পাত্রী দেখতে এসে পাত্রীর বাড়িতে তিনবার টয়লেটে যাওয়া হয়ে গেছে। এই অবস্থা দেখে পাত্রীর মা অবশ্য বলে ফেলেছে “বাবা তোমার কি পেট খারাপ?” আমি কিছুক্ষন উনার দিকে তাকিয়ে ঠিকঠাক উত্তর না দিয়ে উল্টো প্রশ্ন করলাম “আপনাকে আমার এই মুহুর্তে কি ডাকা উচিৎ? আন্টি, হবু শ্বাশড়ি আম্মা নাকি শুধু পাত্রীর মা?” উনি আমার কথা শুনে হা করে তাকিয়ে থাকলেন। তবে সবচেয়ে বেশি অবাক হয়েছে উনার স্বামীটা। এমন কথা শুনে উনি এহেম এহেম করে দুটো কাশি দিয়েছিল। কিন্তু এতে অবাক হওয়ার কি আছে আমি কিছুই বুঝলাম না। এমন প্রশ্ন করা কি ঠিক হয়নি? আমার প্রাণ প্রিয় আব্বা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য হাসি দিয়ে বললো “আমার ছেলেটা এমোনি বুঝলেন ভাইসাব।সহজ সরল ছেলে। মুখে কিছু আটকায় না।” আব্বার সাথে তাল মিলিয়ে আম্মা বললো “আপনারা আবার কিছু মনে করবেন না।ও এমন করেই কথা বলে।” এটা বলেই আম্মা আমার দিকে তাকিয়ে চোখ বড় বড় করে ইশারা করলো।
যেন আমায় বলছে “বাসায় যাইয়া নে, তোর টয়লেটে যাওয়া আমি বাহির করবো।দেখবো তুই কতবার টয়লেটে যেতে পারিস। আজ তোরে সত্যি খাইছি।” আমি চুপ থাকলাম। পাত্রীর মা মুখে চাপা হাসি এনে বললো “বাবা তুমি যেটা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছো সেটাই ডাকতে পারো এখন।” আমি কি বলবো বুঝতে পারলাম না। বুঝতে পারলাম না এই কথা বলাটা কি আমাকে মানাবে যে পাত্রী দেখতে এসে আমার নার্ভাস লাগছে। আমার ভিতরটাতে নার্ভাসের মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে শরীরে ঘাম দেয়। আর তখন গোসল দিতে ইচ্ছা করে। তাই হাত মুখ ধোয়ার জন্য গিয়েছি। কিন্তু এটা কেন হয় আমার, বুঝতে পারি না। কিন্তু আমি বললাম “আপনাদের মেয়ে কোথায়? তাড়াতাড়ি একটু আসতে বলবেন? আপনার মেয়ে কি সাঁজগোজ করছে? এখনকার মেয়ে মানুষের এই এক প্রবলেম আন্টি বুঝলেন যত না তারা সাঁজগোজের মাঝে সময় দেয় ঠিক তত তারা রান্নাবান্না যদি মনোযোগ দিয়ে শিখতো।
আমার খুব ইচ্ছা আমার বউ আমাকে মাঝে মাঝে ভালো রান্না করে খাওয়াবে। আপনার মেয়ে রান্না পারে তো?” এটা বলার পর উনার স্বামী আরও কয়েকটা কাশি দিল। আব্বা হাসতে হাসতে আমার হাত শক্ত করে চেপে ধরে বললো “তুই এতো রসিকতা কেন করিস বাবা? একটু থাম।” আমি বেশ বুঝতে পারলাম আব্বা আমাকে আর একটাও কথা না বলার জন্য এভাবে চেপে ধরেছে। আমি আব্বার হাত ছাড়িয়ে বললাম “এইভাবে কেউ ধরে? এটা রসিকতা না আব্বাজান।” পাত্রীর বাবা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন “বাবা তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে। যারা এমন করে সোজা সাপটা বলে ফেলতে পারে সেই মানুষগুলো আসলেই ভালো হয়। তাদের মনে কোন প্যাচ থাকে না। বাবা আমার মেয়ে খুব ভালো রান্না করতে পারে। নিজের মেয়ে বলে এমন বলছি না।”
এর মিনিট খানেক পরেই পাত্রী নাস্তার ট্রেতে নাস্তা নিয়ে এসে সালাম দিয়ে আমাদের বিপরীতে বসে।পাত্রীর নাম সুমাইয়া আফরিন। আমি বেশ কয়েকবার সুমাইয়ার দিকে তাকালাম। এই দেখার মাঝে উপলব্দি করলাম আমার ভিতরে যে নার্ভাসটা কাজ করছিল তা কোথায় যেন হারিয়ে গেলো।এমন সাধারন একটা মেয়েকে মায়াবতীর মত লাগবে বুঝতে পারিনি। একদম সাধারনভাবেই তেমন সাঁজগোজ না করেই সামনে এসেছে। এই সাধারণের মাঝেও আমি অসাধারন কিছুকে খুজে পাই। খুজে পাই সুমাইয়া আফরিনের চোখ দুটোর মাঝে এক ধরনের পাখির ছাপ। সেই পাখির নাম ঘুঘু পাখি। চোখ জুড়ানো ঘুঘু। এই ঘুঘু লোকালয়ে থাকলেও সবার সামনে আসে না। লুকিয়ে লুকিয়ে থাকতেই পছন্দ করে। আচ্ছা আমার কি পাত্রী সুমাইয়াকে জিজ্ঞেস করা উচিৎ কেমন আছেন সুমাইয়া আফরিন? এসব ভাবতেই সুমাইয়া আফরিন নাস্তার ট্রে থেকে একটা গ্লাস নিয়ে আমার দিকে বাড়িয়ে বললো “শুনলাম আপনি তিনবার টয়লেটে গিয়েছেন?
