– নীলাঞ্জনা শুনছো?
-হ্যাঁ মৃদুল বলো।
-আমাকে তোমার নোটগুলো দিতে পারবে? আসলে আমি নোট করিনি।
– সে তো আমি প্রতিবারই তোমাকে দেই মৃদুল। যাইহোক আমারও নোট শেষ হয়নি। আজ শেষ করবো কাল দেই?
– হ্যাঁ তা ঠিক আছে। এখন চলো ক্যান্টিনে কিছু খেয়ে আসি। যা খিদে লেগেছে, বুঝাতে পারবো না।
আমি মৃদুল হাসান। নীলা ও আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী। নীলাঞ্জানাকে আমি নীলা বলেই ডাকি। নীলাঞ্জনা নামটি বেশ সুন্দর। তবে আমার মনে হয় নীলা নামটি আরো সুন্দর। মেঘমুক্ত বিস্তৃত নীল আকাশ যেমন সুন্দর ঠিক তেমনি নজরকাড়া। নীলা মেঘমুক্ত সুবিশাল নীল আকাশের থেকেও যে বেশ সুন্দর তা আমি হলফ করে বলতে পারি। খাওয়া শেষে নীলা ও আমি পুকুরপাড় দিয়ে হাঁটছি।আজ নীলার মন খুব ভালো। যেদিন নীলার মন অনেক ভালো থাকে সেদিন নীলা বারবার আকাশের দিকে তাকায়। কলেজ লাইফ থেকে আমাদের বন্ধুত্ব। ঠিক বন্ধুত্ব বলাটা ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছি না, কারন আমাদের সম্পর্ক যে আরো কিছুটা গভীর। তবে মন ভালো থাকলে নীলা কেন যে বারেবারে আকাশের দিকে তাকায় তা আমিও আজও বুঝতে পারিনি। তবে আমি মনে মনে একটা ব্যাখা দাঁড় করিয়েছি। হয়তো নীলা আকাশকে উদ্দেশ্য করে বলে, আকাশ সৌন্দর্যের দাবিদার তুমি একা নও।
-মৃদুল, বাবা বেশ কয়েকবার ফোন দিচ্ছিলেন।
-তুমি কি বাসায় যেতে চাও নীলা?
-হ্যাঁ মৃদুল।
– ঠিক আছে নীলা। চলো তোমাকে নামিয়ে দেই।
– তার প্রয়োজন হবে না মৃদুল, আমি একাই যেতে পারবো।
আমি জানি আরো শতবার বললেও নীলা একাই যাবে। নীলাকে বিদায় দিয়ে বাইকের চাবি ঘোরাতেই রিফাত এসে হাজির। রিফার আমাদের কলেজ জীবনের বন্ধু। বেশ হাসিখুশি ধরনের মানুষ। রিফাতের মুখে হাসি লেগেই থাকে। রিফাতকে নিয়ে টিএসসিতে গেলাম। প্রতিদিন টিএসসিতে চা আর আড্ডা এই দুটো যেন আমার রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে আজ অন্যান্যদিনের মতো অনেকটা সময় নিয়ে আড্ডা দেইনি। মূলত একটা কারনেই আজ দীর্ঘসময় থাকবো না। আগামীকাল ২২শে জুন আমার বাবা-মায়ের বিবাহবার্ষিকী। প্রতিবছর এই দিনটিতে আমরা পরিবারে সবাই মানিকগঞ্জে আসি। এটাই আমার দাদা বাড়ি। অবশ্য এখন কেউ থাকে না এখানে। রহিম চাচা সব দেখাশোনা করেন। আজ রাতেই আমরা রওনা দিব। যেন ২২ শে জুন পুরো দিনটাই আমরা সেখানে থাকতে পারি। বাসায় ঢুকতেই মা বললেন,
-মৃদুল, এত তাড়াতাড়ি এলি আজ?
-মা সব গুছিয়ে নিয়েছো?
