২০০৫ সাল সবে মাত্র সপ্তম শ্রেনীতে শৈশব কাল শেষ করে কৈশোরে পদার্পন করি ।উড়ু উড়ু মন চারদিকে কেমন জানো রঙিন আর নতুনত্বের ছোয়াঁ ।নতুন নতুন ভালো লাগা নতুন সব অনুভূতি ! কেমন জানো সব কিছু ,কোন এক অদৃশ্য মায়া আমাকে জড়িয়ে নিয়েছিলো । কে জানতো আমার এই অনুভূতি আর আবেগই আমার জীবনের কাল হবে ! সকাল সকাল মা আমাকে ঘুম থেকে টেনে তুলে আড়মোড়া ভেঙ্গে ছোট ছোট চোখে মায়ের দিকে বেশ বিরক্ত নিয়ে তাকাই ।মা রিতীমত আমাকে কথা শুনাতে ব্যস্থ হয়ে পড়ে আর আমিও প্রতিদিনের মত না শুনার ভঙ্গিতে বসে থাকি ।আমি ঘুম জড়ানো কন্ঠে মা কে উত্তর দেই
-“মা আজ তো ছুটির দিন আজ তো একটু ঘুমাতে দেও!” কিন্তু মা শক্ত গলায় বলল
-“এত কিসের ঘুম ? সারারাত না ঘুমিয়ে কি চুরি করতে যাস !” মায়ের কথায় আমার মুখ ছোট হয়ে যায় আমি মুখ ভার করে মাকে বলি
-“হয়েছে মা আর কত বোকবে ? এবার বলো সকাল সকাল আমাকে কেন ঘুম থেকে উঠিয়েছো ?” মা আমার হাতে মিস্টির বক্স ধরিয়ে দিয়ে বলল
-“যা আরশি এগুলো তোর জেঠুর বাড়িতে দিয়ে আয় !” আমি মাকে প্রশ্ন করলাম
-“ কিসের মিষ্টি মা ?”
-“তোর বাবা এলাকার ব্যবসা সমিতীর সভাপতি হয়েছে সেই খুশিতে এই মিষ্টি যা তোর জেঠুকে দিয়ে আয় ।”
জেঠুর বাড়িতে যাওয়ার কথা শুনতেই আমার মন আনন্দে নেচে উঠে কারন আমার জীবন বাবার পরে যদি কেউ থাকে তা হলো আমার জেঠু ! নারায়ন দাস আমার বাবার বন্ধু উনাকে আমি জেঠু বলে ডাকি । আমরা মুসলিম পরিবারের আর নারায়ন জেঠু ছিলো হিন্দু ধর্মের ।দুই পরিবার দুই ধর্মের হলেও ছিলো গভীর সম্পর্ক আর আন্তরিকতা ।দুই পরিবার এক সাথেই সকল উৎস -পার্বন পালন করতাম ।জেঠুর চোখের মনি আমি !জেঠু সবসময় বলতো আমি না থাকলে নাকি সব পূজা পার্বন অপূর্ন থেকে যায় ।জেঠুর তিন ছেলে আর দুই মেয়ে ।মেয়ে দুটো একদম অপ্সরীর মত যেন স্বর্গ থেকে ভুল করে পৃথিবীতে চলে এসেছে ।আপু দুটো একদম জেঠি মায়ের মত হয়েছে অপরূপ সুন্দরী ।জেঠুর দুই ছেলে আর দুই মেয়েকে দেখলেও জেঠুর বড় ছেলে কে কখনো দেখিনি কারন সেই ভাগ্য হয়ে উঠেনি কখনো আমি যখন খুব ছোট ছিলাম তখনই তিনি ঢাকায় পড়তে চলে আসে ।
শর্ট কামিজ আর ডিভাইডেড পাজামা পড়ে দু বিনুনী করে মিষ্টির পেকেট টা হাতে নিয়ে ঢেং ঢেং করে রওনা দিলাম মালি পাড়ার উদ্দেশ্য । শুনেছি সেখানে যারা বসবাস করে তাদের পূর্বপুরুষ এক জমিদার বাড়ির মালি ছিলো সেখান থেকেই এই পাড়ার নাম হয়েছে মালি পাড়া ।আমার মালি পাড়া যেতে বেশ ভালো লাগে কারন সেখানে আমার সখী সৌমি ,ভৈরভী আর চন্দনা রয়েছে ,সখি বলতে হয়তো ভুল হবে কারন তারা আমার থেকে বয়সে বড় ছিলো কিন্তু আমাকে খুব স্নেহ করে ।তাদের সাথে পরিচয়টাও বেশ অদ্ভুদ ভাবে হয়েছিলো ।