এই স্যালাইনটুকু খান আমি নিজ হাতে বানিয়েছি।” আমি আম্মার দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে সুমাইয়ার হাত থেকে স্যালাইনটুকু নিয়ে ঢগঢগ করে খেয়ে একটা হাসি দিলাম। আমি জানতাম ঘুঘু পাখিরা একদম চুপচাপ টাইপের হয়, লজ্জাবতী হয়, কিন্তু এই ঘুঘু পাখি যে এমন করে বলে ফেলবে কে জানতো।মিস সুমাইয়া আপনার কি লাজ শরম বলতে কিছু নেই? এমন করে কেউ লজ্জা দেয়? যদিও আমি কথাগুলো মনে মনে বলেছি। এই কথা প্রকাশ করার সাহস আমার নেই। এরপর আমার বাবা মা আর ওর বাবা মা টুকটাক কথা বললো। আমি শুধু আড়াল চোখে কয়েকবার অনুভব করলাম সুমাইয়া আফরিনের চোখ দুটোকে। এই চোখ দুটোর মাঝে আমি তাকিয়ে হঠাৎ বললাম “কিছু মনে না করলে আপনি কি আমায় আপনাদের বাড়িটা একটু ঘুরিয়ে দেখাবেন? উনারা না হয় কথা বলুক। আসলে এইভাবে চুপচাপ বোবার মত বসে আছি তো তাই।” আমার কথা শুনে মিস সুমাইয়া কি মনে করলো আমার জানা নেই। ও শুধু ওর মায়ের দিকে একবার তাকালো। আর ওর মা ইশারা করলো যা না একটু ঘুরিয়ে দেখা।
এই ঘুরিয়ে দেখাতে দেখাতে আমি এখন অবস্থান করছি ওদের এই পুরানো বাড়ির ছাদে। বাড়ির দেয়ালে আঁকা নকশি ছাপ গুলো কি চমৎকার করে আকাঁ। যারা এমন চমৎকার করে কোন কিছুর উপর সৌন্দর্যটা তুলে ধরতে পারে সে মানুষ গুলোকে কেন যেন আমার চোখে আঁকতে ইচ্ছে করে। অনুভব করতে ইচ্ছে করে সে মানুষগুলোর ভিতরটা কেমন। ছাদে এসে আমি যখন একটা দীর্ঘশ্বাস নিলাম ঠিক তখন সুমাইয়া বললো “আমরা মানুষেরা কেন হঠাৎ করে কাঁদি বলেন তো?” আমি অবাক হয়ে কিছুটা সময় নিলাম তারপর বললাম “আমরা মানুষেরা এই শহরটার মত। এই শহরটার মাঝে আলো, বাতাস, বৃষ্টি সবকিছু বিদ্যমান।সময়ের সাথে সাথে এসব কিছুই আমাদের সামনে হাজির হয়। এই হাজির হওয়ার মাঝে আমরা অনুভব করি এই আলো, বাতাস, বৃষ্টির অনুভূতিগুলো। এই অনুভূতিরা আমাদের ভিতরে একটা জায়গা দখল করে রাখে।
সেই অনুভূতিরা ঘুমিয়ে থাকে। মধ্যরাতে হঠাৎ করে যখন এমন অনুভূতিরা জেগে উঠে তখনই আমাদের চোখ ভিজে।পুরানো অনুভূতির জন্য মায়া হয়। কষ্ট লাগে। আমাকে কেন এমন প্রশ্ন করলেন সুমাইয়া?” সুমাইয়া মুখে হাসি এনে বললো “এমনি বলেছি। আপনাকে কি বলা যায় ভাবতে ভাবতেই মাথায় এই প্রশ্নটা এসেছে। আপনি খুব সুন্দর করে কথা বলেন জাহেদ সাহেব।এমন সুন্দর করে কথা বলার জন্য আপনাকে একটা কবিতা শুনাতে ইচ্ছে করছে। আমার পছন্দের কবিতা।কবি নির্মলেন্দু এর কবিতা। শুনবেন?” আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক ইশারা দেওয়াতে সুমাইয়া এই বিকেলের আকাশের দিকে তাকিয়েই কবিতা আবৃত্তি করলো আমি বলছি না ভলোবাসতেই হবে, আমি চাই কেউ একজন ভিতর থেকে আমার ঘরের দরোজা খুলে দিক। কেউ আমাকে কিছু খেতে বলুক । কাম-বাসনার সঙ্গী না হোক, কেউ অন্তত আমাকে জিজ্ঞেস করুক: ‘তোমার চোখ এতো লাল কেন?’
আমি সুমাইয়াকে বললাম “এই বিকেলটা এখন পরিপূর্ণ লাগছে আপনার কন্ঠে কবিতা শুনে।কিন্তু আপনি আমাকে প্রশ্নটা এমনি এমনি করেন নি সুমাইয়া।আপানার চোখ দেখেই বুঝতে পেরেছি। আপনার কাউকে ভালো লাগে? আমাকে বলতে পারেন।” ও আমার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলো।কথার প্রসঙ্গ বদলে বললো “চলুন যাই।” এটা বলেই যখন দু কদম হেটে গেলো আমি সাহস করে মিস সুমাইয়ার হাতটা ধরলাম। আমার ছোয়া পেয়েই সে আমার দিকে ফিরে তাকায়। হয়তো এটা আশা করেনি এমন করে ওর হাতটা আমি ধরবো। আমি হাতটা ছেড়ে দিয়ে বললাম “দুঃখিত।আপনি আমাকে চিন্তায় ফেলে যাচ্ছেন।আমি চিন্তিত থাকতে পছন্দ করি না।একদম না।” সে কিছু না বলেই চলে যায়।আর আমি পুনরায় একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে এই বিকেলের আকাশটার দিকে তাকাই।থমথমে এই বিকেলটার মত হঠাৎ করেই আমার ভিতরটা এমন থমথমে হয়ে যায়। ভাবি বিকেলটা সব সময় এমন থমথমে কেন হয়? এই থমথমে হওয়ার কারণ কি?
