লাইলী তার ছেঁড়া ওড়না দিয়ে বারবার পুরো শরীর ঢাকার চেষ্টা করছে। চল্লিশোর্ধ লোকটি তবুও লাইলীর গলার দিকে তাকিয়ে ঢেকুর তুলছে। ক্ষুধার্ত শিকারী বাঘের মতো এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। লোকটি মনে হয় চোখের পলক ফেলতে ভুলে গেছে। অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে লাইলী আবার কখন নিচের দিকে নুয়ে খুনচি দিয়ে পিঠা তুলবে। তখন ওড়নাটি একটু সরলেই গলার কাছের জামার ফাঁক ফোকর দিয়ে কিছু একটা দেখতে পাবে। আমি গিয়েছিলাম লাইলীকে একনজর দেখতে। রোজ সকালে তাকে না দেখে আমি আমার কর্মদিবস শুরু করি না। গিয়ে দেখি লম্বা টুলে দুইজন বসে আছে। একজন বৃদ্ধ লোক চাদর জড়িয়ে বসে আছে। উনাকে আমার চেনা হয়ে গেছে এতদিনে। রোজ সকালে বৃদ্ধ লোকটি তার নাতনির জন্য পিঠা নিতে আসে। দ্বিতীয় লোকটিকে আজই প্রথম দেখলাম। ডানে বামে না তাকিয়ে সোজা তাকিয়ে আছে লাইলীর দিকে। এই কুয়াশার ভোরেও রাগে আমার শরীরে আগুন ধরে যাচ্ছে। আমি লোকটির সামনে গিয়ে লাইলীর দিকে মুখ করে দাঁড়িয়েছি।
লাইলী মাথা তুলে তাকাতেই জানতে চাইলাম, “কেমন আছিস লালী?” লাইলী হাতে খুনচি নিয়ে মাথা তুলে তাকিয়েছে আমার দিকে। মনে হচ্ছে চোখ কোঠর থেকে বেরিয়ে আসবে। চোয়াল শক্ত করে বলল, “তোকে কতদিন বলছি আল্লাহর দোহাই লাগে আমার দোকানে আসবি না। লাজ-শরম নাই তোর? আর লালী কী? আমার নাম লাইলী, গরু ছাগলের নাম লালী। তুই আমারে গরু ছাগল পাইছস?” পেছনে টুলে বসা লোকটি আমার জন্য লাইলীকে দেখতে পাচ্ছে না। তাই একটু ডানদিকে সরে বসেছে, যেন দেখতে পারে। আমি হাতের মুষ্ঠি শক্ত করে আবারো লোকটির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে লাইলীকে বললাম, “তুই অযথাই আমার সাথে রাগ করোস। তুই গরু ছাগল হবি কেন? তুই কত সুন্দর। একদম লাল টকটকে সুন্দর। যখন চূলার পাশে বসিস, আগুনের ফুলকির মতো একদম লাল টকটকে দেখা যায়। তাইতো লালী ডাকি, লাল থেকে লালী।”
লাইলী পিঠা তুলতে তুলতে বলল, “মিজান তুই যা তো আমার চোখের সামনে থেকে। আমার এখন বেচা-কেনার সময়।” লাইলী পিঠা তুলে কাগজের উপর রেখে বৃদ্ধ লোকটিকে উদ্দেশ্য করে বলল, “এই যে দাদা। এই নাও তোমার পিঠা।” বৃদ্ধ লোকটি পিঠা নিয়ে যাবার পর পেছনে বসা লোকটি আবার বাম দিকে সরে বসলো লাইলীকে দেখতে। এবার মেজাজ চরমে উঠে গেছে। আমি পেছন ফিরে সরাসরি লোকটির চোখের দিকে তাকালাম। লোকটি আমার দিকে তাকিয়ে কেমন ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। আমি চোয়াল শক্ত করে লোকটিকে উদ্দেশ্য করে বললাম, “একটু উঠুন তো, টুল সোজা করব।”