আমার বড় কাকা মেম্বার হওয়ায় এলাকায় আমাদের বাড়ির মেম্বার বাড়ি নামে বেশ নাম ডাক রয়েছে এর পাশাপাশি অন্য কারনেও আমাদের বাড়ি সবার কাছে বেশ পরিচীত আর তা হলো আমাদের বাড়ির উঠানে বেশ কিছু শিউলি ফুল গাছ আর বকুল ফুল গাছ আছে ।সৌমি ,ভৈরভী আর চন্দনা যখন ভোর সকালে পূজোর জন্য ফুল কুড়াতে আসতো সেসময়ই তাদের সাথে পরিচয় হয় ।আস্তে আস্তে তাদের সাথে গভীর সম্পর্ক হয়ে যায় এক সময় তারা আমার সখী হয়ে যায় ।তাদের সাথে আজ জমিয়ে আড্ডা দিবো এই ভাবতে ভাবতে খুশি মনে নাচতে নাচতে জেঠুর বাড়িতে যাই ।
ভিতরে প্রবেশ করতেই দেখি আসে পাশে কেউ নি ড্রইং রুমের দিকে যেতেই আমার চোখ জোড়া আটকিয়ে যায় ড্রইং রুমে বসা সুদর্শন ছেলেটির উপর ।নিজের হার্টবির্ট অতি দূত উঠানামা করছিলো নিশ্বাস যেন আটকিয়ে আসছিলো বার বার মনে একটাই প্রশ্ন উঠছিলো এত সুন্দর পুরুষ কি আদো হয় ? আমার চোখ জোড়া তার উপর আটকিয়ে যায় নিজের ইচ্ছের শর্তেও কোন ভাবেই তার থেকে নিজের চোখ ঘোরাতে পারছিলাম না ।তার সুন্দর সেই নীলচে চোখের মায়ায় যেন আমি হারিয়ে গিয়েছি ।ধবধবে সাদা ইংরেজ দের মত দেখতে শরীরে ফিডনেস যা একদম পার্ফেক্ট মোট কথা একদম প্রকৃত সুদর্শন পুরুষ যাকে বলে তার মধ্যে তা সবটা রয়েছে ।আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে সুন্দর সুদর্শন পুরুষ হলো তিনি ! উনি আমাকে দেখে উঠে এসে দু’কদম আমার দিকে এগিয়ে এসে শান্ত গলায় প্রশ্ন করে
-“কে তুমি ? তুমি কাকে খুজঁচ্ছো ?” আমার আর বুঝতে বাকি রইলো না কে উনি ।উনার চেহারা কিছুটা জেঠি মায়ের সাথে মিল তার মানে উনিই জেঠুর বড় ছেলে শুভ্র দাস ।কিছুদিন আগে শুনেছি উনি চিটাগাং ভার্সিটি থেকে মাস্টার্স শেষ করেছে এবার তিনি বাড়িতে ফিরবে সেই অনুমান করেই বুঝে নিলাম উনিই শুভ্র দা ! আমি কাপাঁ কাপাঁ কন্ঠে বলি
-“আমি আরশি ।জেঠুর বন্ধু জাফর মির্জার মেয়ে ।মা জেঠুর জন্য মিষ্টি পাঠিয়েছে তা দিতে এসেছি ।” উনি আমার পরিচয় শুনে আমাকে চিন্তে পাড়েন আমাকে না চিনলেও বাবার পরিচয়ে ঠিকই চিনেছে । শুভ্রদা আমার সাথে টুকটাক কথা বলছিলো এর মাঝেই জেঠীমা চলে আসে আমি কোন মতে জেঠি মায়ের হাতে মিষ্টির পেকেটটা ধরিয়ে দিয়ে সেখান থেকে একপ্রকার ছুটে বাড়ি আসি ।
বাড়িতে আসতেই আমার কেমন জানো সবটা গুলিয়ে যাচ্ছিলো হাজারো চিন্তাভাবনা আমার মাথায় ভিড় করছিলো বার বার শুধু শুভ্রদায়ের কথা মনে পড়ছিলো ।তার চেহারা তার কথা বলা সব কিছু আমাকে বারবার তার দিকে আকর্ষন করছিলো ।তার জন্য মনের মধ্যে ভালোলাগা শুরু হয়েছিলো ।১২ -১৩ বছরের কিশোরীর মনে এমনটা হওয়াই স্বাভাবীক কারন এই বয়সটাই ছিলো এমন ।অনেকে একে বলে বয়সের দোষ ! প্রতিটা কিশোরী মেয়ের মনই এই সময়ে এমন ভালোলাগা কাজ করে আমার সাথে ও তাই হচ্ছিলো কিন্তু এটা আদো কি ভালোলাগা ছিলো নাকি অন্যকিছু ? শুভ্রদার আর আমার বয়সের ব্যবধান ১৫ বছরের ।আমাদের ধর্ম ভিন্ন আমাদের রিতী নিতী ভিন্ন কিন্তু এই সব কিছু তখন কিছুই মনে হতো না তা নিয়ে একবারের জন্যও ভেবেও দেখিনি ।দুনিয়ার সব চিন্তা চেতনা সমাজ সবকিছুর চিন্তা বাদ দিয়ে মনের সবটা দিয়ে তার জন্যআশার ঘর বাধঁতে শুরু করি ।