ঠিক দুদিন পর সুমাইয়া আমাকে ফোন করে চুপ করে থাকলো। আমি বললাম ”কেমন আছেন?এটা যে আপনার নাম্বার আমি জানি। নাম্বারটা আমি মায়ের কাছ থেকে নিয়ে রেখে দিয়েছি। কিন্তু ফোন করা হয়নি।” সে তারপরও চুপ করে থাকলো। আমি যেই আবার কিছু বলতে যাবো ঠিক তখন সুমাইয়া বললো “আপনার ভিজিটিং কার্ড থেকে নাম্বারটা নিয়ে ফোন করেছি। আপনাকে সেদিন ওমন করে বলাটা আমার ঠিক হয়নি। ঠিক হয়নি আপনার সামনে থেকে ওমন করে চলে যাওয়ার ব্যাপারটা।
আমি খুব দুঃখিত জাহেদ সাহেব।তবে আপনি যা ভাবছেন আসলে এমনটা না। আমি কাউকে এমন করে চাইনি।এই চাওয়ার যোগ্যতা আমি রাখি না।” এটা বলেই সে একটু থামে। আমি বললাম “তাহলে এমন করে চলে গেলেন কেন? আমাকে একটু ক্লিয়ার করে বলবেন প্লিজ?” সে আরও একটু সময় নিয়ে বললো “আসলে আমি আমার বাবা মায়ের আসল মেয়ে না।এই কথাটা বাবা নিশ্চয় আপনাদের জানায়নি।তারা আমাকে তাদের নিজ মেয়েই মনে করে। তাদের কোন সন্তান নেয়।হাসপাতালে আমার জন্ম হয়েছিল।আমার আসল বাবা মা কারা আমি জানি না। জন্ম হওয়ার একদিন পরই আমার মা আমাকে হাসপাতালে ফেলে রেখে চলে গিয়েছিল।উনি আমার সাথে কেন এমন করলেন এই উত্তর এখনো খুঁজে পাইনি। যদি উনাকে কখনো সামনে পাই তাহলে জিজ্ঞাস করতাম কেন তিনি এমন করেছেন?
আমার বর্তমান বাবা ঐ হাসপাতালের কর্মকর্তা ছিল। আমার এই ভালো বাবাটাই ঐদিনের পর আমাকে তার রাজকন্যা করলো।এমন একটা রাজকন্যা করলেন মনে হয় পৃথিবীর সমস্ত সবুজে ঘেরা পাহাড় আমার। সেই পাহাড়ের চুড়ায় থেকে আমার ভেজা চুল শুকিয়ে নীল গগনের সাথে ভাব জমাতে পারি জানেন।”এটুকু বলেই সুমাইয়া থামলো। আমি ফোনের এপাশ থেকেও ঠিক বুঝতে পারলাম সুমাইয়ার চোখ গুলো হয়তো ভিজে গেছে।ভিজে গেছে তার সবুজে ঘেরা পাহাড়টা। সুমাইয়া আবার বলতে লাগলো “ভাবছেন হয়তো আমি কি করে আমার বিষয়টা জানলাম। সত্য কখনো চাপা থাকে না জাহেদ সাহেব। আমার সেই ছোট বেলা থেকে আমার সমস্ত অনুভূতি, একটু একটু করে হাটতে শিখা, প্রথম মা বলে ডাকা, প্রথম বাবা বলে ডাকা, আমার প্রথম স্কুলে যাওয়া, সব কিছু আমার বাবা তার ডায়েরীতে লিখে রেখেছে।বাবা এখনো লিখে রাখে। এই যে আপনারা আমাকে দেখতে আসলেন সেটাও আমার ভালো বাবাটা লিখে রেখেছে।
এই ডায়েরী কাউকে ধরতে দেয় না। কাউকে দেখতে দেয় না। তার যে একটা ডায়েরী আছে সেটাও কাউকে জানাতে চায় না।কিন্তু এসব কিছু আড়াল থাকে বলুন? আমি যখন ইন্টার পাস করলাম তখনি ডায়েরীটা চোখে পড়েছে। ডায়েরীর পাতার ভিতরে ছোট্ট একটা চিরকুট পেয়েছিলাম। তাতে লিখা ছিল “ভাইজান আমার বাচ্চাটারে দেইখেন। আমি জানতে পারছি আপনার কোন বাচ্চা নাই। ওরে আপনার কাছে দিয়া গেলাম। আমারে খুইজেন না ভাইজান। ” সেদিন আমি ভয়ংকর ভাবে কেঁদেছি বিশ্বাস করুন। আমার একটুও ঘুম আসেনি।আমি অনেক কেঁদেছি অনেক। তবে আমি আমার এই ভালো বাবা মাকে বুঝতে দেই না আমি যে সত্যটা জেনে গেছি। এসব যখনি মনে পড়ে তখন কান্না পায় খুব কান্না পায়। চোখ ভিজে লাল হয়। আপনারা যখন আমাকে দেখতে আসলেন তখন বার বার মনে হয়েছে তাদের আমি হারিয়ে ফেলবো। আমার এই ভালো বাবা মাকে হারিয়ে ফেলবো।
তাদের প্রতি কোন রাগ রাখবেন না কেমন? তাদের পক্ষ থেকে আমি ক্ষমা চেয়ে নিয়ে নিচ্ছি।” এটা বলেই সুমাইয়া আবার থামে।আমার কি বলা উচিৎ আমি ঠিক বুঝলাম না। আমার চুপ থাকা দেখে ও একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললো “যেদিন আপনারা দেখে গেলেন সেদিন বাবার পাশে বসে বলেছিলাম “বাবা তোমরা আমাকে পর করে দিবা? কষ্ট লাগবে না?” আমার কথা শুনে আমার ভালো বাবাটা কান্না করে দিয়েছিল।আমার বাবার চোখে পানি দেখলে খুব কষ্ট হয়। আমার ডাক নাম সুমাইয়া না। আদিবা। পুরো নাম সুমাইয়া আফরিন আদিবা।” আমি চুপ করে রইলাম।সুমাইয়ার কথা শুনে আমার ভিতরটা নাড়া দিয়ে উঠলো। আদিবা নামটা শুনেই মনে হলো কেউ আমার গলা চেপে ধরছে। আমার বুকে কষ্টরা জমাট বেধেছে।আকাশটা মেঘের রুপ নিয়েছে। সেই মেঘের শব্দরা একত্রে হয়ে আমাকে ঘিরে ধরেছে।আমি শুধু তাকে বললাম “আপনার সাথে পরে কথা বলি?” এরপর তার কোন উত্তরের আশা না করেই আমি ফোনটা রেখে দেই।
আমার ভিতরে একজন বাস করতো। এই বাস করার মাঝে আমার স্বপ্নগুলোকে একটা রঙ্গিন মলাটে বেধে ছিলাম।তাকে আমার জীবনের সমস্ত কিছু দিয়ে চেয়ে ছিলাম। আমি জানি না আমার এই চাওয়ার মাঝে কোন কমতি ছিল কিনা।আমি যতবার তাকে আমার এই চাওয়ার কথা বলতাম সে ঠিক ততবার আমাকে এড়িয়ে যেত।ঠিক এড়িয়ে যাওয়া না, অপমান করার মত ছিল।ভদ্র আচরনে অপমান। আমরা তখন ভার্সিটিতে অধ্যয়নরত মাঝামাঝি সময়ে। তাকে যখন আমার জীবনের প্রথম ভালো লাগার কথা জানালাম সে তখন শুধুই আমার দিকে নিরব চোখে তাকিয়ে চলে গিয়েছিল। আর যাকে ভালো লাগার কথা জানালাম তার নাম আদিবা।একদিন হঠাৎ আমাকে বললো “আমাকে এমন করে কেন ভালোবাসো জাহেদ? ভালোবাসা বিষয়টাকে আমার ভয় হয়।খুব ভয় হয়। এটা মানুষের ভিতরটাকে একদম শেষ করে দিতে পারে।যে ভালোবাসা মানুষকে শেষ করে দিতে পারে সেটার মাঝে জড়াতে ইচ্ছে করে না। আমরা না হয় বন্ধু হয়ে থাকি? খুব ভালো বন্ধু?”
