আজ জমির মিঞার চতুর্থ বিয়ে এবং শেষ বিয়ে।তিনি তওবা করে বলেন এ বিয়ে না টিকলে আর জীবনেও বিয়ের নাম নিবেন না। জমির মিঞা জমিদার বংশের লোক।জমিদারি তার পেশা।জমিদার বাবার একমাত্র ছেলে হওয়ায় সহায় সম্পত্তির অভাব নেই।যার কারণে বিয়ে করাও তার কাছে পুতুল খেলায় পরিণত হয়েছে।তার মতে বউ হতে হবে আমার সেবা যত্নের খোরাক।জমির মিঞার স্বপ্ন বউ হাতে লুঙ্গি,সাবান নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে ,তারপর গোসল করতে যাবেন।এসে দেখবেন বউ ভাত বেড়ে অপেক্ষা করছেন,হাত পাখার বাতাস খেতে খেতে খাবার শেষ করবেন। বউ পান নিয়ে বসে থাকবেন,পান চিবোতে চিবোতে শুইবেন। তবে এতসব পরিকল্পনা ঘটক সাহেবকে বলেন নি।কারণ বিয়ে হতে যদি হয় নয় ছয়।যার কারণে মনের কথা মনে রেখে বিয়ের প্রস্তুতি শুরু করেন। তার ভাবনা যে বউ আমার খেদমত করতে অপারগ হবে সে বউ আমার সম্পত্তি ,টাকা কড়ি কিভাবে ভোগ করবে?আমার খাবে,আমার পরবে,আমার মুখের উপর আবার বড় কথা!না,কিভাবে সহ্য করি?
প্রথম বউ বংশ মর্যাদা সম্পন্ন এবং শিক্ষিত।তবে মেয়ের বাবা না থাকায় অভিভাবকের অভাব ছিল।যার কারণে তদন্তের অভাবে বিয়ে সম্পন্ন হয়।আর জমিরেরও উদ্দ্যশ্য এ টাইপের মেয়েদের দিয়ে ভাল সেবা যত্ন পাওয়া যাবে।কিন্তু বউয়ের,মতিগতি,আচার- আচরণে সে সন্তুষ্ট নয়।বছরখানেক কিছুটা স্হির থাকলেও তারপর থেকে দুইজনে গোলমালে লেগেই থাকে। হয়তো দেখেন যে কাপড় আয়রণ করা নেই,সময়মত নাস্তা খেতে পারেন না,চিরুনী খুঁজে পান না।নানান ছোট খাট বিষয় নিয়ে বাকবিতণ্ডায় বেঁধে যান।কিন্তু বউ এসবের গ্রাহ্য করেন না। কারণ স্বামী স্ত্রীর মাঝে এমন হওয়া স্বাভাবিক। তবে স্বামীর চাওয়া পাওয়া বউ আদৌ বুঝে উঠতে পারেন নি। এদিকে ওদের কোলজুড়্ আসে এক পুত্রসন্তান।ছেল েপুলে নিয়ে তার এত সোহাগ যত্ন নেই।গ্রামের মাতব্বর হয়ে ,দাপট খাটানো তার পেশা। একদিন বউকে জমির মিঞা বিশ লাখ টাকা রাখতে দেন। মিঞা বাইরে থেকে এসে খাবেন অমন সময় দেখেন বউ মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত ।
জমির মিঞা বলেন,বউ কি রান্না করছ? মাছ,মাংস,সব্জি আমার জন্য শুঁটকির ভর্তা কর। বউ বলে এতকিছু আছে,তারপরও মন ভরছে না? না।করতে বলছি কর? বউ বলে রাতের বেলা আমি পারবো না,এত ঝামেলা করতে। জামাই বলে পাখনা গজাইছে? মানে? হাতে টাকা আছে তো এজন্য চোখে মানুষ লাগে না? কি টাকা? এখন তো ভণিতা করবে? জমির মিঞা সংসারের প্রাত্াযহিক খুঁটিনাটি বিষয়গুলোকে সিরিয়াস নিয়ে বসে থাকে।কিন্তু বউ তার এত ন্যারো মাইন্ডের খবর জানে না। নানা সূত্রের জেরে একসময় বউকে বছর তিনেকের মাথায় তালাক দেন। দ্বিতীয় বিয়ের জন্য ঘটক সাহেবকে ডেকে বলেন,মেয়ে যেন স্বামীর ইশারায় চলে,স্বামীর খেদমত করে একথাটা আগে জানিয়ে দিবে। ঘটক বলে ,তাহলে আমাদেরকে যেখানে সেখানে যাওয়া ঠিক হবে না। অত কথা বুঝি না।
