– তুমি তো বিসিএস ক্যাডার পাত্র চেয়েছিলে।
– হুম।
– আজ আমি বিসিএস ক্যাডার। আজ তোমার আপত্তি কিসের?
– জানি না।
– তখন আমার ক্যারিয়ার ছিলো না বলে ব্রেকআপ করেছিলে। তোমার বাবার পছন্দের পাত্রকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলে। তাহলে বিয়ে করো নি কেন?
– তোমার কাছে জবাবদিহি করতে আমি বাধ্য নই।
– জবাবদিহি করতে হবে না। আমাকে কেন গ্রহণ করবে না সেটা বলো।
– সেটাও বলতে আমি বাধ্য নই।
– অবশ্যই তুমি এটা বলতে বাধ্য। তখন আমাকে রিজেক্ট করার কারণ বলেছিলে। কারণ শুনে আমি চুপ হয়ে গিয়েছিলাম। আজও উপযুক্ত কারণ বলতে হবে।
– তখন ব্রেকআপ করার পরও আজ আবার কেন এসেছো আমার কাছে? আমাকে ছোটো করার জন্য?
– তোমাকে ছোটো করবো কেন?
– সেদিন তোমার ক্যারিয়ার এর জন্য ব্রেকআপ করেছিলাম। আজ তুমি ভালো ক্যারিয়ার নিয়ে আমাকে বিয়ে করতে চাওয়া মানেই আমাকে অপমান করা। ইনডিরেক্টলি আমাকে বুঝিয়ে দেওয়া যে আমি স্বার্থপর।
– তুমি স্বার্থপর কি না আমি জানি না। তবে আমি স্বার্থপর। আমি ভালো থাকতে চাই। আমার ভালো থাকার জন্য তোমাকে প্রয়োজন। তাই আবার তোমার কাছে এসেছি।
– আমি দুঃখিত। আজও তোমাকে ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে।
– কারণটা তো বলবে?
– তোমাকে আমার পছন্দ না।
– পছন্দ না মানে? কোন দিক দিয়ে?
– আমার ফর্সা ছেলে পছন্দ। তুমি কালো।
– এই কালো ছেলেটার হাত ধরেই চারটি বছর ভালো ছিলে।
– এখন ভালো থাকতে পারবো না। আমি বিজি। উঠলাম। ভালো থেকো।
রেস্টুরেন্ট এ বসা নেহালকে পেছনে ফেলে হাঁটতে শুরু করে নিসা। পেছনে ফিরে তাকায় না, পাছে নেহাল ওর অশ্রু দেখে ফেলে। রিক্সায় বসে কল দেয় বান্ধবি শোভাকে।
– কোথায় তুই?
– অফিসে।
– একবার দেখা করতে পারবি?
– অফিস শেষে দেখা করছি।
– না, এখনই।
– কি হয়েছে? তুই কি কান্না করছিস? কণ্ঠ এমন শোনাচ্ছে কেন?
– চুপ করে আছিস কেন? বল কি হয়েছে।
– প্লিজ এখনই দেখা কর।
– আচ্ছা আমি ম্যানেজ করে আসছি। কোথায় আসবো বল।
– পার্কে আয়। কিছুক্ষণ পর…..
– কি হয়েছে নিসা? ফোনে কান্না করছিলি কেন? চোখ মুখ ফোলা কেন?
– (হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে নিসা)
– আরে বাবা এত কান্না করলে শুনবো কিভাবে? এই নে পানি খা। তারপর বল কি হয়েছে।
– নেহাল দেখা করতে বলছিলো ক’দিন ধরে। আজ দেখা করলাম।
– বলিস কি? এতদিন পর? কি বললো নেহাল ভাই?
– বিয়ে করতে চায় আমাকে।
– তুই ব্রেকআপ করার পরও বিয়ে করতে চায়? শুনেছি উনি নাকি এখন বিসিএস ক্যাডার?
– ঠিক শুনেছিস।
– তাহলে তো খুব ভালো। তুই কি বলেছিস?
– আমি কি বলতে পারি তুই বল? পাঁচ বছর আগে যে ছেলেটার সাথে তার ক্যারিয়ার এর জন্য ব্রেকআপ করেছি, বাবার পছন্দের পাত্রকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছি, আজ কোন মুখে তার বউ হওয়ার আশা করবো?
– কিন্তু তুই তো বিয়ে করিস নি। তুই তো নেহাল ভাইকেই ভালোবাসতি।
– সেটা আমি জানি, তুই জানিস, নেহাল তো জানে না।
– তুই ওনাকে বুঝিয়ে বল।
– কোনো লাভ নেই। ওকে আমি যতই বোঝাই না কেন, ও ভাববে আমি ওর ক্যারিয়ারের জন্যই ওকে বিয়ে করতে রাজি হচ্ছি। এমনও তো হতে পারে ও প্রতিশোধ নিতে চায়। হতে পারে ও মজা নিচ্ছে। আমি হ্যাঁ বললেই অট্টহাসিতে লুটিয়ে পড়বে।
– তুই সবসময় নেগেটিভ ভাবিস কেন বলতো?
– আমি যা করেছি তারপর পজিটিভ ভাববো কিভাবে?
– তাহলে কেন করেছিলি?
