কাঁপা কাঁপা হাতে বুকশেলফ থেকে বই নিতে গিয়ে বৃদ্ধা আনোয়ারা বেগমের নজরে পড়ল শোকেসে উপর রাখা তাঁদের বহু পুরাতন যুগলবন্দী ছবির ফ্রেমের দিকে। সেখানে চোখ পড়তেই তিনি লাজুক হেসে ফ্রেমটা তুলে নিলেন। ছবিটা তোলার পেছনে ছিল মিষ্টি একটা ইতিহাস। তখন আনোয়ারা বেগম এ বাড়ির নতুন বউ। এক দুপুরবেলা ছোট্ট ননদ জামিলার সাথে আমের আচার খাচ্ছিলেন, গল্পে গল্পে হেসে গড়িয়ে পড়ছিলেন ননদিনীর কাঁধে। কোত্থেকে যেন হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে তাঁর “উনি” এসে বললেন, “আনোয়ারা, শাড়ি পড়ে একটু সেজেগুজে নাও। স্টুডিওতে ছবি তুলতে যাব।” একথা শুনে উচ্ছ্বসিত কিশোরীর মতোই আনোয়ারা বেগমের খুশি আর ধরে না। ঠোঁটে রঙ মেখে, চুলে বেণুনী করে লাল শাড়ি পড়ে স্টুডিওতে ছবি তুলতে রওনা দিলেন স্বামীর সাথে। কিন্তু রাস্তায় হেঁটে যাওয়ার সময় পড়লেন বিপাকে! তখন তিনি সবে কিশোরী, শৈশব থেকে কৈশোরে পদার্পণ করেছেন মাত্র। যেই মেয়ে ফ্রক ছেড়ে সবেমাত্র সালোয়ার-কামিজ গায়ে জড়িয়েছে, তার পক্ষে শাড়ির কুঁচি সামলে গাঁয়ের এবড়ো-থেবড়ো পথ হেঁটে চলা বেশ কষ্টকর হয়ে দাঁড়াল। তিনি তো কয়েকবার হোঁচট খেয়ে পড়েই যেতেন যদি “উনি” চটজলদি তার বাহুডোরে আগলে না ধরতেন। তখন তার স্বামী ছিলেন সুঠাম দেহের অধিকারী একজন সুদর্শন যুবক, ভারী কাজগুলো একা হাতেই সামলে উঠতে পারতেন। কিন্তু দিন এখন বদলেছে। আনোয়ারা বেগম ফ্রেমে আবদ্ধ আফজাল রহমানের থেকে চোখ সরিয়ে পাশের খাটে ঘুমন্ত আফজাল রহমানের দিকে তাকালেন। বার্ধক্য, রুগ্নতা তাঁর সেই সুঠাম দেহ কেড়ে নিলেও বিন্দুমাত্র কমাতে পারে নি তাদের মধ্যকার ভালোবাসা। সাদা দাড়ি সাদা চুলে আগের মতোই বলীয়ান আর আকর্ষণীয় লাগে তাঁকে। একথা ভাবতেই আবার লজ্জাবনত হয়ে এলো আনোয়ারা বেগমের মাথা। বিছানার পাশে বসে সন্তর্পণে ঘোমটা টেনে তিনি স্বামীকে ঘুম থেকে জাগানোর চেষ্টা করলেন, “উঠুন। আর কতক্ষণ ঘুমাবেন? এতিমখানায় যেতে হবে না?” আফজাল রহমান ঘুম থেকে আধোআধো চোখ মেলে ঘড়ির দিকে তাকালেন। ইদানিং রাতে তার ঘুম হয় না। সারাদিন ঘুমে ঝিমুতে থাকেন। কিন্তু রাতের বেলা কিছুতেই চোখের পাতায় ঘুম আসে না। শুধু শুয়ে এপাশ-ওপাশ করতে থাকেন। ফলটা হয় সকালবেলা; তখন চোখ থেকে ঘুম সরাতেই পারেন না। স্বামীর ঘুম ভেঙেছে দেখে আনোয়ারা বেগম চা আনতে গেলেন। ঘুম থেকে উঠার পর উনার এক কাপ চা খাওয়ার পুরোনো অভ্যেসটা এখনও রয়ে গেছে।
