কায়নাতের বেঁচে থাকার কথা নয়। মরে গেলেও এই মুহূর্তে তার জাহান্নামে থাকার কথা। আর সেখানে অনমের থাকার কথা নয়। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে অনম সেখানে উপস্থিত। অনম কি তবে জাহান্নামের কোনো ফেরেশতা, যে তাকে শাস্তি দিতে এসেছে? হবে হয়তো। না হলে সে তাকে থাপ্পড় মারলো কেন?
পিটপিট চোখে অনমের দিকে একবার তাকিয়েই চোখ বন্ধ করে ফেলে কায়নাত। বিড়বিড় করে বলে, ‘মরার পরেও বুঝি কেউ স্বপ্ন দেখতে পারে? আশ্চর্য তো!’ তৎক্ষনাৎ আরো একটা থাপ্পড় পড়ে তার বা’ গালে। কায়নাত এবার ধড়ফড় করে চোখ খুলে। হতভম্ব দৃষ্টিতে দেখে সে আসলে জাহান্নামে নয়, হসপিটালের কোনো এক ক্যাভিনের বেডে শুয়ে আছে। আর তার সামনেই অনম নামের লাল চোখের ছেলেটা দাঁড়িয়ে। খানিক দেরি হলেও বিষয়টা বুঝতে পেরে কায়নাত একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে। শেষ পর্যন্ত মৃত্যুও তার সহায় হলো না। কিন্তু অনম এখানে কেন? সে তাকে মারলোই বা কেন? করুণ এবং কৌতূহলী চোখে সে অনমের দিকে তাকালে অনম তার দিকে দুই পা এগিয়ে আসে। স্বভাবসুলভ তার গাল চেপে ধরে। দাঁতে দাঁত চেপে বলে, ‘মরার শখ তো মরবি। সাথে দুইটা প্রাণ নেওয়ার অধিকার কে দিলো?’
চমকে উঠে কায়নাত। অনম কি বললো একটু আগে? দুইটা প্রাণ? একটা না হয় তার পেটের বাচ্চা টা। আরেক জন কে? অনম? সে কি নিজের কথা বলছে? চিকচিক করে উঠে কায়নাতের চোখের কোণ। হসপিটালে কায়নাত কে আরো দুই দিন থাকতে হয়। বাকি দুই দিনে অনমের দেখা সে পায়নি। বাড়ির ফেরার দিন খুব করে চাইছিল অনম আসুক। নিষিদ্ধ একটা ইচ্ছে, তবুও চাইছিল। কিন্তু অনম আসে নি। আসবেই বা কেন? তার তো আসার কথা নয়। যার আসার কথা ছিল সে তো চলে গেছে দূরে, বহুদূরে। কায়নাত ভেবেছিল অনম হয়তো চলে গেছে চট্টগ্রামে। কিন্তু বাড়ি ফিরে সে অবাকের চূড়ান্তে। অনম, তার বাবা এবং সাথে আরো একজন বৃদ্ধ লোক তাদের অপেক্ষায়। অনমের বাবা তাকে দেখে মুখ কালো করে ফেলেন। কায়নাত দৃষ্টি নামিয়ে নিজের ঘরে চলে যায়।
কিছুক্ষণ পরই তার মামা তার ঘরে যান, হাতে টুকটুকে লাল একটা শাড়ি। কায়নাতের সামনে শাড়িটা রেখে খানিকটা শক্ত গলায় আদেশের সুরে বলেন, ‘শাড়িটা পড়ে রেডি হয়ে নিচে আসো। আজ তোমার বিয়ে।’ যদিও কায়নাত এমন কিছুই অনুমান করেছিল, তবুও সে হতবাক। নিচু আওয়াজে বললো, ‘বিয়ে করার মতো মানসিকতা আমার নেই, মামু।’ কায়নাতের মামার কিছু বলার আগেই অনমের গম্ভীর ঝাঁঝালো আওয়াজ কানে আসে তার, ‘থাপ্পড় কম পড়েছিল নাকি কেবল শব্দই হয়েছিল?’ কায়নাত কাঁচুমাচু মুখ করে অনমের দিকে তাকায়। থাপ্পড় কম পড়লেও কেবল শব্দ হয় নি। খুব গভীর ভাবে লক্ষ্য করলে তার গালে এখনো পাঁচ আঙুলের দাগ পাওয়া যাবে নিশ্চিত। কায়নাতের ভাবনার মাঝেই অনম তার সামনে চলে আসে। মামার দিকে তাকিয়ে নির্লিপ্ত গলায় বলে, ‘আমি কায়নাতের সাথে কথা বলতে চাই, একান্ত ভাবে।’