লোকটি অবাক হয়ে অনিচ্ছায় উঠে দাঁড়ালো। আমি টুল তুলে পাঁচ হাত পেছনে সরিয়ে লোকটিকে বললাম, “এখানে বসেন আপনি। পিঠা হলে আপনাকে ডেকে দিবে।” লোকটি আমার দিকে বাঁকা চোখে তাকিয়ে কিছু না বলে চলে গেল। লাইলী আবারো আগের মতো খুনচি হাতে নিয়ে আমার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে। আমি একটু এগিয়ে যেতেই বলল, “এই বেশরম। এই বেহায়া, তোকে কতবার বলছি আসবি না তুই আমার দোকানে। সাতসকালে আমার কাস্টমার তাড়িয়ে তোর কী লাভ হলো বলতো?” আমি মাথা নিচু করে বললাম, “লালী তুই তো জানিস আমি কেন আসি তোর কাছে? তোকে ভালোবাসি বলেই আসি।” লাইলী বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আমি মরার আগ পর্যন্ত তোকে ভালোবাসব না। তোকে না শুধু কাউকে না। আল্লাহর দোহাই লাগে তুই আর আমার দোকানে আসিস না মিজান।”
চিতই পিঠা পুঁড়ে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি করে পিঠা তুলতে গিয়ে দেখে নিচে পোঁড়া অংশ লেগে গেছে। আমার দিকে তাকিয়ে লাইলী পিঠা ফেলে দিলো। প্রচন্ড রেগে গেছে মেয়েটা। আমি মাথা তুলে তাকিয়ে বললাম, “আমার নাম মিজান হলেও তোর জন্য নাম আমার মজনু। লাইলীর একমাত্র মজনু। তুই যেহেতু চাস না, আমি আর আসব না তোর দোকানে। কিন্তু ওড়না এভাবে না দিয়ে কোমড়ে পেঁচিয়ে পরে নিস।” কথাটুকু বলে আমি চলে এসেছি সেখান থেকে। এখানে লাইলীর মা পিঠা বিক্রি করতো দশ-বারো বছর ধরে। বছর দুয়েক আগে লাইলীর মায়ের কী এক অসুখ করেছে। অসুখের নাকি নামই জানে না। পরীক্ষা না করলে জানবে কী করে? আর পরীক্ষা করানোর টাকাটাই আসবে কোথা থেকে? সবচেয়ে বড় কথা হলো, গরীবের রোগের কোনো নাম জানা লাগে না। ফার্মেসীতে গিয়ে বললেই হলো, মাথাটা ঘুরায়, শরীরটা কামড়ায়, মাজা ব্যথা করে। এতেই কম দামের দুই চারটা ট্যাবলেট খেয়ে শুয়ে থাকে এই বস্তির মানুষগুলো।
লাইলীর মা বিছানায় পড়ার পর হঠাৎ একদিন লাইলী এসে পিঠা বানিয়ে বিক্রি শুরু করে। প্রথম থেকে লাইলীর সাথে আমার এমন দা-কুমড়া সম্পর্ক ছিল না। প্রেম-ভালোবাসার সম্পর্ক না থাকলেও তার সাথে আমার এতো তিক্ত সম্পর্ক ছিল না। দোকানে বসে গল্প জুড়ে দিতাম। সকালে অনেকে একসাথে পিঠা নিতে আসে, তাই একটা ধাক্কা যায় তখন। তারপর আসে টুকটাক কাস্টমার। আমি তখন নানান গল্প জুড়ে দেই লাইলীর সাথে। আগে তার এতো রাগও ছিল না। কত ক্ষেপানোর চেষ্টা করতাম। বলতাম “তোর চোখ এমন বড় বড় কেন? একদম গোরুর মতো।” বলতাম, ” তোর দাঁত তো একেকটা লাউয়ের দানার মতো বড় হইছে।” কিছুক্ষণ গাল ফুলিয়ে আবার রাগ কমে যেত। তার রাগ শুরু হয়েছে তাকে যেদিন প্রেম নিবেদন করেছিলাম, সেদিন থেকে।