– ২-১ দিনের তো ব্যাপার। তেমন আর কি গোছানোর আছে বল? তুই ফ্রেশ হয়ে খেতে আয়।
– আচ্ছা মা, আসছি এখনি।
ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নীলাকে ফোন দিলাম। নীলা ফোন কেটে দিচ্ছে৷ অনেক আগেই ফোন দেয়া উচিত ছিল। তবে ফোন দেয়া হয়ে উঠেনি। নীলাদের বাসা কলাবাগান। বাবা-মেয়ে থাকেন৷ নীলার এসএসসি পরীক্ষার সময় নীলার মা গাড়ি এক্সিডেন্টে মারা যান। বাবা ছিলেন স্কুল শিক্ষক। রিটায়ার্ড করেছেন তিন বছর হল। পেনশন টাকা ও কোচিং সেন্টার এ নীলার শিক্ষকতার সন্মানী দিয়ে বাবা মেয়ের সংসার ভালোই চলছে।
রাত ৮ টা নাগাদ রওনা হলাম মানিকগঞ্জের উদ্দেশ্য। বিগত কয়েক বছর যাবৎ আমিই গাড়ি চালিয়ে আমাদের গ্রামের বাড়ি যাচ্ছি। চালক হিসেবে আমি খারাপ না। তবুও বাবা প্রতিবার হাইওয়েতে গাড়ি চালাতে গেলে বাধা দিবেন। রাত সাড়ে নয়টায় পৌঁছে গেলাম। রহিম চাচা সব গুছিয়ে রেখেছিলেন। এখানে রহিম চাচা ও তার ছেলে থাকেন। কাল বাবা-মায়ের ২৩ তম বিবাহবার্ষিকী। মা বাবার কাছে আগামীকাল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মা প্রথম এই বাড়িতেই বাবার সাথে আসেন। আমি যে রুমটাই এখানে আসলে থাকি সেটা শুধু বড় নয় বেশ বড়। দক্ষিণে জানালা। দখিনা হাওয়া, ঝিঝি পোকার ডাক সবমিলিয়ে যদি জীবনের সেরা মূহুর্তের মধ্যে ধরি তা হলে বোধহয় বাড়িয়ে বলা হবে না।
আজকে পূর্ণিমা। পৃথিবী থেকে লক্ষ কি.মি. দূরে যে চাঁদটি আধার পৃথিবীকে করেছে জ্যোৎস্নাময় তার রুপে মুগ্ধ না হওয়াটা একধরনের বোকামি বটে। নীলাকে ফোন দিলাম। অল্প খানিকাটা অভিমান জমে ছিল আমার প্রতি। তার সদ্য ধুলোমাখা অভিমানকে হাওয়ায় উড়িয়ে মৃদু ঝংকারের হাসির শব্দ না শুনলে যেন স্বস্তি ফিরে পাচ্ছিলাম না। ৪ দিন বাদে ঢাকায় ফিরেছি। এবার অনেকদিন থাকা হল গ্রামে৷ এর আগে প্রায়ই ২ দিন কিংবা ১ দিন থাকা হতো সর্বোচ্চ। ঢাকায় ফিরে সেই পুরোনো ধারায় ফিরে গেলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস, টিএসসিতে আড্ডা, ক্যান্টিনে খাওয়া-দাওয়া, নীলার সাথে রিকশায় খোলা আকাশ দেখতে যাওয়া। সবকিছুই যেন জীবনের একটি অংশে পরিনত হচ্ছিল। ইচ্ছে করতো সময়কে মিনতি করার, যেন সামনে এগিয়ে না যায় এই মুহুর্তগুলোকে একা রেখে।
শীত বেশ জাকিয়ে পরেছে। রাস্তার পাশের চায়ের দোকানগুলোতে পথচারীদের ভীড়। কুয়াশার চাদর দিয়ে আচ্ছাদিত স্বপ্নের শহরের স্বপ্নবাজ মানুষগুলো শীতকে কাবু করতে এককাপ চা-কে সঙ্গী করে। হিমেল সকালে এককাপ চা যে মানুষকে উষ্ণতা যোগায় তা আমি আর নাই বলি। তবে চা যে সতেজতা যোগায় তা বলার বোধহয় প্রয়োজন হবে না। ফুটপাত ধরে হাটছি মিনিট তিনেক হলো। যাব রিফাতের বাসায়। কাল ২৭ ডিসেম্বর, নীলাঞ্জনার জন্মদিন। কাল বিশেষ কিছু করে নীলাকে চমকে। সেই আলোচনা করেতেই রিফাতের বাসায় যাওয়া। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের আরো অনেক বন্ধুরা এসে জড়ো হবে। এখন সকাল সাড়ে দশটা তারপরেও আমি নিশ্চিত হয়েই বলতে পারি ব্যাটা ঘুমুচ্ছে। আসলে একটু ঘুম কাতুরে কিনা।