সেসময় শুধু মনে হয়েছে তাকে আমার ভালোলাগে তার আসে পাশে থাকতে ভালো লাগে তাকে সবসময় নিজের চোখের সামনে দেখতে ভালো লাগে ।তার প্রতি আস্তে আস্তে ভালো লাগাটা তিব্র হয়ে যাচ্ছিলো । প্রতিদিন জেঠুর বাড়িতে যাওয়া যেন আমার নেশা হয়ে যাচ্ছিলো কারন শুধু একটাই শুভ্রদা ! আস্তে আস্তে তার সাথে আমার সম্পর্ক গভীর হয়ে যাচ্ছিলো শুভ্রদা আমাকে স্নেহের নজরে দেখলেও আমার কাছে তিনি ছিলো অন্যরকম এক অনুভূতি অন্যরকম তার প্রতি ছিলো আমার অন্য অনুভূতি । শুভ্রদা আর আমার সম্পর্ক তুমি থেকে তুই এ রূপান্তরীত হলো ।দুজন এক সাথে যথেস্ট সময় কাটাতাম আমার সব আবদার গুলোও ছিলো তার কাছে কখনো তাদের গাছ থেকে তেতুঁল পেড়ে দেওয়ার আবদার করতাম আবার কখনো তাকে রাগিয়ে দিতাম রেগে গেলেও কখনো কিছু বলতে পারতো না জেঠুর ভয়ে ।কারন জেঠু জানতে পারলে তার রক্ষা নেই ।
আগে সৌমি ,ভৈরভী ,চন্দনা আমাদের বাড়িতে এসে আমাকে ডেকে স্কুলে নিয়ে যেত কিন্তু এখন উল্টো আমি তাদের বাড়িতে তাদের ডাকতে যাই কারন শুভ্রদার বাড়ি যে তাদের বাড়ির পাশেই ।সকাল ৯ টায় রেডি হয়ে ফিটফাট ভাবে চলে যেতাম মালি পাড়ায় কারন ৯ টার দিকেই যে শুভ্রদা বাড়ি থেকে ব্যাংকের জন্য বের হতো যদি এই উছিলায় তাকে এক পলক দেখার ভাগ্য হতো এই ভেবেই এসব করতাম । জেঠি মায়ের কাছে কথার ছলে বিভিন্ন ভাবে শুভ্রদার পছন্দ অপছন্দ জেনে নিতাম সে কি খেতে পছন্দ করে কি অপছন্দ করে সবটা ।তার পর মাঝে মাঝে তা শুভ্রদার জন্য বানিয়ে নিয়ে আসতাম । অবশ্য আমার এই পাগলামিতে সবার বেশ সন্দেহ হতো ! কিন্তু প্রতিবার সবাইকে কোন রকম ছয় -নয় বুঝিয়ে পাড় পেয়ে যেতাম ।
সামনেই ছিলো শুভ্রদার ২৭ তম জন্মদিন তাকে কি দিবো ? কি দিবো তা ভাবতে লাগি ।হঠাৎই মনে পড়ে সে বই পড়তে বেশ পছন্দ করে তাই বাবার দেওয়া টি-ফিনের টাকা ৫-১০ টাকা করে জমাতে শুরু করি পুরো দু মাসে সাড়ে পাচঁশত টাকা জমিয়ে তা দিয়ে শুভ্রদার জন্য তার পছন্দের দুইটা বই কিনি ।জন্মদিনের দিন যখন শুভ্রদা কে বই দুটো উপহার দেই তিনি বেশ খুশি হন ।তার প্রিয় বই পেয়ে তার চোখে মুখে আনন্দ ফুটে উঠিছিলো আর তাই ছিলো আমার সবচেয়ে বড় প্রপ্যতা । হঠাৎই শুভ্রদা আমাকে প্রশ্ন করে যে আমি এই বই দুটো কেনার টাকা কোথায় পেলাম ? এমন প্রশ্ন জাগারই কথা সে সময় সাড়ে পাচঁশত টাকার অনেক মূল্য আর সপ্তম শ্রেনীতে পড়া একটা মেয়ের কাছে সাড়ে পাচঁশত টাকা থাকা মানে বেশ বড় ব্যপার । তাই আমি সবটা সমলানোর জন্য শুভ্রদা কে মিথ্যা বলি যে আমার জন্মদিনে আমার নানি আমাকে জামা কিনতে দিয়েছিলো আর আমি তা না কিনে জমিয়ে রেখেছিলাম আর সেই টাকা দিয়েই বই দুটো কিনেছি ! শুভ্রদা তা শুনে কিছুটা রেগে বলে