সেদিন সকালে কুয়াশায় চারদিক আচ্ছন্ন ছিল। হাত পাঁচেক পরের মানুষকে দেখা যাচ্ছিলো না। আমি গিয়ে দেখি লাইলী চূলা জ্বালাচ্ছে। গোবরের তৈরী লাকড়ি কুয়াশায় কেমন নেতিয়ে আছে। আগুনের আঁচে তেতে উঠার আগ পর্যন্ত জ্বলবে না মনে হচ্ছে। আমি টুলে বসতে বসতে বললাম, “লালী তোর কষ্ট দেখে আমার অন্তর পুঁড়ে। বিয়ের পর আমার ঘরে যেদিন যাবি, সেদিন থেকে তোর কষ্টের দিন শেষ। আর পিঠা বানাতে হবে না।” লাইলী ডানে কাত হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “সাত সকালে আমাকে রাগাতে আসলি?” আমি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে লাজুক স্বরে বললাম, “লালী তোর বিষয়টা জানা দরকার। বুঝা দরকার। আমি ভেবেছিলাম এতদিনে তুই বুঝতে পারবি। আমি যে রোজ নিয়ম করে তোকে দেখতে আসি। তার কারণ একটাই। আমি তোকে ভালোবাসি। মা’কে বলেছি তোর কথা। তোকে বউ করতে চাই।” লাইলী উঠে দাঁড়িয়েছে। তার প্রধাণ অস্ত্র খুনচি হাতের মধ্যে। তারপর বলল, “রোজ শুধু তুই একা আসিস না। কত মানুষ পিঠা নিতে আসে। তার মানে সবাই আমাকে ভালোবাসে?”
-সবার কথা আলাদা লালী। আমি তোকে দেড় বছর আগে থেকেই পছন্দ করি।
-আমি পছন্দ করি না। শুধু তোকে না, কোনো পুরুষকেই না। পেটের দায়ে পিঠা বিক্রি করি পুরুষের কাছে। কিন্তু মন থেকে ঘৃণা করি। লাইলীর কথা শুনে আমার প্রচন্ড রাগ হলো। সমগ্র পুরুষ জাতীকে সে কেন অপছন্দ করবে? আমি রাগের মাথায় বলে ফেললাম, “তোর বাবা নাহয় তোদের ছেড়ে চলে গেছে। চারটা পাঁচটা বিয়ে করে বিভিন্ন জায়গায় বাচ্চা ফুটাইছে। তাই বলে সব পুরুষ খারাপ?”
কুয়াশা কাটতে শুরু করেছে। অনেকটা দূর অবধি রাস্তাঘাট দেখা যায়। সলিম চাচা খেজুরের রসের কলস নিয়ে এদিকে আসছে। লাইলীর চোখে টলমলে পানি। চোখের পলক ফেলার সাথে সাথে টপ করে গাল বেঁয়ে নেমে যাচ্ছে নিচে। খুনচি উঁচু করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোর যদি শরম থাকে তুই আর কোনোদিন আমার দোকানে আসবি না। বেহায়ার মতো তোর চেহারা দেখাতে আসবি না। যা এখান থেকে।” আমি লাইলীর কথায় সেদিন চলে আসলেও তার দোকানে যাওয়া ছাড়িনি। সে দাঁতে কিড়মিড় করে আমাকে সহ্য করে। কখনো গালি দিয়ে রাগ ঝাড়ে। একই বস্তিতে থাকি বলে অনেকেই জানে বিষয়টা। লাইলীর বাবা তার মা’কে রেখে আরো তিনটা বিয়ে করেছে। বাড়িতে আর আসে না। দশ বারো বছর আগেই লাইলীর মা সংসার চালাতে আর পেট বাঁচাতে পিঠা বানানোর কাজ শুরু করে। সেই সময়টাতে লাইলী অনেক ছোট ছিল। তাকে প্রথম ভালো লেগেছিল এই পিঠার দোকানেই। পছন্দের কথাটি মা’কেও জানিয়েছি। মা বলেছে, “আগে টাকা পয়সা জমানো শুরু কর। লাইলীর মা’কে আমি বললে রাজী হয়ে যাবে।”