আনোয়ারা বেগম চলে গেলে আফজাল রহমান পাশ ফিরতেই বিছানায় ফ্রেমটা পড়ে থাকতে দেখলেন। সাদা-কালো পুরোনো তাঁদের এই ছবিটা কত স্মৃতিরই না সাক্ষী। অতীতের কথা মনে করে মুখ টিপে হাসলেন বৃদ্ধ। আনোয়ারার সাথে তখন বিয়ের কথা চলছিল। বরাবরই আফজাল রহমান ছিলেন ডানপিটে প্রকৃতির, সংসারের প্রতি সম্পূর্ণ উদাসীন। বিয়ের কথা শুনেই ভীষণ রেগে গেলেন তিনি। কিন্তু বাবার কথার উপর কোন কথা বলার সাহসই ছিল না তার। তাই মুখ ফুটে কিছু বলতে না পারলেও জেদ মেটালেন অন্যভাবে। পাত্রী দেখার সময় আনোয়ারাকেও দেখতে যান নি তিনি। আনোয়ারার সাথে বিয়ে পাকা হবার পর ভাবী বিমর্ষমুখে জানালেন, তাঁর হবু বউ লক্ষ্মীট্যারা। আফজাল রহমানের রাগের আর দুঃখের সীমা রইল না। এমনিতেই তাঁর বিয়ের মতো গুরুদায়িত্ব কাঁধে নেয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই, তার উপর ঘরে যেই বউ আনবেন সে কিনা ট্যারা! কথা বলবেন বউয়ের সাথে, অথচ বউ কোনদিকে তাকিয়ে কথা বলছে সেটা তিনি কিছুই বুঝবেন না এটা কেমন কথা! আফজাল রহমান তক্ষুণি বাবার কাছে সাফ জানাতে চাইলেন তিনি বিয়ে করবেন না। কিন্তু ভাবী সান্ত্বনা দিল লক্ষ্মীট্যারা মেয়ে গুণবতী হয়, এরা সংসারে লক্ষ্মী। অনেকটা ভাবীর কথায় রাজি হয়েই ঘরে তুলে আনলেন আনোয়ারাকে। সেদিন তিনি লক্ষ্য করেছিলেন, এই কিশোরীটি আসতেই তাঁর অনুজ্জ্বল ঘরটা যেন আলোকিত হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে যেন ফুলের বিছানায় বসে আছে লাল টুকটুকে একটা পুতুল বউ! তার ঘোমটা সরাতেই তার কাজলঘেরা নয়ন আর মিষ্টি মুখের দিকে অপলক দৃষ্টিতে খানিকক্ষণ তাকিয়ে ছিলেন আফজাল রহমান। ফ্রেমের থেকে চোখ সরিয়ে চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়ে থাকা আনোয়ারার দিকে দৃষ্টি ফেরালেন তিনি। তার সেই পুতুল বউ এখনও যেন আগের মতোই আছে, শুধু চুলের গোড়ার একটু পাক ধরেছে আর কাজলঘেরা নয়নদুটো ঢাকা পড়ে গেছে মোটা কাঁচের চশমার আড়ালে। এখনও মনে হয় যেন বছর কাটে নি, মনের ভেতর লাজুকভাবেই বিচরণ করছে তাদের ভালোবাসা।
আনোয়ারা বেগম তার স্বামীর হাত থেকে ফ্রেমটা রেখে চায়ের কাপ ধরিয়ে দিলেন। মুখের হাসি গোপন করে বললেন, “শুনুন। তৈরি হয়ে নিন। আজ এতিমখানায় যেতে হবে। ভুলে গেছেন? আমি সব সোয়েটার প্যাকেট করে রেখেছি।” চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে আফজাল রহমান বললেন, “আসিফকে ফোন করে দেখো। ও যদি যায় সাথে, উপকার হতো। আমরা বুড়োবুড়ি আর কতটুকু পারবো?” আনোয়ারা বেগম হতাশ কণ্ঠে স্বামীর জবাব দিলেন, “ওর তো কাজের ব্যস্ততা। ছেলেটা কি আসতে চাইবে?” মুখে বললেন ঠিকই, কিন্তু মনে মনে তীব্রভাবে চাইছিলেন তাদের ছেলেটাও দুজনের সাথে যোগ দিক, স্বামীর আশা পূর্ণ হোক। তাই টেলিফোন সামনে নিয়ে নিজেই ফোন করলেন ছেলের কাছে।
-“হ্যালো আসিফ।”
-“হ্যালো মা, ভালো আছো? মেডিসিন নিয়েছ ঠিকমতো?”
-“হ্যাঁ বাবা। আমরা ভালোই আছি। তোর বাবা চাচ্ছিল তুইও যদি আমাদের সাথে আজ এতিমখানায় যেতি!”
-“মা, তোমরাও না। আজব! আমার কি কাজ নেই? অফিস রেখে কিভাবে যাব?”
-“চেষ্টাও করতে পারবি না?”