আমি এটা মানতে পারছিলাম না। যে মোহের ভিতরে ডুবে গিয়েছিলাম সেই মোহটা হঠাৎ করে এমন একটা কথা বলে আমার মনের অবস্থা পালটে দিয়েছিল। এই পাল্টানোর মাঝে তবুও আমি মেনে নিয়েছিলাম থাক না সে বন্ধু হয়ে আমার আশে পাশে। সাদা মাটা এই মেয়েটাকে অন্তত আমার পাশে পাবো।আমি না হয় একাই ওকে ভালোবেসে যাবো। এই ভালোবাসার ঝড়ে একাই ভিজে শহরটার মাঝে মিশে যাবো।শহরটাকে সাঁজাবো। একদিন সে আমার শহরটার মাঝে আসবে আমার চোখে তাকিয়ে ভালোবাসার কথা জানাবে।
দিনগুলো সেই আগের মতই চলে যাচ্ছিল। মাসের পর মাস পার হয়। আমি আমার মত করে ভিতরে ভিতরে ওকে নিয়ে গল্প লিখতাম। যে গল্পে রাতের বেলা পূর্ণিমার চাঁদ উঠে। সেই বাধ ভাঙ্গা পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় আমাদের ছায়ারা কথা বলে। ভালোবাসার কথা। কখনো কখনো সেই গল্পে জানান দেয় এক বর্ষনমুখর সন্ধ্যার। আমরা নিজেকে বৃষ্টির মাঝে মেলে ধরি।বৃষ্টিতে ভিজে শরীরে কবিতা মাখাই। কিন্তু আমি যে একটা ভুল পথে হাটছিলাম, ভুল বৃষ্টিতে ভিজছিলাম, ভুল গল্প সাজাচ্ছিলাম সেটা বুঝতে পারিনি।
বুঝতে আমার অনেকটা দেরি হয়ে গিয়েছিল।নজরুল জয়ন্তীতে সাদমানের হাত ধরে বসে রিকশা করে যেতে দেখেছিলাম। চলন্ত রিকশার মাঝে তার চুল গুলো উড়ছিল।সেই উড়ন্ত চুল কি সুন্দর করে কানের পিছনে নিয়ে গুজে দিয়েছিল সাদমান। আমার খুব খারাপ লাগছিল মনে হচ্ছিল ভিতরটা ফেটে যাচ্ছিল।কয়েকদিন পর আমি ওকে জিজ্ঞাস করলাম “সত্যি করে বলো তো, ভালোবাসা ব্যাপারটায় আসলে কি তোমার ভয় হয়?” সে কিছুক্ষন সময়ে নিয়ে বললো “কেন বলো তো?” আমি বিষন্ন মন নিয়ে বললাম “তুমি কি সাদমানকে পছন্দ করো?” ও আমার কথা শুনে খানিকটা অবাক হয়। ওর অবাক হওয়া দেখে আমি বললাম “তোমাদের সম্পর্কটা কতদিনের জানতে পারি?” সে ইতস্তত করে বললো “বেশিদিনের না। দুমাসের।কিন্তু তুমি কি করে জানলে?” আমি একটু হাসলাম।
তারপর বললাম “কিন্তু আমি তো তোমাকে সেই ভার্সিটির শুরু থেকে চেয়েছি।আমি কি বোকা দেখোই না। যে আমার না, তাকেই আমি এতো এতো চেয়েছি।আমায় তো বলেছিলে ভালোবাসায় জড়াবে না কিন্তু ঠিকি জড়ালে।তোমার তো ভালোবাসা ব্যাপারটার মাঝে ভয় লাগতো।কি লাগতো না? বলো মেয়ে? আমি কি ধরে নিব আমি তোমার যোগ্য ছিলাম না বা আমার সাথে তোমার যায় না। অবশ্য তাই ধরে নেওয়া যায়। কিন্তু আমি তোমার দোষ দিব না।ভালোবাসা কখন কিভাবে স্বপ্ন দেখায় বলা যায় না। আমাকে নিয়েই যে স্বপ্ন দেখতে হবে এমন কোন নিয়ম নেই। এই স্বপ্নটা তোমার। তোমার স্বপ্নে তুমি যাকে ইচ্ছে তাকে নিয়ে দেখতে পারো। কিন্তু এমন মিথ্যে আমাকে কেন বলেছো? খুব কষ্ট পেলাম মেয়ে। আশা করি খুব ভালো থাকবে।”
সেদিনের পর থেকে আদিবার সাথে আমি আর একটা বারও দেখা করলাম না। ইচ্ছে করতো না ওর সাথে যোগাযোগ রাখতে। যে মানুষ গুলো এমন হয় তারা অনেক ভয়ংকর হয়। তাদের আশে পাশে থাকতে নেই। আমার সময় গুলো যেন কোথায় থেমে গিয়েছিল।এই থামার মাঝে সব স্বপ্নদের আমি হারিয়ে ফেললাম।আমি উপলব্দি করলাম জীবন্তের এই সমুদ্রে ভালো লাগা কাউকে জানাতে নেই।জানালেই মানুষটার কাছে নিজের গুরুত্ব থাকে না।নিজের ইমেজটা ছোট হয়ে যায়। অপর মানুষটা দুর্বল মনে করে আঘাত আনে। আজ এতো বছর পর সুমাইয়ার মুখে আদিবা নামটা শুনে কেন যেন আমার খুব খারাপ লাগতে শুরু করলো।
