এক কাজিনের বিয়েতে গেছি বরযাত্রীর অনেকেই আসছে আমি কনের পাশে বসে আছি। বরযাত্রীর কয়েকজন কনে দেখতে এসে বলল বউকে একটু বেশি করে মেকাপ দিও নয়তো অন্ধকারে খুঁজে পাওয়া যাবেনা। আমি প্রতিবাদ করলাম বললাম কনে দেখতে ফর্সা এতো মেকাপ দেওয়ার প্রয়োজন নাই তো।
-বলল আরে আমরা তো ভাবছি আপনি কনে? -আমি বললাম কনে আমার পাশেরজন শাড়ি পড়লেই কি বিয়ের কনে নাকি? তারপর মন খারাপ হয়ে গেলো আমি এতোটাও কালো নই আব্বা মা তো বলে তুই কালো না শ্যামা, এবং শ্যামা মেয়েরা সুন্দর হয়। জানতাম তারা আমাকে শান্তনা দিতো তাছাড়া পৃথিবীর সব সন্তানই বাবা মায়ের কাছে সুন্দর। তবে আমাকে নিয়ে আমার আব্বা মায়ের দুশ্চিন্তার শেষ ছিলোনা কিভাবে এই মেয়েকে বিয়ে দিবে। কিন্তু তাই বলে আমাকে অন্ধকারে খুঁজে পাওয়া যাবেনা এমন তো না। খুব মন খারাপ করে বসে আছি এমন সময় এক ছেলে বলল,
-এই যে মিস আপনি কিন্তু সুন্দর আপনার চোখ দুটো অসাধারন আই থিংক আপনি হাসলে আরো সুন্দর লাগবে প্লিজ মন খারাপ করে থাকবেন না। আমি লজ্জা পেয়ে গেলাম নিজের এতো সুন্দর কমপ্লিমেন্ট জীবনেও শুনিনি।
-আমি হাসি হাসি মুখ করে বললাম সত্যি বলছেন নাকি পাম দিচ্ছেন?
-আই সয়ার সে গলা ছুয়ে বলল। দেন আপনার নাম্বারটা দেন বেশ ভালো বুঝতে পারছি মাঝেমাঝে আপনার মোটিভেশন দরকার আর আমার মত ফ্রি মোটিভেশন স্পিকার কোথাও পাবেন না। আমি খুব খুশি হয়ে ফোন নাম্বার দিয়ে দিলাম।
এরপর প্রায় প্রতিদিন ফোনে কথা হয়। একবছর চলে যাওয়ার পর আমরা ভালো বন্ধু হয়ে গেলাম আমি মনে মনে ভাবি আসিফ কি আমাকে কখনো ভালোবাসবে, প্রপোজ করবে? কারন ওকে আমার ভালো লাগে মোটামুটি সুন্দর আমার চেয়েও ভালো দেখতে। তারচেয়ে বড় কথা ও অসাধারন মনের একজন মানুষ। আমিই ওকে প্রপোজ করতাম কিন্তু দেখতে অসুন্দর কিনা যদি আবার এভোয়েড করে বন্ধুত্ব টা যদি নষ্ট হয়ে যায় তাই আর করিনা অপেক্ষা করি।
তারপর একদিন ওই দিন আসলো আসিফ নিজেই আমাকে প্রপোজ করলো একেবারে প্রস্তুতি নিয়ে ওর বন্ধুদের ডেকে পার্টির অ্যারেঞ্জমেন্ট করে সবার সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলো ওর বন্ধুরা শুভেচ্ছা জানালো। কিন্তু আড়ালে সবাই বললো আরে আসিফ এই মেয়েকে পছন্দ করছে কি দেখে। আসলে এসব কথায় আমার আর এখন মন খারাপ হয়না ছোট বেলা থেকে এমন কথা শত শত শুনে আসছি।
আসিফ বলে দেখো তানিসা সেদিন তোমাকে সবাই কালো বলছিলো তুমি যেভাবে মুখ ভারী করে ছিলে তখন তোমাকে দেখে আমার খুব মায়া হয় এরপর কথা বলতে বলতে তোমার ব্যবহার আন্তরিকতা আমাকে মুগ্ধ করে, তোমার চেহারার সাথে কিছু আসে যায়না। প্রথমে ভেবেছিলাম এটা ইনফ্যাচুয়েশন তাই তোমাকে কিছু বলিনি কিন্তু ধীরে ধীরে বুঝতে পারি আমি তোমার প্রেমে পড়েছি। তারপর ও সময় নিয়েছি তাছাড়া আমি জানি তুমি তোমার সম্পর্কে এসব কথা শুনে অভ্যস্ত কিন্তু আমার কাছে মানুষের ওসব কথার কোন ভ্যালু নাই। তুমি জেনে রেখো আমি তোমাকে তুমি যেমন তেমনটা নিয়েই ভালোবেসেছি, কখনো কোনদিন অভিযোগ করবেনা তুমি সুন্দর না আর আমি তোমাকে অবহেলা করেছি।
হ্যা জীবনে চলার পথে বাধা-বিপত্তি ঝামেলা আসবে মান অভিমান ঝগড়া হবে কিন্তু তোমার সৌন্দর্য নিয়ে আমাকে কখনো খোঁচা মারবেনা। সো আই লাভ ইউ, ডু ইউ লাভ মি? আমার চোখে পানি চলে আসলো। আসিফ শান্তনা দিয়ে বলল ঠিক আছে ইমোশনাল গার্ল আর কাঁদতে হবেনা আমি জানি তুমি আমাকে লাভ করো। আমার পড়াশোনা শেষ আসিফ ও জবে ঢুকলো কিন্তু ও কখনো বিয়ে কথা বলেনা। আমিও লজ্জায় কিছু বলিনা কারন আমি জানি আসিফ আমাকে প্রচণ্ড ভালোবাসে নয়তো আমার মতো কালো মেয়েকেই কেন পছন্দ করবে। ও অসম্ভব ভালো মনে একজন মানুষ। কারন ওর যদি অন্য ইনটেনশন থাকতো আমাকে নিয়ে, তাহলে আমি বুঝতে পারতাম ওর ব্যবহারে কখনো আমি সেটা উপলব্ধি করিনি আসিফ আমাকে অসম্মান করতে পারে তা ভাবতেও পারিনা। এরপর আমি ও একটা প্রাইভেট জবে ঢুকলাম। একদিন সাহস করে বলেই ফেললাম,
-আচ্ছা আমার যে বয়স হচ্ছে তা কি তোমার চোখে পড়ে?