ঘটক কিছুক্ষণ পর একটা দীর্ঘশ্বাস দিয়ে বলেন,আমাদের ছেলেটা কেমন আছে?যোগাযোগ হয়েছে ?ভাইসাব। জমির মুখ বাঁকা করে ,আরে কত্ত ছেলে আসবে যাবে তার জন্য এত মাথাব্যথা কিসের?আপনি বাঁচলে বাপের নাম।এসব ছেলেপুলের আমি তোয়াক্কা করি না।বড় হলে কানে ধরে নিজে নিজে চলে আসবে। ঘটক দুঃখ করে বলেন,আহ!ছেলেটার জন্য বড় মায়া লাগে। অবশেষে জমির মিঞা দ্বিতীয় বউ ঘরে তুলেন।বউকে আগাম নির্দেশনাবলী জানিয়ে দেওয়ায় খুবই তীক্ষ্ণসহকারে স্বামীর দায় -দায়িত্ব বুঝে নেন।স্বামী যা চায় তা রুটিনমাপিক পালনে ব্যস্ত,সতর্ক। বউ এসে স্বামীর পা টিপে মাথা টিপে ঘুমিয়ে দেয়। স্বামী বলে,কি রে বউ ,গন্ধ লাগে কেন? বউ বলে ,কই,আমার তো লাগে না।আপনার নাকে হুদাই গন্ধ লাগে।
বউ পান দিলে মাছেরগন্ধ,খাবারের প্লেটে, পানির গ্লাসে তেলাপোকার গন্ধ,খাটের কিনারায় চুন ,ওয়ালে চুন,ডিম পোচ করলে ডিমের খোসা ,তেল পানি মেশানো চুলের গন্ধ,বালিশে তেলচিটচিটে দাগ,অপরিস্কার ,অপরিচ্ছন্ন তায় জমির মিঞার চিন্তার লাইন দীর্ঘ হতে লাগল। কিছুদিন পর জমির মিঞার স্ট্রং ডায়রিয়া হয়।ডায়রিয়ায় তার শরীর এতই দূর্বল হয়ে পড়ে যে নিজে এক গ্লাস পানি খেতেও কষ্ট হয়। বউকে তো বলছেন না,এবং কি আশপাশেও থাকতে বারণ করেন।অনেক কষ্টে নিজ দায়িত্বে রোগমুক্ত হন। সুস্হ হয়ে এ বউকেও বিদায় করেন। এবার নিজে নিজে জেদ করে আর ঘটকের ধার ধারলেন না। নিজেই ঘটক নিজেই পাত্র।আর মনস্হির করেন বউকে নিয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন করবেন।আর কোন নিয়ম কানুনের ছক আঁকলেন না। আস্তে আস্তে জমির মিঞার বিবেক বুদ্ধির দরজা খুলতে চলছে।
এক আত্মীয়ের মাধ্যমে এক আনম্যারিড মেয়ের খোঁজ পান ।বয়সও জমির মিঞার অর্ধেক।খুবই গরীব ঘরের সুন্দরী মেয়ে।মেয়ের এফেয়ার থাকায় বাবা মা তড়িঘড়ি করেন বিয়ের জন্য।তার উপর নুন আনতে পান্তা ফুরায়।আর সুযোগের সন্ধান পেয়ে জমির মিঞা খুবই সিম্পলভাবে তৃতীয় বউকে ঘরে তোলেন। এমন সুন্দরী বউ এনে জমিরেরও টনক নড়ল।বউকে পাশে পাশে রাখবেন,যেনতেন ব্যবহার করবেন না,একটু বাড়তি আদর ,সোহাগেরও ভাব জমালেন।।কিন্তু বউ ধারে কাছে আসে না।শুধু কান্দে আর কান্দে।কিছুদিন পর বউ বলে বাবার বাড়িত যাব।জমির মিঞা নিয়ে যায়। দশ/বারদিন পর বউটা পালিয়ে গেল। এ বউ হারিয়ে জমির মিঞা স্তব্ধ হয়ে যান।বাকরুদ্ধ হয়ে যান।উনি ভেবেছিলেন জীবনে টাকা পয়সা থাকলে সবই সম্ভব।কিন্তু না, ভুল ভাবনায় আজ তার জীবন তছনছ করে দিল। হৃদয় ভেঙ্গে গেল।আফসোসের হায়নারে এসে জাপটে ধরল।