-“এটা তোর গিফ্ট ছিলো তু্ই কেন আমার জন্য তা দিয়ে গিফ্ট কিনতে গেলি ?” উত্তরে আমি মুচকি হেসে বলি
-“কারন আমার ভালো লেগেছে তাই !”
শুভ্রদা আর কথা বাড়ায় না তার পরের দিনই আমার জন্য গিফ্ট নিয়ে আসে যেখানে ছিলো এক মোঠ চুড়ি ,পায়ের নুপুর আর বেশ কিছু চকলেট ! এসব পেয়ে যেন আমি অমূল্য রত্ন পেয়ে গিয়েছিলাম । না এগুলো পড়তাম না চকলেট গুলো খেতাম খুব সামলিয়ে রাখতাম কারন আমার শুভ্রদা দিয়েছে বলে কথা ! ফ্রিজে চকলেট গুলো বেশ যত্ন করে রেখে দিতাম ছোট ভাই বোন ধরলে তাদের উপর বেশ চিৎকার করতাম তাদের বলতাম যে
– “তোদের অন্য আরো অনেক চকলেট এনে দিবো কিন্তু এগুলো তে স্পর্শ করবিনা !” না আমি তা খেতাম না অন্য কাউকে তা খেতে দিতাম ।আস্তে আস্তে সময় কাটতে লাগে আর আমার অনুভূতি গুলো ও নতুন রূপ নিতে লাগে সেই ভালোলাগাটা যেন নতুন কোন মোর নিচ্ছিলো ।শুভ্রদার রাগ ,ভালোলাগা ,মন্দ লাগা সবটা আমার উপর বেশ প্রভাব ফেলতো । সময় যাচ্ছিলো আর সময়ের সাথে পাল্লা ধরে যেন আমি আস্তে আস্তে আরো বেশি দূর্বল হয়ে যাচ্ছিলাম উনার প্রতি ।উনার বাড়িতেও উনার জন্য পাত্রী দেখতে শুরু করে দিয়েছিলো ।এমনটাই স্বাভাবীক ছিলো কারন তার বিয়ের বয়স হয়েছে স্টাবলিশ ব্যাংকার সব দিক থেকে পার্ফেক্ট কিন্তু কেন জানো তাকে অন্যকারো সাথে দেখবো তা ভাবতেই আমার কলিজা ছেদ করে উঠতো ।
একদিন বিকেলে জেঠি মা আমাদের বাড়িতে আসে ।মায়ের সাথে গল্প করছিলো আমিও পাশে বসে ছিলাম ।কথায় কথায় জেঠি মা জানায় শুভ্রদার জন্য পাত্রী পছন্দ করেছে পাত্রী যথেষ্ট রূপবতী শিক্ষিত ডিগ্রিতে পড়ছে বয়স বিশ একুশ ।দুজনকে এক সাথে বেশ মানাবে । এসব শুনে আর সেখানে বসে থাকতে পারলাম না দৌড়ে নিজের রুমে চলে আসলাম ।দরজা বন্ধ করে সারারাত চিৎকার করে কান্না করতে লাগলাম ।আমার নিশ্বাস নেওয়াটা যেন বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল ।সবাই বলতো এই সময়টায় আবেগ কাজ করে যদি তাই হয় তবে আমার কেন এতটা যন্ত্রনা হচ্ছিলো আমার কেন এতটা কষ্ট লাগছিলো ।শুভ্রদার প্রতি কি শুধুই আমার আবেগ কাজ করছিলো ? নাকি তার চেয়ে বেশি কিছু ? সে দিনের পর থেকে কেমন জানো হয়ে যাচ্ছিলাম ।না কিছু ভালো লাগতো ,না কোন কিছুতে মন বসতো সব কিছুই কেমন যেন বিরক্ত লাগতো ।
