃপ্ত নও। হতাশায় ভোগ আর ভাবো এমন কেন হলো! পৃথীবিতে তোমার কেউ নেই। একেবারে পিছুটান মুক্ত একজন মানুষ।” এতটুকু বলে একটু থামল। “এই যে মাহতাবকে দেখতে পাচ্ছ, ও আর বেশি দিন বাঁচবে না। কিন্তু সবাই চায় বেঁচে থাকতে। তাই ওর বাঁচার একটা উপায় আমরা আবিষ্কার করেছি।” এতটুকু বলে হাসল।
“কিন্তু এসবের সাথে আমি কেন?” কথাগুলো জড়িয়ে আসছে। আমার কোন পিছুটান নেই বলে কি বাঁচার কোন ইচ্ছে থাকবে না নাকি।
“ওকে তোমার শরীরে স্থাপন করে ওকে বাঁচিয়ে রাখতে পারব। এর জন্য তোমার মতো কাউকে খুঁজছিলাম। পেয়েও গেলাম।” ছেলেটার মুখে বিজয়ী হাসি।
শেষ পর্যন্ত এই ছিল! পরগাছা হয়ে বেঁচে থাকতে হবে আমাকে!
“তোমরা তাহলে কারা?” প্রশ্নটা করে নিজেই বোকা হয়ে গেলাম। জীবন বাঁচানোর সময় কিসব প্রশ্ন করলাম। হাসলো মেয়েটা।
“এইযে আমাকে দেখতে পাচ্ছ, আমি এই দেহে স্থানান্তরিত হয়েছি বছর দুই আগে। রুনু নামের মেয়েটার শরীরে। তাই তুমি আমাকে রুনু নামেই ডাকতে পার।”
“এর আগে কার শরীরে ছিলে তাহলে?” বিষয়টা কল্পনা করতে গিয়ে ঘাম বেড়িয়ে এলো কপলা বেয়ে।
“এটাই আমার প্রথম স্থানান্তর। তখন মাহতাব সাহায্য করেছিল। এখন ওর বেলায় আমারও করা উচিত। তাই তোমাকে বাছাই করেছি। তুমি মামুষটা ভালো। ভালো একজন মানুষ আর বন্ধু একই সাথে আমার পাশে থাকবে। কি চমৎকার একটি বিষয় হতে যাচ্ছে।”
এটাকে ওরা চমৎকার বলছে। হয়তো তখন আমার নিজের জীবনের প্রতি আর কোন নিয়ন্ত্রন থাকবে না। আমার সামান্য জীবনে পাওয়া স্বল্প আনন্দগুলো আর অনুভব করতে পারব না ভাবতেই শূন্যতা অনুভব করলাম। এর থেকে কি বের হবার কোন উপায় নেই!
“এসো তোমাকে আমাদের পৃথীবিতে নিয়ে যাই। ওখানে তোমাকে স্পর্শ করবে না কোন দুঃখ। দিন শেষে একজন মানুষের ভালোবাসা পাবার আকাঙ্ক্ষায় মন ছটফট করবে না। ওখানে সবাই তোমাকে ভালোবাসবে।”
হাতের তালুতে কিছু একটা করছে মেয়েটা। মাহতাব নামের ছেলেটা নিঃশব্দে আমার কাঁধে হাত রাখল। আমার চোখে চোখ রেখে হাসল অল্প। হয়তো আমার দ্বীধান্বিত মনের কথা বুঝতে পেরেছে।
মেয়েটার শেষের কথা আমার কানে যেন আনন্দ ঢেলে দিল। হ্যাঁ, দিন শেষে ওই ছোট্ট “দাদা” ডাকটি শোনার জন্য আমি সব করতে পারি, সব। নিরব পৃথীবিতে ওই একটুখানি ভালোবাসাটা আমি এভাবে হারাতে পারি না। অনেক বছর পর এই প্রথম বাড়ি ফেরার জন্য মনের মাঝে তীব্র আকাঙ্ক্ষা অনুভব করলাম।
মেয়েটার হাতে রূপালী আলোর একটু ঝলকে উঠল। তারপর ধীরে ধীরে তা বাড়তে লাগল। বিশাল এক চকতির মতো হলো এক পর্যায়ে।
ওপাশে কিছু লোকদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। তাদের মুখে হাসি। একজনকে দেখতে পেলাম প্রায় মাহতাবের মতো। মহিলা হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে। হয়তো নিজের ছেলেকে কখনো না হারানোর অনুভূতি পেয়ে বসেছে। তাই কোন দিকে তাকাচ্ছে না। শুধু ছেলের দিকেই তাকিয়ে আছে।
সবার জন্য সবাই কত ভালোবাসা নিয়ে অপেক্ষায় আছে। আমার জন্যও কেউ এখন বসে আছে। “দাদা”কে একটা সারপ্রাইজ দেবে বলে। আজকের পর হয়তো সারাজীবন মনের গহীনে চাপা কষ্ট নিয়ে বেড়াবে মেয়েটা। মিথ্যে অভিমান করে থাকবে। মনে করবে ওকে একা রেখে আমি হয়তো কোথাও চলে গিয়েছি। কিন্তু এমন এক জায়গায় গিয়েছি যেখানের খোঁজ কেউ জানে না। এমন একটি দেশ যার অস্তিত্ব সম্পর্কে কারো কোন ধারনা নেই। অথচ দূরত্ব মাত্র একটি রূপালী আলোর বাঁধা।