– আর কি করতাম আমি বল? বাবা-মাকে খুব ভালোবাসতাম। বাবাকে কষ্ট দিয়ে যদি নেহালকে বিয়ে করতাম তাহলে নিজেকে ক্ষমা করতে পারতাম না। বাবার কষ্টভরা মুখটা যখনই সামনে ভেসে উঠতো নেহালের ভালোবাসা খুব তুচ্ছ মনে হতো। বেকার নেহালকে বাবা তখন কিছুতেই মেনে নেন নি। যে বাবা-মা আমাকে জন্ম দিয়েছেন, লেখাপড়া শিখিয়েছেন, এত বছর ধরে আদর-যত্ন-ভালোবাসা দিয়ে বড়ো করেছেন, নেহালের সাথে চার বছরের সম্পর্কের জন্য আমি চব্বিশ বছরের ভালোবাসা ভুলে যেতাম? কষ্ট দিতাম ওনাদের? কি গ্যারান্টি যে ওনাদের কষ্ট দিয়ে আমি সুখী হতাম? বাবা-মাকে কষ্ট দিয়ে কোনও সন্তান সুখী হতে পারে?
– তাহলে বিয়েটা করিস নি কেন? আঙ্কেল তোর জন্য বিসিএস ক্যাডার পাত্র আনলেন। বিয়েও ঠিক হলো। পরে বিয়েটা করলি না।
– নেহালকে যে বড্ড ভালোবাসতাম। একজনকে মনে বসিয়ে রেখে আরেকজনের সাথে কিভাবে সংসার করতাম? তাকে যে ঠকানো হতো। প্রথমে বাবাকে খুশি করার জন্য বিয়েতে রাজি হলেও পরে এসব গভীরভাবে ভেবেছিলাম। যতদিন নেহাল আমার মনের মধ্যে থাকবে ততদিন যত ভালো ছেলেই হোক না কেন, আমি তাকে ভালোবাসতে পারবো না। আর ভালোবাসা ছাড়া কারো সাথে সংসার করা মানে তার সাথে অভিনয় করা, তাকে ঠকানো। কেন তাকে আমি ঠকাবো? সে তো কোনো দোষ করে নি। তাই তো পরে বিয়েটা ভেঙে দিলাম। কিন্তু ততদিনে দেরি হয়ে গিয়েছিলো। নেহালের ক্যারিয়ারের জন্য ব্রেকআপ করে ওর কাছে ফিরে যাওয়ার রাস্তা আমি নিজেই বন্ধ করেছিলাম। পারি নি ওকে বলতে যে ওকেই আমি ভালোবাসি।
– তাহলে আজ কেন নেহাল ভাইকে ফিরিয়ে দিলি?
– আজ ওকে গ্রহণ করলে আমি নিজের কাছে ছোটো হয়ে যাবো। এতদিন যেমন ওকে একা ভালোবেসেছি, পরের সময়টুকুও নাহয় একাই ভালোবেসে যাবো। সব সম্পর্ক সম্পূর্ণ হতেই হবে এমন কোনও কথা নেই।
– কিন্তু আমার যে পূর্ণ সম্পর্ক চাই(পেছন থেকে বলে উঠলো নেহাল)
– তুমি? এখানে কি করছো? কখন এসেছো? তুমি কিভাবে জানলে আমি এখানে আসবো? তুমি আমাকে ফলো করছিলে?
– ভার্সিটিতে যখন ছিলাম তখন থেকেই তো তোমাকে ফলো করি। এ আর নতুন কি?
– তু….তুমি কখন থেকে আমাদের কথা শুনছো?
– যে মেয়ে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সবসময় কথা বলতো, আজ সে আমাকে কালো বলে ফিরিয়ে দিচ্ছে, এটা কি বিশ্বাস করার মতো কথা?
– মানে?
– তুমি কি জানো আমি গত পাঁচ বছর ধরেই তোমাকে ফলো করছি?
– মানে কি??
– যখন শুনেছিলাম তুমি বিয়ে ভেঙে দিয়েছো তখনই বুঝেছিলাম কিছু একটা ব্যাপার আছে। তখন তোমার সেই হবু বরের সাথে দেখা করি। উনিই আমাকে বলেন যে তুমি কাউকে ভালোবাসো। তাই ওনাকে বিয়ে করতে চাও না। আমি ছাড়া আর কেই বা ছিলো যাকে তুমি ভালোবাসতে। তখনই ঠিক করি, আগে ক্যারিয়ার, তারপর বিয়ে। তোমার সাথে যোগাযোগ করি নি কারণ নিজেকে যোগ্য বানাতে চেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম আগে ক্যারিয়ার গড়ি, তারপর তুমি কপালে থাকলে আমার হবে। এই পাঁচ বছরে তোমার প্রতিটি স্টেপের খবর রেখেছি আমি। কখন কোন বাড়িতে টিউশনে যেতে, কোন ছেলে তোমাকে প্রপোজ করতো, কোন ছেলের বাড়ি থেকে বিয়ের জন্য তোমাদের বাড়িতে গিয়েছে সবই আমি জানি। সবগুলো বিয়ের প্রপোজাল তুমি ফিরিয়ে দিয়েছো সেটাও আমি জানি।
– সব জানার পরও একবার সামনে আসার প্রয়োজন মনে করলে না?
– তখন সামনে আসলে কি এখন এই খুশিটা তোমার চোখে দেখতাম?
– কিসের খুশি? আমি মোটেও খুশি না। আমি তোমাকে বিয়েও করবো না।
– বিয়ে তো তুমি আমাকেই করবে। হয়তো তোমার বাড়িতে কাজি নিয়ে যাবো, নতুবা কাজি অফিসে তোমাকে তুলে নিয়ে যাবো।
– আমি গেলে তো? তুমি একটা অসহ্যকর ছেলে।
– এই অসহ্যকর ছেলেটার সাথেই সারাজীবন থাকতে হবে ম্যাডাম।
নেহাল পরম যত্নে নিসাকে বুকে টেনে নিলো। নিসা কাঁদছে। শোভা বেকুবের মতো দাঁড়িয়ে ফেসবুকিং করছে। আজকে ও একটা লাভ স্টোরি লিখবে। নেহাল-নিসার লাভ স্টোরি।
গল্পের বিষয়:
গল্প