-আসিফ হেসে বলে বয়স হলো তো কি হলো তোমার যেমন বয়স বাড়ছে আমারও বয়স বাড়ছে আমরা বুড়োবুড়ি হবো আমরাই বিয়ে করবো টেনশন কিসের?
আমাদের বিয়েতে খুব জাঁকজমক ছিলোনা যতটা জাঁকজমক ছিলো আসিফ যেদিন আমাকে প্রপোজ করেছিলো। বিয়ের পরে আসিফদের বাড়ি যাওয়ার পর প্রায় সবার মুখেই শুনতে হলো এত বাদ দিয়ে অবশেষে আসিফ কিনা এমন মেয়ে বিয়ে করলো!! তারপর আমার ননদের থেকে জানতে পারলাম এতদিন ধরে আসিফ বাড়ির মানুষদের রাজি করাতে পারছিলোনা। কারন তারা আমার সাথে বিয়ে দিবেনা সুন্দর বউ নিবে। অবশেষে আসিফ বলেছে তোমরা বিয়ে না দিলে আমি একা বিয়ে করবো বাড়িতে টাকা পয়সা দিবোনা তোমরা কি চাওনা আমি সুখে থাকি? তানিসা অসুন্দর হতে পারে কিন্তু অসম্ভব ভালো মেয়ে ওর সাথে সংসার করতে আমার যদি সমস্যা না হয় তাহলে তোমাদের কি সমস্যা। বাড়ির মানুষদের রাজি করাতে আসিফের অনেক কাঠখড় পোহাতে হয়েছে অথচ ছেলেটা আমাকে কিচ্ছু জানায়নি।আর আমি কিনা মাঝেমাঝে সন্দেহ করতাম ও আমাকে বিয়ে করবেনা ভেবে।
আমার মেয়ে হয়েছে আমার মত দেখতে, কিন্তু আমি ওকে আমার মত হেল্পলেস হয়ে থাকতে দেইনি ওকে বলেছি সৌন্দর্য তোমার চেহারাতে নয় সৌন্দর্য তোমার ব্যবহারে আচরণে আন্তরিকতায় এবং তোমার ট্যালেন্টে। তুমি এসব কিছু দিয়ে সৌন্দর্যকে কবজা করতে পারো অর্জন করতে পারো। শুধু শারীরিক গঠনের সুন্দর নিয়ে আর কিছুর যোগ্যতা অর্জন না করে সুন্দর হওয়া যায়না। আমার সামনে কখনো কেউ আমার মেয়ে অসুন্দর বলার মত জায়গা রাখিনি। আমি আমার মেয়েকে নিজের উপর কনফিডেন্ট অর্জন করতে শিখিয়েছি। তাকে আমার মত হীনমন্যতায় ভুগতে হয়না। কারন ও নিজেও বিশ্বাস করে সুন্দর মানেই শুধু শারীরিক সৌন্দর্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ না এর বাইরে ও অনেক কিছু আছে।
আমি ওকে বুঝিয়েছি যে তোমাকে ভালোবাসবে সে তোমাকে ভালোবাসবে তোমার অস্তিত্ব তোমার সত্তাকে ভালোবাসবে। তোমার বাবা যেমনটা আমাকে বেসেছে। যেমন এখন আমাকে আর লজ্জায় কুঁকড়ে থাকতে হয়না এখন কেউ আর আমাকে কথা শুনাতে পারেনা। যারা বলে তাদের সুন্দর করে বুঝিয়ে দেই সৌন্দর্যের আসল মানে।।
গল্পের বিষয়:
গল্প