পানির ধারা বেয়ে পরল গাল বেয়ে। সামনে তাকিয়ে আছি। দেখছি তাদের উল্লাস।
ওপাশ থেকে কেউ একজন বেরিয়ে এলো। আমার সামনে এসে দাঁড়াল। চোখের পানি দেখে কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে গেছে। নিচু হয়ে হাত রাখল মাথায়। একটা ঝাটকা খেলাম। হয়তো এখনই আমার অন্তিম মুহূর্ত চলে এসেছে।
গম্ভীর স্বরে বলে উঠল, “তোমার এই মনের অনুভূতি যদি আরো আগে জাগিয়ে তুলতে তাহলে আজ এমন হতো না।” চোখ তুলে তাকালাম। কথিত রুনু বিভ্রান্ত হয়ে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। পরাজয়ের অনুভূতি দেখছি ওর চোখে।
“আমরা তোমাকে চাইলেই নিয়ে যেতে পারি। কিন্তু এটা অন্যায় হবে। এমন নিয়ম আমরা তৈরী করি নি যেটা কারো বিপক্ষে যায়।” রুনুর দিকে ইশারা করে “ওর আরো পর্যবেক্ষণ করা উচিত ছিল।” কিছু একটা বলতে চাচ্ছিল রুনু। ইশারায় থামিয়ে দিল।
এখন কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না। সব মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।
লোকটা হাতের ইশারা করতেই আকাশ থেকে কিছু একটা নেমে এলো আমার কাছে। মাহতাব মন খারাপ করে সরে দাঁড়াল। তারপর অন্ধকার গ্রাস করল আমাকে।
টুংটাং শব্দে জেগে উঠলাম। ফর্সা হয়ে আসছে প্রকৃতি। কয়েটা রিক্সা ছুটছে এদিক ওদিক। মৃদু বাতাস বইছে। এখন আমি কোথায়? আমি কি ওই রূপালীর আলোর অন্যপাশে যেখানে আমাদের পৃথিবীর মতো রিক্সা চলে। চারপাশে ভালোমতো তাকিয়ে দেখলাম আমি এখন ভিক্টোরিয়া পার্কে বসে আছি। তারমানে আমি বেঁচে আছি!
এক লাফে দাঁড়িয়ে গেলাম। বের হয়ে এলাম ওখান থেকে। হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলাম, তারপর এক পর্যায়ে দৌড় শুরু করলাম। ফিরতে হবে আমাকে। আর কিছুর জন্য না হলেও ছোট্ট জুলির জন্য অবশ্যই। দৌড়াচ্ছি আর চোখের পানি মুছছি। পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্য অবমল্বন আমি পেয়েছি। শুধু একটি শব্দ “দাদা” আর একজনের ভালোবাসা।
দড়জায় কড়া নাড়ছি জোরে জোরে। অস্থির হয়ে আছি। দড়জা খুলল জুলি। আমাকে দেখে কেঁদে দিল মেয়েটা। হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে নিলাম। ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, “আমি মনে করেছি তুমি চলে গেছ দাদা!”
“না, যাইনি আমি!”
“কোথায় ছিলে সারা রাত?”
“কি যেন সারপ্রাইজ দিবি আমাকে?”
“ওটা নিয়েই তো বসে ছিলাম। কিন্তু তোমার কোন খবর নেই।”
“তা কি নিয়ে বসে ছিলি?”
চোখ মুছে ঘরে নিয়ে গেল আমাকে। টেবিলে কেক রাখা। ওতে সুন্দর করে লেখা “শুভ জন্মদিন দাদা”!
আসলেই আজ নতুন করে জন্ম হলো আমার। একজন সুখী মানুষ হিসেবে। যেখানে এখন আর নেই কোন অভিযোগ। রূপালী আলোর ওপাশের মানুষগুলো কিছু একটা শিখিয়ে গেল। কখনো জানতে পারব না ওরা কারা ছিল। তবে ভালো যে ছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই।
ছাদে এসে দাঁড়ালাম আমি আর জুলি। সূর্য অল্প উঁকি দিয়েছে পূবাকাশে। একটি নতুন ভোরের সুন্দর সূচনা হচ্ছে। ভোরের রোদ্দুর আমার গা ছুঁয়ে দিচ্ছে। ঝড়িয়ে দিচ্ছে সব না পাওয়াগুলো। আর সামনের সব পাওয়াগুলোর হিসেব বুঝিয়ে দিচ্ছে।