আমার বাবা ছিলেন ভ্যান ড্রাইভার। সামান্য পেট ব্যথার মতো অসুখে তিনি মারা গেলেন। আমি তখন এসএসসি পাশ করে কলেজের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। বাবার অনেক ইচ্ছে ছিল আমি অনেক লেখাপড়া করব। কিন্তু ভাগ্যের কারণে সেই ভ্যান এখন আমি চালাই। পাওয়ালুমের সূতার ববিন নিয়ে যাই এক স্থান থেকে অন্য স্থানে। লাইলীকে বিয়ে করার জন্য টাকা জমাচ্ছি। রাতে প্রতিদিনই দুয়েক ঘন্টা বেশি পরিশ্রম করি। রাতের পরিশ্রম গায়ে লাগে না। চারিদিক নিরিবিলি থাকে। শুধু সাহেবনগরের উঁচু ব্রীজটা টেনে তুলতেই যা কষ্ট। তারপর ব্রীজ থেকে ধরে রাখলেই ভ্যান নেমে যায়।
আজ সকাল শুরু হয়েছে কুয়াশা ছাড়া। মাঘ মাসের শীত এমনই। দিনে মনে হয় শীতই নেই। সকালে কুয়াশা থাকে নাম মাত্র। কিন্তু রাতে চিমটানো শীত। আমি লাইলীর দোকান থেকে একটু দূরে ভ্যানে বসে আছি। সেদিনের পর থেকে আর তার দোকানে যাই না। আমার দিকে দুইবার চোখাচোখি হয়েছে। আমাকে দেখে একটু সোজা হয়ে বসে ওড়না টেনে নিচ্ছে কোমরের দিকে। সেদিনের পর থেকে লাইলী ওড়না পরে কোমড় পেঁচিয়ে। আমি তাকিয়েই আছি তার দিকে। আগুনের আঁচে সুন্দর মেয়েটা দিনদিন কেমন কালো হয়ে যাচ্ছে। কাস্টমার নেই তেমন একটা। হঠাৎ লাইলী একটু জোরেই ডাক দিলো আমাকে। “এই মিজান, টুলে এসে বস।”
অবাক হয়েই জানতে চাইলাম, “ডেকে নিয়ে আবার গালি দিবি নাকি? আমি তো তোর কাস্টমার নষ্ট করি।” লাইলী আর কিছুই বলছে না। আমি ভ্যান রেখে এগিয়ে গিয়ে টুলে বসে পড়লাম। আমি তার দিকে তাকিয়ে থাকলেও সে পিঠা বানিয়ে কাঠের বাক্সে জমা করায় মগ্ন। আমি বললাম, “লালী, মিজান না ডেকে মজনু ডাকতে পারিস না?”
চোখ তুলে তাকিয়ে বলল, “তোকে ডেকে আনাটাই আমার ভুল হইছে।” বস্তির সালাম চাচার ছোট মেয়েটা দৌড়ে এসে বলল, “লাইলী আফা তোমার মা কেমন জানি করছে। তুমি আসো তাড়াতাড়ি।” লাইলী ব্যস্ত হয়ে উঠে পড়ল। আমাকে বলল, “মিজান তুই একটু দেখিস আমি মার কাছে গেলাম।” খালি পায়ে দৌড় দিলো লাইলী। চূলার তাওয়ায় এখনো একটি পিঠা আছে। খুনচি দিয়ে তুলতে হবে। নয়তো পুঁড়ে যাবে অচিরেই। আমি বস্তির গলির দিকে তাকিয়ে আছি। পাঁচ মিনিট পরই লাইলী ব্যস্ত হয়ে ফিরে এলো। দূর থেকেই বলছে, “মিজান মা’কে হাসপাতালে নিতে হবে। তোর ভ্যানটা একটু নিয়ে আয়।”