-“আচ্ছা ঠিক আছে মা। তোমার নাতনীকে স্কুল থেকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে তারপর এতিমখানায় রওনা দেয়ার চেষ্টা করবো।”
-“আচ্ছা।” বলে বিষণ্ণমুখে ফোন রাখলেন আনোয়ারা বেগম। পাশ থেকে তার স্বামী উৎসাহিত কণ্ঠে বললেন, “কি? আসবে?”
স্বামীকে আশাহত করতে চাইলেন না আনোয়ারা বেগম। ছেলেটা বড় হয়ে কেমন যেন দূরে চলে গেছে। বাবা-মাকে সময় দেওয়াটাকে অহেতুক কাজ বলেই মনে করে। শুধু টাকা-পয়সা, খাবার-দাবার, খরচাপাতি দিলেই কি চলে? বোকা ছেলেটা এটুকুও বুঝে না তার মা চায় এখনও ছেলে তার মায়ের কোলে মাথা রেখে পিঠা খাওয়ার অবাধ্য আবদার করুক। দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বললেন, “বলেছে, রিয়াকে স্কুল থেকে আনার পর আসবে।” আফজাল রহমান আর কিছু না বুঝুক, তার স্ত্রীর দীর্ঘশ্বাসের অর্থটুকু বুঝে গেলেন।
এই বৃদ্ধ দম্পতি প্রতিবছর এতিমখানায় শীতবস্ত্র দান করে থাকেন। তাই মোটামুটি সবাই তাঁদের চিনে। এতিমখানায় প্রবেশ করতেই সুপার দৌড়ে আসলো। গাড়ি থেকে মালামাল নামাতে সাহায্য করলেন। খুবই খাতিরের সাথে তাঁদের দোতলার কামড়ায় বসালেন। এই দুই বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে দেখলেই তার সসম্মানে ও শ্রদ্ধায় মাথা নিচু হয়ে আসে। উনারা বড়লোক হলেও মনে কোন ক্লেশ নেই, কোন অহংকার নেই। এতিমখানার প্রতিটা শিশুকে নিজের সন্তানের মতো স্নেহ করেন। লোক দেখানো স্নেহ নয়, মনের গভীর থেকে সাচ্চা স্নেহ এটা সুপার বুঝতে পারে। বুড়ো দম্পতি আর দেরি করতে চাইলেন না। দ্রুত বাচ্চাদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণের ব্যবস্থা করতে বললেন। সুপার সব শিশুকে এতিমখানার প্রাঙ্গণে জড়ো হতে বললেন। আনোয়ারা বেগম খুব সাবধানে তার স্বামীকে আগলে ধরে দোতলার সিঁড়ি বেয়ে প্রাঙ্গণে পৌঁছাতে সাহায্য করলেন। স্ত্রীর কাঁধে ভর দিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে আফজাল রহমানের চোখে পানি এসে গেল। যে বয়সে ভরসা করার কথা পুত্রের কাঁধের উপর, সেই বয়সে ভরসা করতে হচ্ছে স্ত্রীর কাঁধের উপর। কতটা ভাগ্যগুণে তিনি এমন স্ত্রী পেয়েছেন!
এতিমখানার প্রাঙ্গণে সারি বেঁধে জড়ো হয়েছে ছোট থেকে বড় অনেক শিশু। কি মায়াকাড়া তাদের মুখ! একে একে গুটি গুটি পায়ে তারা এগুতেই তাদের হাতে সোয়েটারের প্যাকেট তুলে দিচ্ছেন আফজাল রহমান। কিঞ্চিৎ দূরে বেঞ্চে বসে তাই দেখছেন আনোয়ারা বেগম। পঁয়ষট্টি বছরের বার্ধক্য যেন তার স্বামীকেও নধর কচি শিশুগুলোর সামনে শিশুর মতোই করে তুলেছে। বাচ্চাগুলো সোয়েটার হাতে পেয়েই প্যাকেট থেকে তা বের করে আনন্দে বিগলিত হয়ে নিজের গায়ে পড়ে নিচ্ছে, একজন আরেকজনকে জড়িয়ে তার গায়ের সোয়েটার দেখাচ্ছে। অশ্রুসজল চোখে আনোয়ারা বেগম স্বামীর পাশে এসে দাঁড়ালেন। পাখিদের মতো কলরবে বাচ্চাগুলো যেন আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে উঠেছে। প্রতিটি শিশুকে দেখাচ্ছে রঙিন ফুলের মতো। এতিমখানার প্রাঙ্গণ যেন লাল নীল প্রজাপতির ছুটোছুটিতে স্বর্গপুরী হয়ে উঠেছে। পরম ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ এক বৃদ্ধ দম্পতি মুগ্ধ হয়ে উপভোগ করছে এই স্বর্গপুরীর আনন্দ।