স্মৃতির অতল গহীনে

আমার বয়স তখন ২৪ বছর হবে। আমি তখন সবে মাত্র এম,এস,সি, সম্পুর্ণ করেছি। আর সে সময় ভালোবেসে ফেলেছিলাম এস,এস, সি, পরীক্ষা দেওয়া এক মেয়েকে। ওর নাম নিশি।

দেখতে বেশ সুন্দর,হালকা পাতলা গড়ন। তার পর সামান্য সময়ের মধ্যে ভালোবাসা। সে সময়ের সামাজিক অবস্হা এতোটা উদার ছিলো না। যখন আমার বয়স ২৫ বছর, তখন বিয়ে করি ১৬ বছরের নিশিকে।

বাবা মায়ের ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ে হয়েছিল আমাদের।

তখন সময়টা এমন ছিলো যে,নিজেই লুঙ্গি সামলে রাখতে পারতাম না,রাতে ঘুমালে গিট্টু দিতাম।

অথচ সেই আমি তখন চেষ্টা করতাম ছোট্ট

নিশিকে শাড়ি পরিয়ে দিতে।

নিজেই পেতাম না পকেট খরচের টাকা,অথচ নিশির জন্য আচার কিনে আনতাম । খুব সুন্দর ছিলো দিন গুলি। ভালোবাসা যেন অজান্তেই তৈরি হয়ে গেলো মনের ভিতর।

প্রথম কেউ বলতে নিশিই ছিলো আমার জীবনে। নিশি ছিল খুব ছোট কিশোরী,সারাটা দিন খেলতো। আমি নিশির কান্ড দেখে হাসতাম এইভেবে যে, এটাই আমার বউ। ছোট্ট মিষ্টি সোনা বউ। সারাদিন হৈহুল্লোড়ে থেকে যখন রাতে নিশি বলত মাথা ব্যাথা করছে, মাথা টিপে দিতাম। পা দুটোও টিপে দিতাম। আমার বউতো,

আমিই তো তারসব। আমি ভাবতাম আজ অবুঝ কাল তো বুঝবেই। তখন নিশি আরো বেশি ভালোবাসবে আমাকে।

দিন যেতে থাকলো। নিশির বয়স যখন ১৮,তখন আর নিশি আর খেলেনা। এখন অনেক কিছুই বোঝে নিশি। নিশি ওর বাবার বাড়িতে গেলে একাকি থাকতাম আমি। নিশি আমায় বলতো, তুমি আমার সাথে চলো ,কিন্তু সে সময় আমার ভীষন লজ্জা করতো।

কিছু বলতাম না,কষ্ট লুকিয়ে রাখতাম।

নিশিকে নিয়ে বাবার বাড়িতে যাবার পরে নিশি বায়না ধরত তাকে রেখে যেতে। রেখে আসতাম। বাড়ি এসে প্রতিদিন ফোন করতাম তাকে। প্রতিটা কলই ওয়েটিং থাকতো। মেসেজ গুলোর উত্তর না পেয়ে লজ্জায় আর মেসেজ করতাম না।

তিনমাস পর যখন শ্বশুর বাড়ি যেতাম বউয়ের, প্রথমবাক্য ছিলো তিনদিন থেকে চলে যাবে। রাতের আধারে চুপিচুপি তার ফোনটা অন করে দেখতাম প্রতি মিনিটে কারো প্রেমময় মেসেজে চাপা পরেছে আমার মেসেজ গুলো। কষ্ট পেতে থাকলাম আমি। সবাইকে বলে শাসন করা হলো তাকে।

সেই থেকেই শুরু। তারপর নিশির বয়স যখন ২০,আমাদের একটা মেয়ে এলো নিশির কোলজুরে।

আনন্দের সীমা ছিলনা আমার। আমার মেয়েটার বয়স যখন মাত্র ৬ মাস। আধো আধো দুএকটা শব্দে ডাকে আমার মেয়ে। যখনি বাবা বলে ডাক দিতো কলিজা যেন ঠান্ডা হয়ে যেত আমার।

নিশি তখন অন্য দুনিয়া নিয়ে ব্যস্ত।তখনো ফোনে কথা বলত বুঝতাম। আমার প্রতি দুর্ব্যবহারই সেটা প্রমাণ করে দিতো। কিন্তু আমি আমার মেয়ের কথাভেবে কিছু বলতাম না।

