আব্বা বিয়ে করবেন! কথাটা শুনার পর আপা অঝর ধারায় কেঁদেছিলেন। আমার ভাই অবশ্য বরাবরই চুপচাপ ধরনের। কিন্তু আমি একফোঁটাও কাঁদিনি। বরং হাসিখুশিভাবে নতুন মাকে দেখতে গিয়েছিলাম।
তখন সম্ভবত ঊনত্রিশ রোজার দিন ছিলো। আমার বড় আন্টির বাড়িতেই বিয়ের এংগেজম্যান্ট এর আয়োজন করা হয়। যখন আমরা সেখানে পৌছালাম আন্টি বলেই ফেললেন গিয়ে দ্যাখ তোর মা ফিরে আসছে। আমি কথাটা শুনার পর একমুহুর্তও দেরি করি নি। এক দৌড়ে পাশের রুমে গিয়ে দেখলাম একজন মহিলা শুয়ে আছেন। কেন জানি মনে হয়েছিলো আমার আম্মাতো সর্বদা শাড়ি পড়েন তবে ইনি কে ? ইনি তো থ্রি পিস পড়ে আছেন। ভদ্রমহিলাও আমাকে পরখ করার জন্য পাশ ফিরে শুয়েই রইলেন। আমি পকেট থেকে আব্বার দেয়া দশটাকার নতুন নোটটি বের করে উনার হাতে গুঁজে দিয়ে বলেছিলাম আমার আম্মা হবেন। উনি এপাশ ফিরেই আমাকে বুকে জড়িয়ে নিয়েছিলেন। কেন জানি সত্যিই আমি আমার আম্মাকে ফিরে পেয়েছিলাম। মাসখানিক পরে বিয়ের কাজ সম্পন্ন হয়েছিলো। আপাও নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছিলো। বিয়ের দিন যখন উনাকে(আম্মাকে) সাজাচ্ছিলো তখন আমি সাথেই ছিলাম। কতজনে কতরকম কথা বলছিলো। আমি কেবল দেখেই যাচ্ছিলাম একটা মুখের দিকে। বারবার মিলানোর চেষ্টা করছিলাম আমার মায়ের মুখ তো এটা!
বিয়ের পরের দিন ধীরেধীরে পা টিপে উনার কাছে গেলাম। আমাকে দেখে ডাকলেন। আমি আবারো মিলানোর চেষ্টা করলাম সত্যিই আম্মা ফিরে আসলো কি না। তারপর উনি জিজ্ঞেস করলেন আমার কিছু চাই কি না। আমিও কানে কানে বললাম আপনি তো আমার আম্মা নন। আপনাকে আমি চিনি। আপনি সুমির(মামাতো বোন) মেঝো আন্টি হোন। পরে উনি বললেন তো কি হয়েছে আজ থেকে আমি তোমার আম্মু। তোমাকে আমি আদর করবো, ঘুম পাড়াবো, চুল আঁচড়ে দিবো। কেন জানি পরম যত্নে অনেক্ষন উনার কাছে রয়ে গেলাম। আপা আর ভাইজানের দেখাদেখি উনাকে আন্টি বলেই ডাকতাম। উনিও তেমন কিছু মনে করতেন না। এভাবেই দিন যেতে লাগলো। হঠাৎ আপা একদিন ডেকে বললো উনাকে এখন থেকে আর আন্টি ডাকবি না। আম্মা বলেই ডাকবি। উনিই আমাদের আম্মা।
বিশ্বাস করবেন না যখন দরজার আড়াল থেকে আম্মা বলে ডাক দিয়েছিলাম চিলের মতন এসে ছুঁ মেরে বুকে টেনে নিয়েছিলেন। খুশিতে কেঁদে দিয়েছিলেন। যখন কোন প্রতিবেশির বাড়িতে যেতেন তখন কিছু খেতে দিলে আম্মা খেতেন না। নিয়ে আসতেন আমাদের জন্য। অনেকে তো কত হাসি তামাশা করতো। আবার কেউ কেউ বলে বসতো নিজের যখন হবে তখনও কি এমনই করবা ? তখন উনার উত্তর