তার মামা এক মুহুর্ত দেরি না করে চলে যান ঘর ছেড়ে। অনম তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তে তাকায় কায়নাতের দিকে। আগের আওয়াজেই বলে, ‘কি সমস্যা?’ কায়নাত দৃষ্টি নামিয়ে নেয়। ভাঙা গলায় জিজ্ঞেস করে, ‘কেন বিয়ে করতে চাইছেন আমায়?’ ‘ভালোবাসি, আর দ্বিতীয় কোনো কারণ খুঁজতে চাই না আমি।’ অনমের কাঠ কাঠ জবাবে কায়নাত মিনমিন করে বলে, ‘আমি নিজের কাছে নিজে ছোট হয়ে যাবো। আর সবার কাছে স্বার্থপর।’ ‘এর জন্য আমি নিজের জীবন নষ্ট করতে পারি না।’ ‘আপনার জীবন নষ্ট হবে আমাকে বিয়ে করলে।’ ‘আমি বুঝে নেবো।’ কায়নাত দীর্ঘশ্বাস ফেলে। অনমকে বুঝানো আসলেই কষ্টসাধ্য, তবে অসম্ভব নিশ্চয়ই না। সে ধপ করে বিছানায় বসে পড়ে। দু’হাতে মুখ ঢেকে বলে,
‘বুঝতে কেন চাইছেন না? অন্যের সন্তান কে নিজের মনে করা সহজ। কিন্তু তাকে মেনে নেওয়াটা সহজ নয়।’
‘যদি কখনো আমার জন্য তোমার অস্তিত্বের উপর বিরূপ প্রভাব পড়ে, তবে সেদিন থেকে মুক্ত।’ ‘আর আপনার পরিবার?’ প্রথমবারের মতো অনম করুণ দৃষ্টি তে তাকায়। কায়নাতের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। কাতর স্বরে বলে, ‘অনেক তো লড়াই করেছো। পরিবারের সাথে, নিজের সাথে, মনের সাথে.. একবার এবং শেষবার না হয় আমার জন্য আমরা করলাম, একসাথে। দুজনে।’ দীর্ঘ জীবনে সুখের কান্নার সাথে কায়নাতের পরিচয় ছিল না। তবে সে আন্দাজ করতে পারে আজকের, এখনকার কান্নাটার নামই হয়তো সুখের কান্না। দ্বিতীয় বারের মতো কায়নাত স্বার্থপরের মতো আচরণ করে। অনমের হাত ধরে নতুন একটা যুদ্ধে নামে, সুন্দর একটা যুদ্ধে।
পরিশিষ্টঃ কায়নাত ভেবেছিল প্রণবের সাথে হয়তো কখনো তার দেখা হবে না। কিন্তু প্রকৃতি তার ধারণা কে ভুল প্রমাণিত করে দিয়ে দুজনের দেখা করায়। হসপিটালের করিডরে তাদের দেখা হয়, অনেক গুলো দিনের পার্থক্যের পর।
কায়নাতের হসপিটালে যাওয়ার কারণ ছিল তার ডেলিভারি। ফুটফুটে একটা মেয়ে হয় তার। অনম কেঁদেকেটে একাকার। কায়নাত যতটা না শারীরিক কষ্ট পেয়েছে, তার থেকে কয়েক গুণ বেশী মানসিক যন্ত্রণায় কাটিয়েছে অনম। নাওয়া খাওয়া ছেড়ে হসপিটালে পড়েছিল। হসপিটাল ছাড়ার আগে সবাইকে ডেকে ডেকে মিষ্টি খাইয়েছে সে। কায়নাত তার এই পাগলামো, দমবন্ধ ভালোবাসা সম্মোহনের মতো উপভোগ করে। মনে মনে সহস্র বার ধন্যবাদ জানায় সৃষ্টিকর্তাকে, অনমের সাথে তার দেখা করানোর জন্য। সেদিন একই হসপিটালের একই করিডরে আরো একজন ছিল, যে মানসিক যন্ত্রণায় কুঁড়ে কুঁড়ে মরছিল। তবে তার যন্ত্রণা অনমের মতো মিষ্টি ছিল না, তিক্ততায় ভরা ছিল।
প্রণব কায়নাতের বিয়ের কয়েক দিন পরই তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী সিনজা কে নিয়ে দেশে ফিরে আসে। দীর্ঘ জার্নি এবং একটা দূর্ঘটনার পর জানা যায় তার মিসক্যারেজ হয়। কায়নাতের ডেলিভারির দিনেই সিনজার অপারেশনে তার মৃত, জমজ দুইটি ছেলে-মেয়ের মুখ দেখতে হয় প্রণবকে। যাওয়ার আগে অনম যখন তাকে ডেকে মিষ্টি খাওয়ায় তখন সে হতবাক দৃষ্টি তে তাকিয়ে ছিল কেবল। মনের কোথায় একটা কেউ একজন বলছিল, কায়নাতের টুকটুকে এই মেয়েটা তার হলেও পারতো। অনমের জায়গায় সে-ও থাকতে পারতো হয়তো।
গল্পের বিষয়:
গল্প