এই খারাপ লাগা মন নিয়ে রাতের আকাশের দিকে তাকাই।একটা শূন্যতা আমার ভিতরটার মাঝে ভর করে।এই শূন্যতা নিয়ে আকাশের বুকে ভেসে চলা তারাদের গুনার চেষ্টা করি। কিন্তু ব্যর্থ হই। আমার মত গাধার এই জ্ঞানটাও এখন নেই যে এই তারা গুনা যাবে না। এই তারা অগনিত। দুদিন কেটে গেছে আমার দিন গুলো হঠাৎ করে কেমন যেন হয়ে গেলো। অফিসেও তেমন মন বসাতে পারিনি। সাদিক ভাই খুব ভদ্র ভাবে একটা বকা দিয়েছে “জাহেদ দরকার হলে ছুটি নাও তবুও এমন চেহারায় অফিসে দেখতে চাইনা। ই-মেইলটাও চেক করোনি তুমি আমার।” আমি শুধু ইতস্তত হয়ে বললাম “দুঃখিত সাদিক ভাই।মনের অসুখ হয়েছে।এখন একটু ভালো অনুভব করছি।”
রাতে যখন খাবার টেবিলে খেতে বসলাম “আম্মা পানির জগে পানি ঢালতে ঢালতেই বললো “তুই তো হ্যাঁ বা না কিছুই বললি না। মেয়েটাকে কি পছন্দ হয়নি?” আমি চুপ করে খেতে থাকি। বাবা আমার দিকে তাকিয়ে লোকমা দিয়ে বললো “কাকে কি বলো? নবাবজাদা তো কথা এই কান দিয়ে শুনে ঐ কান দিয়ে ঝেড়ে ফেলে দিবে।দিন দিন মানুষের বিবেক বুদ্ধি মজবুত হয়।আর তোমার ছেলের বুদ্ধি লোপ পায়।মেয়ের মাকে বলে আপনাকে কি পাত্রীর মা বলে ডাকবো? হারামজাদা একটা।” আমি কি বলবো বুঝতে পারি না।সেদিন ছাদ থেকে সুমাইয়া হঠাৎ করে কিছু না বলে চলে যাওয়াতে আমার কেমন যেন লেগেছিল বিষয়টা। সেকারণে কিছুই জানানো হয়নি।কিন্তু এমন ময়ুরাক্ষি মেয়েটার মনে যে একটা বিষন্নতা ছুয়ে আছে তোমরা কি তা জানো? এই ময়ুরাক্ষি মেয়েটার চোখে রোদ আর বৃষ্টি দেখেছি আমি। আমি খেতে খেতেই বললাম “মেয়ের ব্যাপারে তোমরা কি কিছু জানো?” বাবা খাবার থামিয়ে কিছুক্ষন চুপ করে থাকলো।আমি আর কিছু বললাম না। খেয়েই উঠে গেলাম।
অফিস শেষ করে যেই ফুটপাথ ধরে হাটতে লাগলাম তখন মনে হলো সুমাইয়াকে একবার ফোন দিলে কেমন হয়? এসব ভাবতেই সত্যিই সুমাইয়াকে ফোন দিলাম।সে রিসিভ করতেই বললাম “কিছুদিন আগে আপনাকে কিছু বলতে না দিয়েই ফোন কেটে দিয়েছি এতে কি আপনি দুঃখ পেয়েছেন মিস সুমাইয়া?” সে ঝিম মেরে থাকলো। আমি বললাম “আপনি হয়তো ভাবছেন আপনার পরিস্তিতি বা জীবনের কথা জেনে আপনাকে এড়িয়ে গিয়েছি। এমনটা ভাববেন না ঠিকাছে? আপনি যখন হঠাৎ করে আদিবা নামটা বললেন তখনি আমার চারপাশটায় আঁধার নেমেছিল। সেই আঁধারে আমি নিজেকে অসহায় মনে করছিলাম।”
আমি তাকে আমার জীবনের কথা জানাই। জানাই এই নামের একজনকে আমি কতটা চেয়েছি।কিন্তু এই চাওয়াটা কখনো আমার হয়ে উঠেনি।সুমাইয়া ইতস্তত করে বললো “মানুষটাকে কি এখনো ভালোবাসেন?” আমি কি উত্তর দিব বুঝতে পারলাম না।তবুও আমি তাকে বললাম “ভালোবাসি কিনা জানি না। কিন্তু তার কথা মনে পড়লো হঠাৎ করে বিষন্নতা ছুয়ে যায়।কাউকে এই ভাবে ভালো না লাগলে এমন বিষন্নতা হওয়ার কথা না।তবে আমি তাকে মনে করতে চাই না। তার নাম আমি হারানো বিজ্ঞপ্তিতে অনেক আগেই দিয়ে দিয়েছি। মনের হারানো বিজ্ঞপ্তিতে। সে কথা বাদ দিন।আপনাকে আমি সুমাইয়া নামেই ডাকি?” সে আমাকে শুধু বললো আচ্ছা। আমি বললাম “আপনি কখনো আপনার আসল মা বাবাকে খুঁজতে চেষ্টা করেন নি?” সে বললো “বাবা মা জানতে পারলে অনেক কষ্ট পাবে। তাই খুঁজিনি।” আমি বললাম “আপনার আসল বাবা মাকে দেখার ইচ্ছা জাগে না?”