শুনে সকলেই দমে যেত। বলতো ওরা তো আমারই। একদম আমার নিজের। সব সন্তান গর্ভে ধারন করতে হয় না। আল্লাহ প্রদত্তই মা হওয়া যায়। সেবার আমার সুন্নতে খাৎনায় দেখেছিলাম একজন মা কতটা উদ্বিগ্ন হয় সন্তানের ব্যাথায়। সারারাত ব্যাথায় যেমন আমি ঘুমায়নি তেমনি আম্মাও ঘুমান নি। কারেন্ট চলে গেলে বাতাস করেছেন। বাথরুমে যাওয়ার হলে নিজে নিয়ে গেছেন। গোসলে কষ্ট হবে বলে একটু পর পর গামছা ভিজিয়ে শরির মুছে দিয়েছেন।
এতশত বলে উনার কেবল প্রশংসা করছি তেমনটা নয়। আম্মাও শাসন করতেন আর দশটা মায়ের মতন। তবে মারার পর দেখতাম সেই ডলে ডলে গোসল করিয়ে খাইয়ে দিচ্ছেন। অন্য মায়েদের মতন বলতেন কেন যে শয়তানি করিস ইত্যাদি। যেদিন নতুন বাবু হবে বলে জানতে পেরেছিলাম আমরা সকলে কী খুশিটাই না হয়েছিলাম। সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছিলো আপা। আমাদের খুশি তে সবাই খুব খুশি হয়েছিল। সন্তান প্রসবের দিন সবচেয়ে বেশি ভয় পেয়েছিলাম আমি। কারণ তখন তো খুব ছোট ছিলাম। রাতে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ি। কিন্তু স্পষ্ট মনে আছে যখন দেখলাম ঘুম থেকে জাগিয়ে আপা আমার হাতে ছোটবোনকে দিলো মনের মধ্যে একটা প্রশান্তির বাতাস বয়ে গিয়েছিলো।
ফুড়ুৎ করে দরজার ফাঁক দিয়ে আম্মাকে দেখতে গিয়েছিলাম। নানি মামিরা আমাকে দেখতে দেয়নি। পরেরদিন যখন আব্বা আসলো তখন খুব খুশি হয়েছিলাম। আব্বা যখন ছটিঘরে(স্থানীয় ভাষায় যে ঘরে সন্তান জন্ম হয় তাকে ছটিঘর বলে) যাবে তখন দরজার ফাঁক দিয়ে আমি আম্মার দিকে চেয়েছিলাম। উনি আমাকে দেখেই ডেকে নিলেন। আমিতো খুশিতে আত্মহারা। আব্বাকে ছোটবোনের এটাসেটা বর্ণনা দিতে দিতে জান যায় অবস্থা। আমার পাগলামী দেখে আব্বা আম্মা উভয়ে হেসে দিয়েছিলো। আম্মার পাশে গিয়ে বসে কেবল একটি কথাই বলেছিলাম আম্মা আপনার অনেক কষ্ট হয়েছিলো তাই না? আমি শুনেছি আপনি অনেক কান্না করেছেন। কত আসতে চাইলাম। নানিরা আসতেই দিলো না। আম্মা কিছু না বলে কেবল বুকে টেনে নিয়েছিলেন।
মাঝেমধ্যেই একটি কথা বলে আম্মা আমাকে খুব খেপাতেন। বলতেন “ধর যদি আমি মরে যাই তখন কি করবি” । আমিতো তো উনাকে ধরে বলতাম আপনাকে কখনো মরতেই দিবো না। পাগল ছেলে বলে আম্মা হাসতেন। তারমাঝে অনেক দিন কেটে যায়। মাঝেমাঝেই আম্মা অনেক ভুল করে বসতেন পাড়া প্রতিবেশির কুযুক্তি শুনে। বিশেষ করে উনার এক খালার বাড়ি ছিলো আমাদের বাড়ির খুব কাছেই। যিনি নানা কুমন্ত্রণা দিতেন। কিন্তু আম্মা ভুল করার