শুভ্রদার আশির্বাদের দিন ফিক্সড করার কথা শুনে বেশ কয়েক বার আত্নহত্যা করার চেষ্টা করেছিলাম কখনো বাবার ঘুমের টেবলেট খেয়ে আবার কখনো ছুড়ি দিয়ে হাতের শিরা কাটার চেষ্টা করে ।কিন্তু কোনটাই আর হয়ে উঠেনি কিশোরীর মন তো ভয় কাজ করতো বার বার চেষ্টা করতে যেয়েও ফিরে চলে আসতাম ।তাই আত্নহত্যাটা আর করে উঠা হয়নি ! কিন্তু হাতের শিরা কাটার চেষ্টার সময় বেশ কিছু আচড় পড়েছিলো হাতে শিরা পর্যন্ত ছুড়ি না পৌছালেও রক্তক্ষরন হয়েছিলো সামান্য । দেখতে দেখতে সে দিনও চলে আসে যেদিন আমার ভালো লাগার মানুষটার আমার চোখের সামনেই অন্য কারো সাথে আশির্বাদ হচ্ছিলো আর আমার কি ভাগ্য ? সব কষ্ট গুলো বুকে চেপে হাসি মুখে সব সয্য করে নিচ্ছিলাম আমার ভিতরের সব কিছু জ্বলে পুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছিলো অথচ আমি সব কিছু হজম করে নিচ্ছিলাম!
~আবেগ আমাকে ছিড়ে খাচ্ছিলো
~ক্ষতবিক্ষত হচ্ছিলো মন
~আত্নীক ভাবে ছিলাম মৃত প্রায়
~তবুও ঠোঁট দুটো হাসছিলো সারাক্ষন
সেদিনের পর থেকে শুভ্রদা দের বাড়িতে যাওয়া কমিয়ে দিলাম বলতে গেলে এক প্রকার বন্ধ করে দিলাম ।যে অন্য কারো বাগদত্তা তার উপর কেনই বা নিজের অধিকার খাটাতে যাবো ? না ছিলো তার উপর কোন অধিকার তো কিসের ভিত্তিতে আমি তার কাছে যাবো !
আশির্বাদের দু মাস পর পড়ে শুভ্রার বিয়ের লগ্ন । এরই মাঝে হঠাৎ শুভ্রদা অসুস্থ হয়ে যায় তার বার বার রক্ত বমি হচ্ছিলো মাথার চুল উঠে যাচ্ছিলো শরীর কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছি । আমার দেখা যেই সুন্দর সুদর্শন পুরুষটা যেন আস্তে আস্তে পাল্টিয়ে যাচ্ছিলো শরীরে শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছিলো চোখের নিচেও কালি জমে যাচ্ছিলো ।আসে পাশে ভালো কোন হাসপাতাল ছিলোনা তাই পরিক্ষা নিরিক্ষা করতে শুভ্রদাকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয় ।পরিক্ষা নিরিক্ষা করে যা রিপোর্ট আসে তা যেন সবাইকে পাগল করে দেয় আমার জীবনটা কে থমকিয়ে দেয় ।রিপোর্টে ছিলো শুভ্রদার ব্লাড ক্যান্সার হয়েছে যা লাস্ট স্টেজে চলে গেছে ।জেঠু প্রায় পাগল হয়ে যায় নিজের সন্তানকে বাচানোঁর জন্য মধ্যবিত্ত পরিবার আহামরী তেমন কোন ধনসম্পদ নেই জেঠি মায়ের কিছু গহনা আর কয়েকটা জমি বিক্রি করে বিশ -পচিঁশ লক্ষ টাকা জমা করে ইন্ডিয়া নিয়ে চিকিৎসা করার জন্য ।বাবা মায়ের কাছে তার সন্তান অনেক মূল্যবান পুরো পৃথিবী একদিকে আর তাদের সন্তান এক দিকে থাকে ।জেঠু নিজের ছেলেকে বাচাঁনোর জন্য শেষ চেষ্টাটুকু করে যায় ।শুভ্রদাকে ইন্ডিয়া নিয়ে যায় ।
আমি দিন রাত নামাযে বসে শুধু দোয়া করে গেছি আমার তাকে লাগবেনা সুস্থ হলে কখনো তার সামনেও যাবো তার দিকে তাকাবোনা শুধু শুভ্রদার বাবা মায়ের জন্য যেন তার প্রান ভিক্ষা দেয় তাদের কোল যেন খালি না করে !