সে কিছুটা সময় চুপ করে থেকে বললো “যে মানুষ গুলো আমাকে এইভাবে ফেলে রেখে যেতে পেরেছিল তাদের দেখে কি হবে? দেখতে ইচ্ছে করে না।শুধু তাদের সামনে গিয়ে বলতে ইচ্ছে করে কি দোষ ছিল আমার? কেন আপনারা আমার সাথে এমন করলেন? আপনাদের মনে কি একটুও মায়া হয়নি আমার ফুটফুটে মুখটা দেখে, আমার ছোট ছোট চোখ গুলো দেখে?” বারান্দায় বসে সিগারেট ফুকতে ফুকতে আমি রাতের শহরটা দেখি। ভাবি রাতটা কেন তৈরি হলো? দিনের পর রাত কেন আসে? এই রাত যত গভীর হয় মানুষের ভিতরটা তার সাথে সাথে গভীর হয়।রাতের মত মানুষের ভিতরটায়ও নিরবতা ভর করে।এই নিরবতার মাঝে দুরের একটা পথ তৈরি হয়।সে পথটার মাঝে শুধু বালি আর বালি।সে বালি মুঠোয় বন্ধি করা যায় না। একটু বাতাসেই সব হাওয়ায় বিলিন হয়ে যায়।এই হাওয়ার মাঝেই সিগারেটের ধোয়া ছেড়ে মিশিয়ে দেই।
সিগারেট খাওয়া শেষ করে রুমে যখন আসলাম ঠিক তখন আম্মা দরজায় টোকা দিয়ে ঢুকে একটু চুপ করে থেকে ইতস্তত হয়ে বললো “তুই গতকাল এমন করে বলাতে তোর বাবা, মেয়ের ব্যাপারে সব কিছু জেনেছে।বিয়েটা তুই করবি।আমরা তোকে জোর করবো না।তবে মেয়েটা ভালো।ওর জন্য একটা মায়া মায়া কাজ করছে।মানুষকে শুধু মানুষ হিসেবে চিন্তা করলে সব কিছু ঠিক থাকে। পৃথিবীটা সুন্দর থাকে। আমরাই মানুষকে বংশ, সাটিফিকেট দিয়ে গন্য করতে করতে মানুষকে মানুষ মনে করি না। সিদ্ধান্ত তোর বাবা।” আমি আম্মার কথার কোন প্রত্যুত্তর দিলাম না।শুধু ভরা চোখে চেয়ে থাকলাম। আমি এখন যে জায়গাটায় অবস্থান করছি তা দেখেই আমার কেন যেন জায়গাটার প্রেমে পড়তে ইচ্ছে করলো।আমার চোখের সামনে কি অপূর্ব সবুজময় দৃশ্য। কুমিল্লার গোমতী নদীর দৃশ্য। এই নদী দেবিদ্বার, মুরাদনগর, তিতাস ও দাউদকান্দি হয়ে একত্রি হয়েছে মেঘনা নদীর সাথে।
নদীর দুই তীরে সবুজে সবুজে ছেয়ে গেছে এই গোমতী নদী। সুমাইয়া একবার আমার দিকে তাকায় আর একবার তাকায় এই নদীটার দিকে।আমি ওর চোখের দিকে তাকিয়ে উপলব্দি করলাম সে চোখে কত প্রশ্ন।হাসপাতালে গিয়ে সেই তারিখ, দিন, সব কিছুর বিবরন দিয়ে অনেক ঝামেলার পর ওর মায়ের ঠিকানা বের করতে পেরেছি।যদিও এই শহরে এতো সহজে সব কিছু মিলে না।প্রত্যেকটা পদে পদে টাকা ঢালতে হয়। যদিও আমার দুই হাজার টাকা খরচ হয়েছে।নদীর বুকে নৌকা করে আমরা হেলতে দুলতে বেয়ে যাই। সুমাইয়া শুধু আকাশটার দিকে তাকিয়ে থাকে।এই বিশাল আকাশটার মধ্যে সাদা সাদা মেঘগুলোর দিকে তাকালে মনে হয় আমাদের সাথে সাথেও মেঘগুলো ভেসে যাচ্ছে। সে আমাকে বললো “জানেন মনটা কেমন জানি করছে।আমার হাত পা ঘেমে যাচ্ছে।” আমি বললাম “নিজেকে তৈরি রাখুন সুমাইয়া। আপনি একটা প্রশ্নের সাথে মোকাবেলা করতে যাচ্ছেন।” সে আমাকে আর কিছু বললো না। শুধু মুখ দিয়ে হুম নামক একটা শব্দ উচ্চারন করলো।