তবে শুধুমাত্র আমি ও নীলা ওর জন্মদিনে গত তিনবছর যাবৎ যে কাজটা করে আসছি তা হলো, নীলাদের বাসার কাছে ছোট একটা এতিমখানা আছে। নীলা তাদের জন্য নিজ হাতে রান্না করে এবং আমরা দু’জন সেই বাচ্চাগুলোর সাথে খেয়ে, সময় কাটিয়ে আসি। বাচ্চাগুলোর মুখের হাসি এত সুন্দর আর প্রশান্তিময় যে কাউকে মুগ্ধতায় ঘিরে ফেলবে। আজ নীলার জন্মদিন। নীলাকে চমকে দেবার জন্য যে আয়োজন করা হয়েছিল তাতে নীলা মোটেও চমকায়নি। আসলে রিফাত আর মঞ্জুর মাথা থেকে যে বুদ্ধি বের হয় তাতে চমকানো তো দূরে থাক চমকানোর জন্য মানুষ ভাড়া করলেও তারা যে চমকাবে না তা আমি শুধু নিশ্চিত না বাজি রেখে বলতে পারি। বেলা ১১.৩০, নীলার জন্য অপেক্ষা করছি প্রায় ৪০ মিনিটের মত। এতগুলো বাচ্চার খাবার হয়তো গোছাতে সময় লাগছে।
– মৃদুল চলো। পিছনে ফিরতেই দেখি নীলা হাতে একটা বড়সড় ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
– এতক্ষন সময় লাগলো নীলা?
– কতক্ষন লাগলো শুনি?
– তা মিনিট ৪০ তো হবেই।
– তুমি আমার জন্য ৪০ মি. দাঁড়াতে পারবে না?
– এটা আবার কখন বললাম আমি?
– কথা বাড়িও না, চলো।
নীলা আমার পাশে বসা। আমি গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছি। সর্বোচ্চ ১০ মিনিট সময় লাগবে পৌঁছাতে। নীল শাড়িতে নীলাকে বেশ মানিয়েছে। সাথে নীল চুড়ি। মেয়েটাকে আজ এত মায়াবী লাগছে যা আমি লিখে বোঝাতে পারবো না। নীলার কাজল দেয়া চোখ দুটো যেন আরো মায়াবী করেছে ওকে। নীলাকে ভালোবাসি বলে নয় সত্যিই নীলা অপ্সরীর চেয়েও সুন্দর। কিছু সময়ের মাঝেই আমরা পৌঁছে গেলাম। নীলা প্রায়ই আসে এখানে। বাচ্চারা নীলাকে দেখে প্রায় দৌড়ে জড়িয়ে ধরলো। নীলা প্রতিটা বাচ্চাকে আলাদা খাবার দেয়ার পরও সবাইকে নিজ হাতে খাইয়ে দিল। যে মানুষটার মন এত সুন্দর, এত বিশাল যার হৃদয় সেই মানুষটাকে না ভালোবাসা যেন সীমাবদ্ধতা নিজেরই। নীলার সব কিছুই আমার ভালো লাগে। তবে আজকের ঘটনাটি আমাকে ছুঁয়ে গেছে। ভেবেছি আমিও নীলার সাথে প্রায়ই এখানে আসবো। আমাদের সম্পর্কের যখন বয়স ৩ বছর ৭ মাস তখন নীলা ও আমি সিন্ধান্ত নেই বিয়ে করার৷ আমরা আমাদের পরিবারকে সবকিছু জানাই। আমার বাবা-মাকে যখন নীলার কথা বলছিলাম তখন বাবা বলেছিলেন, ‘কত ঘটনা আমাদের সাথে শেয়ার করিস তবে এই বিষয়টা কেন চেপে গেলি’? মা বলেছিলেন, পরশু নীলাকে নিয়ে আমাদের বাসায় আয়।
