কলকাতায় পা দিয়ে প্রথমেই মনে হলো, এখানকার নায়িকারাই শুধু ডায়েট করে। মেয়েরা করে না। এছাড়া সম্ভবত থলথলে ভুঁড়িই এখানকার ফ্যাশন। হতে পারে কলকাতার মেয়েরা গোপাল ভাঁড়ের ব্যাপক ভক্ত। প্রাণপণ চেষ্টা করে তার মতো ভুঁড়ি বানায়। হোটেলে উঠে ফ্রেশট্রেশ হয়ে নানা বলল ‘লম্বা ঘুম দে।’ আমি বললাম ‘বর্ডার পার হয়েছি কি ঘুমানোর জন্য?’ বইয়ের লিস্টটা হাতে নিয়ে বন্ধু সুমনকে ফোন দিলাম। সুমন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে জার্নালিজমে মাস্টার্স করতে এসেছে। ও আমাকে নিয়ে গেল কলেজ স্ট্রিটে, দেজ পাবলিকেশন্স-এ। কলকাতার বিখ্যাত পাবলিকেশনের দোকানটা আকারে অনেক বড়। অনেক অনেক বই। কিন্তু দোকানের সামনে ক্রেতাদের দাঁড়ানোর জায়গা খুবই কম । ছোট একটু চিপা জায়গা। সেখানে একসাথে চার-পাঁচজন দাঁড়ানো যায়।
বইয়ের দোকানে আমার গা ঘেঁসে দাঁড়িয়েছে একটি মেয়ে। এই মেয়েকে গোপাল ভাঁড়ের ভক্ত ভাবার সুযোগ নেই। মেয়েটা না শুকনা না ভুঁড়িওয়ালা। প্রথম দেখায় মনে হয় পরিণীতি চোপড়ার বোন। বাম গালে টোল। চোখের পাতা ধনুকের মত বেঁকে উপরে উঠে গেছে। মেয়েটার চোখের দিকে তাকাব না টোলের দিকে তাকাব বুঝতে পারছি না। আমার বিশ্বাস নব্বই ভাগ পুরুষ মেয়েটাকে দেখে এই সমস্যায় পড়বে। বাকি দশভাগের তো চোখে সমস্যা।
মেয়েটা আমার পাশে দাঁড়াল। একেবারে গা ঘেঁসে। যতটা কাছে দাঁড়ালে ঘাম, পারফিউম ও চুলের মিশ্র ঘ্রাণ পাওয়া যায়। বন্ধু সুমন পেছন থেকে কানে কানে বলে গেল, ‘আসাদ তোর পাশে যে দাঁড়িয়েছে সে তোর ভাবী। বেশি গা ঘেঁষিস না।’ আমি মনে মনে বললাম, ‘বললেই হলো? এটা তোর ভাবী শালা।’ আসলে দোকানে যা ভিড়, আমাকে ঘেঁসতে হচ্ছে না। পাবলিকের ধাক্কায় গা ঘেঁষা হয়ে যাচ্ছে। আমি সুনীলের উপন্যাস সমগ্রের প্রথম চারখণ্ড কিনলাম। সাথে সত্যজিৎ রায়ের ‘বিষয় চলচ্চিত্র’ বইয়ের দুই কপি। আমার জন্য একটা, সুমনের জন্য একটা। আমরা দুজনেই তারেক মাসুদ হব। চলচ্চিত্রের বই পড়ে সিনেমা বানানো শিখব।
আমার বইয়ের মূল্য এলো দুই হাজার চারশো রুপি। এত টাকার বই কেনা দেখে মেয়েটার মুখ হা হয়ে গেল।
আমরা বাংলাদেশি বুঝতে পেরে কী না জানি না, মেয়েটা দোকানদারকে বলল, ‘তসলিমা নাসরিনের একটা বই দিন তো?’ দোকানদার বলল, ‘কোন বইটা?’ মেয়েটা মাথা চুলকানো শুরু করলো। বুঝলাম তসলিমার একটা বইয়েরও নাম জানে না। আগ বাড়িয়ে জানতে চাইলাম, তসলিমার কবিতা না উপন্যাস, কোনটা পড়তে চান? মেয়েটা বিভ্রান্ত, সম্ভবত জানতই না তসলিমা কবিতা লেখে। আমি বললাম, কবিতা পড়তে চাইলে- ‘খালি খালি লাগে’, ‘জলপদ্য’, ‘কিছুক্ষণ থাকো’, ‘ভালোবাসো? ছাই বাসো!’ বইগুলো নিতে পারেন। উপন্যাসের ক্ষেত্রে- ‘ফরাসি প্রেমিক’, ‘ভ্রমর কইয়ো গিয়া’, ‘ফেরা’, ‘নিমন্ত্রণ’ বেশ ভালো। মেয়েটা গোল্লা গোল্লা চোখে আমার দিকে তাকালো। চোখের ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো- ‘তুমি ছবগুলো পড়েচো?’ আমি উপর নিচ মাথা নাড়লাম।