মিনিট পনেরো পর আমরা আফজাল মিয়ার বাড়ি পৌছালাম।সুমাইয়ার আসল মায়ের নাম ছিল বিবি ফাতেমা।এক মধ্য বয়স্ক লোকের সাথে স্বাক্ষাৎ পেতেই যখন উনার কথা জিজ্ঞেস করলাম উনি খানিকটা ঝিম মেরে রইলো। তারপর কি মনে করে যেন বাড়ির ভিতরে ঢুকে গেলো।আমি সুমাইয়াকে আশ্বাস দিয়ে বুঝাই একটু ধৈর্য ধরুন। তার আরও একটু পর বাড়ির ভিতর থেকে তিন চারজন লোক বের হলো মধ্যবয়স্ক লোকটা সহ।একজন আমাকে বললো “কেন খুঁজতাছেন তারে?” আমি বললাম “উনি কি বাসায় আছে? উনার সাথে একটু কথা বলতে চাচ্ছিলাম।” লোক গুলো আরও কিছুক্ষন আমাদের দিকে কেমন করে তাকালো। এই তাকানোর মাঝে আমি বেশ অবাক হওয়ার ছাপ পাচ্ছি। একজন মহিলা কান্নার গোঙরানি দিয়ে বললো “ক্যান কি হইছে?মাইয়াটা মইরাও শান্তি পায় নাই।” এটা বলেই উনি কান্না করতে লাগলেন।আমি সুমাইয়ার দিকে তাকাই। সুমাইয়া কেমন করে যেন উঠলো এই কথা শুনে।আমি কি বলবো বুঝতে পারলাম না।
অন্য আরেকজন লোক কান্না করা মহিলাটাকে দু হাতে ধরে শান্তনা দিতে লাগলেন। আমি বললাম “উনি কি বেঁচে নেই?” আমার কথা শুনে মধ্যবয়স্ক লোকটা বললো “আপনারা কারা সেইটা জানি না। কিন্তু আমাগো ফাতেমা মা তো বহু আগে মইরা গেছে ফাসি খাইয়া। তবে যার লাইগা মরছে ঐ হারামির বাচ্চাটাকে মরার আগে দাউ দিয়া কুবাইয়া মারছে।মাইয়াটারে উল্টা পাল্টা বুঝাইয়া ভাগাইয়া নিয়া গেছিলো শহরে। পরে ওরে বিক্রি কইরা দিছিলো।আমি ওর হতভাগা বাবা হই।” এটা বলেই উনি একটু থামে। একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে আবার বলতে লাগলো “মরার একদিন আগে ও আমার হাত ধইরা কাঁদতে কাঁদতে কইছিলো বাজান আমার কলিজাটারে শহরে রাইখা আইছি।আমার শরীরটা পইচা গেছে। একেবারে পইচা গেছে। বাচ্চাটার তো কোন দোষ নাই বাজান। তার প্রতি আমার কোন ঘৃনাও নাই।কিন্তু ও আমার চোখে চোখে থাকলে অত্যাচারের দৃশ্যগুলা খুইব কইরা মনে পড়বো।এটা আমার সহ্য হইবো না।
কতবার ভাবছি ওরে দুনিয়ার মুখ দেখামু না।পেটের মধ্যে থাকতেই মাইরা ফেলার ইচ্ছা হইছিল কিন্তু এই টুকু একটা বাচ্চারে মাইরা ফেলতে এই সাহস কি আমার আছে? কেমন কইরা মারমু ওরে? আকাশ কাইপা উটবো না? ওরে আমি হাসপাতালে একলা রাইখা চইলা আইছি। তবে যার কাছে রাইখা আইছি হে ওরে দেখবো। মানুষটা অনেক ভালা। আমি জানি ও একদিন আসবো। আমারে খুঁজবো।যদি আসে তাইলে ওরে জানাই দিবা ওর সামনে আমার এই মুখ দেখার কোন সাহস নাই।আমার বাচ্চাটা যেন আমাকে মাফ কইরা দেয়।” এটা বলেই উনি কাঁদতে লাগলো। এই কান্না দেখে আমার চোখের কোনায়ও পানি আসে।সুমাইয়া কেমন করে যেন একটু কেপে উঠলো। তারপর কেমন একটা আওয়াজ করে মুখে হাত চেপে একটু দুরে চলে গেলো।লোকটা আবার বলতে লাগলো “আমরা ভয়ে শহরে যাই নাই।
আমার মাইয়াটার কথা আমি বুঝি নাই। ক্যান এমন কইরা বললো। এমন কইরা বইলা গলায় ফাঁস দিবো আমরা কেউ বুঝি নাই। আপনারা কি জন্য আসছেন? হঠাৎ ওর কথা ক্যান জিজ্ঞেস করলেন?” আমি আলতো করে চোখের পানি মুছে একটু সময় নিয়ে বললাম “না না আমরা যে ফাতেমাকে খুঁজছি সে ফাতেমা কলেজে পড়ে।আমরা ভুল ঠিকানায় চলে আসছি।কিছু মনে করবেন না।” এটা বলেই চলে আসলাম। আমি জানি আমার এই মিথ্যা কথাটা বলা উচিৎ হয়নি।সুমাইয়া এখন যেভাবে আছে সেভাবেই থাকুক। এটা নিয়ে কথা বাড়ুক জানাজানি হোক ওর বাবা মায়ের কানে পৌছাক একটা ঝামেলা হোক আমি চাইনা।ও ওর বাবা মায়ের রাজকন্যা হয়েই থাকুক।কিন্তু আমি এটাও জানি এই বিষয়টা ওকে মাঝে মাঝে খুব কাঁদাবে।আর এই কান্নার শব্দটা পুরো শহরটাকে জানানোর দরকার কি আছে?