কিন্তু নিয়তীর হয়তো অন্য কিছু চাইছিলো । যখন তারা ইন্ডিয়া থেকে ফিরে তখন শুধু শুভ্রদার মৃত দেহটি নিয়ে ফিরে । যখন আমি তার মৃত্যুর সংবাদ শুনি আমার পুরো পৃথিবী যেন স্থব্দ হয়ে যায় ছুটে চলে যাই তাদের বাড়িতে চিৎকার করে কান্না করি ।তার মৃত দেহটি দেখে আমার শরীর বার বার কাটা দিয়ে উঠছিলো তার প্রানহীন দেখ যে আমার সয্য হচ্ছিলোনা ।আমি যে তার মৃত্যুটা কোন ভাবে মেনে নিতে পারছিলাম না বার বার মনে হচ্ছিলো এই বুঝি আমার শুভ্রদা আমাকে আরশি বলে ডাকবে !
তার অন্তিম ত্রিয়ার কাজ শেষ করে তাকে শষানে নেওয়া হয় আমিও তার লাশের পিছু পিছু শষান পর্যন্ত যাই তার শেষ বিদায়টাও নিজের চোখে দেখি ।যখন তার চিতায় আগুন দিচ্ছিলো মনে হচ্ছিলো আমার মন প্রান সেই আগুনে জ্বলছে এভাবেই নিজের চোখের সামনে আমার শুভ্রদাকে ছাই হতে দেখলাম । সারাজীবনের জন্য তাকে হারিয়ে ফেল্লাম ।তার মৃত্যুটা আমাকে স্থব্দ করে দিয়েছিলো আমার হাসি খুশি সবটাই যেন সেই চিতার আগুনে দগ্ধ হয়ে গিয়েছিলো । শুভ্রদা মারা যাবার পর জেঠু স্টক করে প্যারালাইস হয়ে যায় তাদের পরিবারে দরিদ্রতার কালো ছায়া নেমে আসে ।জেঠু শুভ্রদা আর মহেষদা (জেঠুর মেজো ছেলে ) আয়ের টাকা দিয়েই তাদের সংসার চলতো ।জেঠু অসুস্থ হবার পর মহিষ দাদার মুদির দোকানের টাকা দিয়েই কোন মতে টানা -টানিতে সংসার চলতো তেমন ভালো খেতে পারতোনা ।মাঝে মাঝে আমার বাবা তাদের সাহায্য করতো কখনো আমি সবার থেকে আড়ালে লুকিয়ে জেঠুর জন্য তার পছন্দের খাবার রান্না করে নিয়ে যেতাম ।কখনো আবার বাবা থেকে মিথ্যা বলে টাকা নিয়ে তা জমিয়ে জেঠুর জন্য ফল ,হরসিক্স ,দুধ কিনে নিয়ে যেতাম ।জেঠুর কাছে গেলে সবসময় তিনি আমাকে জরিয়ে কান্না করতেন আর বলতেন
-“মা তুই অনেক সুখি হবি ! পরের জন্মে কোন মহাপুরুষ জন্মালে তোর গর্ভে জন্মাবে ।” উত্তরে আমি শুধু মলিন হাসি দিতাম ।
শুভ্রদার মারা যাবার পর সাতটা বছর কেটে যায় আমার জীবনে না ছিলো কোন বন্ধু আর না ছিলো কোন প্রিয়জন সময়ের সাথে অনুভূতিটাও তখন কিছুটা ফ্যকাশে হয়ে গিয়েছে। পড়া লেখার তাগিদে বাড়ি থেকে দূর কুমিল্লায় চলে আসলাম ।কিন্তু ছুটিতে যখনই বাড়িতে যেতাম জেঠুর সাথে সময় কাটাতাম ।এরই মাঝে বাড়ি থেকে বিয়ের চাপ দিতে লাগে ।