‘খালি খালি লাগে’ আর ‘ফরাসি প্রেমিক’ পাওয়া গেল। মেয়েটা আমার দিকে ফিরে ধন্যবাদ দিল। আমি তখন আমার বই শক্ত করে বাঁধা হচ্ছে কি না সেটা খেয়াল করছিলাম। ধন্যবাদের প্রতিউত্তর দিয়ে জানতে চাইলাম হুমায়ূন আহমেদের কোনো বই পড়েছে কী না। পড়েনি বলে জানালো। আমি বললাম, ‘হুমায়ূন আহমেদের একটা চরিত্র আছে। নাম হিমু। হিমুর একটা বই পড়লে আপনি তিনজনের প্রেমে পড়বেন।’ অবিশ্বাস নিয়ে তাকালো। চোখের ইশারায় বললাম, ‘হুমমম বিশ্বাস না হলে ট্রাই করেন।’ মেয়েটা বললো, ‘তিনজন কেন? কোন তিনজনের প্রেমে পড়ব?’ আমি বললাম, ‘প্রথমে ধপাস করে প্রেমে পড়বেন হিমুর। তারপরের লেখক হুমায়ূন আহমেদের।’ মেয়েটা বলল ‘তৃতীয়তে কি আপনার?’ আমি বললাম, ‘এবসোলিউটলি! আমার।’ মেয়েটা বলল ‘কেন? আপনার প্রেমে পড়তে যাব কেন?’
‘কারণ, আমি হিমুর ২৪টা বই-ই আমার পড়া। এবং এখন যে ভবিষ্যৎবাণী করছি সেটাও উচ্চমার্গীয় হিমুগিরি। এছাড়া প্রথম দুই প্রেমিককে তো পাবেন না। তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে। অপেক্ষমাণ তালিকার সামনে থাকায় নিকটতম আমার উপরে আগের দুজনের জমানো ভালোবাসা উগরে দেবেন।’ মেয়েটা কোয়েল মল্লিকের মত চোখ বন্ধ করে শরীর দুলিয়ে হেসে উঠল। আমি তাকে হিমুর সঙ্গে পরিচয়ের স্মারক স্বরূপ ‘তোমাদের এই নগরে’ বইটা গিফট করলাম। সে কিনল হিমু সমগ্র। আমাকে সত্যজিৎ রায়ের ‘একেই বলে শুটিং’ বইটি গিফট করলো। ‘তোমাদের এই নগরে’ বইয়ে আমাকে বাধ্যতামূলক অটোগ্রাফ দিতে হলো। এর মাঝে সুমন বলে দিয়েছে আমি ‘নোবেল প্রাইজ’, ‘অসুখের নাম তুমি’, ‘অতঃপর বুঝলাম তুমি কত পর’, ‘চুড়ি অথবা চেয়ারের গল্প’ নামে চারটা বই লিখে ফেলেছি। অসুখের নাম তুমি, নাম শুনে বেশ প্রশংসা করল। সবগুলো বই পড়ার আগ্রহ জানালো। আমি বললাম, ‘একেই বলে শুটিং’ এ অটোগ্রাফ দিতে। সে অটোগ্রাফের সাথে মোবাইল নাম্বার লিখে দিলো। নাম লিখলো মনোমিতা মুখার্জি। আমি বললাম, মমু!
আমরা চেন্নাই যাব। নানার চিকিৎসা করাতে। নানা ছাড়াও এই যাত্রায় সঙ্গী হয়েছেন আমার বয়সী রুপম। সেও যাবে ডাক্তার দেখাতে। ট্রেনের টিকেট দুইদিন লেট। এই দুইদিন কলকাতা থাকতে হবে। রাতে মেয়েটাকে কল দিলাম। ঠিকমত বাসায় ফিরেছে কি না জানতে চাইলাম। সে আবার হাসল। এবার শুধু শরীর দুলিয়ে না। পুরো কলকাতা দুলিয়ে। জানালো, বাসায় গিয়েই হিমু পড়তে বসেছে। নানার ভয়ে বেশি কথা বলা গেল না। অল্প একটু কথা হলো।
রাত দুইটার দিকে মমুর ফোনে ঘুম ভাঙ্গলো। সকালে দেখা করতে চায়। নির্দ্বিধায় বললাম, ঠিক আছে। সকালে রুপমকে সাথে নিয়ে গেলাম নিউ মার্কেট। রাতে হোটেলের ছাঁদে বসে রুপমকে সব বলা হয়েছে। মমু এসেছে নীল শাড়ি পরে। শাড়ির পাড় মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। পিঠ বোঝাই শ্যাম্পু করা চুল। কপালে নীল টিপ। চোখেও সম্ভব নীল লেন্স পরেছে। এতে করে গাঢ় মমতাময়ী রূপ বাসা বেধেছে মমুর চোখে। ওর সামনে গিয়ে মুগ্ধ চোখে বললাম, রুপা!
