রায় বাড়িতে আজ প্রচুর কোলাহল। লোকজন ব্যস্ত হয়ে এদিক-সেদিক দৌড়াচ্ছে। বাড়ির বড়কর্তার ছোটমেয়ে চপলার আজ বিয়ে বলে কথা! লোকজনের ব্যস্ততা থাকবে না সে কি হয়? ওইতো টগরদা আর গগনলাল মিলে প্যান্ডেল টাঙাচ্ছে, তাদের এতো ব্যস্ততার পরেও মেসোমেশাই চেঁচিয়ে তাদের তাড়া দিচ্ছেন, “কই হে বাপু? জলদি জলদি হাত চালাও।” তাঁর তাড়ায় চটজলদি হাত চালাতে গিয়ে উলটো টগরদা আর গগনলালের প্যান্ডেলে প্যাঁচগোচ লেগে যাচ্ছে। রমেশবাবু হাতে হাতে লাড্ডু বানাচ্ছেন, তাঁর পাশেই বসে পিসিমা পান সাজাচ্ছেন। দ্রুত পা চালিয়ে হাঁটতে গিয়ে মাথার একঝাঁকা গাঁদাফুল নিয়ে আরেকটু হলে হুড়মুড়িয়ে পড়েই যেত বলরাম, ভাগ্যিস পলাশদা তাকে ধরে ফেলেছে বলে রক্ষা। ছোটু, মিতু, টেপু, পুতুল কানামাছি খেলছে আর ছোটাছুটি করছে। ওদিকে জয়ন্ত কাকা কিছুই করছেন না, শুধু চেয়ারে বসে অনবরত হেঁকে যাচ্ছেন, “আমার হুঁকোটা দিয়ে যাও গো”, “আমাকে এক খিলি পান দাও দিকি”, “ও হরি, পা ব্যথা করছে, টিপে দাও দিকি।” কাজের ব্যস্ততা থাকলেও সকলেই তাঁর হাঁক-ডাক থেকে বাঁচার জন্য হাতের কাজ ফেলে আবদার পূরণ করে দিচ্ছে। সবার মাঝে ব্যস্ততা থাকলেও ব্যস্ততা নেই শুধু শাহেদের মাঝে। গালে হাত দিয়ে ভাবুক মুখ করে দিঘীর ধারে বসে সে অলস ভঙ্গিতে বসে আছে। সেজো ঠাকরুন দিঘীর ঘাটে বাসন ধুতে এসে তাকে ওভাবে বসে থাকতে দেখে যেন তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন, “ওমা! আমার হয়েছে মরণদশা। ওদিকে বিয়ের সাজসজ্জা হচ্ছে, সে হাতে হাতে করবে কি তা না! ভাবখানা দেখে মনে হয় যেন আমরাই দাস-দাসী, আর তারাই কর্তা! উঠে আয়, সবসময় কাজ চুরির ধান্দা।” রাগে বিড়বিড় করে কিছু বলতে বলতে সেজো ঠাকরুন উঠে চলে গেলেন। শাহেদ মুখ ফিরিয়ে দিঘীর পানির দিকে তাকালো। সে কাজ চোর না, ওই দিঘীর পানি যেমন স্বচ্ছ, শাহেদের মনটাও স্বচ্ছ। দিঘীর কচুরিপানার দিকে তাকিয়ে আবারও ভাবনায় ডুবে যাচ্ছিল শাহেদ। কাঁধে হাতের স্পর্শ পেতেই চমকে তাকায় সে; হরিহর কাকা উপুর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এ বাড়িতে একমাত্র হরিহর কাকাই আছে যে শাহেদের মন বুঝে। বুঝবেই না কেন? ছোটবেলায় মা-বাবাকে হারিয়ে এতিম শাহেদ যখন রেলস্টেশনে ভিক্ষার হাত পাতছিল, তখন এই বাবুর্চি হরিহর কাকাই তাকে মায়া করে এই রায় বাড়িতে এনে তুলে। নিজ সন্তানের মতোই তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে বড় করে, রাঁধুনীর কাজ শেখায়, তার মা-বাবা বলতে গেলে হরিকাকাই সব। তার মনের কথা সে বুঝবে না তো বুঝবে কে? এইবাড়িতে আসার পর হরিকাকা শাহেদকে অনেকবার বলেছে, “তোর নামটা বদলে নে রে শাহেদ। কর্তা যদি জানতে পারেন, তার বাড়িতে হিন্দু নয়- মুসলমানকে এসে ঠাঁই দিয়েছি তবে আমাকে তিনি আস্ত রাখবেন না।” শাহেদ রাজি হয়নি, বাবা-মাকে সে ছোটবেলাতেই হারিয়েছে; তাদের দেওয়া নামটা বদলে শেষমেশ নিজের পরিচয়টাও হারানোর মোটেও ইচ্ছা ছিল না তার। কিন্তু কপালের লিখন কি আর খন্ডানো যায়! কর্তাবাড়ির কোন পূজায় শাহেদ অংশ নেয় না, অর্চনা করে না, নিতান্তই দায় পড়ে যেন প্রসাদ গ্রহণ করে। এসব ব্যাপার চোখে পড়লেও প্রথমটায় সবাই পাত্তা দিত না। সবাই নিশ্চিত হলো সেদিন, যেদিন বুড়ো ঠাম্মা শাহেদের ঘরে জায়নামাজ আর তাসবীহ খুঁজে পেলেন। চারদিকে রই-রই ব্যাপার ঘটে গেল। এ যাবৎকাল মুসলমান বাবুর্চির হাতের খাবার খেয়েছে বলে বাড়ির মেয়েগুলো ঘৃণায় ওয়াক করে উঠল। “ধর্ম গেল, পাপ হলো” বলে বুড়োরা ঘোর অন্যায়ে হায় হায় করে উঠলেন। কর্তাগণ মিটিং বসালেন হরিহর আর শাহেদের নামে। তাদের দুজনক্ব বহিষ্কার করার সিদ্ধান্ত নিল সবাই। হরিকাকা যেন আঁতকে উঠলেন। বাবুর্চির কাজ, মাথা গোঁজার ঠাঁই দুটোই চলে গেলে তিনি বুড়োবয়সে বাঁচবেন কি করে! শাহেদকে জড়িয়ে ধরে তিনি পঞ্চাশবার বেতের বারি খেলেন, পঞ্চাশবার কান ধরে উঠবস করলেন। কথা দিলেন, এই মুসলমান ছেলে বাবুর্চির কাজ করবে না, কোন কিছু ছোঁবে না, তাও যেন তাদের বাড়িছাড়া করা না হয়। তার কথায় কর্তাদের মনে যেন একটু দয়া হলো। মায়া করে হলেও স্থান দিলেন বাড়িতে।
সেই থেকে এইবাড়িতে অবহেলিতভাবেই; তবে হরিকাকার স্নেহের পরশে বড় হতে লাগল শাহেদ। এই ছেলেটার কিছু হলে হরিহরের যেন নিজের বুকেই কষ্ট লাগে। তাই হরিকাকা বললেন, “কি রে ছোঁড়া? মন খারাপ যে!” শাহেদ কোন জবাব দিল না। মুখ ঘুরিয়ে বসে রইল শুধু। হরিকাকা সবই বুঝেন, জানেন। এইবাড়িতে আসার পর শাহেদ যদি অন্য কারো ভালোবাসা পেয়ে থাকে সে হলো চপলা। একই সাথে দুটি শিশুসুলভ মন হেসে-খেলে বড় হয়েছে রায়বাড়িতে। ধর্মের দেয়াল কিংবা জাতিভেদ কোনোটাই প্রবেশ করেনি এই দুটি শিশুর মনে। তাই তো এরা মন থেকেই ভালোবেসেছে একে অপরকে। এই ভালোবাসা উঠন্ত বয়সের সাথে সাথে পরিণত হয়েছে প্রণয়ে। সময়ের বাধ্যবাধকতায় তা রয়ে গেছে তাদের মনের অন্তঃরালে, প্রকাশ হয়ে উঠেনি কখনওই। সেই মানুষটি আজ চোখের সামনে অন্যের হাত ধরে বিয়ের মন্ডপে বসে পাড়ি জমাবে বহুদূর দেশে, সে কথা কি মেনে নেয়া যায়? ওদিকে চপলা মেয়েটার কি অবস্থা কে জানে! কনেকে ঘিরে বসে আছে সবাই, ভীষণ ব্যস্ততা। দেখা করার সুযোগটাও মিলছে না।