সবার চাপে পড়ে বাবার পছন্দ মত পাত্রর সাথেই বিয়ে ঠি ক হয় বিয়ে ঠি ক ঠাক হবার পর জেঠু সাথে উনার কথা বলিয়ে দেই । সেদিন জেঠু বলেছি উনাকে – এটা আমার মা হয় কখনো আমার আরশি মাকে কষ্ট দিও না সবসময় হাসি খুশি রাখবে । যদি কখনো কষ্ট দেও তাহলে আমি যেখানেই থাকিনা কেন খুব কষ্ট পাবো ।” বিয়ের ঠি ক এক সপ্তাহ আগে জেঠু মারা যায় ।আর এটা ছিলো আবার জীবনের দ্বিতীয় ধাক্কা ।বাসে করে কুমিল্লা থেকে বাড়ি আসতে দেরী হয়ে যায় ।বাড়িতে ফিরে দেখি চিতা সাজানো হয়ে গেছে আগুন দিচ্ছে । জেঠুকে শেষ দেখা আর হয়নি ।সেদিন আবারো চিৎকার করে কেদেঁছিলাম পিতা সমান জেঠুকে হারিয়ে ।
আজ পনেরটা বছর হয়ে গেছে স্বামী সংসার নিয়ে ভালো আছি সুখে আছি ।আমার স্বামী আমাকে অসীম ভালোবাসে দু সন্তানের মা আমি । কিন্তু আজো শুভ্রদাকে ভুলতে পারিনি তার চিতার আগুন আমার বুকে এখনো জ্বলে মাঝে মাঝে তার চেহারা ভেসে উঠলে এখনো বুক হাহাকার করে ।পাগল পাগল হয়ে যাই শ্বাস নেওয়াটা কষ্টর হয়ে যায় । মানুষ বলে কিশোর কালের অনুভূতি খানিকের আবেগ থাকে ।খানিকের ভালোলাগা থাকে । তাহলে কেন আজ ও শুভ্রদার জন্য আমার অন্তর পুড়েঁ আমার ভিতর কেন ক্ষত -বিক্ষত হয় ? সে কি শুধুই আমার আবেগ ভালোলাগা ছিলো ? নাকি তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু ! আজ ও তার চিতার আগুন আমার মনকে দগ্ধ করে।
~নাইবা রইলি পাশে তুই
~থাকবি সদা মনে
~খুজঁবোনা আর বাস্তবেতে
~লুকিয়ে রাখবো গোপনে
এই গল্পটা কোন কাল্পনিক গল্প না ।এটা কারো জীবন থেকে নেওয়া ।গল্পের প্রতিটা ঘটনা কোন এক জনের জীবনে সত্য ঘটনা ।গল্পে যে আরশি (ছদ্মনাম ) এটা তারই জীবনের সত্য ।আপুর রিকোয়েস্টে তার অপূর্ন ভালোবাসার গল্পটা লিখেছি জানিনা আপুর অনুভূতির কতটা তুলে ধরতে পেরেছি কিন্তু এটা আপুর জীবনের সত্য ।যখন আপু ফোনে তার গল্পটা বলেছে অপর পাশ থেকে তার কান্নার শব্দ পাচ্ছিলাম নিজেকেও ধরে রাখতে পারিনি আপুর কথা গুলো শুনে একাই চোখ থেকে পানি ঝড়ছিলো । আপু নিজের পরিচয় গোপন রেখে গল্পটা লিখতে বলেছে এতে আপু নিজের মনের পোষা ১৫ বছরের আবেগ অনুভূতি আর কষ্টকে শেয়ার করতে চাইছে ।কেউ আপুর আসল পরিচয় জানতে চাইবেন না আমি বলতে পারবোনা কারন আমি আপুর কাছে ওয়াদাবদ্ধ !
গল্পের বিষয়:
গল্প