পর যখন বুঝতে পারতেন তখন দেখতাম নিজে নিজে কান্না করতেন ঠিকমতো খেতেন না। এমন অনেকবারই হয়েছে। কিন্তু যদি ভুলেও কোন প্রতিবেশি আমাদের কখনোই কিছু বলতো উনি একচুলও ছাড় দিতেন না। সেবার উনার আপন বড়বোন অর্থাৎ আমার মামি যার বড় মেয়ে আমাকে টুল থেকে ফেলে দিয়েছিল সেটার বিচার না করায় আপন বড়বোনের সাথে কি ঝগড়াটাই না করলেন। পুরো বাড়ির লোকজন থ হয়ে গিয়েছিল।
আম্মা আর ছোটবোনকে নিয়ে আব্বা লক্ষীপুরে কর্মস্থলে চলে গেলেন। আমাকে নেয়ার জন্য কত জোরই না করেছেন। ওই যে কথায় আছে কানপড়া কানে একবার ঢুকলে সহজে বের করা যায় না। আমাকে অনেক চাচি প্রতিবেশিরা বলেছিলেন বাসায় নিয়ে ইচ্ছেমতন মারবে। আমিও বিশ্বাস করে বসেছিলাম। তাই আর যাওয়া হয় নি। আব্বা তো ভীষণ রেগে গিয়ে ছিলেন। তবে সেবার স্কুলের গ্রীষ্মের ছুটিতে আব্বা ছোটবোনকে নিয়ে আসলেন আমাকে বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আমি নির্ধিদ্বায় গিয়েছিলাম। লক্ষীপুর যাওয়ার কয়েকদিনের মাথায় আব্বা হার্ট এ্যাটাক করলেন। আমি তখন নিত্যদিন একজন মাকে দেখতাম, একজন স্ত্রী কে দেখতাম একজন সেবিকা কে দেখতাম। খুব ভোরে উঠে রান্না করে খাবার নিয়ে আমরা হাসপাতালে দৌড় লাগাতাম। সারাদিন থেকে আবার রাতে চলে আসতাম। ধীরেধীরে আব্বা সুস্থ হয়ে গেলেন। মাঝখানে কয়েকটা মাস কেটে যায়।
ঠিক এমনই রোজার দিনে বিকেলে আম্মার ফোন থেকে কল আসে আপার ফোনে। কি কারণে যেন ফোন আমি রিসিভ করতেই ওদিকের কণ্ঠ শুনে আর কান্না ধরে রাখতে পারি নি। আম্মা কাঁদছেন আমিও কাঁদছি আমার কান্না দেখে আপা এসে কে কে বলতে ফোন নিয়ে আপাও ভীষণ কাঁদলেন। আম্মা ফোনের ওপার থেকে বললেন কেউ উনার সাথে কথা বলে না কাছে যায় না। শুধু নার্সরাই যায়। তাও নাক ছিটকাতো। আব্বাই কেবল কয়েকদিন পরপর ছুটি নিয়ে গেলে ওনার পাশে বসে থাকতেন। তবে ডাক্তারের কড়া নিষেধ ছিলো আম্মা যেন কোন কথা না বলেন। আম্মার টি.বি হয়েছিলো। যার ফলাফল লিভারে পানি জমে গিয়েছিল। একটু থেকে একটু কথা বললেই লিভারে পেইন হতো। সেদিন নাকি আব্বা ফোন চার্জে লাগিয়ে বাইরে গিয়েছিলো। আম্মা ফোন হাতে পেয়েই কল দিয়েছিলো। ফোনে কাঁদতে কাঁদতে আম্মা আর আমাদের খুবই করুণ অবস্থা হয়েছিলো।