ঘটক এসে মাঝে মাঝে জমিরকে সান্ত্বনা দিয়ে যায়।আবার আশার আলো জাগায় ,সাহস দেয়।জমিরও ক্রমান্বয়ে মানসিক বিপর্যয় কেটে উঠে। একসময় ঘটকের অনুরোধে ,নিজের ভবিষ্যত চিন্তা করে চতুর্থ বিয়ের জন্য প্রস্তুতি নেন। আজ চতুর্থ বউ ঘরে তুললেন।বউ আসতে না আসতে জামাইকে ফিসফিসিয়ে বলে পানি খাব।জামাই পাশের লোককে পানি আনতে বলে।পানির গ্লাস বউকে হাতে দিতে নেয় না।আবার জামাইকে কানে কানে বলে আপনি দেন। প্রথমদিন আপনার হাতে খেলে মহব্বত বাড়ে। দুইদিন যেতে না যেতে বউ বলে মার্কেটে যাবে,কিছু কেনাকাটা আছে। জমির বলে ননিকে নিয়ে যাও? বউ বলে,আমি তোমাকে ছাড়া এক কদমও নড়ব না। জামাই ভাবে,সম্ভবত আমি ভাল মসিবতে পড়ছি।
বউ দোকানে বসে ওড়না দেখে ।জামাইকে ব্যাগ হাতে দিয়ে ওড়না ঘোমটা দিয়ে দেখে,কাঁধে দিয়ে দেখে নানাভাবে দিয়ে দেখে অন্য দোকানে যায়।জামাই বউ এর হদিস পায় না,চোখের পলকে ঝাপসা হয়ে যায়।সে ব্যাগ নিয়ে ভ্য্যবাচ্যাকা খেয়ে থমকে যায়,আবার ধীর গতিতে পা চালায় ।এভাবে পুরো মার্কেট ঘুরে যত বাজার করল সব জামাইর হাতে দিয়ে বউ গেল রূপচর্চার সরঞ্জমাদি কিনতে। জমির অবলার মত তব্দা চাহনিতে এদিক সেদিক তাকায়। বাসায় এসে জমির মিঞা ভাত খাবে ভেবে বউর সামনে যেতে দেখে বউ চোখে শসা,মুখে ব্লিচ মেখে বসে আছে। স্বামী কিছু বলার আগে বউ বলে ,এই আমার ভীষণ ক্ষিধে পেয়েছে।আমার জন্য এক প্লেট ভাত নিয়ে আস না…,প্লীজ প্লীজ । পর রাতে এসে দেখে বউ হাতে মেহেদী লাগাচ্ছে।জমির বলে,ভাত দাও। বউ বলে,আমি কি করছি তুমি দেখছ না? তোমার বিয়ের মেহেদী তো এখনও ঝাপসা হয় নি?
-ঝাপসা হইতে দিমু না,আমি কিছু ঝাপসা হইতে দিই না। জামাই বিড় বিড় করে ঠোঁট নাড়ে, “তিন বিয়ে করা পাত্র পেয়ে যার এত প্রেম ,ইনটেক পাত্র পেলে না জানি কি করত!!” পরক্ষণে বউ বলে তুমি খেয়ে আমাকে খাওয়ায় দেবে। জমির বিস্ময় চোখে তাকাতে অভিমানী স্বরে বউ বলে,এমন করে তাকাচ্ছ কেন?দেখছ না আমি মেহেদী লাগাচ্ছি।
সকালে উঠে দেখে বউ এর দুই হাতের দুই আঙ্গুল ঝলসে গেছে ।বউ তো ভয়ে,ব্যথায় কান্নায় একাকার। জামাইকে বলে,বাথরুমে যাব। জমির বলে,আমি কি করব? বউ বলে,কি আজব!আমার এ হাত দু’টো দিয়ে কিছু করতে পারছি? তোমার আক্কেল জ্ঞান বলে কিছু আছে? জমির মিঞা সন্ধ্যা নাগাদ একাকী নির্জন জায়গায় গিয়ে ভ্যা ভ্যা করে কান্না করে।কান্নার শব্দ শুনতে পেয়ে ঘটক যায়। ঘটক বলে শুনেন মিঞা ভাই,আগে মনটাকে উন্নত করুন।এ গণ্ডি থেকে বের হন।সভ্য হোন। টাকার জোরে সভ্যতা আসে না। অসময়ে হায় হায় করে কোন লাভ নেই।
গল্পের বিষয়:
গল্প