আমি ভ্যান নিয়ে ছুটে গেলাম বস্তিতে। লাইলী আর সালাম চাচার বউ মিলে অসুস্থ মানুষটিকে ভ্যানে তুলল। আমি সদর হাসপাতালের দিকে রওনা দিলাম। লাইলী কান্না করছে। তার মা বুক ব্যথায় আর্তনাদ করছে। আমার বাবা যেদিন মারা যান, সেদিনও এমন দৃশ্য দেখতে হয়েছে আমাকে। বুকে হাত রেখে মায়ের হাত ধরে বলেছিল, “তোমার পোলাটারে তুমি দেইখা রাইখো। বস্তির খারাপ পোলাপাইনের সাথে চলতে দিও না।’ হাসপাতালে নেবার ঘন্টা চারেক পর বাবা মারা গেলেন। সালাম চাচার বউ আমাকে বলল, “মিজান ভ্যান ঘুরিয়ে ফেল।” আমি পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখি আর্তনাদ করা মানুষটি ভ্যানে শুয়ে আছে নীরব হয়ে। ঘুমিয়ে পড়েছে লাইলীর মা। এই ঘুম আর ভাঙ্গবে না। চিরতরে মানুষ যখন ঘুমিয়ে পড়ে তখন কারো ডাকে সাড়া দেয় না। লাইলী তার মায়ের বুকের উপর শুয়ে জোরে কান্না করছে। আমার চোখ ভরে পানি এলো। ভ্যান ঘুরিয়ে বস্তিতে নিয়ে গেলাম। অনেকেই ছুটে এসেছে। ভ্যানের চারিদিক জটলার মতো হয়ে গেছে। বেঁচে থাকতে মানুষ আসার অভাব হলেও মরে গেলে ভীড় জমে। শেষবারের মতো দেখার ভীড়।
চারদিন পর লাইলী পিঠার দোকান খুলে বসলো। আমি টুলে বসে আছি। বৃদ্ধ লোকটি আজ আবার এসেছে তার নাতনীর জন্য পিঠা নিতে। লাইলী পিঠা বানাতে ব্যস্ত। কখনো খুনচি হাতে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে অন্যদিকে। আমি তাকে কিছু বলার মতো সাহস পাচ্ছি না। আমি কাউকে সান্তনা দিতে পারি না। বৃদ্ধ লোকটি পিঠা নিয়ে চলে যাচ্ছে। আমি বললাম, “লাইলী একটা পিঠা দে তো। সরিষার ভর্তাটা বাড়িয়ে দিবি।” লাইলী আমার দিকে তাকিয়ে হেসে দিলো। আমি তার হাসির কারণ খুঁজে পাচ্ছি না। কিন্তু হাসলে যে তার বাম গালে টোল পড়ে, এই মনোরম দৃশ্য দেখা থেকে পিছপা হইনি। আমি জানতে চাওয়ার আগেই হেসে হেসে লাইলী বলল,
“আজ আবার লালী থেকে লাইলী হয়ে গেলাম?”
নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। আমি চাচ্ছিলাম না তাকে লালী ডেকে রাগাতে। মন খারাপের সময় কেউ রেগে গেলে ভয়ংকর আকার ধারণ করে। আমি বললাম, “লালী ডাকলে তো তুই রেগে যাস। আর তুই তো প্রতিদিন নিষেধ করোস লালী ডাকতে।” লাইলী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “লালী ডাক শুনে রাগ করতাম ঠিকই। কিন্তু আজ তোর কাছ থেকে লাইলী ডাক শুনে মনে হচ্ছে কোনো এক অচেনা নামে আমাকে ডাকছিস।” আমি কিছু বুঝে উঠতে পারছি না আজ কী হলো লাইলীর? সে কি তাহলে এতদিন মনে মনে পছন্দ করতো আমাকে? মেয়েদের মন বুঝা বড় দায়। জিলেপীর প্যাঁচের মতো। আমি বললাম, “লালী আমাকে মজনু বলে ডাকবি?” আবারো সেই পুরোনো রূপ। খুনচি হাতে নিয়ে রেগে বলল, “যা তো তুই এখান থেকে। আর আসবি না আমার দোকানে।” আমি লাইলীর কথা শুনে মন খারাপ করে চলে আসছিলাম। লাইলী ডাক দিলো, “এই মজনু শোন।”