সন্ধ্যা পেরিয়ে রাতের আঁধার ঘনিয়ে আসছে। বিয়ের মন্ডপ ফুলের সাজে সজ্জিত, তার মাঝে লাল টুকটুকে বউ বসে আছে কিন্তু বর নেই। বরপক্ষও আসছে না। হয়তো আসবেও না। ধীরে ধীরে লগ্ন পেরিয়ে যাচ্ছে বিয়ের। বাড়ির ঝি-চাচীদের মধ্যে মৃদু গুঞ্জন উঠেছে, কর্তাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। জোয়ান ছেলেগুলো রাগে ফুঁসে উঠছে আজ বরপক্ষের একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়বে বলে। বিয়ের অতিথি সব সারিবেঁধে দাঁড়িয়ে কি যেন বলাবলি করছে। শুধু বউটি যেন কাঠের পুতুলের মতো স্থির হয়ে বসে আছে। কাকাবাবু, মেসোমশাই সবাই অস্থির পায়ে পায়চারি করছে বরপক্ষের জন্য। ধীরে ধীরে চোখমুখ অন্ধকার হয়ে এলো সবার। সেজো ঠাকরুন মুখে পান গুঁজে আঁচল টানতে টানতে বললেন, “ওরে, চপলা, তুই যে লগ্নভ্রষ্টা হলি রে! তোকে কে বিয়ে করবে এখন?” লগ্নভ্রষ্টা! কথাটা হয়তো একসারি মানুষকে ছাপিয়েও একজনের হৃদয়ের গহীনে গিয়ে হানা দিল, পেছনের দাস-দাসীদের সারি থেকে সে যেন চেঁচিয়ে উঠল, “চপলা আমি বিয়ে করবো।” সঙ্গে সঙ্গে সবাই ঘুরে তাকালো, বাড়িভর্তি সমগ্র চোখ অবাক দৃষ্টি হানলো, সে আর কেউ নয়, শাহেদ! কর্তাবাবু লাফিয়ে উঠলেন, “ওরে, সাহস দেখেছ ছোকরার?” সেজো ঠাকরুন চেঁচিয়ে উঠলেন, “মরেছে, দুধকলা দিয়ে তো দেখি কালসাপ পুষেছি।” “বামুম হয়ে চাঁদের দিকে হাত বাড়াস। তবে রে…” বলেই হৈ হৈ করে ছুটে এলো বড়পিসির ছেলে ভগবত। তার সুঠাম পালোয়ান পেশীর আঘাত সইতে পারলো না শাহেদের ঢ্যাঙঢ্যাঙে দূর্বল শরীর। অকষ্মাৎ প্রকান্ড এক ঘুষি খেয়েই থামের উপর কপাল লেগে মাথা ঘুরে পড়ে গেল। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোতে লাগল কপাল থেকে। বেধড়ক এলোপাথাড়ি মারে পালটা প্রতিক্রিয়া দেখানোর জো রইল না তার। আর একটু হলে বাড়ির জোয়ান ছেলেগুলো মিলে শাহেদের দূর্বল শরীরটাকে দুমড়ো-মুচড়ো করেই দিত, যদি না হরিকাকা এসে দুহাত জোর করে তার প্রাণভিক্ষা না চাইতো।
রাঁধুনীদের পরিত্যাক্ত ঘরে শুয়ে তীব্র জ্বরে কোঁকাচ্ছে শাহেদ। জ্ঞান ফিরতেই সে নিজেকে এখানে আবিষ্কার করেছে। পুরো শরীরে ব্যথা, এখানে ওখানে থেঁতলে গেছে। মাথায় তীব্র যন্ত্রণা, হরিকাকা যতটা পেরেছে কাপড় দিয়ে পট্টি লাগিয়ে দিয়েছে। ওদিকে বাড়ির অন্দরমহলের খবর সে কিছুই জানে না। যা কান্ড ঘটিয়েছে তাতে কর্তাদের ওপরের সিঁড়িতে পা বাড়ানোর কোন উপায় নেই তার। মাটিতে শুয়ে শুয়ে চপলার মায়াবী মুখখানাই বারবার ভেসে উঠলো তার মনে। আর কেউ না দেখুক, চপলার ওই টলমলে চোখের ভাষা শাহেদ বুঝতে পেরেছে, তার মনের কথা পড়তে পেরেছে। ওদিকে চপলার সাথে কি হচ্ছে কে জানে! বাড়িতে অনেক হট্টগোলের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। কি হচ্ছে কিছুই বুঝা যাচ্ছে না। দরজার দিকে তাকাতেই হরিকাকাকে হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকতে দেখা গেল। হাউমাউ করে কেঁদে বললেন, “ওরে কপালপোড়া রে! তোর কপালে সুখ নেই। চপলা মাকে সাপে কেটেছে। বিষের বেদনায় কাঁতরাচ্ছে মেয়েটা!” দূর্বল শরীরে শাহেদ হুড়মুড়িয়ে বসল, “সাপে কেটেছে? বলো কি হরিকাকা!” কপাল চাপড়ে হরিকাকা বললেন, “বদ্যি ডাকা হয়েছে। বিষ নামাতে হলে প্রয়োজন অজুরা পাতার রস। এই রস কোথায় পাবে রে? কেউ খুঁজে পাচ্ছে না। আহারে! ব্যথায় কাতরাচ্ছে মেয়েটা!”
গায়ে কাপড় জড়িয়ে শাহেদ উঠে দাঁড়ালো। সে জানে, কোথায় পাওয়া যাবে এই অজুরা পাতা! তার ওমন তাড়াহুড়ো দেখে হরিকাকা ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “ওরে কোথায় যাচ্ছিস?” “তুমি আমার চপলার পাশে থেকো হরিকাকা।” বলে দ্রুত বেগে বেরিয়ে গেল শাহেদ। ঘরের দুয়ার ধরে তার চলে যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইল হরিকাকা।
পুরোনো মন্দিরটার বামপাশে ঝোপের মাঝে অজুরা পাতার খোঁজে হাতড়ে বেড়াচ্ছে শাহেদ। পুরো শরীরের ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠছে সে, কপালের পট্টি ছাপিয়ে টপটপিয়ে রক্ত পড়ছে। হাত-পায়ে জংলি কাঁটা বিঁধে কেটে এফোঁড়ওফোঁড় হয়ে যাচ্ছে। তবুও পাগলের মতো খুঁজে যাচ্ছে শাহেদ কিন্তু অজুরা পাতার দেখা মিলছে না। আজ কি সব পাতা উধাও হয়ে গেল নাকি! না চপলাকে বাঁচাতে হলে তার অজুরা পাতা খুঁজে বের করতেই হবে। চপলা যখন ব্যথায় কাতরাচ্ছে, মরা চাঁদের মলিন আলোয় জংলি কাঁটার মাঝে শাহেদের রক্তাক্ত হাতদুটো তখন অজুরা পাতা খুঁজে বেড়াতে ব্যস্ত।