তারপর এলো সেদিন,যেদিন আমি কেঁদেছিলাম। স্বামী হয়েও তার দুটো পা জড়িয়ে ধরেছিলাম, ভিক্ষে চেয়েছিলাম মেয়ের মা ডাকার অধিকার। কিন্তু নিশি আমাকে ত্যাগকরে চলে গেলো। স্পষ্ট মনে আছে ৩ টা ৩৮ মিনিটে সই করলাম ডিভোর্স পেপারে। সে নতুন ভালবাসারমানুষকে নিয়ে চলে গেলো অনেক দূরে।

মা হারা হলো আমার মেয়েটা। আমার মেয়ের বয়স যখন ২ বছর নিজ হাতে তাকে আমি সব কিছু করতাম। ও যখন ছোট কাঁদতো ওর মায়ের জন্যে। ওকে কোলে তুলে নিজেও কাঁদতাম।

মার অভাব কি কখনো পুরন হয়?। নিজের মাকে ডাকতে গিয়ে কান্না আসতো আমার। আমার মেয়ের যে মা নেই, ও ডাকবে কাকে?

রান্না করতাম,সাজিয়ে দিতাম নিজে।

আমি আর মেয়ে এই আমার দুনিয়া। এই আমার পৃথিবী। আর কখনো বিয়ে করিনি।

কারন ভালবাসতাম নিশিকে তখনো এখনো।

আস্তে আস্তে সময় তার নিজের নিয়মে বয়ে চলতে লাগলো দেখতে দখতে কেটে গেলো ২১ টি বছর। আমার মেয়ে আজ ২৩ বছরের। মেয়ের বিয়ের কথা চলছে।আমি আবার একাহয়ে যাবো। এক সময় মেয়ে বিয়েও ঠিক হয়ে যায়। আমার চিন্তা এ সময়ে মেয়ে অন্তত তার মাকে একবারে জন্য দেখুক কিন্তু মেয়ে তাতে কখনো রাজী নয় তবুও মেয়ের অনিচ্ছা সত্বেও ওর মাকে খবর দিয়েছি।

কাল এসেছিলো নিশি।অনেক গুলো বছর পরে দেখলাম আমি নিশিকে । ছমাস তিনদিন, বাইশ মিনিট কম ২৪ বছর পর দেখলাম নিশিকে। কল্পনায় ভেবেছিলাম এখনো সেই ছোট্টই আছে নিশি । কিন্তু না,আমার মতই চুলে পাক ধরেছে ওর।

দুটো ছেলের মা আজ ও। আমি সেদিন ভালোবাসার কাছে হারমেনে জিজ্ঞেস করেছিলাম-

“কেমন আছো?”

আজো কি তোমার মাথা, পা ব্যাথা করে?

সে শুধু মাথা নেড়েছিল।

কি বুঝিয়েছে তা দেখতে পাইনি। কারন চোখদুটো তখন জলে ভেজা ছিল। তাছাড়া বয়স তো আর আগের মতনেই।

কিন্তু আমার মেয়ে দেখা করেনি নিশির সাথে।

পর্দার আড়াল থেকেই একটা প্রশ্ন করেছিল আমার মেয়ে,

“আমার বাবার চব্বিশটা বছর ফিরিয়ে দিতে পারবেন কি?”

যদি না পারেন তাহলে আর আসবেন না কোন দিন।আমার বাবাই আমার মা। আমি গর্ভবোধ করি বাবা ডেকে। মা ডাকার কোন ইচ্ছে নেই আমার। চলে যান আপনি আপনার জায়গায়। জীবনে আর কোন দিনও এদিকে আসার চেষ্টা করবেন না। ”

আমি দেখলাম নিশির চশমাটা কেমন যেন ঝাপসা হয়ে উঠেছে। জল গড়িয়ে পড়ছে ওর চোখ থেকে। অগত্যা নিশি চলে গেলো।

আমি শুধু তাকিয়ে রইলাম নিশির চলে যাবার পথের দিকে আর অনুভব করলাম কেমন করে নিশি মাড়িয়ে গেলো আমার সুন্দর জীবনের ভালোবাসার দিন গুলোকে।

কখন যেন নিজের চোখও ভিজে উঠলো।

হঠাৎ আমার মেয়ে আমার সামনে এসে দাড়ালো, সদ্য মেহেদী রাঙ্গানো হাত দুটো দিয়ে আমার চোখের জল মুছিয়ে আমাকে বলল, বাবা আমি তো আছি।

যে অনেক আগে চলে গিয়েছে, তাকে আর ডেকে কি লাভ! যে তোমার নয় তাকে কাছে ডাকার বিড়ম্বনা করো না বাবা।

আসলেই তাই যে আমার ছিলোনা কোন দিন, তাকে আপন ভাবার কোন কারন নেই। জানিনা ভালোবাসা কেমন যেন শুধুই হারিয়ে যায় স্মৃতির অতল গহীনে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত