বাবা যখন দ্বিতীয় বিয়ে করে আনে তখন থেকে আমি আমার বাবা আর আমার নতুন মাকে ঘৃণা করি। আমার মায়ের মারা যাওয়ার ১ মাস হতে না হতেই বাবা আবার বিয়ে করে নিলো এটা ভাবতেই যেন আমার সারা শরীর গুলিয়ে ওঠে।
মা বেচে থাকাকালীন শুনেছিলাম বাবা আর মা নাকি পালিয়ে বিয়ে করেছিলো। আমার নানারা খুব উচ্চবংশীয় হওয়াতে বাবা মায়ের ভালোবাসাকে তারা মেনে নিচ্ছিলোনা কারণ আমার বাবা এতিম ছিলো। এ জন্য বাবা মা পালিয়ে চলে আসে। এরপর ভালোবাসার সংসার শুরু। বিয়ের তিন বছরের মাথায় আমার জন্ম হয় বাবাও বেশ ভালো চাকরি পেয়ে যায়। আমার ১৩ বছর বয়সে, অর্থাৎ গত মাসেই আমার মা আমার ছোটো ভাই রিমনকে জন্ম দিতে গিয়ে মারা যায়। আর আজকে বাবা তার নতুন বউকে নিয়ে বাড়িতে আসে। হ্যা ওটা বাবার নতুন বউ তবে আমার নতুন মা না।স্কুল থেকে ফিরে এসে দেখলাম লাল বেনারসি শাড়ি পড়ে একজন মহিলা ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে আছে। তার কোলে আমার ছোট্ট ভাইটা নিজের হাত পা ছুড়ে খেলা করছে। বাবা আমাকে দেখেই বলল,
– মা রিন্তী, এটা হচ্ছে তোমার নতুন মা।
ওই মহিলাটা হাতের ইশারায় আমাকে কাছে ডাকলো। তবে আমি গেলামনা ওনার কাছে বরং দৌড়ে নিজের ঘরে চলে গিয়ে দরজা আটকে দিলাম। ১৩ বছর বয়সে এটা বোঝা একেবারে সহজ যে বাইরে যেই মহিলাটা বসে আছে ওটা আমার সৎ মা। বাংলা সিনেমাতে দেখেছি সৎ মা তার সতিনের মেয়েদের দিয়ে ঘর পরিষ্কার করিয়ে নেয়, বাসন মাজিয়ে নেই, কোনো কাজে ভুল হলে মারধর করে, রান্না করায় ভুল হলে গরম খুন্তির ছ্যাক দিয়ে হাতের বা পিঠের চামড়া পুড়িয়ে দেয়। এসব ভাবনা মাথায় আসতেই হাওমাও করে কাদতে লাগলাম। কাল থেকে হয়তো আর আমার স্কুলে যাওয়া হবেনা। আমার ভাইটা? ওকে উনি কোলে নিয়ে রেখেছেন। ফেলে দেবে না তো? দরজা খুকে দৌড় লাগালাম। নিচে গিয়ে খপ করে ওনার কোল থেকে ভাইকে কেড়ে নিয়ে আবার নিজের ঘরে চলে আসলাম। এতোক্ষণ শুধু নিজের কথায় ভেবেছি, আমার ভাইটার কি হবে ভাবিই নি। আজকে আমার কান্না দেখার কেও নেই। কিছুক্ষণ পর দরজায় টোকা পড়লো। ওপাশ থেকে বাবা বলল,
– রীন্তি, এটা কি ধরনের বেয়াদবি? মায়ের কাছে থেকে ভাইয়াকে কেড়ে নিয়ে আসলে কেন? আমি চেচিয়ে বললাম,
– উনি আমার মা না। উনি আমার সৎ মা। আমাকে আর আমার ভাইয়ুকে কষ্ট দেবে এখন থেকে, আমি জানি। আমাকে কষ্ট দিলে তাও আমি সহ্য করবো আমার ছোট্ট ভাইয়ুকে কষ্ট দিলে আমি মরে যাবো যে। এবার ওই মহিলাটা কথা বলল,
– রীন্তি মামুনি, তুমি দরজটা আগে খোলো। আমি তোমাকে কষ্ট কেন দেব? তোমরা যেন কষ্ট না পাও সে জন্যই তো তোমাদের বাবা আমাকে এ বাড়িতে নিয়ে এসেছেন। ভয় কাটলো কিনা জানিনা তবে দরজাটা খুলে দিলাম। আমার কোল থেকে রিমনকে নিজের কোলে নিলো।
– আমি তোমার মা রীন্তি, সৎ হলেও তো মা। আর মা কোনোদিন তার সন্তানকে কষ্ট দেয়না। আমিও কোনোদিন কষ্ট দেবো না তোমাদের।
আমি কিছুটা স্বাভাবিক হই। তবে মা আর এই মহিলাটার সাথে আমি কথা বলতাম না। স্কুলে যাওয়া, খাওয়া, পড়তে বসা, ভাইয়ুর সাথে খেলা করা, আর ঘুম এই ছিলো আমার দিনের রুটিন। একদিন সন্ধ্যায় প্রচন্ড জ্বর আসে তারপর কি হয়েছিলো কিছু মনে নেই। যখন চোখ খুলি তখন দেখতে পাই আমার সৎ মা নামাজের পাটিতে বসে বসে মোনাজাত করছে, ঘরে জিরো পাওয়ারের বাল্বে খুব ভালো ভাবেই দেখা যাচ্ছে তার চোখের চিকচিক করা জল। মোনাজাত ধরে বলছে,