গোমতী নদীর বুক ধরে নৌকা করে ফিরার পথে আমি সুমাইয়ার দিকে তাকিয়ে থাকি।তাকিয়ে থাকি ওর চোখের দিকে। সে চোখে নদীর জলের মত জল দেখতে পাই। সে চুপ করে পানির মাঝে হাত ডুবিয়ে রাখে। আমি তাকে কিছু বলি না। এই মেয়েটার এখন যে খুব একা থাকা দরকার। কিন্তু তারপরও আমি বললাম “আমি একটা কথা মিথ্যে বলেছি সুমাইয়া। আপনি কি সেটা শুনতে পেরেছেন?” সে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে শুধু হুম করে শব্দ করলো।আরও কিছুক্ষন পর পানির মাঝে হাত ডুবিয়ে পানির দিকে তাকিয়েই বললো “মায়ের জন্য খুব কান্না পাচ্ছে জানেন। আমার মায়ের প্রতি কোন রাগ নেই এখন।সে যে আমাকে এই পৃথিবীর আলো দেখিয়েছে তার জন্য তার প্রতি আমার কৃতজ্ঞ থাকা দরকার। জাহেদ সাহেব, আমাকে কি এখন আপনার ঘৃনা করা উচিৎ না?” আমি এই মায়াবতীর দিকে তাকিয়ে থাকি। কি মায়ামায়া করে কথা বলে মেয়েটা।
আমি একটু সময় নিয়ে বললাম “মা কিছুদিন আগে একটা কথা বলেছে মানুষকে শুধু মানুষ হিসেবেই ভাবতে অন্য কিছু না।আপনি আমার কাছে এখন এমন একটা মানুষ যার চোখে তাকালে আমি একটা শহর দেখতে পাই।সেই শহরে হাজার হাজার কবিতা ঘুরে বেড়ায়।আপনি কি আমাকে কবিতা শুনাবেন রোজ?” আমার কথা শুনেই সুমাইয়া একটা আওয়াজ করে কান্না করতে লাগলো।আমি তাকে কোন শান্তনা দিলাম না।এই মেয়েটার যে একটু কান্না করা দরকার।খুব দরকার। কয়েকটা দিন কেমন করে যেন কেটে গেলো।ব্যাংকে কিছু পার্সোনাল কাজের জন্য যখন আসলাম তখন হঠাৎ একজন আমার সামনে এসে বললো “আমাকে চিনতে পেরেছেন?” আমি কিছুক্ষন উনার দিকে তাকিয়ে চিনার চেষ্টা করলাম। তিনি আবার বললেন “আমি সাদমান।যদিও আমি ভার্সিটিতে আপনাদের ডিপার্টমেন্টে ছিলাম না তবে একই ব্যাচ এর ছিলাম। আপনার কথা অনেক শুনেছি।” আমার বুকটা ধক করে উঠে। এই ধক করার মাঝে আমি অনুভব করলাম শহরে বৃষ্টি নেমেছে।
তবুও আমি স্বাভাবিক ভাবে বললাম “হ্যাঁ মনে পড়েছে। প্রথমে চিনতে পারিনি তার জন্য দুঃখিত। কেমন আছেন?” সাদমান একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললো “ভালো কি রেখেছেন ভাই?” আমি একটু অবাক হলাম। বললো “আদিবাকে বিয়ে করেছি চার বছর হয়ে গিয়েছে। আমাদের একটা ছেলে আছে। দুজনকেই প্রচন্ডরকম ভালোবাসি বিশ্বাস করুন। আদিবাাও আমাকে ভালোবাসে। কিন্তু আমাদের এই ভালোবাসার মাঝে কি যেন একটা প্রবেশ করে মাঝে মঝে। প্রায় ওর চেহারায় আমি একটা অদ্ভুত বিষন্নতা দেখি। এই বিষন্নতা হওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করবো বলে বলে কখনো করা হয়নি।কিন্তু একদিন ঠিকি করেছিলাম। সে খুব গভীর হয়ে বলেছিল “জানতে চেও না তোমার খারাপ লাগবে।” তারপর কিছুটা দিন কেটে যায় আমি আবার একই প্রশ্ন করাতে সে আপনার কথা বললো। বললো আপনি তাকে কতটা চেয়েছিলেন। আপনার সাথে যা ঘটেছে ভালো ঘটেনি। আপনার কথা মনে পড়লেই তার মনে বিষন্নতা প্রবেশ করে।
কি অদ্ভুত ব্যাপার তাই না? হা হা হা।” আমি একটু চুপ করে থেকে হাসি দিয়ে বললাম “ভাইজান আদিবার নামটাও আমি ভুলে গেছি। তখন তো ছেলে মানুষি মন ছিল কত কিছুই করেছি। আদিবা নামে একজন আমার বান্ধবী ছিল সেটাও ভুলে গেছি। আপনি মনে করিয়ে দিলেন। আচ্ছা ও চশমা পড়তো না?” সাদমান বললো “না চশমা তো পড়ে না।” আমি আরও একটা হাসি দিয়ে বললাম “দেখলেন ভাই ওর চেহারাটাই মনে নেই। আচ্ছা ভালো থাকবেন তাকেও ভালো থাকতে বলবেন।যাই কিছুটা কাজ আছে।” এটা বলেই আমি বের হয়ে যাই। রাস্তায় বের হয়ে আমি অনুভব করতে লাগলাম আমার এতো খারাপ কেন লাগছে? যাাকে মনে করতে চাই না তার কথা মনে পড়লেই খারাপ লাগে। মানুষ এতো অদ্ভুত কেন? মানুষ আর একটা মানুষের ভিতরে কেমন করে প্রবেশ করে? প্রবেশ হয়ে মানুষটাকে ছাড়কার করে দিতে পারে। এই শক্তি মানুষ কেমন করে পেয়েছে?
অন্ধকার হলেই মানুষ কল্পনা দেখতে পছন্দ করে। আর আমি মানুষটা তার বিপরীত। রাত সাড়ে দশটা বাজতেই সুমাইয়া আমাকে ফোন দিয়ে কিছুক্ষন নিরবতা পালন করে বললো “আপনি আমাকে বিয়ে করতে কেন রাজি হলেন জাহেদ সাহেব?” এই কথার কি প্রত্যুত্তর দিব আমি বুঝতে পারি না। গতকালই বাবা মাকে আমি হ্যাঁ বলে দিয়েছি।আমি বললাম “কেন রাজি হয়েছি তা বলতে পারবো না।“ সে বললো “করুনা করছেন?” আমি বললাম “এটা করুনা না সুমাইয়া।এই কয়েকটা দিন যত আপনার সাথে মিশেছি ঠিক ততবার মনে হয়েছে আপনি আমার মতই। শুধু বিষন্নতা গুলো আলাদা।
আমাদের মানুষের মন রোদ বৃষ্টির মত হয়ে থাকে। কখনো রোদের মত আলো হয়ে মুখে হাসি ফোটায় আবার কখনো বৃষ্টির মত চোখে পানি ঝড়ায়। আপনার মাঝে ছয়টা ঋতুর সব কিছুই পেয়েছি। এই ছয় ঋতুর মাঝে বিভিন্ন রকমের কবিতার ছাপ দেখেছি। শুধু রোদ বৃষ্টির কবিতা নয়। আপনি আমার ছয় ঋতুর কবিতা হবেন?” সুমাইয়া চুপ করে থাকলো। তারপর খুব গভীর হয়ে বললো “এমন করে কেন বলেন জাহেদ সাহেব? আপনি কি জানেন আপনি খুব ভালো একটা মানুষ।” আমি ভাবি সুমাইয়া কখন আমার কবিতা হয়ে আসবে। যে কবিতা আমাকে আবদ্ধ করবে। শুধু রোদ বৃষ্টির কবিতা না। ছয় ঋতুর ভালোবাসার কবিতা…
গল্পের বিষয়:
গল্প