বিশ্বাস করতে পারবেন না সেদিন জীবনে নিজেকে এতো অসহায় মনে হয়েছিলো যে দৌড়ে চট্টগ্রাম মেডিকেলে গিয়ে আম্মার বুকে ঝাপিয়ে পড়ে বলি আম্মা দেখেন এইতো আমরা এসেছি। তবে কথা দিয়েছিলাম পরেরদিন ই আমরা রওনা দিবো। দিয়েছিলাম ও। কিন্তু আম্মার সাথে সেই যে কথা হয়েছিলো এর পরে আর কথা হয় নি। পরের দিন যখন গাড়ি কুমিল্লার কাছাকাছি তখন আব্বা ফোন করে কাঁদছিলেন আর কিছু বলতে পারেন নি। পরেরদিন দুপুরে যখন আমরা পৌছাই তখন আম্মাকে নানারবাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো। মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিলো। যখন ঘরে গিয়ে দেখলাম আম্মাকে শুইয়ে রাখা হয়েছে আর ছোটবোন কাঁদছে বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছিলো। আব্বাকে সেবার পুনরায় কাঁদতে দেখেছিলাম। একজন অসহায় বাবাকে দেখেছিলাম। ছোটবোন আমাদের দেখেই দৌড়ে এসেছিলো। মনে তখন একটি কথাই আসছিলো আমার আম্মা মারা যাওয়ার সময় তো তাও আমি যথেষ্ট বুঝি। কিন্তু ছোটবোন তো একেবারেই ছোট।
যখন আম্মাকে কবর দেয়া হলো কেন জানি কবরে মাটি দিতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিলো এই বুঝি আম্মা বলছে আমজাদ আয় আমার বুকে আয়। একবার আম্মা বলে ডাক। আমার একটা অভ্যাস ছিলো আম্মার পেটে হাত দিয়ে ঘুমাতাম। মাঝেমাঝে এটা নিয়ে আম্মা মজা করে বলতেন যখন আমি মারা যাবো তখন আমার পেটটা কেটে রেখে দিস। নইলে তো তোর ঘুম হবে না। আম্মার ওই হুটহাট বলা কথাগুলো বড্ড ভাবি। সেদিন আমার চঞ্চল মা কে কবরে রেখে এসেছিলাম একদম একা করে। যখনই কক্সবাজার যাই এবং নানারবাড়ি যাই আগে কবরস্থান হয়ে যাই যেখানে আমার চঞ্চল মা ঘুমায়। যেখানে আমার শান্তির আবাসস্থল নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে। যে আমার দিকে চেয়ে বলছে আমজাদ আয় আমার বুকে আয়। মানুষ বলে নিজের মা ছাড়া অন্যকেউ মা হতে পারে না। যা হয় তা সৎ মা। কিন্তু আমি সবাইকে গর্ব করেই বলতে পারি আমার দু’টো মা। একজন আমাকে জন্ম দিয়েছেন। আরেকজন স্বল্প সময়ের জন্য হলেও মায়া মমতায় ঘিরে রেখেছিলেন।
মোনাজাতে যখন আব্বা আম্মার জন্য ” রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বায়ানি ছগিরা” পড়ি তখন আমি তিনবার পড়ি। একবার আব্বার জন্য আর দুইবার আমার দুই মায়ের জন্য। আমার দু’টো মা আমার দু’টো বেহেস্ত। আমার দু’টো শান্তির আবাসস্থল। আমার দু’টো শান্তির পরশ ঘুমায়। দুনিয়ার সকল মায়ারা, বুনো পাতারা, পাখিরা ভীড় জমায়। তারা কাঁদে আমিও কাঁদি। আকাশের তারাদের মাঝে নাকি মানুষ হারিয়ে যাওয়া আপনজন দের খোঁজে পায়। আমিও পাই। একজন মা আমাকে রাতে ঘুম পাড়ায় আরেকজন মা আমাকে ঘুম থেকে জাগায়।
গল্পের বিষয়:
গল্প