– হে আল্লাহ, তুমি আমার মেয়েটার সমস্ত জ্বর আমাকে দিয়ে দাও। ওকে তুমি সুস্থ করে দাও। আমি কাল সকালে ওর বাবাকে মুখ দেখাবো কিভাবে। ও যদি বলে একদিন বাড়ির বাইরে গেছি আর মেয়ের জ্বর কিভাবে হলো, তাহলে আমি কি উত্তর দেবো ওনার কাছে। তুমি তো জানো প্রভু আমি রীন্তি আর রিমনকে আমার নিজের সন্তান ছাড়া অন্য কিছুই ভাবিনা। তুমি আমার মেয়েটাকে সুস্থ করে দাও। অল্প আলোতে দেয়াল ঘড়িতে খুব ভালোই বোঝা যাচ্ছে এখন রাত ৩টা বাজে। মাথার কাছে একটা বড় বাটিতে কাপড় ভেজানো। বুঝতে বাকি রইলো না আমার সৎ মা সারারাত আমার মাথায় জলপট্টি দিচ্ছে। আমার পাশে রিমন ঘুমাচ্ছে। যেহেতু ও খাটের একপ্রান্তে আছে তাই ওর চারিদিকে ছোটো ছোটো কোল বালিসের যেন সুরক্ষা বলয় তৈরি করা হয়েছে। কিছুক্ষণ পর উনি উঠে এসে আমার কপালে হাত রাখলেন। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখলেন আমি ওনার মুখের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছি। উনি স্বাভাবিক ভাবেই বললেন,
– আলহামদুলিল্লাহ, জ্বর নেই বললেই চলে।
এরপর আমার পাশে শুয়ে আমার মাথাটা নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে নিলেন। এইতো সেই ছোয়া যেটা আমার মা আমাকে বুকে নিলে পেতাম। এটা তো সেই শান্তি স্থান যেখানে মাথা রাখলে আমার সারাদিনের কষ্ট দুর হয়ে যেত। তাহলে কি এই মানুষ আমার অজান্তেই আজকে আমার মা হয়ে গেছেন? সকালে আমাকে নিজ হাতে খাইয়ে দিলো। এরপর থেকে প্রায় রোজ নিজ হাতে খাইয়ে দিতো। স্কুলে যাওয়ার আগে নিজেই গুছিয়ে দিতো। এভাবেই দিন কাটতে লাগলো। দশ বছর পর, আজকে আমাকে রিদয়ের বাবা মা আসবে আমাদের বিয়ের ডেইট ফাইনাল করতে। মা আমাকে সাজিয়ে দিচ্ছে। আমি আয়নার দিকে তাকিয়ে আছি। মা পিছন থেকে আমার কাধে থুতনি রেখে নিজেও আয়নার দিকে তাকিয়ে বলল,
– মাশাল্লাহ! আমার মেয়েটাকে এবার একদম লালটুক টুকে বউ মনে হচ্ছে। মায়ের কথায় আমি বেশ লজ্জা পেলাম। কিছুক্ষণ পর মা নিজেই বলল,
– আর হয়তো একমাস পর এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবি এ বাড়িতে আমি, তোর বাবা আর রিমন থাকবো। তবুও তুই ছাড়া যেন বাড়ির সব ফাকা লাগবে। তোকে কিছু কথা জিজ্ঞাসা করতে চাই।
– হ্যা মা বলো।
– আচ্ছা রীন্তি, আমি কি তোর মা হতে পেরেছি নাকি সৎ মা রয়েগেছি এখনো?
– সত্যি তুমি আমার সৎ মা। যার ভিতরে কোনো অসৎ ইচ্ছা নেই। নাহলে আমাদের দুইভাই বোন যেন কষ্ট না পাই সে জন্য নিজে সন্তান নাওনি কোনোদিন। তোমার মত সৎ মা এই সমাজের প্রতিটা পরিবারে একটা একটা থাকা উচিৎ মা। তাহলে মানুষ সৎ শব্দের আসল মানে বুঝতে পারবে। বললে না তুমি আমার মা হতে পেরেছো নাকি সৎ ই আছো। আমি বলবো তুমি আমার সৎ মা। তোমার মত সৎ মা আমি হাজার বছর ধরে আমার পাশে চাই। আমি আর মা দুইজন দুইজনকে জড়িতে ধরে খুব কাদছি। রিমন এসে বলল,
– মা, আপু তোমরা এখনো এখানে দাড়িয়ে আছো? আংকেল আন্টি চলে এসেছে। মা আমার কপালে চুমু দিয়ে বলে,
– আমি নিচে যাচ্ছি, তুই বসে থাক কিছুক্ষণ পর তোকে নিয়ে যাচ্ছি।
মা চোখের জল মুছে রিমনকে নিয়ে নিচে চলে গেলো। আমি স্রষ্টার কাছে হাজার শোকর আদায় করতে থাকি এমন সৎ মা আমাকে উপহার দেওয়ার জন্য।
গল্পের বিষয়:
গল্প