দেড় বছর ধরে বলেও মেয়েটাকে মজনু নাম বলাতে পারিনি। আজ আমাকে মজনু বলে ডাকলো। আমার খুশিতেও চোখ ভিজে যায়। এটা প্রতিটা মানুষেরই স্বভাবগত। অতি আনন্দে চোখ ভিজে যায়। আমি এগিয়ে গিয়ে টুলে বসে পড়লাম। তাওয়ার পিঠা হয়ে গেছে। পিঠা তুলে কাঠের বাক্সের উপর রাখা উচিত। কিন্তু লাইলী তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি দুইবার চোখ নামিয়ে নিয়েছি। লাইলী তবুও তাকিয়ে আছে। পিঠা নিশ্চয় এতক্ষণে পুঁড়ে যাচ্ছে। সেদিকে তার মনোযোগ নেই। লাইলী হঠাৎ বলে উঠল, “তোকে শতবার না করার পরও আমাকে লালী ডাকিস। শতবার না করা পর আমাকে দেখতে দোকানে আসিস। এখন একবার চলে যেতে বললাম আর চলে যাবি?” হঠাৎ করে মেয়েটাকে পূর্ণ নারী মনে হচ্ছে। প্রাপ্ত বয়ষ্ক সংসারী একটা মেয়ে মনে হচ্ছে। ভিতরের কথা যেন কাব্য হয়ে ঠোঁটে চলে এসেছে। আমি বললাম, “না যাব না। একবার যেহেতু মজনু বলে ডেকেছিস, আমাকে আর তোর কাছ থেকে তাড়াতে পারবি না।’ লাইলী নিচে তাকিয়ে দেখে তার পিঠা পুঁড়ে গেছে। মুচকি হেসে পোঁড়া পিঠা ফেলে দিয়ে খুনচি দিয়ে তাওয়া পরিষ্কার করতে করতে বলল, “তোর চোখ দু’টিকে আমি বিশ্বাস করি। এজন্যই তোর চোখে চোখ রেখে কথা বলি।”
আমি জানতে চাইলাম, “আমার চোখকে বিশ্বাস করিস। আমাকে করিস না?” লাইলী আবারো আমার দিকে তাকিয়ে চোখে দৃষ্টিপাত করে বলল, “মেয়েরা চাহনি দেখে বুঝতে পারে কোনটা লালসার চোখ কোনটা ভালোবাসার চোখ। ঐদিন টুল টেনে পিছনে নেবার পর যে লোকটি চলে গেল। তার চোখে নোংরা কাব্য লেখা ছিল। আর তোর চোখে ভালোবাসা। ভালোবাসার চোখকে বিশ্বাস করাই যায়। আর ঐ চোখের মানুষটিকেও।” আমি টিটকিরি করে বললাম, “নাইন পর্যন্ত পড়ে এতসব রোমান্টিক কথাবার্তা শিখলি কী করে?” লাইলী হেসে বলল, “রোমান্টিক কথা কাগজে ছেপে কেজির দরে বিক্রি করে। আর আমি সেই কাগজে পিঠা বিক্রি করি। শিখতে হয় না, চোখ বুলাতে বুলাতে শেখা হয়ে যায়।”
আমি এই প্রথম একটানা তাকিয়ে আছি লাইলীর চোখের দিকে। চোখও নাকি কথা বলা শুরু করেছে আজকাল। আমার চোখে তাকিয়ে কতকিছু বুঝে ফেলে লাইলী। তার চোখ দুটিকে যেন মনে হচ্ছে “অপেক্ষা”। যেন অপেক্ষা করে আছে কারো জন্য। দূর দেশে যখন স্বামী যায়। নদীর ওপার থেকে এক জোড়া চোখ তার স্বামীর অপেক্ষা করে, কবে সে বাড়ি ফিরবে। লাইলীর চোখেও এক প্রকার অপেক্ষা। বাবা মা হারা মেয়েটি বড্ড একা হয়ে গেছে। আমার অপেক্ষা করছে সে। লালী মজনুকে আপন করে পাবার অপেক্ষায়।
গল্পের বিষয়:
গল্প