নীলাকে যখন জানালাম তখন নীলাও বলল আমাকেও তাদের বাসায় যেতে হবে। নীলার বাবা যখন বাবা-মায়ের কথা বলছিল তখন নীলা মাথায় শাড়ির আঁচল দিয়ে চুল ঢেকে চুপ করে বসেছিল। তবে আমার মনে হচ্ছিল নীলা চুপ নয় তার চারপাশ থেকে স্নিগ্ধতা ছড়াচ্ছে। দুই পরিবারের সম্মতিতে আমাদের বিয়ে ঠিক হয়। ৯ই মে আমাদের বিয়ে হয়। দুই অক্ষরের এই শব্দটি আমাদের অদৃশ্য বন্ধনে আটকে ফেলে। তবে শুনেছিলাম আমার ফুফা নাকি বলেছিলেন আমাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থানের সাথে নীলাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থার মিল খুঁজে পাননি তিনি।
বাবাও তার প্রতি উত্তরে বলেন, ‘এটা আমার ছেলের জীবনের প্রশ্ন। এটি একটি বিয়ে। কোন আর্থিক সংস্থা নয় যে অপরের ব্যাংকের হিসাব জানতে চাইবো। বিয়ের পর থেকেই নীলাকে বাবা-মা খুব আদর করতেন। মেয়ে নেই বলে যে আফসোসটা মায়ের ছিল তাও নাকি ঘুচে গেছে। বিয়ের ২ বছর পর আমাদের পরিবারের একজন নতুন সদস্য নিজের নাম লেখান। নীলার ও আমার প্রথম সন্তান মেঘ। মেঘ দেখতে হুবহু আমার মত তবে ওর মা বলে মেঘ নাকি ওর মত হয়েছে দেখতে। যা আমি কখনোই গ্রহন করবো না।
আমি তখন আমাদের আফিসে কাজ করছিলাম। হঠাৎ মা আমাকে ফোন দিয়ে বলে, নীলা খুবই অসুস্থ। জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যাচ্ছিল মা ধরে ফেলেছেন। তাৎক্ষণিক নীলাকে হাসপাতালে নেয়া হয়। খুব দ্রুত আমি ও বাবা অফিস থেকে বের হয়ে হাসপাতালে যাই। মা ও মেঘ বসে আছে। মেঘ কাঁদছে। আমাকে দেখে জাপটে ধরেছে মেঘ। ডাক্তার আমাদের জানায় নীলা সাধারণ কোন কারণে জ্ঞান হারায়নি, কিংবা যে সমস্যা হলে সপ্তাহ বা মাস পর সুস্থ হবে তা নয়। নীলার নাকি ব্লাড ক্যান্সার হয়েছে। ডাক্তারের কথাগুলো কেমন অবিশ্বাস্য ঠেকছিল তখন। আমি নীলাকে অন্য মেডিকেলে নিয়ে যাই সেখান থেকে অন্য মেডিকেলে। বিদেশেও নিয়ে গেছি তবে বাঁচাতে পারিনি নীলাঞ্জনাকে। নীলা আমার যে হাত ধরে বলেছিল কখনো ছেড়ে যাবে না। সেই প্রতিশ্রুতি নীলা রাখেনি। আমাকে ও মেঘকে রেখে নীলা চলে গেল। নীলাঞ্জনা যদি চলে যাবে তবে মিথ্যে প্রতিশ্রুতি কেন দিলে?
– বাবা যাবে না?
– হ্যাঁ মা।
– দেরি হয়ে যাচ্ছে তো।
– হ্যাঁ মা চল বেরিয়ে পরি।
আমার নীলাঞ্জনার আজ ১৯ তম মৃত্যুবার্ষিকী। নীলা মারা যাওয়ার পর তাকে আমাদের পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করি। অনেকটা বয়স হয়ে গিয়েছে। চুলেও কিছু সাদা-কালো রংয়ের মিশ্রণ দেখা যায়। অনেককিছু এখন ঝাপসা দেখি। চশমা নিয়েছি একটা৷ নীলাঞ্জনাকে একদিনের জন্য নয় প্রতিটি দিন আমি ওকে মনে করি।
গল্পের বিষয়:
গল্প