মমু শাড়ির পাড় হাতের উপর বিছিয়ে বলল, ‘আমাকে রুপার মতো লাগজে?’ আমি বললাম- ‘মতো না, রুপাই লাগছে। হুমায়ূন আহমেদ তার অদৃশ্য চোখ দিয়ে যেন তোমাকেই দেখতেন।’ কফি হাউজে গিয়ে চা খেলাম। সিঙ্গারা খেলাম। ট্যাক্সিতে রুপমকে তুলে দিয়ে বলল- ‘দাদা, আপনি হোটেলে চলে যান। আজ সারাদিন কলকাতার রুপা বাংলাদেশের হিমুকে নিয়ে হাঁটবে।’ পরের দু’দিন এক রুটিনে কাটল। মমু সারারাত হিমুর বই পড়ে। সারাদিন আমাকে সাথে নিয়ে হাঁটে। এই সেই গল্প বলে। জায়গা চেনায়। জাগয়ার পেছনের ইতিহাস বলে। আইটি নিয়ে পড়া মমুর ইতিহাসের দখল ঈর্ষীয়। ঢাকার চেয়ে কলকাতার রোদের ঝাঁঝ বেশি। সেই রোদে হেঁটে হেঁটে সন্ধ্যা গড়িয়ে হোটেলে ফিরি। নানাকে বলি সুমনের কাছে যাচ্ছি। সুমনকে বলি নানা রুম থেকে বের হতে দেয় না। বাসায় ফিরলে নানা গালাগালি করে। বলে আমার পাশাপাশি তোরও চিকিৎসা করাতে হবে।
রাত পৌনে দশটায় মহীশুর এক্সপ্রেসে উঠেছি। চেন্নাই যাবো। চেন্নাই এক্সপ্রেসে যেতে পারলে ভালো হতো। টিকেট পেলাম না। রাতের নির্জনতা কাটিয়ে ঝপঝপ ঝপঝপ শব্দে ছুটে চলছে মহীশুর এক্সপ্রেস। আটাশ ঘণ্টা ট্রেনে থাকতে হবে। আমরা একই সাড়ির টিনটা টায়ার ভাড়া নিয়েছি। নিচের টায়ারে নানা, মাঝের টায়ারে রুপম। একেবারে উপরের টায়ারে আমি। চাদর টেনে মরা লাশের মত টান হয়ে শুয়ে আছি। সারাদিনের ক্লান্তিতে ঘুম আসতে বেশি সময় লাগল না। মোবাইলের ম্যাসেজ টোনে কাঁচা ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো। ম্যাসেজ দিয়েছে মমু। ‘দুইদিন তুমি পাশে ছিলে। মনে হচ্ছিলো আমার পৃথিবীটা রঙ্গিন হয়ে গেছে। আসাদ, তোমাকে বলা হয়নি। মিলন নামে একটা ছেলের সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। মিলন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। হায়দ্রাবাদে থাকে। আগামী মাসে আমাদের বিয়ে। কিন্তু কেন জানি, আমি তোমার সাথে মিলনের তুলনা করতে শুরু করেছি। বারবার মনে হচ্ছে, মিলন না আমার মন তোমাকে চায়। আসাদ, আমার কী করা উচিৎ? আমরা কি হিমু-রুপা হয়ে একটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারি না?’
‘মিলনকে নিয়ে সুখী হও মমু।’ লিখে রিপ্লাই দিলাম। তারপর ভোডাফোনের সিমটা বের করে জানালার ফাঁক দিয়ে ফেলে দিলাম। প্রবল বাতাস এক ঝাপটায় কেড়ে নিলো মমুর সাথে যোগাযোগের এক মাত্র মাধ্যম, সিমটা। চেন্নাই নেমে নতুন সিম কিনতে হবে। হিমুর আর কয়েকটা বই পড়লে মমুও বুঝে ফেলবে, হিমুরা কোনদিন রুপার ডাকে সাড়া দেয় না। আমিও দিলাম না।
গল্পের বিষয়:
গল্প